
বাংলা একাডেমির প্রবর্তিত বরেণ্য কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করেছেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান ২৭ ডিসেম্বর, আর ৩০ ডিসেম্বর পেলেন আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তির সুখবর। দুটি পুরস্কারই তিনি পেয়েছেন তার উপন্যাস উজানবাঁশির জন্য। রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কারের জন্য তিনি পেয়েছেন এক লাখ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কারের জন্য পাবেন ৫ লাখ টাকা। ৬ লাখ টাকার অর্থ পুরস্কারপ্রাপ্তিতে উচ্ছ্বসিত স্বকৃত নোমান জানান, বন্ধুরা খাওয়া-দাওয়ার জন্য খুব চাপাচাপি করছে, তিনিও বেশ চাপে আছেন। এরপর তিনি যুক্ত করেন, ‘উপন্যাস রচনা অত্যন্ত পরিশুদ্ধ একটি কাজ। দীর্ঘ পরিশ্রমের পর স্বীকৃতি আসার পর আনন্দ হয়, দুটি পুরস্কারপ্রাপ্তিতে যেমন হয়েছে। এই পুরস্কার শুধু আমার নয়, আমার বন্ধুদেরও, পাঠকদেরও।’
স্বকৃত নোমান গত ডিসেম্বরে একটা উপন্যাস শুরু করেছেন। ধারণা করছেন সম্ভবত বছরখানেক লাগবে লিখে শেষ করতে। আসন্ন বইমেলায় ‘কয়েকজন দেহ’ নামে একটি গল্পের বই প্রকাশিত হবে পাঠক সমাবেশ থেকে।
ঢাকা লিট ফেস্টের অন্যতম পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ। তিনি একজন লেখক ও প্রকাশক। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউনের প্রকাশক। তার তিনটি ফিকশন বই হলোগুডনাইট মি. কিসিঞ্জার, ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস ও ফোর্টি স্টেপস। তিনি ওয়াসাফিরি ও গ্রান্টায় বাংলাদেশবিষয়ক আয়োজন সম্পাদনা করেছেন। ঢাকা লিট ফেস্ট সামনে রেখে কাজী আনিস আহমেদের মুখোমুখি হয়েছিলেন ধ্রুপদি সম্পাদক শিমুল সালাহ্উদ্দিন
দেশ রূপান্তর : ঢাকা লিট ফেস্ট, এই সাহিত্য সম্মেলনের দশ বছর হচ্ছে। এবার নোবেল লরিয়েটসহ আসছেন তারকা লেখকরা, যখন শুরু করেছিলেন তখন স্বপ্নটা কি এমন ছিল?
কাজী আনিস আহমেদ : যখন শুরু করেছিলাম তখন থেকেই স্বপ্নটা এ রকম ছিল এবং এর থেকেও বড় স্বপ্ন আমাদের আছে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে। আমরা আশাবাদী যে এর পরেরবার বা তার পরেরবার এর কলেবর আয়তনে এবং মানে, বাড়বেই।
দেশ রূপান্তর : দশ বছরে গুণগত কি উত্তরণ হলো ঢাকা লিট ফেস্টের?
কাজী আনিস আহমেদ : যে ক্যালিবারের বিদেশি লেখকরা এখন বাংলাদেশে আসতে রাজি হচ্ছেন এটা কিন্তু পাঁচ বছর আগে আমাদের জন্য খুবই দুরূহ ছিল। এবারে গুরনাহর পাশাপাশি অমিতাভ ঘোষ, হানিফ কোরেশি, নুরউদ্দিন ফারাহ আসছেন এবং এ রকম প্রায় দুই ডজন লেখক কিন্তু ২০২৪ সালের জন্য বুকড হয়ে আছেন। আমরা মনে করি যে এখন থেকে প্রতিবারই আমরা একজন বা দুজন নোবেল লরিয়েট আনতে পারব। সাহিত্যের আসরের একটা জায়গা হিসেবে লিট ফেস্টের কারণে ঢাকার ওই ধরনের একটা ক্রেডিবিলিটি তৈরি হয়েছে।
দেশ রূপান্তর: বিদেশি যে লেখক-সাহিত্যিকরা আসছেন তাদের আপনারা কীসের ভিত্তিতে আমন্ত্রণ জানান?
কাজী আনিস আহমেদ : বাছাইটা আমরা অনেকগুলো ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে করি, যাদের লেখার সাহিত্যমূল্য আমাদের কাছে খুবই মর্যাদাপূর্ণ মনে হয়, যাদের লেখা আমরা মনে করি আমাদের পাঠকদের কাছে রিলেভেন্ট হবে, মনোগ্রাহী হবে, সেটার মধ্যে যেমন নোবেল লরিয়েট বা বড় আইকনিক ফিগারস আছেন তেমনি অনেক ইয়াংগার এবং এক্সপেরিমেন্টাল লেখকও আছেন। অনেকের কিন্তু এখন মনে নেই একমাত্র ঢাকা লিট ফেস্টেই আমরা দূর-দূরান্ত থেকে লেখক এনেছি, আমরা কিন্তু কিউবা থেকে সায়েন্স ফিকশন রাইটার এনেছি, মেক্সিকো থেকে পোস্ট মডার্ন রাইটার এনেছি, আমরা কিন্তু দুবার করে প্যালেস্টানিয়ান কবি এনেছি, উজবেকিস্তান থেকে, থাইল্যান্ড থেকে, ইন্দোনেশিয়া থেকে যেসব দেশ থেকে আমরা সচরাচর লেখক পাই না, তাদেরও আমরা কিন্তু এনেছি। সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক ভাবনার একটা পরিধি আছে এ রকম জায়গা থেকে আমরা লেখক বাছাই করি, আমন্ত্রণ করি, যে এ মুহূর্তে বিশ্বে কী হচ্ছে সেটা আমরা আনতে চাই।
দেশ রূপান্তর : যারা অংশ নিচ্ছেন, তাদের কি বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে কোনো ধারণা বা ব্রিফ দেন? তারা কি এই আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে সাহিত্যিক সম্পর্কে কোনো ধারণা পান?
