চবিতে ফের নিয়োগে অর্থ লেনদেনের অডিও ফাঁস, তদন্ত কমিটি গঠন
চবি প্রতিনিধি | ৬ আগস্ট, ২০২২ ২০:৪৪
মানিক চন্দ্র দাস।
ফের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেনের দুটি অডিও ফাঁস হয়েছে। এতে তিন প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের নিম্নমান সহকারীর মানিক চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে। এছাড়াও চাকরি না হওয়ায় এই টাকা ফেরত চাইলে এক প্রার্থীকে প্রাণনাশের হুমকিও দেন ওই কর্মচারী। চাকরি না পেয়ে প্রতারণার অভিযোগে এবং টাকা ফেরত চেয়ে সম্প্রতি ওই কর্মচারীকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন এক প্রার্থী। টাকা লেনদেনের ব্যাংক রিসিভ কপি ও দুটি ফোনালাপ দেশ রূপান্তর প্রতিবেদকের কাছে এসেছে।
জানা যায়, ২০২১ সালে ৩১ মে ও পহেলা জুন দুইটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেখানে নিম্নমান সহকারী ও অফিস সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মাদারীপুরের রাকিব ফরাজী সোহেল খান ও মাকসুদুল সালেহীনের কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নেয় মানিক।
লেনদেনের স্লিপে দেখা যায়, ২০২১ সালে ৫ জুন ৫০ হাজার টাকা, ১১ জুলাই ৩৫ হাজার টাকা, ১৫ জুন ৫০ হাজার টাকা ও ৩ মে আরও ৫০ হাজার টাকা নেয়া হয় প্রার্থীদের কাছ থেকে। মানিকের ডাজ বাংলা ব্যাংক একাউন্ট ৭০৮১ এর মাধ্যমে এই টাকাগুলো নেয়া হয়। তবে চাকরি না পেয়ে প্রতারণার অভিযোগে ও টাকা ফেরত চেয়ে গত ২৫ জুলাই মানিককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠায় এক প্রার্থী।
নিচে ফাঁস হওয়া ফোনালাপে কথোপকথন হুবহু তুলে ধরা হলো:
মানিক চন্দ্র দাস: তুমি আমারে চিনো? একদম খাইয়া ফেলবো, একদম পেটের মধ্যে মোচড় দিয়া খাইয়া ফেলবো তোরে।
প্রার্থী: আচ্ছা দেখা যাবে।
মানিক চন্দ্র দাস: পেটের মধ্যে মোচড় দিয়া খাইয়া ফেলবো কিন্তু একদম। পার্সোনাল বিহেবিহার ঠিক করতে না পারলে খাইয়া ফেলবো একদম।
প্রার্থী: যত টাকা নিছেন, সব টাকা এই মাসের মধ্যেই দিবেন।
মানিক চন্দ্র দাস: এই বেটা কিসের টাকারে তোর, তুই জুলাইয়ের আগে এক টাকাও পাবি না। শুন তুই পরীক্ষা দিছোস তোর এপ্লিকেন্ট পরীক্ষা দেক, তখন যদি না হয় তুই ফুল টাকা পেয়ে যাবি একসাথে।
প্রার্থী: না, এই মাসের মধ্যেই দিবেন।
আরেকটি ফোনালাপের কথোপকথন:
প্রার্থী: গেছে ৫০?
