
জয়েসের জন্য দরুদ
ছড়ানো ছিটানো শহরের পথে পথে
একলা এবং অনেকে একসাথে
আমরা খেলেছি আদম হাওয়ার খেলা
নাম দিলো যে সকল বস্তুকে
রাতের প্রবল ঢালুরেখা ধরে ধরে
ছুটে চলা কোন সুবেহ্ সাদিকে
আমরা খুঁজেছি শব্দ এবং মানে
(এখনো স্মরণে আছে)
কাকে বলে চাঁদ, মৃত্যু এবং আলো
মানুষের যত ভুলে যাওয়া ডাকনাম
ইমেজিজমে আমরা ছিলাম বেশ
কিউবিজমের ঝুলে পড়া বাটখারা
আমরা ছিলাম প্রথাগত সংঘের
বিশ্ব-বিদ্যা-লয় করে যার পূজা
আমরা রচেছি দাড়িকমাহীন যত
অক্ষর যার নাই ঘরদোরছাদ
পঙ্ক্তির পরে পঙ্ক্তি মেলেছে ডানা
আলেহান্দ্রার পাঠাগার করে ফাঁকা
তুমি তো তখন পরবাসে ছিলে একা
দূর শহরে শান দিয়ে গেছো ধীরে
একলা তোমার বেছে নেয়া অস্ত্রের
শিল্পের যত চোরাগলি, রাজপথে
একলা গড়েছো জটিল গোলকধাঁধা
ক্ষুদ্রের থেকে ক্ষুদ্র অথচ অসীম
ইতিহাস থেকে বেশি মানুষের ভিড়
সমীহ জাগানো কুখ্যাতি কুড়িয়েছো
আমরা হয়তো মরেই যেতাম কবে
না দেখে তোমার অদ্ভুতুড়ে পশু
অথবা গোলাপ গোলকধাঁধার চোখে
স্মৃতি ধরে রাখা উজ্জ্বল কেরামতি
প্রতিধ্বনি করে যেন ঠিক ভার্জিল
রাত্রির যত রাস্তায় ঘুরে ঘুরে
ছুটেছে তোমার গুলজার নরকেরা
জ্বলজ্বল করে সুর আর রূপকের
স্বর্ণের মতো যেখানে তোমার ছায়া
কী হয় যদি-বা আমরা কাপুরুষ
পৃথিবীতে থাকে একজনও যদি বীর
কী আসে যায় এইসব বেদনায়
কখনো নিজেকে সুখী কেউ যদি ভাবে
কী আসে যায় হারালে প্রজন্মেরা
ন্যায্যতা দিলে শত শত পুস্তকে
আমিও যাহার আয়নায় চোখ রেখে
হারিয়েছিলাম নিজেকে সেই কবে
আমি হই সেই ছন্নছাড়ার দলে
একগুঁয়ে তুমি রক্ষা করেছো যাদের
দেখোনি কখনো চর্মচক্ষে তবু
আজও দূর থেকে করছো পরিত্রাণ
জেমস জয়েস
একজন মানুষের একটি দিনের ভেতরেই থাকে
এ যাবৎ জন্ম নেয়া সবগুলি দিন, সেই অচিন্ত্যনীয়
প্রথম দিনের থেকে, যখন এক জাহাঁবাজ খোদা
আলাদা করেছিলেন দিনগুলি এবং বেদনাগুলিকে,
সেই অপরের থেকে, যখন সময়ের এক ঐহিক
সর্বব্যাপী স্রোত ফিরে যায় তার উৎসে, অনন্তের দিকে;
এবং প্রজ্বলিত করে বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যৎকে
যা এখন এই আমার ভেতরে বহমান।
সকাল আর সন্ধ্যার অন্তস্তলে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে
এই জগতের ইতিহাস। আর রাত্রির মহাফেজখানায়
আমার পায়ের কাছে আমি দেখি ইহুদির সদাভ্রাম্যমানতা
তরবারির মুখে কার্থেজের পতন, বেহেশত আর দোযখ।
হে প্রভু, সেই সাহস আর আনন্দ আমাকে দাও
যেন আরোহণ করতে পারি এই দিবসের চূড়ায়।
লিট ফেস্টের সমাপনী দিনে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এলোমেলো হাঁটছিলাম। যেন ফুলের বাগান, দিকে দিকে থইথই করছে মৌ মৌ ঘ্রাণ। পথ যেখানেই টানুক ক্ষতি নাই, এমন হেলদোলে নানানভাষী কলকাকলিতে, বিচিত্রবর্ণের মানুষের সম্মেলনের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করি। কিন্তু বিদায়ের সুর! প্রিয়জনের বিয়োগের মতো রক্তক্ষরণ নিয়ে এক সেশন থেকে আরেক সেশনে যাই। মন দিয়ে কথাবার্তা শুনি। মাঝেমধ্যে একাডেমির পুকুরপাড়ে গিয়ে বসি। জনারণ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে মিহিরাতের দিকে তাকিয়ে ভাবি, আচ্ছা কী এত কথা বলছে এঁরা! মানুষ যখন বনে-জঙ্গলে বাস করত, শিকার করে খেতো তখন সাহিত্য কোন স্তরে ছিল! কোনো এক সন্ধ্যায় একদল মানুষ জড়ো হয়ে যখন মাংস পুড়িয়ে খাচ্ছিল তখনো তাদের আলোচনায় সাহিত্য ছিল? তারপরেই এক শিকারি তার খাবার পাত্রে ঝলসানো মাংসের সঙ্গে একটা গমের দানার স্বাদ পেল আর লোভে পড়ে ক্রমান্বয়ে গমের দিকে, উৎপাদন আর চাষের দিকে হাঁটা তারপর কৃষিবিপ্লব সক্ষমভাষা, বাকশক্তির উন্মেষ। হারিয়ে গেল মানুষের আদি যাপন আমাদের পূর্বপুরুষরা গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত হলো। আহা! সেই গমের দানা! সেটা যদি সেদিন না ফুটত তাহলে আজ আমি হয়তো এই লিট ফেস্টেই থাকতাম না। মানুষের এই পরিবর্তনটা অদ্ভুত সুন্দর।
