
নেরুদা বললেন, অচিরেই তুমি বিখ্যাত হতে চলেছ মারিও বার্গাস যোসা এবং বলে দিচ্ছি, কী কী থাকছে তোমার জন্য। তুমি যত আক্রান্ত হবে, তত বিখ্যাত হবে। প্রত্যেকটি প্রশংসার জন্য থাকবে দুই রকম ফলাফল। আমার নিজের বুক অপমান, পাষ-তা আর কুখ্যাতিতে ভরা। এসব সহ্য করা এক লোক আমি। কেউ আমাকে ছাড়েনি। চোর, বদমাশ, বিশ্বাসঘাতক, ঠগ, ব্যাভিচারী এক কথায় সবই। যদি তুমি বিখ্যাত হও এসবের মধ্য দিয়ে তোমাকে যেতে হবে। যোসা এক সাক্ষাৎকারে এ কথা উল্লেখ করেন মায়াময়ভাবে। বললেন, কেবল আমার বুক নয়, পরিচিতজনদের অপমানপূর্ণ লেখাজোখায় আমার বেশ কিছু সুটকেস ভর্তি হয়ে আছে।
মারিও বার্গাস যোসা বিশ্ব সাহিত্যের এক অনন্য নাম। কিন্তু তিনি নিঃসঙ্কোচে ঋণ স্বীকার করেছেন, বিশ্ব সাহিত্যের আরেক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক হোর্হে লুই বোর্হেসের কাছে। যোসাকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি। বোর্হেসের প্রতি তার এই মুগ্ধতা এক অন্যমাত্রায় উপনীত হয়। এ সম্পর্কে যোসা নিজেই বলেছেন ‘ইটস আ সিনফুল প্যাশন’। বোর্হেস তিনি বারবার পাঠ করেন। কোনোবারই তিনি হতাশ হন না। যোসা বলেন, প্রত্যেকবার নতুন পাঠ তাকে উদ্দীপিত ও আনন্দিত করে। যে বোর্হেস তাকে এড়িয়ে চলতেন, সেই বোর্হেসের প্রতি তার মুগ্ধতা কখনো কমেনি বরং বেড়েছে। বোর্হেস তাকে প্রতিবারই নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে দিয়েছেন। যোসার ভাষায় : পৃথিবীর যে সৌন্দর্য ও মনন তিনি তৈরি করেছেন, তা আমার নিজের সীমাবদ্ধতাকে আবিষ্কারে সাহায্য করেছে। এমনকি তার মুখ ফিরিয়ে থাকাও আমার মুগ্ধতা একবিন্দু কমায়নি। বিশ বছরের মধ্যে বোর্হেসের দুটো সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তিনি। তেত্রিশ বছর বয়সে মারিও প্রথম দেখেছিলেন বোর্হেসকে। প্যারিসে। এ সময় বোর্হেসের একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পান, দীর্ঘ কথোপকথন। এ সঙ্গে তিনি দেখেছেন, প্যারিসে বোর্হেসের চোখ ধাঁধানো বিজয়।
বহুমাত্রিক লেখক বোর্হেস খ্যাত তার ছোটগল্পের জন্য। সাহিত্যজীবনে একাধারে কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সাহিত্য সমালোচনাও লিখেছেন তিনি। অনুবাদক হিসেবেও করেছেন অসাধারণ সব কাজ। তার অনন্য সাহিত্যকর্ম অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে গার্সিয়া মার্কেজ, মিশেল ফুকো এবং মারিও বার্গাস যোসার মতো পরবর্তী প্রজন্মের বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকদের।
হোর্হে লুইস বোর্হেসের প্রথম সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়কাল ১৯৬৩ সাল। তার ব্যক্তিগত ভা-ার থেকে লেখাটি উদ্ধার করে যোসার ওয়েবসাইটে ‘অপ্রকাশিত ও বিরল বিভাগ’-এ প্রকাশিত হয়।
সাক্ষাৎকারে বার্লিনে অনুষ্ঠিত জার্মান ও লাতিন আমেরিকান লেখকদের একটি সম্মেলনের অনুভূতি প্রকাশ করেন বোর্হেস। সম্মেলন তাকে বিষণœ ও বিস্মিত করেছিল। সেখানে তিনি দেখেছেন সাহিত্যিকরা সাহিত্যে কম, রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছেন বেশি। ফ্রান্সে বোর্হেসের অভাবনীয় পাঠক ছিল। বেশ কয়েকটি পত্রিকা তার কাজ সম্পর্কে বিশেষ সংখ্যা করে। তার বক্তৃতা শোনার জন্য যারা সভাস্থলে প্রবেশ করতে পারেননি তাদের জন্য বাইরে সাউন্ডবক্স স্থাপন করা হয়েছিল। এটা তাকে নিজের সম্পর্কে বিস্ময়কর অনুভূতি দিয়েছে বলে যোসার কাছে বলেছেন।
