
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের কবিদের জনপ্রিয়তা বিষয়ক কাদা ছোড়াছুড়ির এ সময়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ২২৭টি ‘হাহা’ ইমো অর্জন করেছেন। অনেকে শেয়ারও করেছেন সেই স্ট্যাটাস। তিনি লিখেছেন ‘হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে প্রচুর ভিড়। ঢাকা শহর তো বটেই, আশপাশের এলাকা থেকেও অনেকে এসেছে। সবার গায়ে কামড়ের দাগ। তারা আবার একে অন্যের দিকে তাকিয়ে গজরাচ্ছে। ডিউটি ডাক্তার অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, শরীরে কামড়ের দাগ, আবার নেকড়ের মতো গজরাচ্ছেন, আপনারা কারা!
জবাব এলো, ‘না বোঝার কী আছে! আমরা কবি।’
ধূর্ত ও ধীমান সমালোচকও মাঝে মাঝে মূর্খ ও মুরতাদের মতো এই কথা বলে বসেন যে, সাহিত্যের জনপ্রিয়তা মানেই হলো সাহিত্যের সীমানা বাড়ানো। উল্টোভাবে কথাটার মানে দাঁড়ায়, জনপ্রিয় সাহিত্য জনগণকে সাহিত্যের দিকে টানে।
আসলে কি তাই ঘটে? ফিরিস্তি নেওয়া যাক। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র জনপ্রিয়তা বাংলার জনগণকে নিশ্চয়ই চলচ্চিত্র-দেওয়ানা করে তুলেছিল নব্বইয়ের দশকে। এর ফলস্বরূপ তারা ক্রমান্বয়ে উচ্চতর বোদ্ধায় পরিণত হয়ে সিনেমাহলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। ঘরে বসে দেখতে শুরু করল তারকাভস্কি বা কিসলোভস্কি। ব্যাপারটা কি এমন?
হুমায়ূন আহমেদের গগনচুম্বী মগনগানে উন্মত্ত পাঠককুল কি তার মৃত্যুর পর দলে দলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা কমলকুমার মজুমদার কিংবা নিদেনপক্ষে শহীদুল জহির আবিষ্কারে আকুল হয়ে উঠেছিল? নাকি তারা খুঁজে নিয়েছিল আনিসুল হক বা সাদাত হোসাইনদের?
হেলাল হাফিজের ভিউকার্ড-কবিতা-ক্রেতারা কিংবা পূর্ণেন্দু পত্রীর ক্যাসেট-কাব্য-শ্রোতারা কখনো কি উৎপল কুমার বসু বা মান্নান সৈয়দকে বুঝতে চেষ্টা করেছিল? নাকি তারা মজে গিয়েছিল অশ্রু ও চিঠি ফেরি করা কবি মহাদেব সাহাতে?
প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আমরা দেখব এইসব জনপ্রিয়তায় শিল্পের প্রসার ঘটে না। যা ঘটে তা হলো, অভুক্ত ভোক্তার সুপ্ত বাসনার উদ্যাপন। এই ভোক্তা ভাত খেতে চায়। গামলা-ভর্তি ভাত। মুকুন্দরাম যেমন বলেছেন: শয়ন কুৎসিত এর, ভোজন বিটকাল। ছোট গ্রাসে তোলে যেন তেয়াটিয়া তাল।
এভাবেই আম-পাঠক তৈরি করে রুচির সুচির শর্বরী।
তা দেখে আমরা কেন লাজে মরি!
২
কবিতা কীভাবে জনপ্রিয় হয়? কেন হয়?
