এগিয়ে থাকবে ‘দহন’
ওয়াহিদ সুজন | ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১৮:০৪
‘দহন’ চলচ্চিত্রে সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরি। ছবি: জাজ মাল্টিমিডিয়া
বছর কয়েক আগে রাজনৈতিক কর্মসূচির ছায়ায় সংঘটিত ‘আগুন সন্ত্রাসের’ প্রেক্ষাপটে মানবিক গল্প সাজিয়েছেন নির্মাতা রায়হান রাফী। স্থান-কালের ক্রমাগত রদবদল ও আবহ স্বরের বর্ণনা ধরে আগুনে পোড়া একটি বাসের যাত্রীদের কাছাকাছি পৌঁছে যান দর্শক।
‘দহন’ সিনেমায় বেশ কয়েকটি গল্প আছে। যেমন; যে মেয়েটি নায়িকার হওয়ার জন্য এফডিসিতে নিত্য ঘোরাঘুরি করে, তার শুটিংয়ের প্রথম দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসা দরিদ্র পরিবারের এক তরুণ। নিজের জন্মদিনে দাদার সঙ্গে স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে থাকা ছোট একটা মেয়ে। কিডনি বিক্রি করে মায়ের অপারেশনের জন্য টাকা নিয়ে যাচ্ছে এক তরুণ। আরেকজন ঢাকায় এসেছেন বাবার জন্য হজের কাগজপত্র তৈরি করতে।
আরও একজন আছেন। আশা, যিনি এ সিনেমার নায়িকা। যার চরিত্রে আছেন পূজা চেরি। আগুনে তিনি ঝলসে যান, আর সেই আগুন ছুড়েছে তার প্রেমিক তুলা। এ চরিত্রে আছেন সিয়াম আহমেদ। ট্রেইলারে দর্শকরা দেখেছেন লিডারের নির্দেশে এ অপকর্ম করেন তিনি। তারপর কী ঘটে, থাকুক তবে রহস্য!
সিনেমাটির ট্যাগ লাইন ‘মানুষের জীবন ক্ষমতা পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে না’। এমন বক্তব্য নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্ত হতে হয়। কারণ ক্ষমতাসীনদের ‘ক্ষমতা পরিবর্তনের’ দরকার পড়ে না। তবে কারা মানুষের জীবনকে হাতিয়ার করছে? বাংলাদেশের জটিল ও অমীমাংসিত প্রশ্নসংকুল রাজনৈতিক পটভূমিতে এ ধরনের বক্তব্য পক্ষপাত তৈরি করে বলে মনে হতে পারে। তবে সিনেমায় রায়হান রাফী বিষয়টিকে ভিন্নভাবে সামাল দিয়েছেন। ফলত দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীর কোনো দিকে আলোকপাত করেননি।
মানতেই হবে বিষয় নির্বাচনে নতুনত্ব রয়েছে। কাজটির পরিকল্পনাও সাহসের। আবার বিষয় নির্বাচনের মতো করে গল্প ততটা জমেনি। পুরো ছবি জুড়ে ট্র্যাজিক আবহ ধরে রেখেছেন নির্মাতা। যা গল্পের সাবলীলতাকে ক্ষুন্ন করেছে। তবে স্বস্তিকর কিছু যে নেই, তা নিশ্চয় নয়। বিশেষ করে তুলা ও আশার সম্পর্ক ও এর টানাপোড়েন বেশ আরামদায়ক।