যোসা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এটি নির্জন দ্বীপে যদি পাঁচটি বই নিয়ে যেতে হয় তাহলে কী কী নেবেন? মনে হয় গিবনের ‘হিস্টরি অব ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার’ সঙ্গে নেব। মনে হয় না কোনো উপন্যাস নিয়ে যাব, বরং ইতিহাসের একটা বই নিয়ে যাব। ধরা যাক, এটা হবে দুই খন্ডের একটা সংস্করণ। এরপর আমি নিতে চাই অন্য আরেকটা বই, যেটা আমি পুরোপুরি বুঝিনি, অতএব বারবার পড়ে বোঝার জন্য নিয়ে যাব রাসেলের ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ফিলোসফি’; বা আঁরি গোইঙ্কায়ের কোনো বই। এটাও আমার নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। তিন খন্ড হলো। এরপর চোখ বুজে এনসাইক্লোপিডিয়ার যে কোনো একটা খন্ড। ওর মধ্যে অনেক লেখা পাওয়া যাবে, তবে সত্যিকারের এনসাইক্লোপিডিয়া নয়। কারণ সত্যিকারের এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো পরামর্শমূলক বই, আমি বরং ১৯১০ বা ১১ সালের দিকে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া চাই, ব্রোখাস মেয়ারের কোনো খ- বা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার কোনো খ- অর্থাৎ এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো তখনো পর্যন্ত ছিল পাঠ করার মতো বই। তো চারটা বই পেলাম। এরপর শেষটার ক্ষেত্রে একটা চাতুরী করা যাক, এমন একটা বই নিয়ে যাব, যেটা নিজেই একটা গ্রন্থাগার অর্থাৎ আমি বাইবেল নিয়ে যাব। এবার কবিতা প্রসঙ্গ, যেহেতু এই তালিকার মধ্যে এটা অনুপস্থিত; অতএব, এর দায়িত্ব আমি নিজের ওপর চাপিয়ে দেব। সুতরাং কবিতা পড়ার দরকার হবে না। তা ছাড়া আমার স্মৃতিভা-ার কবিতা দ্বারা এতটাই সমৃদ্ধ যে, মনে হয় কবিতার বইয়ের আর দরকার পড়বে না। আমি নিজে নানা ধরনের সাহিত্যের একটা সংকলনের মতো। যে আমি নিজের জীবনের ঘটনাবলি স্মরণ করার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য নই, সে-ই আমি অসংখ্য কবিতা একঘেয়েভাবে বলতে পারব লাতিন, স্পানঞল, ইংরেজি, প্রাচীন ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয়, পর্তুগিজ ভাষায়।’ এ রকম অজস্র হৃদয়গ্রাহী কথোপকথন রয়েছে আলাপ পরস্পরে। রাজু আলাউদ্দীন অসম্ভব পরিশ্রমী একজন লেখক। আমি চেষ্টা করি তার সব লেখাই মোটামুটি পড়ার জন্য। তবে বিষয়গত আগ্রহের জায়গা থেকেই রাজু আলাউদ্দীনের বইটি সংগ্রহ করা। যাদের বোর্হেস এবং যোসা সম্পর্কে আগ্রহ আছে, তারা নির্দ্বিধায় বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। পাঠক সমাবেশের সমাবেশ প্রকাশনা এটি। বইটির বিক্রয়মূল্য পাঠক সমাবেশের অন্যান্য বইয়ের মতোই বেশি।
আজকের লেখকরা যখন কে মহান আর কে কালোত্তীর্ণ, আর কে ছোট আর কে তুচ্ছ এসব বাগ-সংলাপে মত্ত সে সময় বইমেলা-২০২৩-এ প্রকাশ হলো এই অনন্য সাক্ষাৎকার গ্রন্থ। অগ্রজ লেখক সম্পর্কে একজন অনুজ লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি জানার এক অনন্য সুযোগ এই ছোট্ট বইটি। আমাদের সময়ে অশ্রাব্য আলাপে পরস্পর লেখকরা কিন্তু অনেক সময়ক্ষেপণ করেন। পরস্পর পরস্পরকে অতিক্রম করার প্রচেষ্টার, এসব কথা চালাচালি যে পাঠক মনকে আহত করে, তা হয়তো তারা বুঝতে চান না। সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে শিল্পজনরা কি মহৎ আর আলোকময় কিছু আলাপ করতে জানে না! অনুজ লেখকরা কি অগ্রজদের ভালোবাসতে জানে না!