কাজী আনিস আহমেদ : অবশ্যই। আমরা সব সময় তাদের সঙ্গে যখন কথা বলি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের যে একটা ইতিহাস আছে এবং সে কারণে ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে আমাদের যে বিশেষ একটা অনুভূতির জায়গা আছে, আমরা প্রায় সবার সঙ্গে প্রথম আলাপ এমন একটা জায়গা থেকে শুরু করি। পাশাপাশি আমাদের যে সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস আছে, এমনকি আধুনিক সাহিত্যের যে দীর্ঘ ইতিহাস তা তুলে ধরি। কনটেমপোরারি যারা গত কয়েক দশকে লিখেছেন তাদের কথা আমরা বলি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিথিদের কিন্তু আমরা শুধু ইংরেজিতে যারা লিখছেন তাদের না, বাংলায় যারা লিখছেন তাদের অনূদিত বই পর্যন্ত আমরা ধরিয়ে দিই। কখনো সৈয়দ হক, কখনো শাহীন আখতার, যার জন্য যেটা রিলেভেন্ট মনে করি আমরা কিন্তু হাতে তুলে দিয়েছি, ধরিয়ে দিয়েছি।
দেশ রূপান্তর : বাংলাদেশের যে লেখক-সাহিত্যিকদের আপনারা নির্বাচন করেন কীভাবে, যাদের আমন্ত্রণ জানান তারা কি বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেন বলে মনে করেন?
কাজী আনিস আহমেদ : প্রথমত প্রতিষ্ঠিত লেখক যারা আছেন সবার বিতর্কের ঊর্ধ্বে, যখন জীবিত ছিলেন একজন সৈয়দ হক এসেছেন, হাসান আজিজুল হক এসেছেন, নির্মলেন্দু গুণ এসেছেন, এনারা যখন এসেছেন এ নিয়ে তর্কের তো কিছু নেই, এর বাইরেও অন্য যারা আছেন, যারা প্রমিজিং, যাদের বই আলোচিত হয়েছে, সাহিত্যিক মহলে সমাদৃত হচ্ছে আমরা তাদের প্রাধান্য দিই। কিন্তু ওভার দি ইয়ারস আমরা কিন্তু এটাও চেষ্টা করেছি যে ঢাকার বাইরের যারা লেখক তারা এখানে আসতে পারছেন কি না! এবং নারী লেখক যারা আছেন তারা যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন কি না!
দেশ রূপান্তর : লিট ফেস্টের কারণে বাংলাদেশের সাহিত্যের কী কী উপকার হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
কাজী আনিস আহমেদ : লিট ফেস্টের কারণে পশ্চিমে যাদের এক কথায় গেটকিপার বলা যায়, যেমন এডিটর পাবলিশার এজেন্ট, তাদের মধ্যে কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। দশ বছর আগে যেখানে ছিল জিরো এখন মাইনরিটি পার্সেন্টেজের মধ্যে হলেও সেটা কিন্তু হয়েছে, তার মধ্যে অনেকেই কিন্তু খুবই ইম্পর্ট্যান্ট, এবার যেমন ব্লুমসবেরির আলেক্সান্ডা প্রিঙ্গল আসছেন, আমেরিকায় অনূদিত সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পাবলিশার, নিউ ডিরেকশন্সের প্রধান বারবারা অ্যাপ্লার, তিনি আসছেন। ওদের মার্কেটে ম্যাস লেভেলে যেতে আরেকটু সময় লাগবে।
দেশ রূপান্তর : লিট ফেস্টের প্রথমবার থেকে গত আয়োজন পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন ছিল, এবার দেখা যাচ্ছে টিকিট কেটে আয়োজনে দর্শক হতে হবে! তাহলে কি এই উৎসব শুধু গুলশান বনানীর লেখক আর বড়লোক পাঠকদের জন্য? শাহবাগের কবিরা বা দরিয়ানগর থেকে আসা কবিরা কি ১০,০০০ টাকা টিকিট কেটে অংশ নিতে পারবে? আপনাদের উৎসব কি লেখকদের কয়েকটা শ্রেণিভাগে ভাগ করে দিচ্ছে না?
কাজী আনিস আহমেদ : এই প্রসঙ্গে আমি প্রথমত যেটা বলব যে, আমরা দেখেছি অনেকে এই টিকেটিংয়ের ব্যাপারটা নেতিবাচকভাবে নিচ্ছেন। আমরা মনে করি এটা খুব ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত, যারা সমালোচনা করছেন তারাই কিন্তু অতীতে বলেছেন এখানে করপোরেট স্পন্সরশিপ কেন, এখানে গভর্নমেন্ট সাপোর্ট কেন? আমি যদি করপোরেট বা গভর্নমেন্ট সাপোর্ট কমাই তাহলে টিকেটিং না থাকলে এটা চলবে কী করে? খরচটা তো কোথাও থেকে আসতে হবে! আমরা মনে করি দর্শক-শ্রোতাকে এই টিকেটিংয়ের মাধ্যমে আমরা আরও সদর্থে এই আয়োজনে শরিক করে নিচ্ছি এবং তারা শরিক হলে এই ফেস্টিভ্যাল আরও টেকসই হবে। সেখানে স্টুডেন্টদের জন্য আমরা দিনপ্রতি মাত্র দুইশ টাকা রেখেছি বা চার দিনের জন্য মাত্র ৫০০ টাকা রেখেছি। যে বক্তারা আসছেন তাদের যে কারও একক অনুষ্ঠান লন্ডনে ন্যূনতম ৫০ পাউন্ড ফি হবে, আপনি হে ফেস্টিভ্যালে গিয়ে এদের যে কজনকে দেখতে পাবেন, দেখতে গেলে ওখানে প্রতিটি সেশনের জন্য আলাদা টিকিট কিনতে হয়, মানে আপনার ৩০০ থেকে ৭০০ পাউন্ড খরচ হবে।
দেশ রূপান্তর : আনিস ভাই, আমাদের দেশে এমনিতেই শ্রেণিবৈষম্য প্রকট, লেখকরা সব সময় শ্রেণিবৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলেন, বৈষম্যহীন সমাজের পক্ষে থাকেন। সেখানে আপনাদের এই আয়োজন কি শ্রেণিবৈষম্যের চর্চাকেই উৎসাহ দিচ্ছে না?
কাজী আনিস আহমেদ : এখানে আমি কোনো বৈষম্য দেখি না। প্রথমত সবার জন্য কিন্তু টিকিট প্রাইজ একই। শিক্ষার্থীদের জন্য কম। আর দশ হাজার যেটার মূল্য সেটা তো আসলে টিকিট না, আ ফর্ম অব স্পন্সরশিপ।
দেশ রূপান্তর : আমি যদি দশ হাজার টাকার টিকিট না কাটি আমি কি সব আয়োজনই উপভোগ করতে পারব? কোনো আসন-বৈষম্য থাকবে না?