সিনেমা মুক্তির আগে তুলা চরিত্র সম্পর্কে যতটা বলা হয়েছে, ততটা ভয়ঙ্কর মনে হয়নি তাকে। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর মতো করে নায়ককে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ‘পোড়ামন ২’ সিনেমার সুজনের মতোই খেয়ালী মনে হয়েছে। জন্ম-পরিচয়হীনতা নিয়ে যন্ত্রণা আছে, কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন নাই- ক্ষোভ স্পষ্ট না। হ্যাঁ, আশাকে নিয়ে ঘর বেঁধে বদলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। একটা দৃশ্যে সেটা শোনা যায় তার মুখে। কিন্তু সংলাপের কারণে হাস্যকর হয়ে উঠে। আশাকে তুলা বলে, সামনে একটা বড় কাজ আছে। সেই টাকা পেলে একদম বদলে যাবে। অন্য কিছু করবে। এমনকি সিগারেট-মদ ছেড়ে দেবে। টাকার সঙ্গে ‘সিগারেট-মদ’ ছাড়ার সম্পর্কহীন বিষয়টি ঘটনাকে সিরিয়াস হতে দেয় না। দর্শকের হাসি ছড়িয়ে পড়ে হল জুড়ে।
অথচ এ ধরনের লাওয়ারিশ চরিত্র বাংলা সিনেমায় বিরল নয়। বিশেষ করে মান্না অভিনীত কাজী হায়াতের ‘ধর’-এর কথা না তুললেই নয়। প্রয়াত নায়কের ধূসর চরিত্রটি সবাইকে এখনও ছুঁয়ে যায়। তুলা চরিত্রটিকে তেমন হতে হবে এমন না, কিন্তু চরিত্রের গঠন পূর্ণতা পায়নি বলেই মনে হয়।
ছবিতে আশা তথা পূজার গল্প মোটামুটি বলা গেলেও বাকি সাবপ্লটগুলো বাংলা সিনেমার প্রথাগত মেলোড্রামা দিয়ে আবর্তিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। এমনকি শ্রেণি হিসেবে বাসযাত্রীদের কাছাকাছি রকমের সামাজিক বিন্যাস থেকে আনা হয়েছে। ধর্ম পরিচয়ের ভিন্নতাও ক্লিশে।
গল্পে অবশ্য কোনো সময়ের সরাসরি রেফারেন্স নাই। তবে সিনেমাটির কিছু দৃশ্যে সময় নির্দেশক পোস্টার দেখে খানিকটা বিভ্রান্ত হতে হয়। যেমন; পোড়ামন (২০১৩), আমি তোমার হতে চাই (২০১৬) ও নবাব (২০১৭)। এছাড়া থানায় পুলিশ কর্মকর্তার ডেস্কে একটি ক্যালেন্ডারে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস দেখা যায়।
পুরো সিনেমাটি আবর্তিত হয়েছে তুলা চরিত্রকে কেন্দ্র করে। আত্মকথন ও ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে গল্প এগিয়েছে। ভঙ্গিটি চমৎকার। একহারা বর্ণনার চেয়ে এভাবে গল্প বলায় এক ধরনের উত্তেজনা থাকে। সিয়ামের অনুশোচনাহীন অপরাধ, পরবর্তীতে পাপবোধই গল্পের মূল প্রাণ। কিন্তু চরিত্রটি কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- প্রশ্ন থেকেই যায়। সিয়াম আহমেদ অনেক খাটুনি করেছেন কিন্তু মাঝে মাঝে অতিঅভিনয় মনে হয়েছে। চরিত্র থেকে নায়কোচিত উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।