এবার ঢাকা লিট ফেস্ট বেশ কিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটিয়েছে। কবি-লেখক-সাহিত্যিকের মধ্যে আফ্রিকা প্রাধান্য পেয়েছে। আলোও কেড়েছে। আব্দুলরাজাক গুরনাহ আর নুরুদ্দিন ফারাহ। আফ্রিকার বঞ্চনার ইতিহাস, সংগ্রাম কীভাবে সাহিত্যে প্রবল তা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। আফ্রিকার অজস্র ভাষা-ঐতিহ্য ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে মার খেতে খেতে খাদের কিনারে পৌঁছেছে। দাসপ্রথা আর বণবৈষম্যের রোমহর্ষক ঘটনা কে না জানে! এইতো সেদিন তারা এসবের নাগপাশ পেরুলো! আবার সাহিত্যঙ্গনে বীরদর্পে উত্থানও হয়েছে। শুধু তানজানিয়ারই যত নিজস্ব ভাষা, যত বৈচিত্র্য তা তো ভাবায়! এই আফ্রিকার সঙ্গেই একসময় এশিয়াসহ ভারতবর্ষ ছিল। আমরা ছিলাম! আফ্রিকার মানুষের সঙ্গে সভ্যতার বেড়ে ওঠার সঙ্গে যেসব অন্যায় হয়েছে টেকটোনিক প্লেট সরে আসায় আমাদের সঙ্গে তা ঘটেনি। হয়তো তেমনটা না হলে আমরা একই ভূখণ্ডে বাস করতাম তাদের আর আমাদের ভিন্ন বলে কোনোও সংস্কৃতি থাকত না! দূরেই যে শুধু সরে এসেছি তাই-ই নয় ভিন্ন ভাষা, রীতিনীতি ও যাপনে, বলনে-চলনে, খাদ্যাভ্যাসেও ভিন্নতর! কী আশ্চর্য! অথচ আজ আবার একই বিন্দুতে উপনীত করেছে শুধু সাহিত্য। সাহিত্যের এই শক্তি, শিল্পের এই যে ক্ষমতা তা সব কিছুকে এভাবেই সংগঠিত করে মানুষ ও মনুষ্যত্বের জন্য।
ভাষা নিয়ে আমরাও নিপীড়নে পড়েছিলাম। সেই আগ্রাসনে আমরা ভাষাভিত্তিক একটা দেশই বানিয়ে ফেললাম। মায়ের ভাষাও রক্ষা হলো। অথচ এই লিট ফেস্টে মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে কিছুই উপস্থাপিত হলো না! না ভাষাসৈনিক, না আছে তাদের বীরত্বের বর্ণনা না আছে ইতিহাস-আলোচনা! কেন? এমনকি সব সাইনবোর্ড হোর্ডিংগুলো পর্যন্ত বাংলা ভাষার অক্ষরহীন। আব্দুলরাজাক গুরনাহ শেষের দিনের আলোচনাতেও তার সোহায়েলি ভাষার জন্য আবেগাপ্লুত বক্তব্য দিয়েছেন। কেন তিনি মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা করতে পারেননি তাও বলেছেন। তাঁর ১০টা বই সবই ইংরজিতে। হয়তো আজ তার নোবেলপ্রাপ্তি কিংবা বিশ্বাঙ্গনে তাকে পরিচিত করে তুলতে সহায়তা করেছে ইংরেজি। কিন্তু মাতৃভাষা! তার জন্য বেদনায় তিনি ন্যুব্জ হয়ে আছেন। মায়ের ভাষাই যে সবার আগে তা বাংলা ভাষার কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদাও উচ্চারণ করেছেন। ট্রানজিট ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহণ করা যেতেই পারে। ভাষার সক্ষমতা থাকলে ভিনভাষার যেকোনো শব্দের যদি অনায়াস প্রবেশও ঘটে তাতে ক্ষতি কি! বাংলাভাষায় বহু ভিনদেশি শব্দের ব্যবহার আছে। আমরা গ্রহণ করেছি। আমরা আত্মস্থ করেছি।
চারদিনের আয়োজনে দেশ-বিদেশের ৫ শতাধিক কবি-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-চিন্তকদের লিট ফেস্টের এই সমাবেশ ১০ বছরে এসে ঠেকল। এবার মোট সেশন হলো ১৭৫টি। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকেও বাংলাদেশে সাহিত্য নিয়ে এমন সরগরম আয়োজন ছিল না। আশির দশকে বইমেলার শুরু। বইমেলা একুশের চেতনায় সমুজ্জ্বল সেখানে যেমন অন্যভাষার রচনাবলি নিয়ে স্টল-প্যাভেলিয়ন থাকে না তেমনি ভিনভাষীদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণও জানানো হয় না। ফলে এই ধরনের সম্মিলন থাকে না কেবল পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের উপস্থিতি ছাড়া। সেই অর্থে লিট ফেস্ট-ই একমাত্র আয়োজন যেখানে বহু ভাষার, বহুচিন্তার-সাহিত্যের মিলন ঘটে। এখানে যে যে পেশারই থাকুক তারা উৎসব চলাকালীন সাহিত্যেরই সেবা করছে। ব্যাপারটা ভালো। সে ভলান্টিয়ার থেকে শুরু করে পেশায় চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী। তাদের আচরণ, কথাবার্তা সবই সাহিত্যসুলভ। আহা! যদি বারো মাসই থাকত! সাহিত্যের সঙ্গে তেমন যোগসূত্র নেই তারাও এই শীত উপেক্ষা করে দূর-দূরান্ত থেকে উৎসবে হাজির। এই যে টান! এটাই সাহিত্যের জয়। এই সর্বজনীনতাই সাহিত্যকে সবার মধ্যে একটা আন্দোলনের পথে ধাবিত করতে পারে। যেখানে সবারই কণ্ঠ এক, সুরও এক। লিট ফেস্টেরও জয় সেখানে।
দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদে আমাদের সংস্কৃতি কেমন তা না বলেও, ঘটা করে সেসব বিষয়ে কথা না বললেও বাংলাদেশে এসে ভিনভাষীরা তা বুঝে গেছেন। সামান্য যে কয়েকটা পরিবেশনা ছিল তাতেই মুগ্ধ তারা। রবীন্দ্রসংগীত আর ত্রিপুরা নৃত্যের কথা আলাদাভাবে বলা যায়। এখানেই আমাদের স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা, ঐতিহ্য আর পরম্পরার প্রকাশ ঘটেছে। বাঙালিয়ানা নিয়ে আয়োজন ছিল সীমিত, তাতেও ফুটে উঠেছে। আমাদের পিঠাপুলি, গ্রামীণ রীতিনীতি, বাংলার যাত্রা, পুতুলনাচ, লোকশিল্প, হস্ত-কুটিরশিল্প সবই ছিল। বিদেশি সাহিত্যিক যারা এর আগে বাংলাদেশে আসেননি তারা ভাবতেন এদেশের মানুষ গোড়া, নারীরা সবাই বোরকা পরে থাকে, কথা বলে-টলে না। ধর্মান্ধ, মৌলবাদীই বেশি। কিন্তু পথেঘাটে স্বাধীন মানুষ, তাদের আচরণ, কথাবার্তা, আতিথেয়তা, সৌজন্য দেখে ধারণা পাল্টেছে। সাহিত্যমনস্কতা-উন্মাদনায় তাদের হতবিহ্বলতা আড়াল করতে পারেনি। তাদের কাছে আমাদের সাহিত্য পৌঁছেনি। পৌঁছে দেওয়ার আকুলতা বাংলাভাষী সাহিত্যিকদের তাও সামনে এসেছে। অনুবাদ নিয়ে কাজ করার আহ্বান ছিল সবার কণ্ঠেই। কিন্তু কে করবে সেই কাজ তা নিয়ে কোনো সুচিন্তিত বার্তা কেউ-ই দিতে পারেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বাংলা বিশ্বসাহিত্য সভার আলোচনাটাকে তিনি জীবন্ত করেছেন। এমন একটা আয়োজনে শুধু বাংলা সাহিত্যবিষয়ক দীর্ঘ আলোচনা থাকবে বিশ্বসাহিত্যের সাহিত্যিকদের জন্য। যেখানে শুধু বাংলাকেই তুলে ধরা হবে। নোবেলপ্রাপ্তির তালিকায় বাংলা সাহিত্যের অন্তত ৮/১০ জনের নাম থাকা অবাক হওয়ার নয় এমন চাউর হওয়া কথাটা কিন্তু অমূলক নয়।
আমাদের শুধু প্রয়োজন ছিল পরিকল্পনার। এই লিট ফেস্ট নিয়ে সংস্কৃতজনদের পরামর্শ নেওয়া হলে হয়তো তারাও ভূমিকা রাখতে পারতেন। সেটা হয়নি। বিদেশি লেখকরা বাংলা সাহিত্য জানেন না। একই লেখককে পরপর তিনবার অতিথি করলে এদেশীয় সাহিত্য সম্পর্কে তারা অবগত হতে পারতেন। ‘মন খারাপ হয়ে যায় যখন ক্যামেরার লেন্সে ভিনভাষী নোবেলজয়ীদের ছবি তুলতে হয় অথচ আমি চাই আমার দেশের, বাংলা ভাষার লেখকদের ছবি তুলতে।’ এমন আক্ষেপ নিয়ে প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন বললেনও বেশ কজন সাহিত্যিকের নাম।
সাধারণ দর্শনার্থী যারা টিকিট কেটে উৎসবে এসেছেন কিংবা দেশীয় সাহিত্যিকরা। তারাও সর্বাবস্থায় শিল্প-সাহিত্য-কলা-সংগীত নানা বিষয়ে আড্ডায় মেতেছিলেন। থরে-থরে এই যে আলোচনা তার সৌন্দের্য সাদা চোখেও রঙিন লাগে। কথা হলো মূল সেশনগুলোতে বাংলার ভাববাদ-দর্শন, আউল-বাউল, সুফিদের নিয়ে আলোচনা থাকতে পারত। উঠে আসতে পারত লালন, হাছন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাছনের কথা গত শতাব্দীতে বলেছিলেন ব্রিটেনে এক আলোচনায়। অজপাড়াগাঁর এক সাধক-কবি, কত বড় মাপের দার্শনিক! আমরা তাকেও তুলে আনতে পারলাম না লিট ফেস্টে। লালনের সাহিত্য-দর্শন, আরজ আলী মাতবরদের চিন্তা বিশ্ববাসীকে জানানোর একটা প্লাটফর্ম তো লিট ফেস্ট-ই হতে পারত! সেই আফসোসটা রয়ে গেল।