কাজী আনিস আহমেদ : হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ভিআইপি, যারা ১০ হাজার টাকায় টিকিট কিনছেন হলে ঢুকে সেশন দেখার সময় তিনি কিন্তু কোনো প্রিভিলেজ সিট পাচ্ছেন না। ওখানে লাইন দিয়ে ঢুকে যে আগে ঢুকবে সে ভালো সিট পাবে। ফলে এখানে শ্রেণিবৈষম্যের চর্চাকে উৎসাহিত করার কিছু তো নেই।
দেশ রূপান্তর : ফান্ডামেন্টালি সাহিত্যের যে স্পিরিট বা বোধ, গণমানুষের হওয়া, সর্বজনের অধিকারের কথা বলা, তার সঙ্গে ঢাকা লিট ফেস্টের যে মৌলচিন্তা তা সাংঘর্ষিক বলে অনেকেই মনে করছেন। আপনি কী বলবেন!
কাজী আনিস আহমেদ : এ রকম কারও ধারণা থাকতে পারে। আমরা যখন প্রথম লিট ফেস্ট শুরু করেছি, তখন অনেকে বলেছে বাংলা একাডেমিতে ইংরেজিতে আলোচনা হবে কেন? আন্তর্জাতিক লেখকরা কি এখানে এসে বাংলায় কথা বলবেন? দ্যাট ওয়াজ সিরিয়াসলি ডিসকাসড! সেটা নিয়ে তখন বাংলা একাডেমির সামনে লোকে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সো মানুষ কিন্তু এই লিট ফেস্ট নিয়ে গোড়ার থেকেই ভুল তথ্য বা ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে অনেক সমালোচনা করেছে, সেগুলো পার করে আমরা একটা জায়গায় এসেছি এবং আমার মনে হয় যে আমরা টিকেটিং চালু করে সাহিত্যের মূল্যায়ন কীভাবে হয় বা হবে তার আলোচনার যে একটা সূত্রপাত করেছি।
দেশ রূপান্তর : শিল্প-সাহিত্য তো মুফতে পেয়ে আমরা অভ্যস্ত।
কাজী আনিস আহমেদ : এক্সাক্টলি! এ রকম একটা ধারণা আমাদের সংস্কৃতিতে আছে। এই শিক্ষার্থীদেরই কিন্তু ১০০০,২০০০ টাকা দিয়ে কনসার্ট দেখতে যেতে বিন্দুমাত্র আপত্তি আপনি দেখবেন না, শুধু সাহিত্যের বেলাতেই কেন এত অসুবিধা? নোরা ফাতেহীকে তো লোকে ১৫০০০ টাকার টিকিট কেটেও দেখতে গেছে। তো একজন নোবেল লরিয়েটকে দেখতে গিয়ে দিনে দুইশো টাকা বেশি হয়ে যাচ্ছে?
দেশ রূপান্তর : কিন্তু আয়োজনটা হচ্ছে বাংলা একাডেমিতে, বাংলা একাডেমি জাতির মননের প্রতীক।
কাজী আনিস আহমেদ : বাংলা একাডেমি কি জায়গাটা আমাদের ফ্রি দিচ্ছে? বাংলা একাডেমিকে চার দিনের জন্য আমাদের একুশ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে। বাংলা একাডেমি অতীতে কিন্তু আমাদের কয়েকবার ফ্রিতে দিয়েছে, তখন তারা ভেন্যু পার্টনার ছিল এবং আয়রনি হচ্ছে আমরা যখন হে ফেস্টিভ্যাল ছিলাম তখনো আমরা ফ্রিতে পেয়েছি বা নামমাত্র মূল্যে পেয়েছি। ঢাকা লিট ফেস্ট হয়েও আমরা নামমাত্র মূল্যে ভেন্যু পেয়েছি, কিন্তু এবারই প্রথম আমাদের এত চড়া মূল্যে ভেন্যু নিতে হলো। একুশ লাখ টাকা চেয়েছে, দশ লাখ টাকা আগাম আমরা এরই মধ্যে দিয়েছি।
দেশ রূপান্তর : এটার কারণ কী আসলে? নিয়ম তো বদলায় নাই।
কাজী আনিস আহমেদ : এটার কারণ আসলে বাংলা একাডেমিকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বাংলা একাডেমি এখানে টাকা পাচ্ছে, দেশের প্রত্যেক লেখক পাচ্ছেন, বিদেশিরা কিন্তু অধিকাংশই পারিশ্রমিক ছাড়া যাতায়াত ও আপ্যায়ন খরচটুকু নিয়েই আসছেন। যাতায়াতটা তো খুবই ব্যয়বহুল। এটা একটা কয়েক কোটি টাকার আয়োজন এবং এখনো পর্যন্ত আমরা করপোরেট স্পন্সরদের ওপরই মূলত নির্ভরশীল। যত বেশি পাঠক-শ্রোতারা শরিক হিসেবে শামিল হবেন তত কিন্তু আমাদের করপোরেট ডিপেনডেন্সি কমবে। আমাদের ইভেন গভর্নমেন্ট ডিপেনডেন্সি থাকবে না। তখনি এটা গণমানুষের হবে, কোনো কিছু এমনি এমনি হয় না। ফ্রিতে হয় না, বিশেষ করে যে জিনিসটা আসলেই ফ্রি না।
দেশ রূপান্তর : সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, মানে এখানে আছে এ দেশের জনগণের টাকা।
কাজী আনিস আহমেদ : না নেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবার আমাদের এক টাকাও অনুদান দেয়নি।
দেশ রূপান্তর : আপনারা তাহলে লোগো ব্যবহার করছেন কেন? ওয়েবসাইটে তো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের লোগো আছে!
কাজী আনিস আহমেদ : তারা আমাদের অনুদান দেন। অতীতেও দিয়েছেন, সরকার এ মুহূর্তে একটা অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রতার পথে আছে, সে কারণে এবার এখন পর্যন্ত কোনো অনুদান আমাদের দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, মন্ত্রী চেষ্টা করছেন এবং ফিন্যান্স মিনিস্ট্রিতে একটা আবেদন পাঠিয়েছেন, তাদের এত দিনের সহযোগিতাকে মনে রেখে, সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে এখনো তারা পারেননি, তবে বিবেচনায় রেখেছেন। অব্যাহত চেষ্টার প্রতি সম্মান রেখে আমরা এবারও তাদের লোগো রেখেছি, প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রেখেছি।
দেশ রূপান্তর : আপনাদের উৎসবে কিছু সেশন ও অতিথিদের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক মান নিয়ে সমালোচনা আছে, এসব প্রবণতাকে আপনি কী হিসেবে দেখেন?