সেই তুলনায় সপ্রতিভ ছিলেন পূজা চেরি। তার অভিনয় একদম আড়ম্বরহীন, নায়িকা হিসেবে বাড়তি কোনো চাপই নেই। পোড়ামন ২ বা নূরজাহানেও তেমনটা দেখা গেছে। নানা ঘটনায় ভরাক্রান্ত ‘দহন’-এ তার স্ক্রিনটাইম কম কিন্তু যতক্ষণ ছিলেন আলো ছড়িয়েছেন। বাকি চরিত্রের মধ্যে মুনিরা মিঠু বরাবরের মতোই সাবলীল। ফজলুর রহমান বাবু আজকাল বড়ই একঘেয়ে। এছাড়া দু-একজন ছাড়া অন্য পার্শ্বচরিত্ররা ভালো করেছেন। তবে খানিকটা হতাশ করেছেন জাকিয়া বারী মম। তার অভিনীত চরিত্রের ততটা গভীরতা ছিল না। অভিনয়ও কখনো কখনো আরোপিত মনে হয়েছে।
গল্পে অনেক সাবপ্লটের ছিল, সে অনুসারে সংলাপ ততটা জোরালো ছিল না। সিয়াম-পূজার খুনসুটি মজা দিয়েছে। মনিরা মিঠুর সংলাপগুলোও হাততালি পেয়েছে। সিয়ামের কিছু সংলাপ জোরালো ছিল বটে। আবার খুব বেশি বক্তব্যধর্মী-শিক্ষামূলক।
‘দহন’-এর লোকেশনের ব্যবহার যথাযথ, এর মাঝে বাগড়া দিয়েছে যত্রতত্র ধোয়ার ব্যবহার। কালার এত জমকালো না হয়ে গল্পের ধরন অনুযায়ী ডার্ক টোন হলে ভালো লাগত। কারিগরি টিম ভালোই করেছেন। বিশেষ করে গ্রাফিক্সের ব্যবহার প্রশংসনীয়। এ বিভাগে এমন অনেক ট্রিটমেন্ট ছিল যা ঢাকাই সিনেমায় আগে দেখা যায়নি। বিশেষ করে তুলাকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের দৃশ্যগুলো। এছাড়া গাড়িতে আগুনের থ্রিডি দৃশ্যটি বিদেশি ছবির মতো নিখুঁত না হলেও চমকে দেওয়ার মতো। আগুনে পোড়া গাড়িটির ধারাবাহিকতা ছিল না, অন্য কিছু ঘটনার খাপছাড়া ফুটেজও ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয়েছে মূল গল্পের বাইরে গিয়েও কিছু বলতে চেয়েছে।
‘দহন’-এ বেশ কয়েকটি গান রয়েছে। এর মধ্যে ‘হাজির বিরিয়ানি’ দেখতে স্মার্ট হলেও সিয়ামের চরিত্রকে অনেকটা খেলো করে দিয়েছে। ‘পোড়ামন ২’ এর ‘সুতো কাটা ঘুড়ি’ ও ‘ও হে শ্যাম’-এর সমান্তরালে ছিল ‘সকাল হাসে’ ও ‘প্রেমের বাক্স’ গান দুটি। ততটা জমেনি। প্রথম গানটির দৃশ্যায়ন চলনসই হলেও দ্বিতীয়টি আবেদন তৈরি করেনি। এছাড়া একটি স্যাড সং ও আনুশেহ-এর কণ্ঠে ভিন্নভাবে শোনা গেছে একটি রবীন্দ্রসংগীত। এ দুটি ভালোই লাগে শুনতে। আবহ সংগীতে একাধিক বিদেশি সিনেমা থেকে কপি করার অভিযোগ উঠেছে, এছাড়া অনেক জায়গায় বেশ চড়া দাগের সংগীত। তা সত্ত্বেও অনেক দৃশ্য, আবহ মিলে আবেগ জাগাতে সক্ষম হয়েছে।
এ ধরনের কিছু আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে হাজির হয়েছে ‘দহন’। গল্প নির্বাচন, নির্মাণে এগিয়ে থাকার চেষ্টা মিলে রায়হান রাফীকে আমরা সাধুবাদই জানাবো। এটাও বলব, চলতি বছরের অন্যতম সিনেমা ‘দহন’। তবে প্রশ্ন থাকবে, ‘পোড়ামন ২’ এর রাফী কতটা এগিয়ে গেলেন?
১ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও ভিডিওগ্রাফার আনোয়ার হোসেন। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া শেখ নিয়ামত আলীর বিখ্যাত সিনেমা ‘দহন’-এর চিত্রগ্রহণ সামলেছেন তিনি। এর ৩৩ বছর পর রায়হান রাফী নির্মাণ করেছেন একই নামের সিনেমা। দুটোর ঘরানা বা জিজ্ঞাসা আলাদা- তবে জীবনের গল্পই তো! কাকতালীয়ভাবে আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর দুদিন আগে মুক্তি পেল রাফীর ‘দহন’। শ্রদ্ধা সেই কীর্তিমানের স্মৃতির প্রতি।
দহন
পরিচালক : রায়হান রাফি
কাহিনী : রায়হান রাফী ও আব্দুল আজিজ
চিত্রনাট্য : রায়হান রাফী ও দেলোয়ার হোসেন দিল
অভিনয় : সিয়াম আহমেদ, পুজা চেরি, জাকিয়া বারী মম, ফজলুর রহমান বাবু, শিমুল খান, মুনিরা মিঠু, সুষমা সরকার, রিপা রাজ প্রমুখ
প্রযোজনা : জাজ মাল্টিমিডিয়া
মুক্তি : ৩০ নভেম্বর, ২০১৮
রেটিং : ৩/৫
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
ওয়াহিদ সুজন | ৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ১৮:০৪

বছর কয়েক আগে রাজনৈতিক কর্মসূচির ছায়ায় সংঘটিত ‘আগুন সন্ত্রাসের’ প্রেক্ষাপটে মানবিক গল্প সাজিয়েছেন নির্মাতা রায়হান রাফী। স্থান-কালের ক্রমাগত রদবদল ও আবহ স্বরের বর্ণনা ধরে আগুনে পোড়া একটি বাসের যাত্রীদের কাছাকাছি পৌঁছে যান দর্শক।
‘দহন’ সিনেমায় বেশ কয়েকটি গল্প আছে। যেমন; যে মেয়েটি নায়িকার হওয়ার জন্য এফডিসিতে নিত্য ঘোরাঘুরি করে, তার শুটিংয়ের প্রথম দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসা দরিদ্র পরিবারের এক তরুণ। নিজের জন্মদিনে দাদার সঙ্গে স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে থাকা ছোট একটা মেয়ে। কিডনি বিক্রি করে মায়ের অপারেশনের জন্য টাকা নিয়ে যাচ্ছে এক তরুণ। আরেকজন ঢাকায় এসেছেন বাবার জন্য হজের কাগজপত্র তৈরি করতে।
আরও একজন আছেন। আশা, যিনি এ সিনেমার নায়িকা। যার চরিত্রে আছেন পূজা চেরি। আগুনে তিনি ঝলসে যান, আর সেই আগুন ছুড়েছে তার প্রেমিক তুলা। এ চরিত্রে আছেন সিয়াম আহমেদ। ট্রেইলারে দর্শকরা দেখেছেন লিডারের নির্দেশে এ অপকর্ম করেন তিনি। তারপর কী ঘটে, থাকুক তবে রহস্য!
সিনেমাটির ট্যাগ লাইন ‘মানুষের জীবন ক্ষমতা পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে না’। এমন বক্তব্য নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্ত হতে হয়। কারণ ক্ষমতাসীনদের ‘ক্ষমতা পরিবর্তনের’ দরকার পড়ে না। তবে কারা মানুষের জীবনকে হাতিয়ার করছে? বাংলাদেশের জটিল ও অমীমাংসিত প্রশ্নসংকুল রাজনৈতিক পটভূমিতে এ ধরনের বক্তব্য পক্ষপাত তৈরি করে বলে মনে হতে পারে। তবে সিনেমায় রায়হান রাফী বিষয়টিকে ভিন্নভাবে সামাল দিয়েছেন। ফলত দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীর কোনো দিকে আলোকপাত করেননি।
মানতেই হবে বিষয় নির্বাচনে নতুনত্ব রয়েছে। কাজটির পরিকল্পনাও সাহসের। আবার বিষয় নির্বাচনের মতো করে গল্প ততটা জমেনি। পুরো ছবি জুড়ে ট্র্যাজিক আবহ ধরে রেখেছেন নির্মাতা। যা গল্পের সাবলীলতাকে ক্ষুন্ন করেছে। তবে স্বস্তিকর কিছু যে নেই, তা নিশ্চয় নয়। বিশেষ করে তুলা ও আশার সম্পর্ক ও এর টানাপোড়েন বেশ আরামদায়ক।