প্রশ্নটা এ কারণে ওঠে যে, শিল্পের যে মাধ্যমগুলো ভাষা-নির্ভর, আরও ভেঙে বললে শব্দ-নির্ভর, কবিতা তার মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম, সবচেয়ে এলিট সেই অর্থে। এই সূক্ষ্মতা কীভাবে জনচিত্তে উদ্যাপিত হতে পারে? তবে সেই উচ্চবোধ জনগোষ্ঠী কোন গ্রহে কোন কালে বাস করে, তা আমাদের জানতে ইচ্ছে হয় বৈকি।
পৃথিবীর জননন্দিত কবিদের কথা স্মরণ করলেই আমরা প্রায় সমস্বরে উচ্চারণ করিমায়াকোভস্কি, নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা, মাহমুদ দারবিশ এবং আমাদের নজরুল, সুকান্ত প্রমুখের নাম।
মনে রাখা দরকার, এদের জনপ্রিয়তা পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিজমের সঙ্গে জড়িত। সময়ের বিশেষ প্রয়োজন ও প্ররোচনায় এদের আর্টওয়ার্ক হয়ে ওঠে পারপাসিভউদ্দেশ্য নিহত শিল্পপ্রয়াস। যে শিল্পপ্রয়াসে শিল্পী সর্বদাই ভোক্তার চাহিদা পূরণ করে চলেন। অর্থাৎ এ ধরনের কবিতায় মূলত পাঠকের জ্বালামুখে গ্যাস সরবরাহ করেন কবি। পাঠকের জ্বলুনি থেমে গেলে সেই গ্যাস আর জ্বলে না, বোঁটকা গন্ধ ছড়ায় মাত্র। এবং তারপর অপেক্ষা করতে থাকে আরও একটি ফুলকি ফোটা মুহূর্তের। যদি আবার জ্বলে ওঠা যায়।
জনপ্রিয়তার রকমফেরও আছে। মুগ্ধবোধ জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়তা, আর উচ্চবোধ জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়তা এক জিনিস নয়। রুশ জনগোষ্ঠীর কাছে আসতে তলস্তয়কে আর্টের সঙ্গে যে বোঝাপড়া করতে হয়, বাংলার জনগোষ্ঠীর কাছে যেতে সুনীল-শীর্ষেন্দুর বোঝাপড়াটা হয় ভিন্নতর। বলা ভালো, নি¤œতর। শিল্পীমন ও জনচিত্তের সংযোগ কীভাবে ঘটবে এ নিয়ে গ্যেটেরও ছিল টনটনে টেনশন। ফাউস্টের উপক্রমণিকাতেই তা পরিষ্কার।
আমরা যেসব ক্লাসিক বা সিরিয়াস লিটারেচারের কথা বলি, সেসবও জনপ্রিয়। কিন্তু তা জনপ্রিয় হয়েছে দীর্ঘকালপরিসরে, জীবিত ও মৃত পাঠকের কলরবে। রাতারাতি হাতাহাতি করে মাত করার বিষয় ছিল না সেসব।
তাৎক্ষণিকভাবে, কবির জীবৎকালে কবিতা জনপ্রিয় হতে হলে ঘটতে হবে দুইটি ঘটনা। হয় কবিতাকে স্থূল হতে হবে, নয় পাঠককে সূক্ষ্ম হতে হবে। মানে দুপক্ষকে এক বিন্দুতে এসে মিলতে হবে।
৩
অতি-সম্প্রতি দুচার জন জীবিত কবির জনপ্রিয়তা নিয়ে খানিকটা বিস্ময় ও বিতণ্ডা শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা ফয়সালা করার জন্য চার জন কবিকে নিয়ে সামান্য আলাপের সূচিমুখ তৈরি করা যাক। এই চার জন কবি হলেনহেলাল হাফিজ, মারজুক রাসেল, ইমতিয়াজ মাহমুদ ও হাসান রোবায়েত।
প্রথমত আমরা বুঝতে চেষ্টা করব এদের জনপ্রিয়তা অর্জনের তরিকাটা কী। ওই তরিকার মধ্যেই লুকানো থাকবে কাব্যশৈলীর তর্জা। ফলে কবিতার মূল্যনিরূপণে আমরা বেশিদূর এগোব না আপাতত।
‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’হেলাল হাফিজের এই পঙ্ক্তি একদা দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ ছিল। যে সময়ের কথা বলছি, সেসময় দেয়াল নিজেই এমন একটা পঙ্ক্তির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিল। এই পঙ্ক্তিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করেছিল পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা। যারা মূলত কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পী নন। কিন্তু প্রায়-কবি, ঊনকবি অথবা কবি-ভাবাপন্ন ক্যাটাগরিতে পড়বেন হয়তো। তাদের দ্বারা এইসব পঙ্ক্তি চারদিকে প্রচারিত ও উদ্যাপিত হতে দেখে উঠতি কবিরা রীতিমতো উ™£ান্ত হয়েছেন এবং প্রীতিগতভাবে প্রলুব্ধ হয়েছেন অমন পঙ্ক্তি রচনার জন্য। কিছুটা দূর থেকে, আড়চোখে এইসব দেখেশুনে বয়োজ্যেষ্ঠ কবিরা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন, কখনোবা ঈর্ষায় পুড়ে মরেছেন সঙ্গোপনে।
এই আলোচনার সূত্রপাতে যে সূত্রটি বেরিয়ে আসে তা হলো, সমকালে কবিতা জনপ্রিয় হয় মূলত অ-কবিদের দ্বারা। তারপর তাতে যুক্ত হন দ্বিধান্বিত কবিসমাজ।
মারজুক রাসেলের ক্ষেত্রেও তাই। ভিজুয়াল-মিডিয়ার দ্বারা অর্জিত তারকাখ্যাতি বিজ্ঞাপিত হয়েছে কবিতা-বিক্রির জগতে। পরিমণি বা হিরো আলমের কবিতার বই আরও বেশি বিক্রি হবে, এমনটা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। প্রশ্ন উঠতে পারে, যা কিছু লিখলেই কবিতা হয় নাকি?