নোবেলজয়ীদের দেখতে, কথা শুনতে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে? এমন প্রশ্ন ছিল দিকে দিকে। আবার বিশ্বখ্যাত লেখকদের ভিড়ে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের আমন্ত্রণ না জানানোর প্রতিক্রিয়াও আছে। নির্মলেন্দু গুণের মতোন কবিকে এবার পায়নি ঢাকা লিট ফেস্ট। গুণকে ছাড়া লিট ফেস্ট তাও আবার তাঁর জীবদ্দশায়! এই দৈন্য কার! আয়োজকরা লাখ লাখ টাকা দিয়ে বিদেশি সাহিত্যিক আনতে পারলে কেন ১০ হাজার টাকা সম্মানীও বাংলাভাষার কবির জন্য বরাদ্দ রাখা হয় না? তাঁর কবিতা পড়েছেন উৎসবে আয়োজকদের আমন্ত্রিত পশ্চিমবঙ্গের কবি জয় গোস্বামী। এই ঘটনা উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আয়োজকদের আহাম্মকও বলেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার গুরুত্বর্পণ কবি-লেখকরা আয়োজনে থাকলে হয়তো তাদের সেশনগুলোতে বাংলা ভাষা-সাহিত্যসহ নানাবিধ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে পারতেন ভিনভাষীরা। তুলনামলূক সাহিত্য আলোচনা থেকে বঞ্চিত থেকে গেল বিশ্বসাহিত্য। উৎসবজুড়ে বাংলার ব্যবহারও ছিল দৃষ্টিকটু, সীমিত। বাংলাদেশি কবি-সাহিত্যিকদের ভিনভাষীদের সেশনে উপস্থিত থাকা ছাড়া সম্ভবত আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ সেই অর্থে ছিল না। কবিতা পাঠেও যারা আমন্ত্রিত হওয়ার কথা সেখানেও উপেক্ষিত থেকে গেছেন অনেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমার মনে হয়, এই মেলা নিয়ে একটি যোগ্য সমালোচনার দরকার ছিল, সামনের দিনগুলোতে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য। সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা ছিল, সম্ভবত, এদেশে যারা সত্যিকারের সাহিত্যচর্চা করেন, তাদের অনুপস্থিতি। সেখানে জায়গা করে নিয়েছেন এনজিও এবং করপোরেট কর্তাব্যক্তিরা। ধনী ব্যক্তিদের সাহিত্য মেলাই হয়েছে। কিছু কিছু প্যানেলে যাদের ধরে আনা হয়েছে, প্যানেল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আয়োজক সংস্থায় কাজ করা বা তাঁদের বন্ধুবান্ধব হওয়া ছাড়া তাঁদের নিজেদের কন্টেন্ট সম্পর্কে পাবলিকের ধারণা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।’
একই ভাবে হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো বর্ষীয়ান লেখককে শুধুমাত্র শ্রোতা হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো নিয়েও আয়োজকদের পিণ্ডি চটকেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত লেখকরা।
লিট ফেস্ট এলিটদের নাকি প্রলেতারিয়েতদের? এমন বিতর্ক নিয়েও কথা বলেছেন কবি-লেখকরা। তবে এসব বাদে, মিলনমেলা যাকে বলা যায় তার অনেক কিছুই উঠে এসেছে। ভিনভাষীদের সঙ্গে সাহিত্যবিষয়ক আড্ডা-আলোচনা-বিনিময়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির সঙ্গে উগ্রবাদ- মৌলবাদের নিন্দা একই সঙ্গে উদারবাদের পক্ষে অবস্থান এক শিল্পিত চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে। সমস্ত রকমের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ভাষা এবং সংস্কৃতিকে উচ্চকিত রাখার প্রশ্নে এই যে সবাই একমত, নিঃসন্দেহে তা আনন্দের। স্বাধীনতা হরণ কিংবা দখলদারিত্ব আর একনায়ত্বসূলভ শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ মিলিয়েছেন সাহিত্যিকরা। নুরুদ্দিন ফারাহ্’র প্যানেল আলোচনাতেও তা ধ্বনিত হয়েছে।
চিন্তা ও চিন্তকদের সম্মিলন, বড় চিন্তা কিংবা বড় লেখক সবাই সত্যিকারের সাহিত্য নিবেদিত বলেই মনে হয়েছে। ভার্চুয়াল এই সময়ে মানুষের সম্পর্ক এবং কবিতা-সাহিত্য কীভাবে দিনবদলের পন্থায় পরিচালিত করা যায় এবং তার প্রয়োগ ঘটানো যায় সেইসব মতামত গুরুত্ব পেয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, যুদ্ধ, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈষম্য হ্রাস, মি-টু আন্দোলন, উদ্ভিদ বা প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষায় লেখকদের ভূমিকা কী হতে পারে সেসবের দীর্ঘ সেশন দরকার ছিল।