সিনেমা মুক্তির আগে তুলা চরিত্র সম্পর্কে যতটা বলা হয়েছে, ততটা ভয়ঙ্কর মনে হয়নি তাকে। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর মতো করে নায়ককে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ‘পোড়ামন ২’ সিনেমার সুজনের মতোই খেয়ালী মনে হয়েছে। জন্ম-পরিচয়হীনতা নিয়ে যন্ত্রণা আছে, কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন নাই- ক্ষোভ স্পষ্ট না। হ্যাঁ, আশাকে নিয়ে ঘর বেঁধে বদলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। একটা দৃশ্যে সেটা শোনা যায় তার মুখে। কিন্তু সংলাপের কারণে হাস্যকর হয়ে উঠে। আশাকে তুলা বলে, সামনে একটা বড় কাজ আছে। সেই টাকা পেলে একদম বদলে যাবে। অন্য কিছু করবে। এমনকি সিগারেট-মদ ছেড়ে দেবে। টাকার সঙ্গে ‘সিগারেট-মদ’ ছাড়ার সম্পর্কহীন বিষয়টি ঘটনাকে সিরিয়াস হতে দেয় না। দর্শকের হাসি ছড়িয়ে পড়ে হল জুড়ে।
অথচ এ ধরনের লাওয়ারিশ চরিত্র বাংলা সিনেমায় বিরল নয়। বিশেষ করে মান্না অভিনীত কাজী হায়াতের ‘ধর’-এর কথা না তুললেই নয়। প্রয়াত নায়কের ধূসর চরিত্রটি সবাইকে এখনও ছুঁয়ে যায়। তুলা চরিত্রটিকে তেমন হতে হবে এমন না, কিন্তু চরিত্রের গঠন পূর্ণতা পায়নি বলেই মনে হয়।
ছবিতে আশা তথা পূজার গল্প মোটামুটি বলা গেলেও বাকি সাবপ্লটগুলো বাংলা সিনেমার প্রথাগত মেলোড্রামা দিয়ে আবর্তিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। এমনকি শ্রেণি হিসেবে বাসযাত্রীদের কাছাকাছি রকমের সামাজিক বিন্যাস থেকে আনা হয়েছে। ধর্ম পরিচয়ের ভিন্নতাও ক্লিশে।
গল্পে অবশ্য কোনো সময়ের সরাসরি রেফারেন্স নাই। তবে সিনেমাটির কিছু দৃশ্যে সময় নির্দেশক পোস্টার দেখে খানিকটা বিভ্রান্ত হতে হয়। যেমন; পোড়ামন (২০১৩), আমি তোমার হতে চাই (২০১৬) ও নবাব (২০১৭)। এছাড়া থানায় পুলিশ কর্মকর্তার ডেস্কে একটি ক্যালেন্ডারে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস দেখা যায়।
পুরো সিনেমাটি আবর্তিত হয়েছে তুলা চরিত্রকে কেন্দ্র করে। আত্মকথন ও ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে গল্প এগিয়েছে। ভঙ্গিটি চমৎকার। একহারা বর্ণনার চেয়ে এভাবে গল্প বলায় এক ধরনের উত্তেজনা থাকে। সিয়ামের অনুশোচনাহীন অপরাধ, পরবর্তীতে পাপবোধই গল্পের মূল প্রাণ। কিন্তু চরিত্রটি কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- প্রশ্ন থেকেই যায়। সিয়াম আহমেদ অনেক খাটুনি করেছেন কিন্তু মাঝে মাঝে অতিঅভিনয় মনে হয়েছে। চরিত্র থেকে নায়কোচিত উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।
সেই তুলনায় সপ্রতিভ ছিলেন পূজা চেরি। তার অভিনয় একদম আড়ম্বরহীন, নায়িকা হিসেবে বাড়তি কোনো চাপই নেই। পোড়ামন ২ বা নূরজাহানেও তেমনটা দেখা গেছে। নানা ঘটনায় ভরাক্রান্ত ‘দহন’-এ তার স্ক্রিনটাইম কম কিন্তু যতক্ষণ ছিলেন আলো ছড়িয়েছেন। বাকি চরিত্রের মধ্যে মুনিরা মিঠু বরাবরের মতোই সাবলীল। ফজলুর রহমান বাবু আজকাল বড়ই একঘেয়ে। এছাড়া দু-একজন ছাড়া অন্য পার্শ্বচরিত্ররা ভালো করেছেন। তবে খানিকটা হতাশ করেছেন জাকিয়া বারী মম। তার অভিনীত চরিত্রের ততটা গভীরতা ছিল না। অভিনয়ও কখনো কখনো আরোপিত মনে হয়েছে।
