
সকলেই কবিতার পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক।
কবিতার রস আস্বাদনের জন্য পাঠককে উত্তীর্ণ হতে হয়, ‘কবিতা-শিক্ষিত’ হয়ে উঠতে হয়।
যাদের কল্পনাপ্রতিভা নেই, বিশেষ সংবেদনশীলতা নেই, তারা কি কবিতার বিশুদ্ধ পাঠক? পাঠকের ‘হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা’ থাকার আবশ্যকতার কথা বলতে হবে। সস্তা বাহবা কুড়ানোর প্রবণতায় এ সত্যোচ্চারণ কে করবে?
শব্দ দিয়ে বোনা হয় কবিতা; শব্দের ভেতরে থাকে চিত্রভুবন, যেমন বলতে পারি বিন্দুতে সিন্ধু। তাই শব্দবোধের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কবিতাপাঠে তৃপ্তি আসতে পারে না।
জিহ্বার রুচিতে ও পরিপাকতন্ত্রে ব্যাধি থাকলে উপাদেয় সুস্বাদু আহার গ্রহণ যেমন সম্ভব হয় না, তেমনি কবিতার মন ও মনন যার অনুপস্থিত, কিংবা অচর্চায় উবে গেছে, তার সামনে উৎকৃষ্ট কবিতাবলি এনে দিলে চোখ হয়তো অভ্যাসবশত পাঠ করে যায়, কিন্তু মর্মে প্রবেশ করতে পারে না; কবিতার বিভা ও সুধা গ্রহণে অপারগতাই প্রধান হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে কবিতার স্পন্দনে অসাড় ব্যক্তিটির নীরবতা শোভন হলেও, অহম ও নির্লজ্জতা তাকে তেমনটি থাকতে দেয় না। সে মানসম্পন্ন কবিতাকে তকমা দিতে পারে বাজে লেখা বলে। নিজের হৃদয়তন্ত্রীতে কবিতা বেজে না উঠলে শুধু কবিতা কেন, যেকোনো শিল্পই বাজে অনুভূত হবে।
আধুনিক চিত্রকলা, বিশেষ করে বিমূর্ত শিল্প, উপভোগ ও অনুধাবন বহু রসবেত্তার পক্ষেই অসম্ভব হয়ে ওঠে। তবু সেটি দেয়ালের শোভা বাড়ায়, ফাঁকা জায়গাকে খানিকটা অর্থময়তা দেয়। বুকশেলফের কবিতা বইয়ে তেমন প্রাপ্তি ঘটে না। তাই শিল্পমাধ্যমের ভেতর কবিতা বিমূর্ত শিল্পকলার চাইতেও সর্বকালেই বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
মানবজীবন যখন সংকটবহুল ও জটিলতর হয়ে উঠছে তখন কবিতা কীভাবে সরল থাকতে পারে! জটিলতার জট খোলার জাদু জানতে হবে কবিতার সাম্প্রতিক পাঠককে। তবু অবাক হতে হয় এ কথা ভেবে যে, সরল কবিতার বইগুলো ষাট-সত্তর-আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পাঠকরা সংগ্রহ করেছে; অথচ আজ একই সরল ধরনের কবিতায় আজকের শিক্ষার্থীরা সংযুক্ত হতে পারছে না। তবে কি তারা জটিলতাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত? আজকের আধুনিক কবিতার জটিল ভাব, অনুষঙ্গ, বার্তা বা সংকেতকে কি তারা গ্রহণ করছে? নাহ্, মনে তো হচ্ছে না। মুশকিল হলো, যারা দশ বছর বা কুড়ি বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়েছেন, পেশাগত জীবনে অনেকটা থিতু হয়েছেন, সেসব পোড় খাওয়া কবিতার পাঠকরাও আজকের আধুনিক কবিতা উপভোগে যেন কৃতকার্য হতে পারছেন না; পারলে কবিতার বই বিক্রিতে কি এমন ধস নামত?
যারা জনসমক্ষে কবিতা পড়েন বা জনসমাবেশে যারা কবিতা শোনান, সেই সব আবৃত্তিকাররাও বা আজকের আধুনিক কবিতা কিংবা চিরকালীন আধুনিক কবিতা উপভোগে কতখানি সক্ষম?