অচির অর্থ ক্ষণস্থায়ী। অরোরা মানে ঊষাকাল, আবার হিন্দু ও গ্রিক মতে ভোরের দেবী। বইয়ের নাম অচির অরোরা, মানে কি ক্ষণস্থায়ী ভোর! এখানে অরোরা বাহুল্য। অথচ অচির অরোরা শুনতেই ভালো লাগছে। বাহুল্যও সর্বদা বর্জনীয় নয় বলেই কি ভাবেন কবি! অচির অরোরা শব্দদ্বয় মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে প্রথম যখন বইটা চোখে পড়ে।
‘অচির অরোরা’ ছোট্ট একটা কবিতার বই, যা এই বইমেলায় ‘বাতিঘর’ প্রকাশ করেছে। আল ইমরান সিদ্দিকীর চতুর্থ কবিতার বই। তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। বইয়ের ভূমিকায় লেখা কবিতাটি কবির দেশ ছেড়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে প্লেনে ওঠার আগমুহূর্তে লেখা! বইতে ভূমিকার এই কবিতাটিসহ ধরলে, আসলে ৩৪টি কবিতা আছে। কবি আল ইমরান সিদ্দিকীর কবিতাগুলো স্নিগ্ধ হয়ে উঠতে চায়, শান্ত একটা পরিবেশ তৈরি করে। ৩৪টি কবিতার একটি কবিতা যেটা ভূমিকায় জায়গা পেয়েছে, সেটা কেবল দেশে বসে লেখা। আসলে কি দেশে বসে? দেশ আর ভিনদেশে যাওয়ার মাঝামাঝি অন্যরকম এক অনুভূতির দেশে বসে লেখা। বাকি কবিতাগুলো প্রবাসেই লিখেছেন কবি। দেশ ছাড়ার আগে কবি লিখেছেন, ‘তোমার মুখ মনে পড়ে। একদিন তুমি এসে দাঁড়িয়েছিলে আমার কাছে, যেন পাতাশূন্য গাছের পাশে ফুলভর্তি সাইকেল, গোধূলিরঙিন দুনিয়ায়া।’ এখানে পাতাশূন্য গাছ কি কবির আগেকার কোনো এক সময়ের জীবনের সিম্বল? কখন জীবন পাতাশূন্য মনে হয়? কখন প্রিয়জনের একদিনের আগমন মনে হয় শূন্য হৃদয়ের কাছে সাইকেল ভর্তি ফুল নিয়ে আসা? কী সুন্দর হাহাকার সমেত মুহূর্ত আর ইমেজ এখানে! আবার এই ভূমিকা কবিতায় লেখা, ‘আজ তুমি আমার রাস্তায় আঁকা ক্ষয়ে যাওয়া কোনো তীর চিহ্ন।’ তীর চিহ্ন আঁকা তবে তা ক্ষয়ে যাওয়া। পথের প্রকৃত নির্দেশ যখন নাই। সম্পর্ক যখন আর সম্মোহনী নাই। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে এই ক্ষয়ে যাওয়া তীর চিহ্ন, ফুলভর্তি সাইকেল সব কেমন মন-মরা অথচ সুন্দর হয়ে থাকে যেমত গোধূলি এক নীরব বেদনায় আঁকড়ে রাখে পৃথিবী। যেন সুন্দর হয়ে ওঠে এখানে চিরন্তন। সুন্দর কিছু মুহূর্ত বই থেকে পেয়ে পাঠ শেষে বই থেকে বেরুতে গিয়ে ভাবি, ভূমিকা কবিতার পর এই বইয়ের প্রথম কবিতাটি আর শেষ কবিতাটি বাকি কবিতাগুলো থেকে যথেষ্ট আলাদা করা যায়। বইয়ের প্রথম কবিতায় প্রবাস যাপনের দুঃখবোধ নুয়ে থাকে দেশে থাকা বাবা-মাকে আবর্তন করে। আমার ধারণা, বইয়ের প্রথম কবিতাটি নিয়ে বেশ কথা হবে সামনের কবিতাপৃথিবীতে।