কাজী আনিস আহমেদ : দেখেন যারা ভাবেন পপুলার সবকিছু অচ্ছুত সেটাও কি এক ধরনের এলিটিজম নয়? যদি আমি পপুলিস্ট লিটারেচারকে ইগনোর করি তাহলে একটা গোষ্ঠী আছে যারা আমাদের বলবে এলিটিস্ট, আর আমি যদি উচ্চমার্গীয় সাহিত্য নিয়ে চর্চা করি তাহলে বলবে যে আমি সাধারণ পাঠককে কোনো পাত্তা দিচ্ছি না, আমি হুমায়ূন আহমেদের মূল্য বা মর্যাদা বুঝি না, এসব জায়গায় আমরা যথেষ্ট এগনোস্টিক, উই ট্রাই টু বি ভেরি ইউনিভার্সাল, আমরা চিন্তার জগতে, ভাবনার জগতে এবং ভাবের জগতে, যত ধরনের অভিব্যক্তি আছে, যা কি না মানুষকে এবং নানা গোষ্ঠীর মানুষকে নানাভাবে আলোড়িত করছে, নাড়া দিচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিরক্ত করছে, সব কটাকেই আমরা এখানে আনার চেষ্টা করি, কারণ কোনো কিছুই আলোচনার ঊর্ধ্বে নয়, সবকিছুই আলোচনার জন্য ভ্যালিড।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আনিস ভাই।
কাজী আনিস আহমেদ : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
আন্তর্জাতিক লেখক দিবসের প্রবক্তা কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। বাংলা ভাষার অগ্রগণ্য কবিদের একজন এই কবি লিখেছেন বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক জয়ী এ কবি বাংলা একাডেমিতে হে ফেস্টিভাল আয়োজনের বিরোধীদের অন্যতম ছিলেন। যা পরে ঢাকা লিট ফেস্ট নামে আয়োজিত হচ্ছে। লিট ফেস্ট সামনে রেখে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন ধ্রুপদি সম্পাদক শিমুল সালাহ্উদ্দিন
দেশ রূপান্তর : হুদা ভাই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লিট ফেস্ট শুরু হচ্ছে, আপনি একাডেমির মহাপরিচালক। গণমাধ্যমে দেওয়া লিট ফেস্ট উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে আমরা জেনেছি বাংলা একাডেমি এবার ভেন্যুর জন্য ২১ লাখ টাকা নিয়েছে। তদুপরি অসহযোগিতার অভিযোগও আছে। আপনি একাডেমির মহাপরিচালক, আমাদের প্রশ্ন কোন বিবেচনায় আসলে আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার এত বেশি টাকা দাবি করা হয়েছে? ভেন্যু পার্টনার হিসেবে আগের বছরগুলোতে ছিল বাংলা একাডেমিও। তারা আগে ফ্রি পেয়েছে এমন আলাপও শোনা যাচ্ছে।
মুহম্মদ নূরুল হুদা : প্রথম কথা হচ্ছে লিট ফেস্টের জন্য কখনোই বাংলা একাডেমি ফ্রি তারা পায়নি। সবসময়েই নিয়মানুযায়ী ভাড়া দিয়েই বাংলা একাডেমি ব্যবহার করেছে। বর্তমানে বাংলা একাডেমির সব মিলনায়তন, অডিটোরিয়াম সংস্কার করা হয়েছে, সাউন্ড ও লাইট নতুন করে বসানো হয়েছে, ফলে সবগুলো মিলনায়তন এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সেমিনার কক্ষ, এটা গত বিশ বছর যাবৎ বন্ধ ছিল, এবার সেটা চালু হয়েছে, তারাও ওটা ব্যবহার করবে, একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন, কবি শামসুর রাহমান হল এবং পাশের একটা মুক্তমঞ্চও ওরা ব্যবহার করবে, পুরো মাঠ ব্যবহার করবে, নজরুল মঞ্চ পুনঃসংস্কার করেছি, সেটা ব্যবহার করবে। সব মিলনায়তনের নতুন ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে, এবং তবুও বলব ওদের কাছে ভাড়া বেশি চাওয়া হয়নি, পুরো এলাকাটা ওরা ব্যবহার করবে, তার জন্যও একটা ভাড়া আছে, এর আগে একদিনের জন্য প্রথম আলো যে ভাড়া দিয়েছে, আমরা যদি সেই রেট ধরতাম এটা অনেকগুণ হয়ে যাবে।
দেশ রূপান্তর : প্রথম আলোর চেয়ে কম ভাড়ায় আপনারা এটা দিয়েছেন আসলে?
মুহম্মদ নূরুল হুদা : অবশ্যই। অনেক কম ভাড়ায়। যেহেতু আন্তর্জাতিক বড় লেখকরা আসবেন সেটা বিবেচনায় তাদের কম ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে। তারা যদি বলে থাকে বাংলা একাডেমিতে তারা ফ্রি অনুষ্ঠান করেছে, এটা একেবারেই সত্য না, গতবার তো আমি দেখেছি, দু-বছর আগে কী হয়েছে তা আমার জানার কথা নয়। আর তাদের সঙ্গে আমাদের যে আলাপ হয়েছে, তখন পর্যন্ত আমাদের কাউন্সিল (বাংলা একাডেমি পরিচালনা পর্ষদ) সম্পূর্ণ তাদের বিপক্ষে ছিল, এবং কাউন্সিল এখন পর্যন্ত পুরো তাদের দেওয়ার জন্য আমাদের কিন্তু সিদ্ধান্ত দেয়নি, মন্ত্রণালয়কে তারা চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি, মন্ত্রণালয় আমাদের বলেছে, বাংলা একাডেমির যা পাওনা ওদের কাছে আগে সেটা নাও তারপর সিদ্ধান্ত। আগের বাকি টাকা ওরা দেওয়ার পরই নেগোসিয়েশন শুরু হয়েছে। তারপর তারা আমাদের মিলনায়তনগুলোর ভাড়া কত জানতে চেয়েছে, আমরা তাদের জানিয়েছি চিঠি দিয়ে। তারা এই ভাড়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। প্রশ্ন না তুলে তারা বলেছে যে, আমরা ভাড়াটা পরে দেব, আপনারা আমাদের মাঠ ব্যবহারের বরাদ্দপত্র দেন, বাংলা একাডেমি বলেছে সেটা সম্ভব না, কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব না, আপনারা আগেও সেটা পাননি, এরপর তারা ৫০% অ্যাডভান্স দেওয়ার পর উৎসব করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। উনারা নিয়ম না মেনে যে অভিযোগ করছেন, এটা পুরোপুরি অমূলক। যে রেন্ট বর্তমানে আসে তারপরও কিন্তু সাহিত্য উৎসব বলে আমার পক্ষ থেকে যে বিবেচনা করা সম্ভব সেটা করে আমি কমিয়ে দিয়েছি।
দেশ রূপান্তর : আপনি কমিয়ে দিয়েছেন?