প্রশ্নটা কবিদের কাছে করলে একরকম উত্তর পাওয়া যাবে, জনগণের কাছে করলে ভিন্নরকম। এ দুয়ের মাঝে যে বিস্তর ফাঁক এবং কবিতার সংজ্ঞা-নিরূপণে যে ঐতিহাসিক ফোকর বিদ্যমান, তাতে যে কোনো কিছুকেই কবিতা বলে চালানো সম্ভব। অন্তত গণতান্ত্রিক গণপরিসরে। এখানে প্রয়োজন শুধু একটা লেখাকে কবিতা বলে ক্লেইম করা।
যে কারণে ম্যাক্সিম বা প্রবচনগুচ্ছকে কবিতা বলে ভ্রম তৈরি করা সম্ভব। কিংবা বোর্হেসের প্যারাবলগুলোকে। এমনকি ঈশপের গল্পগুচ্ছকেও। ফেসবুক হচ্ছে তেমনই একটা ‘গণতান্ত্রিক গণপরিসর’। ইমতিয়াজ মাহমুদের কেসস্টাডিতে এমনটাই আমরা দেখতে পাব।
ইভ বনফোয়া একটা কথা বলেছিলেন, কবিতার মধ্যে কবি তার বাসনা ব্যক্ত করেন, পাঠক তার বাসনা দিয়ে সেখানে যুক্ত হন। এই দুই বাসনার মিলন হলে সেখানে আর্টের প্রশ্ন গৌণ হয়ে পড়ে। কিন্তু বাসনার সংঘাত যখন লাগে, তখন আর্টের লড়াইয়ে কবির টিকে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। বস্তুত, সেই টিকে থাকাটা হয় টেকসই।
হাসান রোবায়েতের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে এই বাসনার সম্মিলন। যে বিপুল মাদ্রাসা-আগত বুদ্ধিবৃত্তিমুখর তরুণ তুর্কি ছড়িয়ে আছে চারপাশে, তাদেরই কাছে তার কবিতা ইদানীং ব্যাপক সমাদৃত। তাদেরই দ্বারা সম্প্রচারিত। তার কবিতার কনটেন্ট তাদের কান ধরে টেনে আনছে বলা যায়। এখানে শিল্পের তর্জনী তোলা বৃথা।
আমার বক্তব্য এটা নয় যে, এই চার জন কবি হিসেবে দুর্বল। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা সমকালের অন্য কবিদের তুলনায় তীক্ষè। কিন্তু যে ধরনের রসদ-সরবরাহ তাদের জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে, তা রসে টইটম্বুর যতটা, ততটা রসোত্তীর্ণ নয়।
অনেকটা উন্নয়ন-নাট্যের মতো। তৃতীয় বিশ্বের দেশে উন্নয়নের গল্প মানেই যেমন দুর্নীতির প্রকটন ও স্বচ্ছতার অনটন। কবিতার জনপ্রিয়তা তেমনি সন্দেহের নীড়ে নিঃশব্দ চিত্তের উচাটন। অন্তত আমার কাছে।
দ্বিতীয় পর্বে প্রীতিলতাকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
ভারত উপমহাদেশের অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই অনেক নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। যেমন ছিলেন অগ্নিযুগের প্রথম পর্বে স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী, আশালতা সেন, সরোজিনী নাইডু, ননী বালা, দুকড়ি বালা, পরবর্তীকালে ইন্দুমতী দেবী, (অনন্ত সিংহের দিদি) লীলা রায়, পটিয়া ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী প্রমুখ দেশপ্রেমিক নারী। তারই ধারাবাহিকতায় সেই অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা, বীরকন্যা প্রীতিলতার আবির্ভাব। ‘বাংলার প্রথম নারী শহীদ’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (৫ মে ১৯১১-২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২)।
শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছেন প্রীতিলতা; চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাসের মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে। এ ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধের পর গ্রেপ্তার হন মাস্টারদা সূর্যসেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা।
১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা শুরু। এই আইনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের অনেক নেতা ও সদস্য আটক হয়। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনাসমূহ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। বিপ্লবী দলের কর্মী প্রীতিলতার নিকটাত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়েন ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’, ‘কানাইলাল’।
প্রীতিলতা যখন ঢাকায় পড়তে যান তখন ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন ছিল। শ্রীসংঘের ‘দীপালী সঙ্ঘ’ নামে একটি মহিলা শাখাও ছিল। লীলা নাগ (বিয়ের পর লীলা রায়)-এর নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করত। গোপনে তারা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজও করত। প্রীতিলতা লিখেছিলেন ‘আইএ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।’