‘এই যে বৃদ্ধ লোকটি লম্বা দাড়ি, মাথায় হ্যাট, রংচটা জিনস, পপলিনের শার্ট রবিবার চার্চের দিকে যাচ্ছে, এই লোকটিকে আমি দেখেছি আমার দেশেও মেহেদি দেয়া দাড়ি, মলিন সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি-মসজিদের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।’ হৃদয়ে যেন দেশে থাকার বোধে আচ্ছন্ন তখন কবি। আলাদা ধর্মের, আলাদা আচারের হলেও কবি চার্চে যাওয়া লোকটার ভেতর দেশি মানুষকেই রিলেট করেন, ধর্মাচারকে প্রাথমিক ক্রাইটেরিয়া ধরে এখানে সিমিলারিটি রোপণ করে। আদতে নিজের দেশকে খুঁজছেন কবি এখানে। ‘ওকের সুগন্ধে ভরে আছে চারপাশ; এ গোধূলি রক্তিম ওয়াইন।’ এখানে গোধূলিকে বলা হচ্ছে রক্তিম ওয়াইনের মতো। মুহূর্তটা বিবশ হতে চাওয়ার আগের মুহূর্ত। বিষণœতায়ও মাধুরী মিশিয়ে রেখেছেন কবি এখানে। ‘আমার পায়ের পেছন দিয়ে অর্থাৎ/ আমার ফেলে আসা দিন ও আমার মাঝখান দিয়ে/ এক পাতা উড়ে যায়, ধীরে।// তারপর উড়ে উড়ে সামনে এসে পড়ে;/ আমি হাতে তুলে নিই,/ আমি বসি,/ আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরখ করি মমতায়;/ বারবার এমনই হয়/ তোমার স্মৃতি এমনই।’
এখানে দেখি কবির ফেলে আসা চুম্বকীয় স্মৃতি মমতায় সবুজ (রঙিন) করে দেখছেন। এখন যে জীবন; তার অনেক পেছনে ফেলে আসা যে সে জীবন। বইয়ের এইখানে কিছুটা চুপ হয়ে যেতে হয়। সাদাকালো এক দৃশ্যের ভেতর নম্র হয়ে পড়তে থাকা সবুজ এক মনোরম পাতা ধীরলয়ে উড়তে দেখতে পাই। বিষণœতার সুন্দর সব ছবি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই বইতে, যার বেশিরভাগই প্রকৃতিকে হৃদয়ে নিয়ে। শেষ কবিতাটি বাদে (যেখানে ছন্দের খেলায় নড়েচড়া ওঠা কবিতাটি ইতি টানে বইটির), ধীর একটা মেলানকলি সুর বহমান প্রায় সব কবিতাতেই। প্রবাস জীবনের দৃশ্যাবলি, নস্টালজিয়া, বিষণ্ন অনুভূতি, যা রোজকার ইরেজার দিয়ে ঘষে তোলা যাবে না, তা-ই যেন এই অচির অরোরা।
কবিতাগুলো সহজে পড়ে ফেলা যায়, স্বতঃস্ফূর্ত; দৃশ্যে সহজে নেমে পড়া যায়, আবার সেই দৃশ্য থেকে উঠেও আসা যায়। দৃশ্যগুলো দামামা বাজায় না, ডে-অফের দৃশ্য মনে হয় যখন অবসর মিলে দেখার, মাপার জীবন! এই বইতে আদতে নিজের যাপনকেই এঁকেছেন কবি আল ইমরান সিদ্দিকী কবিতার ভাঁজে ভাঁজে, এবার পাঠকের কাজ ভাঁজ খুলে ঘ্রাণ মগজে ও আত্মায় নিয়ে নেয়া।
তৃতীয় পর্বে ক্ষুদিরাম বসুকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
আমি হাসি হাসি পরবো ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী... একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি... মানুষের মুখে মুখে ফেরা পীতাম্বর দাসের লেখা এই গান বাঁচিয়ে রেখেছে প্রথম বাঙালি শহীদ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে (১৮৮৯-১৯০৮)।