বাংলা একাডেমিতে এই আয়োজন না করে আয়োজকরা কোনো পাঁচতারা হোটেল কিংবা নিজেদের মালিকানাধীন ইউল্যাব ক্যাম্পাসে ব্যক্তিগত প্রদর্শনী হিসেবে করলে অবশ্য এত সমালোচনার কিছুই হয়তো উঠত না।
প্রযুক্তির এই বিকাশমান সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদনে মানুষের অনাগ্রহকেই যেখানে স্বাভাবিক আচরণ ভাবা হয় সেখানে সেইসব দিক বিবেচনায় দশম আসরের এই লিট ফেস্ট আয়োজন কিছুটা হলেও হালে পানি সঞ্চার করেছে। তর্ক আর প্রতিতর্কের এই যে উপলক্ষ তৈরি করে দেওয়া এ উৎসব তো সেখানেই সফল।
একটা বাচ্চারে সারপ্রাইজ দিলাম।
বাচ্চা খুশি। আমিও।
অফিস টাইম শেষে, খুব সম্ভবত ডে-কেয়ার থেকে বের হয়ে, বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিল একটা বাচ্চা। তার বাম হাতে বাবার হাত আর ডান হাতে ছিল একটা কাগজের ফুল। একটা ৩+ ছেলে বাচ্চা। আদুরে গড়ন এবং তাগড়া মেজাজ। আমি ছিলাম ১৩ ফুট পেছনে। বাচ্চার হাত থেকে যখন ফুল রাস্তায় পড়ে গেল আমি তখন ৭ ফুট পেছনে। অসচেতন হইলে এই ফুল আমার পায়ে পিষ্ট হইতে পারত আলবত। রাস্তায় যেহেতু আমি মানুষ দেখি তাই অসচেতন হয়ে হাঁটলে আমার লস হয়ে যায়। আমার সচেতন পর্যবেক্ষণ এইখানে আলোচনার বিষয় না হইলেও, ঠিক এই কারণেই পায়ের কাছে কাগজের ফুল কোনো আচম্বিত ব্যাপার হয়ে থাকে নাই। উপরন্তু, যুদ্ধের সিজনে বাচ্চার হাতে লাল-সাদা কাগজের ফুলের যে রাজনৈতিক-শৈল্পিক ব্যঞ্জনা থাকতে পারে এই ভেবে খুব সম্ভবত তাদের ফটো তুলতে ইচ্ছা হয়েছিল। ফুল যদি হাত না ফসকাতো, আমি হয়তো পেছন থেকে বাপ-বেটার একটা ফটো তুলে ফেইসবুকে কিছু লাভ রিয়েকশন হাসিল করতে পারতাম। ভুতুম নাম্নী আমার নিজের বাচ্চার থেকে যেহেতু আমি শিখছি, তাই এই ফুলের অতি নিকট ভবিষ্যৎ প্রয়োজনটা বুঝতে আমাকে মাথা খাটাতে হয় নাই।
কুড়িয়ে নেওয়া লাল-সাদা ফুল হাতে আমি বাপ-বেটার পেছনে হাঁটলাম খানিক। কদম সাতেক কি আটেক পিছু নেওয়ার পরই বাচ্চা তার বাপকে টেনে থামাল। আদুরে জেদের ভঙ্গিতে, মা-বাপের ওপর বাচ্চার সব গোস্বার আনডিফাইন্ড শর্তে, হারিয়ে যাওয়া ফুল ফেরত চায় সে। আর সেই মুহূর্তেই, একদম সেই মুহূর্তেই, কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গিতে সেই ফুল হাতে আমি বাপ-বেটার পার্শ্বে অবতীর্ণ হই। তারা দুজনেই আমাকে দেখে যেন কিছুটা চমকে যায়। যেন-বা তারা একজন ম্যাজিশিয়ান দেখল; আমিও কপট জাদুকরী গাম্ভীর্য অটুট রেখে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাচ্চার হাতে ফুল তুলে দেই। কথা না বলে বরং মুচকি হাসি স্থায়ী রাখি, যতক্ষণ না ফুল বিনিময় করে আমি তাদের অতিক্রম করে যাই। বাচ্চাটা আমার দিকে চেয়ে থাকবে আরও কিছুক্ষণ, অন্তত যতক্ষণ আমাকে দেখা যায়। বাপও হয়তো বাচ্চার দৃষ্টি ফলো করে থাকবে।
আমি কিন্তু আর পেছন ফিরে দেখি নাই। সচেতনভাবেই আর তাকাই নাই। আমাকে আরেকবার দেখতে চাইবার আগ্রহ যদি তাদের হয়, সেই আগ্রহ না মিটাইলে বাচ্চাটার মেমরিতে আমি তো খানিকক্ষণ কিছুটা ম্যাজিক্যাল ক্যারেকটার হয়ে থাকলাম হয়তো।
গল্প শেষ।
এই গল্পের নাম স্ট্রবেরি
কালারের ললিপপ