প্রতিটি মানসম্পন্ন কবিতাই আলাদা আলাদা পরিবেশন-দক্ষতা দাবি করে। আবৃত্তির আসরে প্রায়ই আমাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়; কোন কবিতা শামসুর রাহমানের, কোনটা আল মাহমুদের তা আগে পড়া না থাকলে প্রথম শ্রবণে একইরকম শোনায়। আবৃত্তিকার যে ছাঁচে ফেলে সবার কবিতা পাঠ করেন, সেই ছাঁচে সমর সেন আর হরিদাস পালের কবিতা একই রকম শোনায়। ফলে মুড়ি ও মুড়কির দরে তারতম্য থাকে না। এ ছাড়াও আছে ভুল জায়গায় আবেগ মেশানোর গলা-কাঁপানো কারিশমা; ফলে কবিতার রঙ ও বৈশিষ্ট্য বিলক্ষণ বদলে যায়। কবিতার ভেতরে যে বার্তা ও আবেগ থাকে সেটি বদলে দিলে গ্রাহকের শ্রুতি কীভাবে তা সঠিক উপভোগ করবে। শম্ভু মিত্রই সম্ভবত জীবনানন্দ দাশের প্রথম সফল আবৃত্তিকার; যিনি দেখালেন ‘আলো অন্ধকারে যাই, মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে’ এই বার্তা কীভাবে উচ্চারণ করতে হয়। একজন আবৃত্তিকারও কবিতার পাঠক, আবার তার পঠন শ্রোতাদের প্রভাবিত করতে পারে। সে জন্যই প্রসঙ্গটি এড়ানো যাবে না।
বলছি না যে কবিতার প্রকৃত পাঠক কেবল তিনিই, যিনি কবি বা ‘ব্যর্থ’ কবি। চলচ্চিত্রের স্বাদ নেওয়ার জন্য চিত্রপরিচালক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না; কবিতার বেলায়ও তাই। তবে সিনেমার মতো কবিতা যেহেতু শুধু চর্মচক্ষু দিয়ে দেখার নয়, মন ও মগজ ব্যবহার করে দেখতে (মানে পড়তে ও অনুধাবন করতে) হয়, তাই কবিতার পাঠককে কবিতায় দীক্ষিত হতে হয়। কবিতাশিক্ষা নেই এমন কারও পক্ষে যথাযথভাবে ভালো কবিতা শনাক্ত ও তার রস গ্রহণ অসম্ভব। আবার বলি, অসম্ভব।
কবিতার পাঠককে ছন্দ না জানলেও চলে; কিন্তু প্রতীক, রূপক, ইংগিত-সংকেত, পরোক্ষ-গূঢ় কথা এবং কবিতায় প্রকাশিত ছবির ভেতরকার ছবি শনাক্তের জ্ঞান বা বোধ থাকতে হয়। আর সে জন্যই কবিতা পড়লেই হয় না পাঠক, পাঠক হয়ে উঠতে হয়। এটিও আর সব শিক্ষার মতো যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও আত্মনিয়োগের বিষয় বৈকি।
তাই সবাই কবিতার পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক।
যে হাতের ইশারায়
যে হাতের ইশারায় ধুলো হলো একটি শহর;
পাঁচটি আঙুলে তার শ্বাসরোধ হলো কতজন,
মৃতেরা দ্বিগুণ হলো, দুই ভাগ হলো শত দেশ;
পাঁচটি রাজার রায়ে শূলে গেল কতনা রাজন।
এই হাত আজও দেখো ক্ষমতার ঘাড় বেয়ে নামে,
আঙুলের কিনারায় লেগে থাকে রক্তের দাগ;
পাখির পালকে তবু শান্তির কথা লেখা হলে
থামবে কি যুদ্ধেরা, ঘুচে যাবে সকল বিরাগ?