১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আইএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইনস, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। এটি ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে পরিচয় লাভ করে। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবী দলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। প্রীতিলতা লিখেছিলেন ‘পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯ এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐসব বীরের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হলো। কিন্তু ঐ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাস্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম।’
১৯৩০ সালে প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে আসেন। যুব বিদ্রোহের পর তিনি মধ্য কলকাতায় বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসির (গুণু পিসি) বাসায় আশ্রয় নেন। দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। প্রীতিলতা ঐ বাসায় গিয়ে দাদার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে মনোরঞ্জন রায় (ক্যাবলা’দা নামে পরিচিত) নারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ করেন। যুব বিদ্রোহের পর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এবং কারাগারে বন্দি নেতাদের সঙ্গে আত্মগোপনে থাকা সূর্য সেনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ হতো। তারা তখন আরও হামলার পরিকল্পনা করছিল। শহর আর গ্রামের যুবকরা পুলিশের চোখে সবচেয়ে সন্দেহভাজন। এ অবস্থায় সূর্য সেন নারী বিপ্লবীদের এসব কাজের দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কারণ গোয়েন্দা বিভাগ তখনো মেয়েদের সন্দেহ করত না। মাস্টারদার অনুমতি পাওয়ার পর নারীদের বিপ্লবের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করা হয়।
প্রীতিলতার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাস্টারদা লিখেছেন ‘তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোনো চিহ্নই লক্ষ করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখেমুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, ঋরপশষবহবংং নেই, ঝরহপবৎরঃু শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত পঁষঃঁৎবফ ষধফু একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম...।’ মাস্টারদা আরও লিখেছেন ‘তার ধপঃরড়হ করার আগ্রহ সে পরিষ্কারভাবেই জানাল। বসে বসে যে মেয়েদের ড়ৎমধহরংব করা, ড়ৎমধহরংধঃরড়হ চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই বলে।’ তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অবস্থানকালে আগ্নেয়াস্ত্র ঃৎরমমবৎরহম এবং ঃধৎমবঃরহম-এর ওপর প্রীতিলতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রামে সূর্য সেনের কাছে বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফেরত আসার একদিন পরেই ২৪ নভেম্বর মনোরঞ্জন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে তারা রিভলবার নিয়ে আক্রমণ চালান কিন্তু ভুল করে তারা মি. ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এসডিও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনেই পুলিশ বোমা আর রিভলবারসহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে। এই বোমাগু্েলাই কলকাতা থেকে মনোরঞ্জন রায় চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদ- এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্বাসন দ- দেওয়া হয়। ব্যয়বহুল বলে আলিপুর জেলের ফাঁসির সেলে মৃত্যু গ্রহণের প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে আত্মীয়দের মধ্যে কেউ দেখা করতে আসা সম্ভব ছিল না। এ খবর জানার পর মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতার কাছে লেখা এক চিঠিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। মনোরঞ্জন রায়ের মা হিজলী জেলে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলে গোপনে তিনি প্রীতিলতাকে লেখা চিঠিটা তার হাতে দেন। প্রীতিলতা মৃত্যুপ্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার জন্য আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ‘অমিতা দাস’ ছদ্মনামে ‘কাজিন’ পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করেন। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে তিনি প্রায় চল্লিশবার রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি হয়। এই ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তার ভাষায় ‘রামকৃষ্ণদার ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকা-ে সরাসরি যুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।’