মুহম্মদ নূরুল হুদা : আমি একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে কমিয়ে দিয়েছি।
দেশ রূপান্তর : তার মানে তো আপনি সহযোগিতা করেছেন, আয়োজকরা কিন্তু অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন। আগে পরে অনেক কম সময় তাদের কাজের সুযোগ দিচ্ছে বাংলা একাডেমি, এমন জানতে পেরেছি আমরা।
মুহম্মদ নূরুল হুদা : বাংলা একাডেমি কোনো অসহযোগিতা করেনি, বাংলা একাডেমি যদি কোনো অসহযোগিতা করত, তাহলে উৎসব হতেই পারত না। এই মুহূর্তে, আজ জানুয়ারির ৩, ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে বইমেলা শুরু, সামনে মেলা ফলে বাংলা অ্যাকাডেমি জানুয়ারিতে কাউকেই অ্যাকাডেমি ব্যবহার করতে দেয় না, ১ তারিখ থেকেই আমাদের মাঠে কাজ করার কথা, আমরা লিট ফেস্টের জন্য ১০ তারিখের আগে কাজই শুরু করতে পারব না, তো আমরা কতখানি পিছিয়ে গেলাম! আর বইমেলার আগে জানুয়ারিতে এটা কখনো হয়নি, এটা নভেম্বরে হলে কোনো অসুবিধা ছিল না, সেপ্টেম্বরে হলেও না, জাস্ট বইমেলার আগে এভাবে একাডেমি প্রিমাইজ দেওয়া খুবই অসুবিধার। আমি বারবার তাদের বলেছি নভেম্বরে করতে, তারা অন্য কারণ দেখিয়েছে, সেই কারণ তো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও বিভিন্ন কর্নারের
মুহম্মদ নূরুল হুদা : চাপে বলব না, অনেকে অনুরোধ করেছে, আমরা মান্য করার চেষ্টা করেছি, আমাদের শত অসুবিধার মধ্যেও আমরা চেয়েছি উৎসবটা হোক।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু আপনি তো এই লিট ফেস্টের যে আগের ভার্সন হে ফেস্টিভাল এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, আপনি প্রতিবাদও করেছেন, অনেকে আপনার ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছে!
মুহম্মদ নূরুল হুদা : শতভাগ আমি সেই প্রতিবাদ করেছি। আমি এখনো সেই অবস্থানে অনড়। আমি বলেছিলাম হে ফেস্টিভাল বাংলা একাডেমিতে হবে না, হতে পারে ব্রিটিশ কাউন্সিলে, হতে পারে ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে, আমার ডিপার্টমেন্টেও হতে পারে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াই, কারণ হে এর সঙ্গে শিক্ষায়তনের ঐতিহ্য জড়িত, বাংলা একাডেমি জাতির মননের প্রতীক, সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না। আমাদের প্রতিবাদটাও কিন্তু একটা কারণ এটার নাম বদলানোর, ঢাকা লিট ফেস্ট করতে বলেছে অনেকেই যারা বাইরে থেকে এসেছে। আমাদের সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তিনি তো ওদের প্যাট্রন ছিলেন, তিনি বলেছেন ইট শুড বি ঢাকা লিট ফেস্ট। তখন আমাকে যখন বলেছে আমি অংশ নিয়েছি।
দেশ রূপান্তর : এবারও আপনি অংশ নিচ্ছেন
মুহম্মদ নূরুল হুদা : অবশ্যই, আমাকে আমন্ত্রণ করেছে, আমি পারটিসিপেট করব, বাংলা একাডেমিতে হচ্ছে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ থাকলে তো আমি পারটিসিপেট করব না। যখন সাদাফ আমার কাছে প্রথম আসে তখনই আমি বলেছি অবশ্যই করতে পারবে, তবে তুমি যে সময়টা বলছ আমাদের জন্য খুবই অসুবিধা হবে। বাংলা একাডেমির ঘাসও তো রেস্ট চায়, কতবার মাড়াবে মানুষ এই ঘাস! তারপরও অসুবিধা স্বীকার করে আমরা দিয়েছি, অর্থের ছাড় আমরা দিতে পারিনি কারণ ওদের আগের উৎসবের টাকা বাকি ছিল এবং সেটা অডিট অবজেকশন হয়ে আছে। এত কথা সত্ত্বেও আমরা ওদের কাছে ফিফটি পার্সেন্ট টাকা নিয়েছি মাত্র। আমার মনে হচ্ছে ঐ ফিফটি পার্সেন্ট টাকা না দেওয়ার জন্য তারা গণমাধ্যমে অসহযোগিতার কথা বলছে, এ-সমস্ত কাজ করছে। আমি শুধু এটুকু বলব, আমি না থাকলে এই ফেস্টিভাল ওরা করতেই পারত না, এখনো তারা দেখতে পারে আমি কাউন্সিল থেকে ক্লিয়ারেন্স পাইনি। কিন্তু তাদের প্রাথমিক অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত কোনো ছাড় আমি এখনো পাইনি। তবুও শুধু নিজের রিস্ক নিয়ে মুখের কথায় আমি এটা করে দিয়েছি যে এত বড় বড় লেখক আসবেন তারা যেন বিড়ম্বনায় না পড়েন। তারা অসহযোগিতার অভিযোগ আমাকে করবে এ কারণেই করে দিয়েছি। এখানে আমার নিজস্ব কোনো গেইন বা সুবিধার কিছু নেই। সাহিত্য অনুরাগী মানুষের সুবিধার কথাই আমি ভেবেছি।
দেশ রূপান্তর : শত অসুবিধা স্বীকার করার কথা বলছেন, বাংলা একাডেমির ক্ষতিটা কী?