মানিক: গেছে। তবে ভেজাল বাজায় দাও তুমি। ওইখানে ১০০ টাকা কেন চার্জ কেটে ফেলছে। চার্জসহ দিবা না। ৫০০ টাকা ঘটকা লাগায়ছো আমার।
প্রার্থী: তাইলে টোটাল কত হইলো।
মানিক: টোটাল বাসায় গিয়ে হিসেব করো। সাত ৭০ এর লগে ৫০।
প্রার্থী- ৮ লাখ ২০ হাজার।
মানিক: হ্যাঁ। ঠিক আছে।
মাকসুদুল সালেহীন নামে এক প্রার্থী বলেন, চাকরি দেওয়ার কথা বলে মানিক আমাদের কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু সে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। আমি টাকা ফেরত চাইলে মানিক আজকে, কালকে দিবে বলে ঘুরাতে থাকে। এক পর্যায়ে হুমকিও দেয় সে। পরে আমি টাকা চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি মানিকের কাছে।
তবে চাকরি নয় ব্যক্তিগত কাজে মাকসুদুলের কাছে টাকা নিয়ে দাবি করে মানিক চন্দ্র দাশ জানান, আমার স্ত্রীর সাথে পূর্ব পরিচয়ের খাতিরে মাকসুদুল সালেহীনের সাথে আমার পরিচয়। তার কাছ থেকে আমি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কাজের জন্য টাকা নিয়েছি। চাকরি দেয়ার নামে নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউকে আমি চাকরি নিয়ে দেব সে সামর্থ আমার নেই। তাহলে কেন আমি চাকরির নামে টাকা নেব। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার জন্য এগুলা করা হচ্ছে।
হুমকির বিষয়ে তিনি বলেন, টাকা নিয়ে সে আমার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, গালি দিয়েছে। তাই আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তাই হুমকি দিয়েছি।
এদিকে এঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চবি প্রশাসন। এতে চবির শাহ আমানত হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক নির্মল কুমার সাহাকে প্রধান করা হয়েছে । সদস্য সচিব হিসেবে আছেন গোপনীয় শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার সৈয়দ ফজলুল করিম। এছাড়া সহকারী প্রক্টর মো. আহসানুল কবীর পলাশ এবং কেন্দ্রীয় স্টোর শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশেদুল হায়দার জাবেদকে সদস্য করা হয়েছ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. এস এম মনিরুল হাসান বলেন, এদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুর্ণ হচ্ছে। প্রশাসনকে বিপাকে ফেলতে তারা এসব কর্মকাণ্ড করছে। আমরা কাউকে ছাড় দিব না। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্তে সত্যতা পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
এর আগেও গত ৩ মার্চ ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত কয়েকটি অডিও ফোনালাপ ফাঁস হয়। এ ঘটনায় গত বছর ৯ জানুয়ারি হাটহাজারী মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপরে মার্চে সিন্ডিকেট সভায় এই নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ বাতিল ও জড়িতদের শনাক্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে গত ৭ জুলাই অডিও ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় উপাচার্যের সাবেক পিএস খালেদ মিসবাহুল মোকর রবীনকে পদাবনতি ও কর্মচারী আহমেদ হোসেনকে চাকরিচ্যূত করে সিন্ডিকেট। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত একটি অসাধু চক্র আছে বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
চবি প্রতিনিধি | ৬ আগস্ট, ২০২২ ২০:৪৪

ফের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেনের দুটি অডিও ফাঁস হয়েছে। এতে তিন প্রার্থীর কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের নিম্নমান সহকারীর মানিক চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে। এছাড়াও চাকরি না হওয়ায় এই টাকা ফেরত চাইলে এক প্রার্থীকে প্রাণনাশের হুমকিও দেন ওই কর্মচারী। চাকরি না পেয়ে প্রতারণার অভিযোগে এবং টাকা ফেরত চেয়ে সম্প্রতি ওই কর্মচারীকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন এক প্রার্থী। টাকা লেনদেনের ব্যাংক রিসিভ কপি ও দুটি ফোনালাপ দেশ রূপান্তর প্রতিবেদকের কাছে এসেছে।
জানা যায়, ২০২১ সালে ৩১ মে ও পহেলা জুন দুইটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেখানে নিম্নমান সহকারী ও অফিস সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মাদারীপুরের রাকিব ফরাজী সোহেল খান ও মাকসুদুল সালেহীনের কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নেয় মানিক।
লেনদেনের স্লিপে দেখা যায়, ২০২১ সালে ৫ জুন ৫০ হাজার টাকা, ১১ জুলাই ৩৫ হাজার টাকা, ১৫ জুন ৫০ হাজার টাকা ও ৩ মে আরও ৫০ হাজার টাকা নেয়া হয় প্রার্থীদের কাছ থেকে। মানিকের ডাজ বাংলা ব্যাংক একাউন্ট ৭০৮১ এর মাধ্যমে এই টাকাগুলো নেয়া হয়। তবে চাকরি না পেয়ে প্রতারণার অভিযোগে ও টাকা ফেরত চেয়ে গত ২৫ জুলাই মানিককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠায় এক প্রার্থী।
নিচে ফাঁস হওয়া ফোনালাপে কথোপকথন হুবহু তুলে ধরা হলো:
মানিক চন্দ্র দাস: তুমি আমারে চিনো? একদম খাইয়া ফেলবো, একদম পেটের মধ্যে মোচড় দিয়া খাইয়া ফেলবো তোরে।
প্রার্থী: আচ্ছা দেখা যাবে।
মানিক চন্দ্র দাস: পেটের মধ্যে মোচড় দিয়া খাইয়া ফেলবো কিন্তু একদম। পার্সোনাল বিহেবিহার ঠিক করতে না পারলে খাইয়া ফেলবো একদম।
প্রার্থী: যত টাকা নিছেন, সব টাকা এই মাসের মধ্যেই দিবেন।
মানিক চন্দ্র দাস: এই বেটা কিসের টাকারে তোর, তুই জুলাইয়ের আগে এক টাকাও পাবি না। শুন তুই পরীক্ষা দিছোস তোর এপ্লিকেন্ট পরীক্ষা দেক, তখন যদি না হয় তুই ফুল টাকা পেয়ে যাবি একসাথে।
প্রার্থী: না, এই মাসের মধ্যেই দিবেন।
আরেকটি ফোনালাপের কথোপকথন:
প্রার্থী: গেছে ৫০?