মেদিনীপুর জেলার হাবিবপুর গ্রামে ক্ষুদিরামের জন্ম। ছয় বছর বয়সে মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর মৃত্যু এবং একই বছরে পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু মারা গেলে বড় বোন তাকে লালন-পালন করেন। এর আগে তার দুই ভাই মারা যায়, তাই ক্ষুদিরামের বড় দিদি অপরূপা দেবী তিন মুঠো খুদ (চালের ভাঙা অবশিষ্ট) দিয়ে তার এই ভাইটিকে কিনে নেন। খুদ দিয়ে তাকে কেনা হয়েছিল বলে নাম হয় ক্ষুদিরাম। গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর তমলুকের ‘হ্যামিল্টন’ স্কুল ও তারপর ১৯০৩ সালে মেদিনীপুরের ‘কলেজিয়েট’ স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন ক্ষুদিরাম। পড়াশোনায় মেধাবী ক্ষুদিরাম ছিলেন দুরন্ত, দুঃসাহসী।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলন স্কুলের ছাত্র ক্ষুদিরামকে প্রভাবিত করে। ফলে পড়াশোনা ছেড়ে সত্যেন বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেন। আরও কয়েকজনের সঙ্গে সেখানে শরীরচর্চার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা শুরু হয় ক্ষুদিরামের। এ সময়ে পিস্তল চালনায় তার হাতেখড়ি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় পোড়ানো ও ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত লবণে বোঝাই নৌকা ডোবানোর অভিযানে ক্ষুদিরাম অংশ নেন।
ক্ষুদিরামের প্রাণ ছিল দরদি। আর তার মধ্যে ছিল মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। কারও অসুখ শুনলে ক্ষুদিরামের প্রাণ কেঁদে উঠত। জনগণের সেবাই ছিল তার ব্রত। প্রকৃতির নানা দুর্যোগে মানুষের সাহায্যের জন্য তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করে রিলিফ-ওয়ার্ক করেছেন।
স্বদেশি আন্দোলন শুরু। চারদিকে বিদেশি জিনিসের বয়কট চলছে। বিলিতি কাপড়, বিলিতি নুন লুট করার কাজে নেতারা লেগে গেছেন। চারদিকে ব্রিটিশ জাতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু। এ সময়ে ১৯০৬ সালে মেদিনীপুরে মারাঠা কেল্লায় কৃষিশিল্প প্রদর্শনী মেলা বসে। এই মেলা প্রাঙ্গণে সোনার বাংলা নামে বিপ্লবী পুস্তিকা বিলি করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম প্রথম রাজনৈতিক অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ক্ষুদিরাম হঠাৎ সেই সময়ে পুলিশের বাধা পেলে পুলিশের বুকে এক প্রচণ্ড লাথি মেরে পালিয়ে যান। কেউ তাকে ধরতে পারে না। প্রায় তিন মাস পার হয়েছে, তখন তিনি ধরা পড়লেন। বিপ্লবীদের এই বই কোথা থেকে বেরিয়েছে সেই গোপন কথা জানার জন্য পুলিশ ক্ষুদিরামের ওপর চরম অত্যাচার শুরু করে, কিন্তু একটি কথাও তিনি প্রকাশ করেননি, বলেননি সতীর্থদের নাম। মুখ বুজে সব সহ্য করেছেন। কোনো কথা আদায় করতে না পেরে তখন ব্রিটিশ সরকার ক্ষুদিরামকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার বিপ্লবীদের মুখে মুখে ক্ষুদিরামের প্রশংসা। ১৯০৭ সালে হাটগাছায় ডাকের থলি লুট এবং নারায়ণগড় রেলস্টেশনের কাছে বঙ্গের ছোটলাটের বিশেষ রেলগাড়িতে বোমা আক্রমণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ক্ষুদিরাম। একই বছরে মেদিনীপুর শহরে অনুষ্ঠিত এক রাজনৈতিক সভায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
সুরেন্দ্রনাথ পরলোকগমন করলেও তার প্রেরণা রয়ে গেল বাংলার তরুণদের মধ্যে। দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে এলেন ক্ষুদিরামসহ আরও অনেকে। তারা ছিলেন অগ্নিযুগের শহীদ।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের প্রয়োজনভিত্তিক কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে কলকাতার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। যুগান্তর বিপ্লবী দল ১৯০৮ সালে কিংসফোর্ডকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের ওপর এ দায়িত্ব পড়ে।
কর্র্তৃপক্ষ কিংসফোর্ডকে কলকাতা থেকে দূরে মোজাফ্ফরপুরে সেশন জজ হিসেবে বদলি করে দিয়েছিল। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮, দুই যুবক স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়ালে অতর্কিত আক্রমণের জন্য অ্যামবুশ পাতেন। কিন্তু কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো অন্য একটি গাড়িতে ভুলবশত বোমা মারলে গাড়ির ভেতরে একজন ইংরেজ মহিলা ও তার মেয়ে মারা যান। এ ঘটনার পর ক্ষুদিরাম ওয়ানি রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তিনি বোমা নিক্ষেপের সব দায়িত্ব নিজে স্বীকার করেন। ব্রিটিশ পুলিশের চরম নির্যাতনের মুখেও প্রফুল্ল চাকীসহ অপর কোনো সহযোগীর পরিচয় বা কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করেননি। বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য অনুসারে, মোজাফ্ফরপুর কারাগারে ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর করধা হয়।
সব কিছু ত্যাগ স্বীকার করে অন্তত জীবন রক্ষা করা ক্ষুদিরামের পক্ষে কঠিন ছিল না। তার এই উজ্জ্বল উদাহরণে দেশের হাজারো তরুণ-তরুণী প্রেরণা লাভ করে। স্বাধীনতার বেদিতে ক্ষুদিরামের জীবনের এই উৎসর্গ উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বাংলা কাব্যে, সাহিত্যে, সংগীতে ও ইতিহাসের পাতায় এই আত্মবলিদানের মধ্য দিয়েই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আছেন।
প্রেমের কবিতা
প্রেমের কবিতা পারি না!
আমি গাই আগুন-লাগা নারী,
তারে জাপটে ধরি, বলি,
আমি গাঙে ভাসা ছেলে,
আমার সারা অঙ্গে পানি!
আমারে জড়াও তোমাতে
আর দহন করো দান,
বিনিময়ে আমি তোমার
ফেলা দেওয়া সন্তান!
মাটির খাদ্য
মানুষ একটা ফলের নাম। মাটির খাদ্য।
ঝরে পড়লে মাটির মুখে তুলে দিতে হয়।
কাউকে রান্না করে আর কাউকে কাঁচা।
বিষ
সাপের বিষ আছে।
মানুষের বিষ নাই।
সাপের কামড়ে সাপ মরে না।
মানুষের কামড়ে মানুষ মরে।
মানুষ তার শৈশবের কঙ্কাল
আমি আমার শৈশবের কঙ্কাল
অচেনা সময়ের কাঁটাতারে ঝুলে আছি
যে মাটিতে গোলাপ ফোটাতে চেয়েছিলাম
সে আমার কবর হওয়ার জন্য দম ধরে বসে আছে।
মানুষের ভূমিকা পালন
বিষয়ের ভূমিকা
নদী দাঁড়াতে পারে না। শুয়ে থাকে।
মাঝে মাঝে তার দাঁড়াতে ইচ্ছা করে
এই ইচ্ছার নাম ঢেউ।
ঢেউ খুব বড় হলে পাড় ভেঙে
নদী চলে যায় নদীর বাইরে।
বাইরে গিয়ে শুয়ে থাকতে হয়।
এইভাবে দেখা গেছে শুধু নদী না
পানির শরীর যার যার
তারা সকলেই জন্ম থেকেই শায়িত
দাঁড়াতে গিয়ে অঘটন ঘটায়।
অন্যদিকে মানুষ হাঁটতে পারে। শুতে পারে
ঘুমানোর সময় মূলত শুতে হয়
দাঁড়িয়ে বা হেঁটে মানুষ ঘুমাতে পারে না।
এই জন্য মানুষের বিছানার দরকার হয়।
নদীর বিছানা মাটি। নদীরে নদীর মতো
করে রাখে যে-পার দুইটি
তারাও মাটির তৈরি।
মাটি কিছু পানি চুষে নেয়
নিয়ে গাছগাছালিরে ফুল-ফল দেয়
নদী তাতে রাজিই থাকে।
খুব ঠা-া পড়লে নদীর বরফ হয়ে
থেমে যেতে হয়। তাই সূর্য তারে সাহায্য করে
বিনিময়ে কিছু পানি সূর্যও নিয়ে যায়
নিয়ে মেঘ বানায়।
মেঘ ঝরলে বৃষ্টি হয়
গাছগাছালির ওপর পড়ে।
ফুল-ফল ভালো হয়।
মানুষ তা খায়। পশু-পাখিও খায়
মাটি, নদী বা সূর্য কিছু খায় না
নদীতে আবার মাছ ইত্যাদি থাকে
মানুষ জাল ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরে খায়
কিন্তু মানুষের নদীর বা সূর্যের বা মাটির মতো
কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না।
কেন দেখা যায় না তা তারাই ভালো জানে।
মা
যখন আমার চতুর্দিকে
জ্বলে বিষের আগুন,
কৃষ্ণচূড়ার লালে লালে
যখন আসে ফাগুন।
তখন মায়ের মুখ,
দেয় ভরিয়ে বুক।
যখন আমি নীল-হতাশায়
শূন্য-আচ্ছাদিত,
মা আমাকে কোলের মধ্যে
ঠিক জড়িয়ে নিতো।
মা মানে তো মাতা
মাথার ওপর ছাতা।
মা মানে তো ভালোবাসার বাড়ি
মনে পড়ে মায়ের রঙিন শাড়ি।
যখন বুকে কষ্ট জমে
দুচোখ জুড়ে ঘৃণা
মা বলতেন, কাউকে কিন্তু
কিচ্ছুটি বলবি না।
মা তো আমার দেবীর মতো
নীল আকাশের পরী-
যখন ছড়া হয় না লেখা
মাকে স্মরণ করি।
ছড়া
আমরা সবাই মিথ্যা কথার রাজা
শরীর-মোটা তাজা।
আমরা সবাই ভণ্ড প্রতারক
সহজ কথায় ঠক।
বই
দামি দামি বই কিনেছি
করেছি সংগ্রহ
আর কিছু নয়, আর কিছু নয়,
বইয়ের প্রতি মোহ।
ঘরে অনেক ইঁদুরছানা
কাটুর কুটুর কুট
বইয়ের প্রতি মোহ তাদের
বই যেন বিস্কুট!
আমীরুল
আমীরুল কথা শোন, আর কত ঘুরবি
কতোদিন ডালে ডালে ঘুরে ঘুরে উড়বি?
নিজের আগুনে তুই কতো আর পুড়বি?
ধীরে ধীরে এইবার হও ধীর শান্ত
জীবনের অপচয় করে তুমি ক্লান্ত
অতিদ্রুত ক্ষয়ে যাবে কেউ সেটা জানতো?
টাকা যদি থাকে তবে আকাশেতে উড়তি
প্রতিক্ষণ প্রতিদিন করে গেলে ফূর্তি
সংসার করলে না, যেন এক মূর্তি।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তিতে
পুরস্কার পাওয়ার পরে
বুঝতে পারি হায় রে
এর তো কোনো মূল্যই নাই
দিন চলে যায় যায় রে!