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির পর প্রায় নয় মাসের মতো প্রীতিলতাকে কলকাতায় থেকে যেতে হয় বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বাড়ি এসে দেখেন তার পিতার চাকরি নেই। সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে বিশিষ্ট দানশীল ব্যক্তিত্ব অপর্ণাচরণ দে’র সহযোগিতায় তখন নন্দনকাননে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমানে অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়)। তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন।
১৯৩২ সালে বিএ পরীক্ষার পর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা তিনি কল্পনা দত্তকে বলেন। মাস্টারদা ঐ সাক্ষাতের সময় কল্পনা দত্তের কাছ থেকে প্রীতিলতা সম্পর্কিত খোঁজখবর জানতে চান। এরমধ্যে একবার মাস্টারদার সংগঠন চালানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু অর্থের প্রয়োজন দেখা দিল। প্রীতিলতার বাবা সংসারের খরচ চালানোর জন্য মাসিক বেতনের পুরো টাকাটা প্রীতিলতার হাতে দিতেন। তিনি ঐ টাকা সংগঠনের কাজে দিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু তা নিতে কল্পনা দত্ত আপত্তি করায় প্রীতিলতা কেঁদে বলেন ‘গরিব দেখে আমাদের টাকা নিতে চান না। আমি যে নিষ্ঠাবান কর্মী হতে পারব তার প্রমাণ করার সুযোগও কি আমায় দেবেন না?’ প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহের কারণেই কল্পনা দত্ত একদিন রাতে গ্রামের এক ছোট্ট কুটিরে তার সঙ্গে নির্মল সেনের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে ঐ সাক্ষাতে নির্মল সেন প্রীতিলতাকে পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে তা জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন ‘টান আছে। কিন্তু ফঁঃু ঃড় ভধসরষু-কে ফঁঃু ঃড় পড়ঁহঃৎু-র কাছে বলি দিতে পারব।’ প্রীতিলতা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী দলে যুক্ত হন। প্রীতিলতার কথায়... ‘মাতৃভূমির মুক্তির জন্য যেকোনো দুরূহ বা ভয়াবহ ব্যাপারে ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়াইয়া সংগ্রাম করিতে তাহারা ইচ্ছুক ইহা প্রমাণ করিবার জন্যই আজিকার এই বিপদসঙ্কুল অভিযানের (ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ) নেতৃত্ব গ্রহণ করিতেছি।’
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের সশস্ত্র আক্রমণে, ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পরিচিত, এই সময়ে একজন নিহত ও ১১ জন আহত হয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডের কারণে সেদিনের ঐ পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড় ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। বিপ্লবীরা ক্লাবে অগ্নিসংযোগ করে এবং পরে ঔপনিবেশিক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তার রিভলবারটা দিয়ে আরও পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন। গ্রেপ্তার এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
অদম্য উদ্যম আর প্রচ- সাহস বুকে ধারণ করে দেশমাতৃকা ভারতের স্বাধীনতার জন্য সেই অগ্নিযুগে কিছু মুক্তিপাগল মানুষ ‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে সেদিন শামিল হয়েছিলেন বীর চট্টলার বীরকন্যা প্রীতিলতা। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয়, সেই ইতিহাসে যে সব বিপ্লবী রয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রীতিলতা অন্যতম।
‘মানবতাবাদী’ সাহিত্যের বিপক্ষে মাসরুর আরেফিন; ইকতিজা আহসানের সঙ্গে আলাপ। সাক্ষাৎকারের এই বইটি বইমেলা ২০২৩-এ প্রকাশিত। মাসরুর আরেফিনের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইকতিজা আহসান দুই পর্বে।
১. প্রথম পর্ব-২০২০, জুন-ডিসেম্বর। ২. দ্বিতীয় পর্ব-২০২২, অক্টোবর-ডিসেম্বর। সম্পাদনার সময় পুরো সাক্ষাৎকারের ৪ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার মতো লেখা ফেলে দেওয়া হয়েছে এই বই থেকে।
‘মানবতাবাদী’ সাহিত্যের বিপক্ষে বলে এই বইকে একটা শেপে রাখার, দেখানোর মানে দেখি না। এটা কি মার্কেটিংয়ের টুল? একটা ধাক্কা দেওয়া পাঠককে? ধাক্কা দিয়ে কি আগ্রহী করা যায় পাঠককে পাঠে? কেন এটা বলছেন মাসরুর আরেফিন? ২৯৬ পৃষ্ঠার এই বইয়ে প্রবেশের জন্য এই ধাক্কাটা আমার প্রয়োজন নেই। বইয়ের নাম ‘মাসরুর আরেফিনের সাক্ষাৎকার’ই যথেষ্ট ছিল।