মুহম্মদ নূরুল হুদা : আমাদের কষ্ট হবে, ১৫ জানুয়ারির আগে মেলার কোনো কাজ প্রায় করাই যাবে না। প্রধানমন্ত্রী এই মেলায় আসেন প্রথম দিন, জানেন সবাই, আমাদের প্রস্তুতিটাও সেই পর্যায়ের হওয়া উচিত, সেই ক্ষতিটা হবে, বাংলা একাডেমির অসুবিধা হবে।
দেশ রূপান্তর : হুদা ভাই, লিট ফেস্ট আমাদের সাহিত্যের কোনো উপকারে লাগছে বলে আপনি মনে করেন?
মুহম্মদ নূরুল হুদা : আমি বলব, যে যেকোনো রকমের সাহিত্যিক ইন্টার্যাকশন সাহিত্যের জন্য উপকারী। তারা এক ধরনের সাহিত্য লেখে, আন্তর্জাতিক পলিশড লিটারেচারের সঙ্গে তারা যুক্ত, তারা আসছেন, আলাপ হবে, এর ফলে বাংলাদেশের তো একটা উন্নতি হবেই। তবে বাংলা সাহিত্য এতদূর যে এগিয়ে গেছে তার কারণ অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাইকেল মধুসূদন দত্তর মতো ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ নজরুল লিখেছেন। অনুবাদ হয়ে পৃথিবীতে সাহিত্য ছড়িয়ে যাওয়া আমি অস্বীকার করছি না, আমি নিজেও ইংরেজি সাহিত্য পড়া লোক, বাংলা একাডেমিতে অনুবাদ বিভাগ প্রথম থেকেই চালু আছে, এই উৎসব অবশ্যই আমাদের উপকারে আসবে, কিন্তু অনুষ্ঠানটা অসময়ে করা যাবে না, বিশেষ করে বইমেলার আগে, নভেম্বরের পরে করলে বাংলা একাডেমির জন্য সবসময় অসুবিধা হয়ে যাবে। বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা যারা আছেন তাদের জন্যও কিন্তু এই সময়ে চারদিন স্পেয়ার করা খুবই কষ্টকর। লিট ফেস্টিভাল বা হে ফেস্টিভাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে হয়েছে, ভারতেও হয়, মূলত করপোরেট আনুকূল্যে হয়, সেসব দেশে ফেস্টিভালের কারণে সাহিত্য কতটুকু উন্নত হয়েছে আমার কিন্তু জানা নেই, এমন কোনো জরিপও হয়তো নেই। আর আমার মনে হয় মাতৃভাষায় না লিখলে কেউ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য লিখতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। আমি উদাহরণ দিচ্ছি, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মাতৃভাষায় লিখিত রচনার অনুবাদের জন্যই পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজে মাতৃভাষায় লেখা রচনার অনুবাদ হতে পারে, মৌলিক সাহিত্যসৃজন কঠিন। ফলে উৎসভাষা বা সোর্স ল্যাংগুয়েজ মাতৃভাষা হওয়া জরুরি।
দেশ রূপান্তর : তার মানে বাংলা একাডেমি নিয়ম মেনে ভাড়া দিয়েছে?
মুহম্মদ নূরুল হুদা : অবশ্যই। তাদের মুখ থেকে তারা অর্ধেক ভাড়া দেবে বলার পর আমি বিভিন্ন জায়গায় কন্টাক্ট করেছি।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু লিট ফেস্ট কর্র্তৃপক্ষ তো এবার টিকিট চালু করেছে প্রথমবারের মতো! চারদিন বাংলা একাডেমিতে একটা উৎসব হচ্ছে, চারদিন বাংলা একাডেমিতে কেউ টিকিট ছাড়া ঢুকতে পারবে না এ ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মুহম্মদ নূরুল হুদা : টিকিট করার ব্যাপারে তো আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। আমার সঙ্গে টিকিট বিষয়ক কোনো আলোচনাই হয়নি। এটা আমি অন্য সোর্স থেকে শুনেছি। এখন আমরা বাংলা একাডেমি থেকে বরাদ্দপত্র দিয়েছি, বাংলা একাডেমি বইমেলাতেও আমরা টিকিট রাখি না জনগণের কথা চিন্তা করে, সেখানেও আমাদের সরকারের পারমিশন লাগবে। টিকিট বিষয়ে আমাদের কনসার্ন ওরা নেয়নি, নিশ্চয়ই তাহলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো এপ্রোপ্রিয়েট বডি থেকে তারা পারমিশন নিয়েছে। নইলে কীভাবে টিকিট চালু করল? এক্ষেত্রেও তারা (আয়োজকরা) কিন্তু নিয়মের বাইরে চলে গেছে।
দেশ রূপান্তর : তার মানে আপনি টিকিট কাটেননি! বাংলা একাডেমিতে কীভাবে ঢুকবেন চারদিন!
মুহম্মদ নূরুল হুদা : আমি তো পারটিসিপেন্টও, আমি হয়তো কার্ড নিয়ে ঢুকব বা আমাকে চেনে, কিন্তু আমার কর্মীরা কী করবে ভাবছি। শোনেন, আমার মন্ত্রী আমার সচিব যখন আমাকে টেলিফোন করেছেন আমি বলেছি পারমিশন আপনারা কি দিয়েছেন, না দিলে আমি কীভাবে দেব! আমি তো ভাড়া দিয়েছি!
দেশ রূপান্তর : কিন্তু হুদা ভাই বাংলা একাডেমি তো একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম না, বাংলা একাডেমি তো এভাবে ভাড়া দিতে পারে না। তাই না? বাংলা একাডেমির তো সাহিত্যের প্রতি সাহিত্যিকের প্রতি দায়িত্ব আছে।
মুহম্মদ নূরুল হুদা : অবশ্যই দায়িত্ব আছে বলেই বাংলা একাডেমি লিট ফেস্ট করতে দিচ্ছে, কিন্তু আয়োজকরা টিকিট বিক্রি করবেন এমন কথা কোথাও আমাদের আবেদনপত্র বা কিছুতেই উল্লেখ করেনি।
দেশ রূপান্তর : তার মানে হুদা ভাই এই উৎসব ঠিক আছে, শুধুমাত্র আয়োজকরা নিয়ম মেনে করলেই ঠিক আছে? খালি টিকিটের ব্যাপারটা আপনি জানতেন না?