মহাকালের গর্ভে আমার
কী বা এমন মূল্য?
কেউ পড়ে না লেখা, আমার
জীবদ্দশায় ভুলল।
পুরস্কার পাওয়ার পরে
বুঝছো ভায়া বুঝছো
বুঝতে পারি আমার লেখা
তুচ্ছ অতি তুচ্ছ।
সোহেল হাসান গালিবের ‘সাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও দরিদ্রের উন্নয়ননাট্য’ লেখাটি প্রকাশিত হয় ধ্রুপদি নবম সংখ্যায়।
‘‘এই লেখাটারই দরকার ছিল। মানে রাইসু-স্টাইলে ‘ফালতু’-টালতু না। এমন। এবং এর অনুবর্তন দরকার। মানে, আখ্যানকারদের কথা ছেড়ে দিচ্ছি। তাদের কারও-কারও জনপ্রিয়তার সুলুকসন্ধান নিষ্প্রয়োজন, সে সব তাদের লেখার সঙ্গে আমপাঠকরুচির অন্বয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। চাহিদা-জোগান, প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ। কিন্তু কবিতার জনপ্রিয়তা? সেটাও, সত্তর-অবধি ওরকমই ছিল। নৈলে গুণ? হাউ ইন দ্য ওয়ার্লড? হেলাল হাফিজও তাই। মহাদেব কী অসীম কী অমুক কী তমুক... রাহমানেরও জনপ্রিয় কবিতা কোনগুলো দ্যাখেন, বা রফিক আজাদ বা আলাউদ্দিন আল আজাদ...
কিন্তু আজ যারা জনপ্রিয়, তথা মারজুক, ইমতিয়াজ বা রোবায়েত... তাদের জনপ্রিয়তা কি সত্তর শ্রেণির? মানে, শুধুই কি তাই? না, বোধ হয়। এ কেবলই রুচির অন্বয় নয়, নানা অন্য কার্যক্রমও এতে আছে, যে সব এই কালেরই অবদান। কবিরা এই কালের, এই মিডিয়াধিপত্যের কালের নানা তৎপরতায় ঠিকমতো পাল তুলতে পারলে তবেই জনপ্রিয়তার প্রশ্ন এমনকি ওঠে। না হলে কবিতা লেখে গাধার পাল, যাদেও লেখাপড়া দূর হোক, তাদের নাম জানবার ফুরসত কারও নাই আর। সকলে মিডিয়া-ব্যস্ত।”
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে সিমিত চন্দ্র (১২) নামের এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (৭ জুন) ভোরে ওই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলগাছা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সিমিত চন্দ্র বেলগাছা গ্রামের মানিক চন্দ্র ড্রাইভারের ছেলে। অভিযুক্ত কিশোর (১৬) একই গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রের (দর্জি) ছেলে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা সংঘ অনুষ্ঠান দেখতে যায় সিমিত ও তার বড় ভাই। সিমিতকে অনুষ্ঠানস্থলে রেখে বাড়িতে ফেরে তার বড় ভাই। পরে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সিমিতের সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরের কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় সিমিতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ওই কিশোর। পরে তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের গর্তে সিমিতের মরদেহ পুতে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সিমিত বাড়িতে না ফিরলে স্বজনরা তার খোঁজে বের হয়। অভিযুক্ত কিশোরকে সিমিতের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে সে অসংলগ্ন আচরণ করে। পরে তার বাবা প্রদীপ চন্দ্র তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের একটি গর্তে সিমিতের মরদেহ দেখিয়ে দেন। বুধবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে।
আটক কিশোরের স্বীকারোক্তিতে সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, অভিযুক্ত কিশোরের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে সিমিতসহ অনেকেই ওই কিশোরকে খোঁচা দিত। গত রাতে সিমিত ওই কিশোরের সাথে এ নিয়ে আবারও খোঁচা দিলে সে সিমিতের গলা চেপে ধরে। এত শ্বাসরোধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কিশোর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনা স্বীকার করেছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।