গল্পে অনেক সাবপ্লটের ছিল, সে অনুসারে সংলাপ ততটা জোরালো ছিল না। সিয়াম-পূজার খুনসুটি মজা দিয়েছে। মনিরা মিঠুর সংলাপগুলোও হাততালি পেয়েছে। সিয়ামের কিছু সংলাপ জোরালো ছিল বটে। আবার খুব বেশি বক্তব্যধর্মী-শিক্ষামূলক।
‘দহন’-এর লোকেশনের ব্যবহার যথাযথ, এর মাঝে বাগড়া দিয়েছে যত্রতত্র ধোয়ার ব্যবহার। কালার এত জমকালো না হয়ে গল্পের ধরন অনুযায়ী ডার্ক টোন হলে ভালো লাগত। কারিগরি টিম ভালোই করেছেন। বিশেষ করে গ্রাফিক্সের ব্যবহার প্রশংসনীয়। এ বিভাগে এমন অনেক ট্রিটমেন্ট ছিল যা ঢাকাই সিনেমায় আগে দেখা যায়নি। বিশেষ করে তুলাকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের দৃশ্যগুলো। এছাড়া গাড়িতে আগুনের থ্রিডি দৃশ্যটি বিদেশি ছবির মতো নিখুঁত না হলেও চমকে দেওয়ার মতো। আগুনে পোড়া গাড়িটির ধারাবাহিকতা ছিল না, অন্য কিছু ঘটনার খাপছাড়া ফুটেজও ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয়েছে মূল গল্পের বাইরে গিয়েও কিছু বলতে চেয়েছে।
‘দহন’-এ বেশ কয়েকটি গান রয়েছে। এর মধ্যে ‘হাজির বিরিয়ানি’ দেখতে স্মার্ট হলেও সিয়ামের চরিত্রকে অনেকটা খেলো করে দিয়েছে। ‘পোড়ামন ২’ এর ‘সুতো কাটা ঘুড়ি’ ও ‘ও হে শ্যাম’-এর সমান্তরালে ছিল ‘সকাল হাসে’ ও ‘প্রেমের বাক্স’ গান দুটি। ততটা জমেনি। প্রথম গানটির দৃশ্যায়ন চলনসই হলেও দ্বিতীয়টি আবেদন তৈরি করেনি। এছাড়া একটি স্যাড সং ও আনুশেহ-এর কণ্ঠে ভিন্নভাবে শোনা গেছে একটি রবীন্দ্রসংগীত। এ দুটি ভালোই লাগে শুনতে। আবহ সংগীতে একাধিক বিদেশি সিনেমা থেকে কপি করার অভিযোগ উঠেছে, এছাড়া অনেক জায়গায় বেশ চড়া দাগের সংগীত। তা সত্ত্বেও অনেক দৃশ্য, আবহ মিলে আবেগ জাগাতে সক্ষম হয়েছে।
এ ধরনের কিছু আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে হাজির হয়েছে ‘দহন’। গল্প নির্বাচন, নির্মাণে এগিয়ে থাকার চেষ্টা মিলে রায়হান রাফীকে আমরা সাধুবাদই জানাবো। এটাও বলব, চলতি বছরের অন্যতম সিনেমা ‘দহন’। তবে প্রশ্ন থাকবে, ‘পোড়ামন ২’ এর রাফী কতটা এগিয়ে গেলেন?
১ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও ভিডিওগ্রাফার আনোয়ার হোসেন। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া শেখ নিয়ামত আলীর বিখ্যাত সিনেমা ‘দহন’-এর চিত্রগ্রহণ সামলেছেন তিনি। এর ৩৩ বছর পর রায়হান রাফী নির্মাণ করেছেন একই নামের সিনেমা। দুটোর ঘরানা বা জিজ্ঞাসা আলাদা- তবে জীবনের গল্পই তো! কাকতালীয়ভাবে আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর দুদিন আগে মুক্তি পেল রাফীর ‘দহন’। শ্রদ্ধা সেই কীর্তিমানের স্মৃতির প্রতি।
দহন পরিচালক : রায়হান রাফি কাহিনী : রায়হান রাফী ও আব্দুল আজিজ চিত্রনাট্য : রায়হান রাফী ও দেলোয়ার হোসেন দিল অভিনয় : সিয়াম আহমেদ, পুজা চেরি, জাকিয়া বারী মম, ফজলুর রহমান বাবু, শিমুল খান, মুনিরা মিঠু, সুষমা সরকার, রিপা রাজ প্রমুখ প্রযোজনা : জাজ মাল্টিমিডিয়া মুক্তি : ৩০ নভেম্বর, ২০১৮ রেটিং : ৩/৫