সাক্ষাৎকারের ‘র’ ফ্লেবার আপনি এখানে পাবেন না। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পাদনা করে এই বইকে এমন একটা মার্জিত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে বইটাকে সাক্ষাৎকারের বই মনে হয় না বা এরকম সাক্ষাৎকার পড়তে আমরা অভ্যস্তও নই, এ দেশে এমন বইয়ের উদাহরণও কম। বইয়ের প্রথম পর্বে সাক্ষাৎকার গ্রহীতার ভূমিকা খালি চোখে নিরালম্ব মনে হয়। মনে হয় মাসরুর আরেফিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে বলছেন, নিজের এতদিনের কংক্রিট জার্নির রাস্তা নিজে পরখ করে দেখছেন, নিজের ভাবনায় শান দিচ্ছেন, নিজের অবস্থানটা একটা সার্কেলে এঁটে দিচ্ছেন কিংবা নিজের অবস্থান স্পষ্ট করছেন। আবার দ্বিতীয় পর্বে ইকতিজা আহসানকে জেগে উঠতে দেখি। সেখানে তার ভূমিকা একদম পাল্টে যায়। দ্বিতীয় পর্বে মনে হয় মাসরুর আরেফিন আয়নার সামনে কথা বলা ছেড়ে পৃথিবীতে নেমে এসে হাঁটছেন ইকতিজা আহসানের সঙ্গে আর ইকতিজা আহসানও একটা উপায় পেয়ে গিয়েছেন মাসরুর আরেফিনের ভয়াবহ কথার ফ্লোকে কিছুটা দিকে রাখার। নিছক সাক্ষাৎকারের বই না হয়ে বইটা হয়ে উঠেছে রেফারেন্স বুক, বিশ্বসাহিত্য নিয়ে, বাংলা সাহিত্যের বিশ্বমানের লেখা নিয়ে জানতে চাওয়া পাঠকদের জন্য একরকম টেক্সটবুক, মাসরুর আরেফিনের লেখক ও পাঠক সত্তার আত্মজীবনী। এই বইটার প্ল্যানিং প্রায় ৩ বছর আগে হলেও মাসরুর আরেফিনের এমন এক বইয়ের অপেক্ষায় আমি তারও আগে থেকে।
বইটা আমার জন্যই। ২০১৯ এ মাসরুর আরেফিনের ‘আগস্ট আবছায়া’ পাঠের পর আমি খুব আগ্রহী হয়ে উঠি মাসরুর আরেফিনের সাহিত্য যাত্রা নিয়ে জানতে। শুধু তার লেখা নয় তার পাঠ জীবন নিয়েও জানতে, তার ফিলোসফি জানতে।
ইকতিজা আহসান নিজেও মাসরুর আরেফিনের লেখার মুগ্ধ পাঠক বলেই ইচ্ছাকৃতভাবে সাক্ষাৎকারে নিজের সাক্ষাৎকার গ্রহীতার অবস্থান থেকে অনেকটা গুটিয়ে এনে প্রথম পর্বে নিজেকে অলমোস্ট শ্রোতার আসনে বসিয়ে ফুল স্পেস দিয়েছেন মাসরুর আরেফিনকে। এই স্পেসটা ছিল বলেই এই বইয়ে মন খুলে মাসরুর আরেফিন তার কথাগুলো বলে গেছেন। সাক্ষাৎকার শেষে ওয়েল ডিজাইন করা গেছে বইটির এবং আমার জন্য ঠিক এই প্রসেসে বের হওয়া মাসরুর আরেফিনের কথাগুলো শোনার প্রয়োজন ছিল দীর্ঘদিন ধরেই।
এই বইতে যাওয়ার আগে মাসরুর আরেফিনের সাহিত্য যাত্রার এক সামারি করা যাক। মাসরুর আরেফিনের জন্ম ১৯৬৯ সালের ৯ অক্টোবর। প্রথম বই; যেটা কবিতার বই, ‘ঈশ্বরদী মেয়র ও মিউলের গল্প’ প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। সেই একই দিনে একই সন্ধ্যায় মাসরুর আরেফিনের প্রিয় বন্ধু; যার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল হয়নি কোনোদিন সেই ব্রাত্য রাইসুরও প্রথম কবিতার বই ‘আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি বের হয়।
একজন লেখকের প্রথম যখন বই প্রকাশিত হয় তখনই কি কেবল তিনি লেখক হন? মোটেও না। একজন লেখক প্রথমে হন পাঠক। পাঠ করতে করতেই একসময় লেখক সত্তার বীজ আসে ভেতরে। সেটা ধীরে ধীরে লিখতে লিখতে, পড়তে পড়তেই বাড়তে থাকে। এই বীজটা প্রথম যেদিন আসে সেদিন থেকেই তিনি লেখক। সম্ভবত বরিশাল ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়ই মাসরুর আরেফিনের ভেতর এই বীজ আসে। সবার সামনে লেখক হিসেবে প্রকাশিত হন কবিতার বই প্রকাশের মাধ্যমে ২০০১ সালে।
এরপর ২০১৩ সালে তার প্রথম অনুবাদ ‘ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র’ প্রকাশিত হয়। এর দুই বছর পর প্রকাশিত হয় তার অনুবাদে হোমারের ‘ইলিয়াড’। এরপর ২০১৯ সালে এক বিস্ফোরণ ঘটান বাংলা সাহিত্যে তার প্রথম উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ দিয়ে। এর পরের বছর ২০২০ সালে প্রকাশ করেন তার দ্বিতীর উপন্যাস ‘আলথুসার’ ও দ্বিতীয় কবিতার বই ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’। তার পরের বছর ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় মাসরুর আরেফিনের তৃতীয় উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ ও তৃতীয় কবিতার বই ‘পরিস্থিতি যেহেতু আগুন হয়ে আছে।’ এর পরের বছর ২০২২ এ প্রকাশিত হয় তার চতুর্থ উপন্যাস ‘আড়িয়াল খাঁ’। এই বইমেলায় (২০২৩) প্রকাশিত হলো এই সাক্ষাৎকার গ্রন্থ।
৪টি উপন্যাস, ৩টি কবিতার বই, দুটি ঢাউস অনুবাদ গ্রন্থ আর এই সাক্ষাৎকার গ্রন্থ মিলে অবাক কি লাগে না যে, ২০০১ এ প্রথম কবিতার বই প্রকাশের পর তার মৌলিক গ্রন্থ নিয়ে ১৮ বছর পর কেন এলেন একজন মাসরুর আরেফিন?