মুহম্মদ নূরুল হুদা : উৎসব ঠিক আছে, সাহিত্য শিল্প নিয়ে যে কোনো উৎসবই আমরা স্বাগত জানাই, আমিও জানাই। কিন্তু টিকিটের ব্যাপারটা ওরা আমাকে এখনো বলেইনি। অথচ টিকিট বিক্রি হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হলো, বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢোকার সময়ও কি টিকিট লাগবে? যদি লাগে, আমি বলব নো, আমি অফিস বন্ধ করে এই উৎসব তো করতে দিতে পারব না মেলার আগে!
দেশ রূপান্তর : বাংলা ভাষার কবিদের তরুণদের টিকিট কেটে লিট ফেস্টে আসতে হবে, এমন লিট ফেস্ট হচ্ছে হুদা ভাই!
মুহম্মদ নূরুল হুদা : আমার তো টিকিট কাটতে হয়নি আগে কখনো! পারটিসিপেন্ট ওরা আমাকে রেখেছে, আমাকে যথেষ্ট সম্মান ওরা করেছে, কিন্তু আমাকেও তো বাংলা একাডেমির ভূমিকা ভুললে হবে না। আমাকে আমার মতো চলতে হবে। সাদাফ প্রথমদিকে এসেছিল আর আসেনি, আমার মনে হয় তারা যেভাবে করতে চেয়েছে সেভাবে করার অনুমতি তারা পায়নি। আমার দিকে ওরা আঙুল তুলছে কারণ প্রথমবার হে ফেস্টিভালের বিরোধিতা করেছি আমি, হে তো আর এখন নেই, নিয়ম মেনে তারা উৎসব করলে আমার কোনো আপত্তিও নেই।
দেশ রূপান্তর: ধন্যবাদ হুদা ভাই আমাকে সময় দেওয়ার জন্য।
মুহম্মদ নূরুল হুদা : তোমাকেও ধন্যবাদ। দুঃখিত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
চাকরি
রাজার দপ্তরে হলো খুব ইঁদুরের উৎপাত। রাজা ইঁদুর নিধন কমিটি গঠন করলেন। কমিটি ইঁদুর কীভাবে নিধন করা যায় এজন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট দল পাঠালেন ইউরোপে। তারা সেখানে সতেরো দিন থাকলেন। হ্যামিলন সম্পর্কে জানলেন এবং ফিরে এসে বললেন, ইঁদুর ধরার জন্য বিড়ালকে নিয়োগ দিতে হবে।
বিড়ালের চাকরি হলো।
বিড়াল ধূর্ত। খপাখপ ইঁদুর ধরে ফেলল। রাজা খুশি। নিধন কমিটি খুশি। বিড়ালও কম খুশি না।
কিছুদিনের মধ্যেই ইঁদুর কমে এলো। বিড়ালের প্রশংসাও গেল কমে। বিড়াল বুঝল তার চাকরি নট হতে চলেছে সামনেই।
বিড়াল এখন বাইরে থেকে ইঁদুর ধরে আনে। এনে দপ্তরে ছাড়ে। সেই ইঁদুরই আবার দপ্তর থেকে ধরে রাজার সামনে রাখে। রাজা খুশি। নিধন কমিটি খুশি। বিড়ালও কম খুশি না।
বিড়াল বুঝেছে যতক্ষণ ইঁদুর, ততক্ষণই চাকরি!
থু
থু করে থুতু ফেলতেই ঝন্ করে আওয়াজ হলো। আশপাশে তাকালাম,
কোথাও কিছু নেই। তবে পা বাড়াতে গিয়েই দেখলাম একটা কয়েন। ঝলমলে স্বর্ণমুদ্রা। দ্রুত পকেটে ঢোকালাম সেটা। কেউ দেখলেই কেড়ে নেবে!
সন্দেহটা তখনই হয়েছিল। একটা গলিতে ঢুকেই আবার থু করে থুতু ফেললাম। আবার ঝন! আবার বেরিয়ে এলো একটা স্বর্ণমুদ্রা। এরপর প্রতিটি থুতুতে একটা করে রোদ ঝলমলে আশ্চর্য কয়েন।
খবর চাউর হতে সময় লাগল না।
প্রথমে এলো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, দূরাত্মীয়, শিক্ষক, ডাক্তার, পথপ্রদর্শক সবাই। সবাই চায় স্বর্ণমুদ্রা...
একে একে এলো সমাজের মণিমাণিক্য; রাষ্ট্রের নখ লুকানো বিড়াল। সবাইকে দিতে হবে ঝনঝনিয়ে।
যত্রতত্র থুতু ফেলতে নেই; তাই, স্বর্ণপ্রার্থীদের মুখটাই আমি বেছে নিলাম।
ওরা বলল, হাআআআআ...
আমি বললাম, থু!
ঘের
তেমন কোনো কারণ ছিল না, কিন্তু ডাইনোসরটা বলে বসল... ওই তিনটা পাহাড় আমার!
খরগোশের একটু মন খারাপ হলোআহারে! তিনটা না হোক, অন্তত একটা পাহাড়ও যদি তার থাকত!
এরপর ডাইনোসরটা প্রতিদিন সেই তিনটা পাহাড়ে ঘোরে। গাছ খায়, পিঠ চুলকায় লেজ দিয়ে, রোদের ওম নেয়...
ওদিকে খরগোশ এ বন ও বন যায়। এ পাহাড় ও পাহাড় ঘোরে। এক দিন ঝরনায় গোসল করে এক দিন নদীতে...
এর মধ্যেই ডাইনোসরের খোঁজ নিতে খরগোশটা ঢুকে পড়ল ওই তিনটা পাহাড়ে। খুব চটল ডাইনোসরজানো না তুমি, এই তিনটা আমার পাহাড়? যাও এখান থেকে।
খরগোশ বেরিয়ে গেলে ডাইনোসর বেশ কসরত করে বেড়া দেওয়া শুরু করল পাহাড় তিনটার সীমান্তে। কাজটা করতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগল তার। কিন্তু ষষ্ঠ দিন শেষে যখন সে চারিদিকে তাকাল, বুকটা ভরে এলো। আহা, তার পাহাড় তিনটায় এবার আর কেউ ঢুকতে পারবে না!
