৬০ ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস বসে আছে: আইইইএফএ
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২১ জানুয়ারি, ২০২১ ০২:০২
বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (ওভারক্যাপাসিটি) তৈরি হওয়ায় সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)।
বুধবার তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ আশঙ্কা করা হয়।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে, যা এক বছর আগেও ছিল ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। স্পষ্টতই ওভার ক্যাপাসিটি বাড়ছে। এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবিকে সরকারের প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (৮৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
আইইইএফএর প্রতিবেদনটি লিখেছেন জ্বালানি খাতে অর্থায়ন বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে নতুন যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো যোগ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। ২০২৫ সাল নাগাদ আরও ২১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। এই সময়ে মাত্র সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে যাবে। এতে স্থাপিত সক্ষমতার ব্যবহার ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে যদি না বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বাড়ে।
'বাংলাদেশেজ পাওয়ার সিস্টেম ওভারক্যাপাসিটি প্রবলেম ইজ গেটিং ওরস' শীর্ষক এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। আগামী ৫ বছর ধরে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে না থাকে, তবে স্থাপিত সক্ষমতার ব্যবহার (ক্যাপাসিটি ইউটিলাইজেশন) ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওভারক্যাপাসিটির বিরূপ প্রভাব পড়বে পিডিবির আর্থিক অবস্থা এবং বিদ্যুতের দামের ওপর। পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রলোর বিদ্যুৎ কেনার স্বল্প (রেন্টাল) ও দীর্ঘমেয়াদি (আইপিপি বা ইন্ডিপেডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) চুক্তি (পাওয়ার পারচেজিং এগ্রিমেন্ট) থাকে। এসব কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা বা জ্বালানির মূল্য দেয় পিডিবি, দেওয়া হয় বিদ্যুতের দাম, সারা বছর কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট অর্থ বরাদ্দ থাকে। এ ছাড়া কেন্দ্রটির একটি ভাড়া দেওয়া হয় যা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নামে পরিচিত। যখন কোনো কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ নেয় না তখন জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম দেওয়া বন্ধ থাকে কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। একটি ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রকে বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। সে কারণে বিদ্যুতের প্রয়োজন না থাকলে কেন্দ্র অলস বসে থাকলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারের লোকসান হয়। এর ফলে বছর শেষে পিডিবির আর্থিক ক্ষতি পোষাতে সরকারকে বিপুল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। এতে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। আর নতুন আইনের ফলে বাংলাদেশে এখন থেকে বছরে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব।
পিডিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, জানুয়ারিতে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) ২১২৩৯ মেগাওয়াট এবং ডিরেটেড ক্যাপাসিটি ২০৭৪৮ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে গত ১৮ জানুয়ারি দিনের পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৭৭৫৮ মেগাওয়াট ও সন্ধ্যার পিক আওয়ারে ৯২৯৭ মেগাওয়াট। তবে ওভারক্যাপাসিটি দেশের বিদ্যুৎখাতে শেষ সমস্যা নয় বলে মন্তব্য করেছে আইইইএফএ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবিষ্যতে আমদানীকৃত ব্যয়বহুল কয়লা এবং এলএনজি ইউনিট প্রতি তাপবিদ্যুতের দাম বাড়াবে। বেশি দামের কারণে ইতিমধ্যে গতবছর বাংলাদেশ এলএনজির একাধিক টেন্ডার বাতিল করেছে। ভবিষ্যতে এই উদ্বেগ আরও বাড়তে পারে কারণ ২০২১ এর শুরুতে এশিয়ান এলএনজির দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ হয়েছে।
এছাড়া, পিডিবির তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের শেষে এক হাজার মেগাওয়াট নতুন, ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রিডে সংযুক্ত হতে পারে, যারা আমদানীকৃত কয়লা ও এলএনজির পাশাপাশি পিডিবির ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।
পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় (পিএসএমপি) একটি সংশোধনী আসতে পারে, যেখানে ওভারক্যাপাসিটি এবং জ্বালানী ইস্যুগুলো অগ্রাধিকার পাবে। আইইইএফএ এর সঙ্গে একমত। তবে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে একই সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, তা ওভারক্যাপাসিটির সমস্যা দূর করবে না।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২১ জানুয়ারি, ২০২১ ০২:০২

বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (ওভারক্যাপাসিটি) তৈরি হওয়ায় সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)।
বুধবার তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ আশঙ্কা করা হয়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে, যা এক বছর আগেও ছিল ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। স্পষ্টতই ওভার ক্যাপাসিটি বাড়ছে। এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবিকে সরকারের প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (৮৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
আইইইএফএর প্রতিবেদনটি লিখেছেন জ্বালানি খাতে অর্থায়ন বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে নতুন যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো যোগ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। ২০২৫ সাল নাগাদ আরও ২১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। এই সময়ে মাত্র সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে যাবে। এতে স্থাপিত সক্ষমতার ব্যবহার ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে যদি না বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বাড়ে।
'বাংলাদেশেজ পাওয়ার সিস্টেম ওভারক্যাপাসিটি প্রবলেম ইজ গেটিং ওরস' শীর্ষক এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। আগামী ৫ বছর ধরে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে না থাকে, তবে স্থাপিত সক্ষমতার ব্যবহার (ক্যাপাসিটি ইউটিলাইজেশন) ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওভারক্যাপাসিটির বিরূপ প্রভাব পড়বে পিডিবির আর্থিক অবস্থা এবং বিদ্যুতের দামের ওপর। পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রলোর বিদ্যুৎ কেনার স্বল্প (রেন্টাল) ও দীর্ঘমেয়াদি (আইপিপি বা ইন্ডিপেডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) চুক্তি (পাওয়ার পারচেজিং এগ্রিমেন্ট) থাকে। এসব কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা বা জ্বালানির মূল্য দেয় পিডিবি, দেওয়া হয় বিদ্যুতের দাম, সারা বছর কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট অর্থ বরাদ্দ থাকে। এ ছাড়া কেন্দ্রটির একটি ভাড়া দেওয়া হয় যা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নামে পরিচিত। যখন কোনো কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ নেয় না তখন জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম দেওয়া বন্ধ থাকে কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। একটি ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রকে বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। সে কারণে বিদ্যুতের প্রয়োজন না থাকলে কেন্দ্র অলস বসে থাকলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারের লোকসান হয়। এর ফলে বছর শেষে পিডিবির আর্থিক ক্ষতি পোষাতে সরকারকে বিপুল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। এতে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। আর নতুন আইনের ফলে বাংলাদেশে এখন থেকে বছরে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব।
পিডিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, জানুয়ারিতে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) ২১২৩৯ মেগাওয়াট এবং ডিরেটেড ক্যাপাসিটি ২০৭৪৮ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে গত ১৮ জানুয়ারি দিনের পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৭৭৫৮ মেগাওয়াট ও সন্ধ্যার পিক আওয়ারে ৯২৯৭ মেগাওয়াট। তবে ওভারক্যাপাসিটি দেশের বিদ্যুৎখাতে শেষ সমস্যা নয় বলে মন্তব্য করেছে আইইইএফএ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবিষ্যতে আমদানীকৃত ব্যয়বহুল কয়লা এবং এলএনজি ইউনিট প্রতি তাপবিদ্যুতের দাম বাড়াবে। বেশি দামের কারণে ইতিমধ্যে গতবছর বাংলাদেশ এলএনজির একাধিক টেন্ডার বাতিল করেছে। ভবিষ্যতে এই উদ্বেগ আরও বাড়তে পারে কারণ ২০২১ এর শুরুতে এশিয়ান এলএনজির দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ হয়েছে।
এছাড়া, পিডিবির তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের শেষে এক হাজার মেগাওয়াট নতুন, ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রিডে সংযুক্ত হতে পারে, যারা আমদানীকৃত কয়লা ও এলএনজির পাশাপাশি পিডিবির ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।
পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় (পিএসএমপি) একটি সংশোধনী আসতে পারে, যেখানে ওভারক্যাপাসিটি এবং জ্বালানী ইস্যুগুলো অগ্রাধিকার পাবে। আইইইএফএ এর সঙ্গে একমত। তবে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে একই সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, তা ওভারক্যাপাসিটির সমস্যা দূর করবে না।