এই ১৮ বছর মাসরুর আরেফিন নিবিড় প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছেন। তিনি কখনো একদিনের জন্য সরে আসেননি তার প্রবল পাঠ ও নিয়ম করে বসে লেখালেখি থেকে। আপনাদের অনেকের কাছে মাসরুর আরেফিনের ব্যাংক এমডি পরিচয় মুখ্য মনে হলেও আমার কাছে তিনি সাধক, সাহিত্যের সাধক। তিনি চাইলেই প্রতি বছর ১টা করে ১৮ বছরে ১৮টি বই বের করতে পারতেন। করেননি। তিনি সময় নিয়েছেন নিজেকে শাণিত করতে, পাঠে নিমগ্ন থেকেছেন জীবনের অপার প্রয়োজনে, নিজেকে বৈশ্বিক পরিসরে বিশ্বমানে প্রকাশ করতে।
এই দীর্ঘ বিরতির পর তিনি যখন ‘আগস্ট আবছায়া’ উপন্যাস নিয়ে প্রকাশিত হলেন ঘনবদ্ধ হয়ে, নিশ্চিত হয়ে, তখন যারা সাহিত্যের এই ফিল্ডে বিচরণ করছেন তাদের অনেকে হঠাৎ করে বাংলা সাহিত্যের বড় একটা অংশে নিজেকে বসিয়ে দেওয়া মাসরুর আরেফিনকে নিতে নারাজ। তারা বিবিধ দোষ পেতে থাকেন মাসরুর আরেফিনে। বিনয় পান না, এলিট শ্রেণির, ব্যাংক এমডি ইত্যাদি ইত্যাদি। তা পেতে থাকুন তারা, কিন্তু ২০১৯ সালকে আমার অস্বীকার করার জো নেই কারণ এই বছর দীর্ঘ সাধনার পর সাড়ে চার বছর ধরে লেখা ‘আগস্ট আবছায়া’ বাংলা সাহিত্যে অবতরণ করে। এক ইলিয়াডের অনুবাদ বাদে মাসরুর আরেফিনের সব লেখাই আমার পড়া। সব সাক্ষাৎকারও দেখা (ইউটিউবে যেগুলো পাওয়া যায়)। মাসরুর আরেফিনের শুধু লেখা নয়, তার এই সাহিত্যের এই টোটাল যাত্রাপথ আমার আগ্রহের বিষয়। আমার ধারণা ছিল একজন ব্যাংকার ভালো সাহিত্যিক হতে পারেন না যেহেতু তাকে স্ট্রেসড, স্ট্রাকচার্ড একটা জীবনের ভেতর গেঁথে থাকতে হয়। সেখানে সময় খুব হিসেবের, বেহিসেবী হওয়ার সুযোগ নগণ্য। এইদিক দিয়ে সাহিত্যে মাসরুর আরেফিনের সবল উপস্থিতি আমার ধারণা পাল্টে দিয়েছে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য, শহীদুল জহিরের সাহিত্য মাসরুর আরেফিনকে অ্যাট্রাক্ট করে না জেনেও শওকত আলীর ‘পিঙ্গল আকাশ’ আর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ কিংবা মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন এর কোনো উল্লেখ না দেখাটা রীতিমতো কষ্টের ছিল। বিশেষ করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে যেভাবে খারিজ করেছেন তাতে ছুরি দিয়ে কেউ আমার হৃদয়ে আঘাত দিয়ে গিয়েছে যেন। এই বইতে ইন্টারেস্টিংলি দেখতে পাওয়া যায় লেখক তার নিজের বই নিয়ে বলতে যতটা না উৎসাহিত তার চেয়ে ঢের উৎসাহী বলতে তার পছন্দের দেশি ও বিদেশি সাহিত্যিকদের নিয়ে। এতটা ইনভলভড আর অ্যাটাচড হয়ে বলা যে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়, ঘোরে পড়ে যেতে হয়। আমি বইটা পড়ার সময় আমার সুবিধার জন্য কোট করছিলাম বই আর লেখকদের নাম। বইয়ের বেলায় ৯৫টা নাম লিখে থেমে যাই আর লেখকদের নাম ১০০-এর মতো লিখে দমে যাই।
যে সব লেখক ও যেসব বই লেখকের পছন্দের তা নিয়ে এমনভাবে বলে গেছেন যে, এমনভাবে উসকে দিয়েছেন আপনি না পড়ে থাকলে ব্যর্থ ভাববেন নিজেকে, লো ফিল করবেন। আবার আপনি চাইলে এই বইয়ের মণি-মুক্তো নিয়ে আাগামী কয়েক বছরের পাঠের একটা দিকরেখা তৈরি করে ফেলতে পারেন যদি বৈশ্বিক লেখক হতে চান, যদি বৈশ্বিক নিবিড় পাঠক হতে চান বা এই যে আমাদের চোখের সামনের পৃথিবী তার ঢাকনাটা খুলে পৃথিবীর ভয়ংকর সত্যটা জানতে চান।
এই বই আমার জন্য এক দুর্দান্ত সংগ্রহ, মাঝে মাঝে উল্টে পাল্টে দেখার জন্যও এবং যেকোনো পাঠকের জন্যও তাই হবে।
কবি মজনু শাহ্ ইতালি থাকেন। তিনি সাহিত্যাঙ্গনে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে দুটি মোক্ষম স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ কবি, এই সময়ের সবচেয়ে ভালো কবি, এভাবে বলাটাই, অতিরঞ্জন। এই যুগ, একসঙ্গে, অনেক ভালো লেখকের।
স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে, আশির দশকের কয়েকজন কবির থেকে, দুর্দান্ত কিছু বই আমরা পেয়েছি। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, জুয়েল মাজহার, কাজল শাহনেওয়াজ, শান্তনু চৌধুরী, বিষ্ণু বিশ্বাস, শোয়েব শাদাব, সাজ্জাদ শরিফ... এমন আরও কয়েকজন। যে কোনো বাখোয়াজি করার আগে, ভালো করে পড়া দরকার এনাদের বইগুলো। ৩০ বছরের বেশি ॥
সময় ধরে এই কবিরা, দুই-একজন বাদে, পুরো মাত্রায় লিখে চলেছেন, যারা এদের পড়েননি, তারা কবিতার পাঠকই নয়।’ সাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা যে কারণে খারাপ শিরোনামে আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘যে কোনো সৃষ্টিকর্ম, প্রতিযোগিতা করে উৎকর্ষের দিকে যায় না। একজন স্রষ্টা, ছাড়িয়ে যেতে পারে কেবল নিজেকেই।’
অন্যদিকে, খেলা বা সমাজে আর বৃত্তিমূলক কাজে দরকার হয় প্রতিযোগিতার, নইলে আরও ভালো করার তাগিদ, আনন্দ, এমনকি, ব্যবসায়িক লক্ষ্যহারা হয়। ১০০ মিটার দৌড়ে শ্রেষ্ঠত্ব দরকার, নইলে ঐ খেলা, প্রথমত, উত্তেজনা হারায়।
আপনি কি বলতে পারবেন, গোলাপ সুন্দরী, আরণ্যক বা মহিষকুড়ার উপকথার লেখকদের মধ্যে কে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড হলেন?
সমাজে তবু শ্রেষ্ঠ বানানোর পাঁয়তারা আছে। কারণ এসবের ভেতর দিয়ে শিল্প-ব্যবসা, মিথ/আইকন তৈরি, পুরস্কারের ধান্দাবাজি, সেই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ-ঘোষিত শিল্পীর সমান্তরালে অন্য শিল্পীদের গৌণ করে তোলার আয়োজন খুব চতুরভাবে করে ফেলা যায়।’
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
বছরে ৪০ কোটি ডলার পারিশ্রমিকের প্রস্তাব নিয়ে লিওনেল মেসির সংগে যোগাযোগ করছে আলো হিলাল। তারা মংগলবার চুক্তির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে বলে জানিয়ে রেখেছে। কিন্তু মেসি তাদেরকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রস্তাবটা পিছিয়ে দিতে বলেছেন বলে খবর দিয়েছে ফুটবল বিষয়ক ওয়েব পোর্টাল গোল ডটকম।
তবে সৌদি ক্লাব এ-ই প্রস্তাব এখনই গ্রহন না করলে আগামী বছর তা একই রকম থাকবে না বলে জানিয়েছে।
মেসি আসলে তার শৈশবের ক্লাবে আরো অন্তত এক বছর খেলতে চান। তাতে তার পারিশ্রমিক সৌদি ক্লাবের প্রস্তাবের ধারে কাছে না হলেও ক্ষতি নেই। জানা গেছে, বার্সা তাকে এক বছরে ১৩ মিলিয়েন ডলার পারিশ্রমিক প্রস্তাব করতে যাচ্ছে।
লা লিগা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ায় মেসিকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে বার্সা। ধারনা করা হচ্ছে বুধ-বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ ব্যাপারে একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।