সপ্তম দিনটা ডাইনোসর কাটল বিশ্রামে। তারপর আবার সে প্রতিদিন সেই তিনটা পাহাড়ে ঘোরে। গাছ খায়, পিঠ চুলকায় লেজ দিয়ে, রোদের ওম নেই...
ওদিকে খরগোশ এ বন ও বন যায়। এ পাহাড় ও পাহাড় ঘোরে। এক দিন ঝরনায় গোসল করে এক দিন নদীতে...
অনেক দূর থেকে দেখে মনে হলো খরগোশটার জন্য আছে সারা পৃথিবী; কিন্তু ডাইনোসরটা তিনটা পাহাড়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত বেড়ায় আটকা পড়ে গেছে। কেউ তাকে উদ্ধার করছে না; এমনকি ডাইনোসরটা জানতেও পারছে না তার প্রয়োজন উদ্ধারের!
কালো হীরার দ্যুতি
জমকালো এক শিকড়
মাটির প্রধান শিরা
খরপারদস্রোতা
হৃৎপিণ্ডের তালাশ
হৃৎপিণ্ডের তালাশ
কোনাতে কাঞ্চিতে
কোনার্কে কাঁচিতে
কোথায়, কোথায় পালাস
কিশোরী ধড়্কন?
একটা অন্য-পাথর
শিকড়টা থমকাল
ঢুকবে, না প্যাঁচাবে?
দুটোই করতে নিল
পাথরভর্তি পারদ
শিকড়টা পাথর
আয়না, মুখোমুখি
হীরার দ্যুতি, কালো
আন্ধারে থমকাল।
ঝালিয়া
তিন-কুড়ি বছরের একটা অজীবন
বাঁচলাম তোমাকে-ছাড়া। এক
ঠাণ্ডা আর অন্ধকার, পাতাল-প্ল্যাটফর্ম, খালি মাঝরাতের হাওয়ার ঝাপট,
খালি একটা খালি-আমি,
নাকোনোই গাড়ি,
কিংবা শবযান,
না ভয়, না আশা।
কত বড় হয়েছ এখন তুমি, ম?
চারপাশের সরগরম দুনিয়াটা
তৃপ্তিহীন তৃষ্ণা যেন, এরমধ্যে তোমার
কখনও সময়-কি হয় পিছে তাকাবার?
ভালো-কোনো অছিলা-কি পাও
পশ্চিম আকাশ-জুড়ে দাঁতকেলিয়ে-থাকা
সবুজ বিড়ালটাকে এড়িয়ে যাওয়ার?
একটা-কোনো পেকে আসা প্ল্যান,
মেয়ের মেয়েলি ভবিষ্যৎ?
দু’দুটো অনন্ত, মধ্যিখানে
এক-শূন্য ফারাক,
কয়েকটা ধূসর গোছা ঊষর চুলের
একটা শীত
সূর্যের পাঁজর থেকে নির্গলিত, যেন,
শান্ত ফোঁটাগুলো
নিবে-আসা নাড়ি,
প্রিয়তমা, মনে পড়ে?
রোববারের সন্ধ্যারাত,
একটা রিকশা, চণ্ডবৃষ্টি-ডোবা—
‘সে-কি আমি?’
‘সে-কি আমি?’
‘সে-কি আমি?’
—‘হ্যাঁ।’
শঙ্খচূড়
সুরেলা গোধূলি যৌন আতর ছড়ায়
বহুকোণ ভাইরাসের মতো,
গোপন বাগানে হাল্কা নৃমুণ্ড গড়ায়
অগ্নি থেকে বায়ু, ইতস্তত—
শঙ্খ থেকে শান্তি নামে শঙ্খচূড়-প্যাঁচ,
বিপরীত ছায়াদের বাঁধে—
উগ্র আগরের মুখে জ্বলে নীলচে ম্যাচ,
‘ইকরা!’— সাপ ফোঁসে সিংহনাদে।
শান্তি
উড়ছে আমার ছায়া
গ্যালপ-দামাল ঘোড়ার ল্যাজের মতো,
এমনই শ্বাস ফেললে সন্ধ্যাকাশে,
এমন অসংযত—
ফটক থেকে আলো
গ’লে পড়ল ঋতুস্রাবের মতো,
ফাটকে কেউ অন্ধকারের আবহার
কেটে দিয়েছে। ওঠো, জাগো, তোমার চোখে
এগিয়ে যাও, উল্টো বহুক আলো,
রঙিন ছায়া রাজকুমারের ঘোড়া
ডাগর দুটি কালোয়।
ধ্রুব এষ নামের একজন বিখ্যাত লেখক ও প্রচ্ছদশিল্পী আছেন, যিনি ঢাকা শহরে আশ্চর্য গুপ্ত জীবনযাপন করেন বলে উনাকে চেনেন দাবি করা লেখক-সাহিত্যিকরা বলেন। এই জটিল মেট্রোপলিটন নগরে এখনো তিনি আশ্চর্য রকম সরল জীবন অতিবাহিত করেন একটা বিশেষ কৌশলে। তার কাছের লেখকদের কাছে শোনা যায় তিনি নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে যেহেতু লেখেন এবং প্রচ্ছদ করেন তিনি এখনো প্রাচীন আমলের মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। মানে বাটন ফোন। সেই ফোন থাকে সব সময় বন্ধ। মাঝেমধ্যে ফোন খুলে অবসর সময়ে তিনি দেখেন কে ফোন করল, কে মেসেজ করল, ফোনে দেওয়া থাকে মিসড কল অ্যালার্ট। যদি সেসব কল বা মেসেজ লিস্ট দেখে মনে হয় যোগাযোগ জরুরি, তখনই তিনি ফোন করে কথা বলেন বা যোগাযোগ করেন। তিনি নিজের বাড়িতেও বেশির ভাগ সময় থাকেন না, যাতে কেউ অহেতুক চলে এসে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে না পারেন।
এমন অভিনব মোবাইল ব্যবহারের কারণে অনেকেই লেখক, শিল্পী ধ্রুব এষের মোবাইলকে বলেন ধ্রুপদি মোবাইল। লেখালেখিতে অনেক ফোন কলের জন্য অসুবিধা হচ্ছে, আপনিও অবলম্বন করতে পারেন ধ্রুব এষের ধ্রুপদি মোবাইল পদ্ধতি।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।