মানিক: গেছে। তবে ভেজাল বাজায় দাও তুমি। ওইখানে ১০০ টাকা কেন চার্জ কেটে ফেলছে। চার্জসহ দিবা না। ৫০০ টাকা ঘটকা লাগায়ছো আমার।
প্রার্থী: তাইলে টোটাল কত হইলো।
মানিক: টোটাল বাসায় গিয়ে হিসেব করো। সাত ৭০ এর লগে ৫০।
প্রার্থী- ৮ লাখ ২০ হাজার।
মানিক: হ্যাঁ। ঠিক আছে।
মাকসুদুল সালেহীন নামে এক প্রার্থী বলেন, চাকরি দেওয়ার কথা বলে মানিক আমাদের কাছ থেকে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু সে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। আমি টাকা ফেরত চাইলে মানিক আজকে, কালকে দিবে বলে ঘুরাতে থাকে। এক পর্যায়ে হুমকিও দেয় সে। পরে আমি টাকা চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি মানিকের কাছে।
তবে চাকরি নয় ব্যক্তিগত কাজে মাকসুদুলের কাছে টাকা নিয়ে দাবি করে মানিক চন্দ্র দাশ জানান, আমার স্ত্রীর সাথে পূর্ব পরিচয়ের খাতিরে মাকসুদুল সালেহীনের সাথে আমার পরিচয়। তার কাছ থেকে আমি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কাজের জন্য টাকা নিয়েছি। চাকরি দেয়ার নামে নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউকে আমি চাকরি নিয়ে দেব সে সামর্থ আমার নেই। তাহলে কেন আমি চাকরির নামে টাকা নেব। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ। আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার জন্য এগুলা করা হচ্ছে।
হুমকির বিষয়ে তিনি বলেন, টাকা নিয়ে সে আমার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, গালি দিয়েছে। তাই আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তাই হুমকি দিয়েছি।
এদিকে এঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চবি প্রশাসন। এতে চবির শাহ আমানত হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক নির্মল কুমার সাহাকে প্রধান করা হয়েছে । সদস্য সচিব হিসেবে আছেন গোপনীয় শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার সৈয়দ ফজলুল করিম। এছাড়া সহকারী প্রক্টর মো. আহসানুল কবীর পলাশ এবং কেন্দ্রীয় স্টোর শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশেদুল হায়দার জাবেদকে সদস্য করা হয়েছ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. এস এম মনিরুল হাসান বলেন, এদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুর্ণ হচ্ছে। প্রশাসনকে বিপাকে ফেলতে তারা এসব কর্মকাণ্ড করছে। আমরা কাউকে ছাড় দিব না। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্তে সত্যতা পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
এর আগেও গত ৩ মার্চ ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত কয়েকটি অডিও ফোনালাপ ফাঁস হয়। এ ঘটনায় গত বছর ৯ জানুয়ারি হাটহাজারী মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপরে মার্চে সিন্ডিকেট সভায় এই নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ বাতিল ও জড়িতদের শনাক্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে গত ৭ জুলাই অডিও ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় উপাচার্যের সাবেক পিএস খালেদ মিসবাহুল মোকর রবীনকে পদাবনতি ও কর্মচারী আহমেদ হোসেনকে চাকরিচ্যূত করে সিন্ডিকেট। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত একটি অসাধু চক্র আছে বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে।