মহাত্মার স্মৃতিবিজড়িত পুকুর কই!
সাইফুর রহমান মিরণ, বরিশাল | ২২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০
আধুনিক বরিশালের রূপকার হিসেবে পরিচিত মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনের সামনে থাকা সরকারি বরিশাল কলেজের পুকুরটি দখল-দূষণের কবলে পড়ে এমনিতে অনেক আগেই ডোবায় পরিণত হয়েছে। এই পুকুরটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি। বিভিন্ন সময়ে নানা কারণ দেখিয়ে কলেজের সাবেক কয়েকজন অধ্যক্ষ পুকুরটির বেশিরভাগ অংশই ভরাট করেছেন। এখন বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকও পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। তিনি রাতের আঁধারে পুকুরের বাকি অংশ ভরাটের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত সোমবার রাতে পুকুরটিতে ইটের গুঁড়া ও খোয়া ফেলে এই ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে।
এর আগে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. মজিবুর রহমান পুকুরের ভরাট করা অর্ধেকের ওপর মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে আরেক অধ্যক্ষ খন্দকার অলিউল ইসলাম পুকুরের বাকি অংশ ভরাটের কাজ শুরু করেন। ভরাটের অংশ হিসেবে তিনি পুকুরের পশ্চিম দিকে সুউচ্চ প্রাচীর তুলে দেন। যাতে ভেতরে ভরাট হলেও বাইরে থেকে সেটা দেখা না যায়। এরপর ভেতরে ধীরে ধীরে চলে ভরাটের কাজ। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত তার বাড়ির সামনে নিজের ব্যবহার ও এলাকাবাসীর সুবিধার কথা চিন্তা করে পুকুরটি খনন করেছিলেন। ২০১০ সালে নাগরিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনের সামনে থাকা পুকুরটি রক্ষায় উদ্যোগ নেন তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। কিন্তু ২০১২ সালে কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান পুকুরের বাকি অংশ ভরাটের জন্য চেষ্টা চালান। তখন নাগরিকদের বাধার মুখে পড়ে পিছু হটেন তিনি। পরে অবশ্য ২০১৮ সালে পুকুরটির মৃত্যু ঘটাতে উঠেপড়ে লাগেন তখনকার অধ্যক্ষ খন্দকার অলিউল ইসলাম। তিনি পুকুরের কিছু অংশে রাস্তা নির্মাণ এবং বেশ কিছুটা অংশ মাটি ও খোয়া দিয়ে ভরাট করেন। আর বর্তমান অধ্যক্ষ পুকুরটিকে পুরোপুরি মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বরিশালের বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের নেতারা।
বরিশালের একাধিক প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৯২৩ সালে মারা যাওয়ার পর ১৯৫৫ সালে তার একমাত্র ওয়ারিশ ভাতিজা সরল দত্ত দেশ ত্যাগ করেন। পরে ১৯৫৭ সালে অশ্বিনী দত্তের বাসভবনটি ব্রজমোহন কলেজের ‘অশ্বিনী কুমার কসমোপলিটন ছাত্রাবাস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরও কিছুদিন পর ১৯৬২ সালে শিক্ষাবিদ জয়ন্ত কুমার দাস, হোসেন আলী এবং আরও কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সহযোগিতায় এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি নৈশ মহাবিদ্যালয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অশ্বিনী কুমারের নামে তার বাসভবনে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। কিন্তু ওই দাবি উপেক্ষিত হয়ে কলেজটির নামকরণ করা হয় বরিশাল কলেজ নামে। পরে ১৯৮৭ সালে বরিশাল কলেজ সরকারিকরণ করা হলে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে থাকা প্রেয়ার রুমটি (প্রার্থনা কক্ষ) কলেজের বাইরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বরিশালবাসীর প্রতিবাদ উপেক্ষা করে অশ্বিনী দত্তের বাসভবনের সামনের ঐতিহাসিক পুকুরটির অর্ধেক ভরাট করে ফেলা হয়। ভরাটকৃত অংশে মসজিদ নির্মাণ করে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। এরপর ১৯৯১ সালে উন্নয়নের নামে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ অশ্বিনী দত্তের মূল বাসভবনটিও ভেঙে দেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, একসময় এই পুকুরপাড়ে এবং অশ্বিনী দত্তের বাসভবনের সামনে প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীসহ শত মনীষী। এসব বিশিষ্টজনরা তখন এই পুকুরের পানি ব্যবহার করেছেন। সেদিক বিবেচনায় এই পুকরটি ইতিহাসের অনেক কিছুর সাক্ষী।
নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অশ্বিনী দত্তের বাসভবন গেছে, পুকুরটিও যাওয়ার পথে।’ বরিশালের প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে এই পুকুরটি রক্ষা করা প্রয়োজন।’
এদিকে পুকুর ভরাটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সরকারি বরিশাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কলেজের কিছু রাবিশ (খোয়া) ছিল, সেগুলো পুকুরের পাশে রাখা হয়েছে। ওই পুকুর ভরাটের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
শেয়ার করুন
সাইফুর রহমান মিরণ, বরিশাল | ২২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০

আধুনিক বরিশালের রূপকার হিসেবে পরিচিত মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনের সামনে থাকা সরকারি বরিশাল কলেজের পুকুরটি দখল-দূষণের কবলে পড়ে এমনিতে অনেক আগেই ডোবায় পরিণত হয়েছে। এই পুকুরটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি। বিভিন্ন সময়ে নানা কারণ দেখিয়ে কলেজের সাবেক কয়েকজন অধ্যক্ষ পুকুরটির বেশিরভাগ অংশই ভরাট করেছেন। এখন বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকও পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। তিনি রাতের আঁধারে পুকুরের বাকি অংশ ভরাটের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত সোমবার রাতে পুকুরটিতে ইটের গুঁড়া ও খোয়া ফেলে এই ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে।
এর আগে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. মজিবুর রহমান পুকুরের ভরাট করা অর্ধেকের ওপর মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে আরেক অধ্যক্ষ খন্দকার অলিউল ইসলাম পুকুরের বাকি অংশ ভরাটের কাজ শুরু করেন। ভরাটের অংশ হিসেবে তিনি পুকুরের পশ্চিম দিকে সুউচ্চ প্রাচীর তুলে দেন। যাতে ভেতরে ভরাট হলেও বাইরে থেকে সেটা দেখা না যায়। এরপর ভেতরে ধীরে ধীরে চলে ভরাটের কাজ। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত তার বাড়ির সামনে নিজের ব্যবহার ও এলাকাবাসীর সুবিধার কথা চিন্তা করে পুকুরটি খনন করেছিলেন। ২০১০ সালে নাগরিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনের সামনে থাকা পুকুরটি রক্ষায় উদ্যোগ নেন তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। কিন্তু ২০১২ সালে কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান পুকুরের বাকি অংশ ভরাটের জন্য চেষ্টা চালান। তখন নাগরিকদের বাধার মুখে পড়ে পিছু হটেন তিনি। পরে অবশ্য ২০১৮ সালে পুকুরটির মৃত্যু ঘটাতে উঠেপড়ে লাগেন তখনকার অধ্যক্ষ খন্দকার অলিউল ইসলাম। তিনি পুকুরের কিছু অংশে রাস্তা নির্মাণ এবং বেশ কিছুটা অংশ মাটি ও খোয়া দিয়ে ভরাট করেন। আর বর্তমান অধ্যক্ষ পুকুরটিকে পুরোপুরি মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বরিশালের বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের নেতারা।
বরিশালের একাধিক প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৯২৩ সালে মারা যাওয়ার পর ১৯৫৫ সালে তার একমাত্র ওয়ারিশ ভাতিজা সরল দত্ত দেশ ত্যাগ করেন। পরে ১৯৫৭ সালে অশ্বিনী দত্তের বাসভবনটি ব্রজমোহন কলেজের ‘অশ্বিনী কুমার কসমোপলিটন ছাত্রাবাস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরও কিছুদিন পর ১৯৬২ সালে শিক্ষাবিদ জয়ন্ত কুমার দাস, হোসেন আলী এবং আরও কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সহযোগিতায় এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি নৈশ মহাবিদ্যালয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অশ্বিনী কুমারের নামে তার বাসভবনে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। কিন্তু ওই দাবি উপেক্ষিত হয়ে কলেজটির নামকরণ করা হয় বরিশাল কলেজ নামে। পরে ১৯৮৭ সালে বরিশাল কলেজ সরকারিকরণ করা হলে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে থাকা প্রেয়ার রুমটি (প্রার্থনা কক্ষ) কলেজের বাইরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বরিশালবাসীর প্রতিবাদ উপেক্ষা করে অশ্বিনী দত্তের বাসভবনের সামনের ঐতিহাসিক পুকুরটির অর্ধেক ভরাট করে ফেলা হয়। ভরাটকৃত অংশে মসজিদ নির্মাণ করে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। এরপর ১৯৯১ সালে উন্নয়নের নামে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ অশ্বিনী দত্তের মূল বাসভবনটিও ভেঙে দেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, একসময় এই পুকুরপাড়ে এবং অশ্বিনী দত্তের বাসভবনের সামনে প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীসহ শত মনীষী। এসব বিশিষ্টজনরা তখন এই পুকুরের পানি ব্যবহার করেছেন। সেদিক বিবেচনায় এই পুকরটি ইতিহাসের অনেক কিছুর সাক্ষী।
নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অশ্বিনী দত্তের বাসভবন গেছে, পুকুরটিও যাওয়ার পথে।’ বরিশালের প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে এই পুকুরটি রক্ষা করা প্রয়োজন।’
এদিকে পুকুর ভরাটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সরকারি বরিশাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কলেজের কিছু রাবিশ (খোয়া) ছিল, সেগুলো পুকুরের পাশে রাখা হয়েছে। ওই পুকুর ভরাটের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’