ফাঁকা রাস্তায় একটা মোটর গাড়ির সাবলীল আনন্দের গতিকে আচমকা প্রবলভাবে ডিনাই করলে যেমন শব্দ হয় আমার পেছনে ঠিক এমন একটা শব্দ হলো। সিনেমায় প্রাণঘাতী অ্যাক্সিডেন্টের শব্দ যেমন হয় আরকি, বিকট। আমি একটা লেন পার হয়ে রোড ডিভাইডারের ওপরে অবস্থান করছিলাম আরেকটা লেন পার হওয়ার বাসনায়। শব্দটা অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকাই। এই তাকানো সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল না; ঘটনার আশপাশের সবাই প্রাইমারি রিফ্লেক্সের কারণেই ত্বরিত সেই গাড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু প্রথমেই আমার চোখ গাড়ির দিকে না গিয়ে থমকে গেল একটা স্ট্রবেরি কালারের ললিপপের দিকে। মধ্য রাস্তায় পড়ে আছে, ভর দুপুরের প্রখর আলোয় জ্বলজ্বল করছে। তার পাশে কালো রং পুড়ে ছাই রং হওয়া বোরখা পরিহিত মহিলা। যে ঘটনা প্রায় আমরা কেউ দেখি নাই তিনি সেই ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল, এখনো কোনো রিয়েকশন দেখাতে শুরু করেন নাই। মহিলার বাম পাশে যে টয়োটা হাইএস গাড়ি দাঁড়ানো দেখলাম সেটা কি তখনো গতি জড়তা সামাল দিতে সাসপেনশনে ঝাঁকি খেয়ে থিতু হওয়ার দশায়, বোঝা গেল না। অতটা দ্রুততার সাথে আমি মনে হয় পেছনে তাকাই নাই। দেখার ভুল। নাকি শব্দের সাথে মাথা এমনটা কল্পনা করে নিয়েছে। হতে পারে সিনেমার ইমপ্যাক্ট।
কিন্তু যা সত্যই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বিশ্বাস করতেও চাইছিলাম না। দেখতেও চাইছিলাম না। আবার মুখ ঘুরিয়ে চলেও যেতে পারছিলাম না। মনে হলো গাড়ির সামনের অংশ ঘেঁষে উপুড় হয়ে বসে থাকা মহিলার হাঁটুর কাছে একটা বাচ্চার মাথা, মনে হচ্ছে যেন শরীরের বাকি অংশ গাড়ির নিচে। মাথা কি না তা রেজিস্টার করতে করতেই তিন বা চার বছরের একটা অপুষ্ট মেয়ে বাচ্চা বের হয়ে আসলো গাড়ির তল থেকে। ভাবলেশহীন চোখমুখ। আমার পাশ থেকে কারা যেন খুব শব্দ করে সুবহানাল্লাহ ধ্বনি তুলল। আমি সম্ভবত একইভাবে তাকিয়ে ছিলাম।
সিনেমার দৃশ্য হলে হয়তো মা জড়িয়ে ধরে চুমু খেতো, কিন্তু এইখানে ঘটল ভিন্ন ঘটনা, অক্ষত বাচ্চাকে দেখে মা উচ্চশব্দে মরা কান্না জুড়ে দিলেন। কাঁদতে শুরু করার সাথে মেয়েকে মারতেও শুরু করেন। ক্লাস সিক্সে হাত ভেঙ্গে ঘরে ফিরলে আমার আম্মা আগে আমাকে দুইটা থাপ্পড় দিয়েছিলেন। আছে হয়তো কোন রিলেশন। একরকম মারতে মারতেই টেনে রোড ডিভাইডারে উঠলেন। কালো-বেঁটে করে ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থেকে নেমে জীবিত বাচ্চার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, আর এদিক-সেদিক তাকালেন কোনো নির্দিষ্ট দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে। তাকে চারপাশ থেকে মানুষজন যে বাহবা দিয়ে যাচ্ছে সেই দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো মানসিক স্টেইটে মনে হয় তিনি নাই এখন। গাড়িতে চড়ে বসলেন কোনো কথা না বলে।
ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে মা দোয়া দরুদ পড়ছেন আর খুব ভালো করে বাচ্চাকে চেক করছেন কোথাও কোনো আঘাত লাগল কিনা। আমারও ইচ্ছা করছিল হাত দিয়ে দেখি বাচ্চাটা আসলে জীবিত আছে কি না। মনে হচ্ছিল হয়তো ঘটনা অন্য কিছু ঘটে গেছে। হয়তো আমার দুর্বল মন সত্য মেনে নিতে না চেয়ে নিজের গড়া ঘটনা দেখছে। বাচ্চাটাকে একটু ছুঁয়ে দেখা দরকার। ভয় লাগছিল ছুঁয়ে দিলে যদি সত্যি ঘটনা রিভিল হয়ে যায়।
জ্যাম লেগে গেছে এতক্ষণে। পেছনের মানুষ তো জানে না এখানে কী ঘটছে তাই স্বভাবসুলভ উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে পরিবেশ অতিষ্ঠ করে তুলছে। আমি সম্ভবত একইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুহূর্তে যেমন করে মানুষের জমায়েত হয়েছিল আবার মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। আমি সময় নিচ্ছিলাম হজম করার জন্য।
গাড়ি চলতে শুরু করল আবার। কয়েকটা গাড়ি চলে গেল, ললিপপটা অক্ষত থেকে জ্বলজ্বল করছিল তখনো। আমি ললিপপটা চূর্ণ হয়ে যেতে দেখতে চাইছিলাম না কিন্তু তবুও তাকিয়ে ছিলাম। কেন যেন চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। মা, বাচ্চা কোলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর দোয়া দরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে চলেছেন।
বাচ্চাটাও দেখলাম আধখাওয়া স্ট্রবেরি ললিপপটার দিকেই চেয়ে আছে। আরও কিছুক্ষণ ললিপপটা গাড়ির চাকার সংস্পর্শ থেকে বেঁচে থাকুক। রোদে জ্বল জ্বল করতে থাকুক।
আকিরা কুরোসাওয়া, জাপানি চলচ্চিত্রের সম্রাট, সিনেমা বানিয়েছিলেনএবং একদিক থেকে ভেবে দেখতে গেলে, তিনি সেই অর্থে নিছক সিনেমা বানানোর চক্করে ছিলেন না। এমনকি যখন সত্যতর অর্থে, শ্যুটিং প্রস্তুতির জন্য রিসোর্সের অভাব বোধ করতেন, তিনি ভবিষ্যতে নির্মাণের জন্য সিনেমার প্রস্তুতি নিতেনপ্রতিটি ডিটেলের কথা নিখুঁতভাবে চিন্তা করে। ক্রিটিক এবং জাপানি সিনেমার ইতিহাসবেত্তা ডোনাল্ড রিচি ‘পরিচালকের স্মরণে’ শীর্ষক এক রচনায় জাপানি চলচ্চিত্রের সংজ্ঞায়নে অন্য যে কারও চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন কুরোসাওয়ার ‘পণ্যটিকে নিখুঁত করবার ভাবনা’কথাটির ওপর। ‘যদিও অনেক চলচ্চিত্র সংস্থা-ই হয়তো নির্মাতার এমন আত্মনিবেদনে আলোকিত হয়ে উঠত’, রিচি লেখেন, ‘জাপানি স্টুডিওগুলো প্রায়ই ইনোভেশনের চেয়ে সহযোগিতায় অধিকতর মুগ্ধ হয়।’
কুরোসাওয়ার পক্ষে, তার চলচ্চিত্র যাত্রাপথে, উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টের জন্য, টাকাপয়সা সংগ্রহ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। রিচি সত্তর দশকের একসময়ের কথা স্মরণ করেন, ‘তিনি বুঝেছিলেন কাগেমুশা বাস্তবিক আলোর মুখ দেখবে না, কুরোসাওয়া সময় কাটাচ্ছিলেন প্রতিটি দৃশ্য এঁকে, এই সংগ্রহটি অবাস্তবায়িত চলচ্চিত্রের জায়গা নিতে পারত। তিনি অন্য কোনো কোনো পরিচালকের মতো স্টোরি বোর্ড ব্যবহার করতেন। এখন সেসব গ্যালারির প্রশস্ততাকে উজ্জ্বল করছেঅনির্মিত মাস্টারপিসের প্রদর্শনকক্ষ।’ যখন সিনেমা নির্মাণে অপারগ ছিলেন তিনি সেসব লিখে ফেলতেন, লেখা সাঙ্গ হলে নেমে পড়তেন আঁকায়।
‘আমার উদ্দেশ্য ভালো মতো পেইন্ট করা ছিল না। আমি নানা রকম জিনিসকে নিজের হাত দিয়ে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম’। কিন্তু আপনারা যেমন দেখতে পাচ্ছেন, সম্রাট জানতেন তিনি কী চান, সুনির্দিষ্ট শটটি স্পষ্টভাবেই আগেই দৃশ্যকল্পনায় তার প্রচুর সময় ও শক্তি খরচের ব্যাপারটি রিপ্রেজেন্ট করত। মাঝেমধ্যে কুরোসাওয়ার নিজের আর্টওয়ার্ক কম পরিচিত সিনেমার অফিশিয়াল পোস্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো, (কম পরিচিত মানে, কুরোসাওয়ার বিশাল কাজের প্রেক্ষিতে) ব্যক্তিগত কাজ যেমন সত্তর দশকের ডোডোসকাদেন কিংবা শেষ কাজ, ১৯৯৩-এর ম্যাদাদেও।
আমরা নথিভুক্ত করতে পারি চলচ্চিত্র পরিচালকের চিত্রকলার প্রতি আগ্রহএবং হয়তো ফিল্ম নির্মাণে, বেশির ভাগটাই তার বড় ভাই হেইগোর প্রভাব, টোকিও শহরে উনিশশো তেইশের পহেলা সেপ্টেম্বরের প্রবল ভূমিকম্পের পর কুরোসাওয়া দাদার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। নির্বাক চলচ্চিত্রের একজন সজীব ধারাভাষ্যকার এবং প্রলেতারিয়ান আর্টিস্ট লিগের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী হেইগো, ১৯৩৩ সালে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ভঙ্গ ও নিজের কেরিয়ার-বিধ্বংসী সবাক চলচ্চিত্রের আবির্ভাবের দরুন আত্মহত্যা করেন। তরুণ আকিরা এক দশক পর পরিচালনার উদ্বোধনী কাজটি করেন, পঞ্চান্ন বছর ধরে ধারাবাহিক থাকবেন তিনি পরিচালনায়। আমরা নিশ্চিত জানি, সব সম্ভাব্য স্তরেই হেইগো ছোট ভাইয়ের জন্য গর্বিত হতেন।
ধ্রুপদি চলচ্চিত্র ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-এর দাবা খেলাটা দেখেছেন!
দৃশ্যটি বিশ্বের অসংখ্য সিনেমাশিক্ষার্থী, প্রেমিক, ভাবুককে ভাবিয়েছে। সিনেমার কেন্দ্রীয় ঘটনা এটি। কত অল্প আয়োজনে বিশ্বের চিন্তাজগৎ আলোড়িত করা যায় এ তার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। যদিও দাবা খেলায় আগ্রহী স্টুয়ার্ট রুবেন খানিক ভিন্ন মত দিয়েছেন। ‘ভিন্ন’ বলেই তুলে ধরা দরকার।
আন্তোনিয়াস ব্লক, একজন নাইট, ক্লান্ত, ক্রুসেডের যুদ্ধ থেকে ফিরছেন নিজভূমে। নিজের প্রিয়তম দেশ প্লেগে মহামারীতে বিধ্বস্ত। ব্লক সহসা আবিষ্কার করলেন, আহত হৃদয়কে অপমান করতেই মৃত্যু তাঁকে নিতে এসেছে। তাই তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন, এমনকি মৃত্যুকে। যদি তিনি জেতেন পরিবারের কাছে ফেরা; নইলে খেল খতম! জীবন ও নশ্বরতা বিষয়ে ভাবানোর মতন মন্তব্য করলেও এই দাবাযুদ্ধ দাবায় উৎসাহীদের প্রামাণ্যতা সম্পর্কে করে তোলে উৎসাহী। ‘চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ভুলভাল করা স্বাভাবিক।’ স্টুয়ার্ট রুবেন, এক দাবাচিন্তক মন্তব্য করেন। তিনি আরও যোগ করেন, ‘যদিও চতুর্দশ শতক সিনেমার পটভূমি, এই তথ্য প্রায় নিশ্চিত যে নিয়মটিতে তারা খেলছিলেন তার প্রতিষ্ঠা পঞ্চদশ শতকে। মৃত্যু একটি চাল দেয়, সাদা রাজাকে চেক দেওয়ার পর, কালো তার রাজা তুলে নেয়, তারপর খেলা ডিজলভ হয়ে যায়।’
খেলা শেষ। কালো জেতে। মনে হতে পারে, এই খেলাটিতে কোনো দাবা পরামর্শক ছিলেন না। খেলাটা এত দ্রুত! সাদা খেলা শুরু করে (ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগের নিয়ম সাদা সবসময় শুরু করবে), খেলাটা সাদায় শুরু হলো পরে বদলে গেল এবং মৃত্যু যে রানী অধিকার করল সেটাকে বড় চাল হিসেবে দেখানো হয়েছে; অথচ তখন রানী কম শক্তির ঘুঁটি ছিল, তাই এই বড় করে দেখানো কোনো অর্থ বহন করে না। ‘ঘটনা হচ্ছে, খেলা গড়ায় না।’ রুবেন লেখেন এক নিবন্ধে। ‘আপনি যা আশা করেন তা হলো, খেলা যত গড়াবে ঘুঁটি কমবে বোর্ডে। আপনি কখনো আশা করবেন না ঘুঁটি কাটা পড়া সত্ত্বেও অনেক অনেক ঘুঁটি থাকবে।’
সুতরাং এ ছবিটি কী? রুবেন বুঝে উঠতে পারেন না। ব্যারিম্যানসুলভ বিমূর্ততা ও অস্তিত্বের ক্লান্তি নিয়ে মন্তব্য না স্রেফ এক সাজানো জিনিস! দাবাচিন্তক সিদ্ধান্ত টানেন, ‘কোনোটাই না।’
হয়তো ফিল্ম ক্রুদের মধ্যে ঘটা অসংখ্য খেলার একটা এটা। খেলাটা তারা দূর থেকে যেকোনো এক অবস্থানে তুলে ধরেছেন। কেননা খেলার শেষ দিকে বোর্ডে অধিক ভিড় অযৌক্তিক লাগে। আমি আসলে শেষ দশাটা কেন চেক মেট ঠিকঠাক দেখে উঠতে সক্ষম হইনি।
দেখেননি এখনো? সিনেমাটা এবার দেখে ফেলুন।
বিদেশি নিবন্ধ অবলম্বনে সৈকত দে
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে নালের বেড়া ওরে হাত বাড়ায়া দিতে পান কপাল দেখি পোড়া, প্রাণ কোকিলা রে এই গানের গীতিকবি কে? তার বিখ্যাত দুটি কাব্যর নাম কী কী? প্রশ্নটির সঠিক উত্তর হাতে লিখে পাঠান ধ্রুপদির ঠিকানায়। নির্বাচিত সঠিক উত্তরদাতাদের একজন পাবেন ধ্রুপদির সৌজন্যে মহামূল্যবান বই। উত্তর ধ্রুপদির ডেস্কে পৌঁছতে হবে ১৭ জানুয়ারির আগে। ধ্রুপদি কুইজ ১ এর সঠিক উত্তর জীবনানন্দ দাশ, কমলালেবু এবং কলকাতা। অজস্র উত্তরের মধ্যে শতভাগ সঠিক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। ৬৬% সঠিক উত্তরের মধ্যে লটারি করে মহামূল্যবান বই জিতেছেন ফিরিঙ্গিবাজার কোতোয়ালির মো. সেলিম। আপনাকে অভিনন্দন। আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে মহামূল্যবান বই
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।