অন্যায় সন্ধিতে যেই হাত কালাজ্বর আনে,
নেমে আসে মহামারী, পঙ্গপাল সারি সারি ওড়ে;
সেই হাত সর্বময় একটি নামের অধিকারে
অনেক বাহানা করে মানুষের নাকে দেয় দড়ি।
সেই পাঁচজন রাজা এসে মৃতদের গোনে, তবু
রহম আসে না দিলে, সরায় না চোখের আব্রু;
কারও হাতে করুণার ধারা, কারও হাতে স্বর্গের চাবি;
হাতেরা কখনো, হায়, ঝরায় না কিয়ৎ অশ্রু।
আমি ভাঙি রুহের বিন্যাস
এই যে শুকনো রুটি, একদিন শস্যদানা ছিল
আর এই মদ ডুবে ছিল অচেনা বৃক্ষে
ঝুলে থাকা ফলের গভীরে;
মানুষেরা দিনে আর মদ্যেরা রাতের আঁধারে
তুলেছিল ক্ষেতের ফসল, ভেঙেছিল আঙুরের ঘুম।
একদিন এই মদ গ্রীষ্মের রক্তপ্রবাহে
মাংসের ভেতরে ঢুকে ছুঁয়েছিল আঙুরের লতা,
একদিন এই রুটির শরীরে
শস্যেরা গেয়েছিল বাতাসের হৈ হৈ গান;
মানুষ তবুও কোন খেয়ালের বশে
সূর্যকে গেঁথে দিল ক্রুশে, বাতাসকে পরালো লাগাম।
এই যে মাংস তোমরা ছিঁড়ে নাও শান দেয়া দাঁতে, আর এই রক্তকে
মিশে যেতে দাও তোমাদের শিরার ভেতরে
একদিন তারা ছিল শস্য এবং আঙুর
রূপে রসে জেগেছিল কামনায় ছিন্ন করে মাটি;
তোমরা পান করো আমার মদ, আর ছিঁড়ে খাও আমার রুহটি।
যে শক্তি সবুজের ভেতরে বহে
যে শক্তি সবুজের সলতের ভেতরে বয়ে ফুল হয়ে বিস্ফোরিত হয়
সে আমার সবুজ বয়স; আমাকে উপড়ে ফেলে শেকড়সুদ্ধ
ধ্বংস করে ফেলে রাখে গাছের খোড়লে।
আমার জবান হারিয়ে যায় কুঁকড়ে যাওয়া কোনো এক গোলাপের কাছে
যৌবনের শৈত্যপ্রবাহে ঘিরে ধরে জ্বরের প্রলাপ।
যে শক্তি জলের ভেতরে ঢুকে পাথরের বুকজুড়ে ধরায় ফাটল
সে আমার লোহিত রক্তের গান; ঝর্ণার স্রোত থেমে যায়
থমকায় জীবনের সতেজ প্রবাহ।
এবং আমি ভুলে যাই সেই উষ্ণ রক্তের স্বাদ
পাহাড়ি ঝর্ণার বুকে একদিন যে দিয়েছিল অসীম চুমুক।
নদীর ভরাট বাঁকে ঢেউ তুলে প্রীত হয় যে তৃষিত হাত
সে আবার চোরাবালি খোঁজে; জাহাজের মাস্তুলে বেঁধে দিয়ে
কাফনের পাল আমাকে বিপন্ন করে।
আমার জবান থমকে যায় কবরে শায়িত কোন মুর্দার নিকটে
কম্পিত শরীর জুড়ে টের পাই একই সেই আতর-লোবান।
সময়ের ঠোঁট এসে চুমু খায় জীবনের উৎসমুখ জুড়ে;
ফোঁটা ফোঁটা প্রেম এসে জড়ো হয়, রক্ত জমাট বেঁধে
ক্ষত সারে আহত শরীরে।
আমার জবান উড়ে যায় মৌসুমি বাতাসের তোড়ে
সময়ের ডানা এসে ফিরে যায় বহুদূর নক্ষত্রের দেশে।
এবং আমার জবান রুদ্ধ হয় আশেকের সমাধিতে বসে
একই সে পতনের গানে স্পন্দিত আমার হৃদয়।
তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপের ঐতিহাসিক ঘটনা যখন ঘটছিল- ভারতবর্ষের ইতিহাসের কোনো কোনো পৃষ্ঠা জ্বলে পুড়ে খাক- সত্যজিৎ রায় সে-ই পঞ্চাশের দশক জুড়ে ডুবেছিলেন গ্রন্থ অলংকরণ আর স্বনিয়োজিত সংগীত শিক্ষায় ক্রমাগত শ্রুতিমাধ্যমে। বোবা বধির মানুষদের বিদ্যালয়ের ঠিক পেছনে একশো এক গড়পার রোডের পৈতৃক বাড়িতে যিনি জন্মেছিলেন একশো দুই বছর আগে, পৃথিবীর চলচ্চিত্রভাষায় শ্রুতি ও বচন অননুকরণীয় পদ্ধতিতে তিনি যুক্ত করবেন- এটি ছিল ইতিহাস নির্ধারিত পথ। একেকজন মানুষ থাকেন, যাদের তৈরি করে তোলে নিজের অদম্য উৎসাহ, পারিপার্শ্বিকতা এবং দুর্মর ইতিহাস। চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সে ভয়েটল্যান্ডের ব্রিলিয়ান্ট ক্যামেরা হাতে আসায় কিছুদিন মগ্ন ছিলেন ছবি তোলায়- বিলেতি কিশোরপত্রিকা ‘বয়েজ ওন পেপার’ পত্রিকার আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন অল্প বয়সে। মায়ের অনুরোধে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন পড়তে, পড়া শেষ না করেই নন্দলাল বসুর অনুমতি নিয়ে ফিরে এলেন, কেননা প্রথাসিদ্ধ চিত্রশৈলীর বদলে তাকে টানত গ্রাফিক ডিজাইনের বর্ণবৈভবের দিকটি। তবে, পৃথ্বীশ নিয়োগী আর দিনকর কৌশিকসহ চার বন্ধু মিলে ভারতের ভাস্কর্যের অনুপম নিদর্শনসমূহ দেখে বেড়ালেন। ইলোরা, অজন্তা, খাজুরাহো, সাঁচীর বৌদ্ধস্তূপ। কোনারকের সূর্যমন্দিরে সূর্যের রথ আমিও দেখতে গিয়েছিলাম- রথের চাকায় এখনো সূর্যরশ্মির পতন দেখে ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেওয়া যায়- অ্যারিয়াল ভিউ থেকে দেখলে এই মন্দির সূর্যদেবের রথপ্রতিম। প্রচুর স্কেচ করেছিলেন এইসময় বন্ধুরা মিলে। ভাস্কর্য দর্শনের এই বিপুল ভ্রমণ, নানা দিক থেকে ভাস্কর্য দেখা তৈরি করেছিল সত্যজিতের যে কোনো ব্যক্তি বা বিষয় অনুপুঙ্খে দেখার চোখ। যে কোনো তুচ্ছ জিনিসও অনেকটা তলিয়ে দেখতে জানতেন তিনি। ফিরে কিছুদিন পড়েছিলেন অর্থনীতি। বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ বলেছিলেন, নিজের ‘সংখ্যা’ কাগজে আড়াইশো টাকা মাস মাইনের চাকরি দেবেন। শেষ হলো না এই পড়াটাও। কিংবদন্তি প্রকাশক দিলীপ কুমার গুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটল এই সময়। সিগনেট প্রেসের অলংকরণ শিল্পী হিসেবে যুক্ত হলেন। বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের এলাকায় একটা দিগন্ত বিস্তীর্ণ প্রান্তর খুলে গেল যেন। পথের পাঁচালী-র কিশোরপাঠ্য সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’র অলংকরণ করতে গিয়েই বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রের বীজ মাথায় রোপিত হলো তরুণ ডিজাইনারের। অবশ্য এটি তার দ্বিতীয় চিত্রনাট্য। প্রথমটি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’। হরিসাধন দাশগুপ্ত সদ্য বিলেত থেকে ফিরে এই উপন্যাসের চলচ্চিত্র স্বত্ব কিনে নিলেন, বংশী চন্দ্র গুপ্ত শিল্পনির্দেশক আর সত্যজিৎ রায় চিত্রনাট্যকার। প্রযোজক জুটে গেল। শেষ মুহূর্তে প্রযোজক মশাই চিত্রনাট্য পরিবর্তন করতে চাইলে প্রকল্প বাতিল হয়ে গেল, কেননা সত্যজিৎকে টলানো গেল না। ভাগ্যিস তিনি অর্থনীতিবিদ, প্রথাসিদ্ধ চিত্রশিল্পী বা প্রযোজকের হাতের পুতুল চিত্রনাট্যকার হলেন না।
পথের পাঁচালীর মুক্তি ও দেশ-বিদেশে প্রশংসাপ্রাপ্তির পর বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক নীরদ সি চৌধুরী স্টেটসম্যান কাগজে, এই চলচ্চিত্রের মূল কাহিনিকারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নীরদ বাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। প্রথম কয়েক পাতার প্রথম পাঠক বলেও দাবি করেন সে চিঠিতে। তেইশের শেষ কিংবা চব্বিশের শুরুতে এই উপন্যাস লিখতে শুরু করবার কিছুকাল পর বিভূতিভূষণ কলকাতা ছাড়েন এবং আটাশের দিকে ফিরে শেষ করেন অনাস্বাদিতপূর্ব এই আখ্যান- পথের পাঁচালী। তো, সত্যজিৎ সুন্দর এক উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সমস্ত ইংরেজি কাগজেই কাহিনিকার হিসেবে বিভূতিভূষণের নাম ছাপা আছে। বই-এর উৎকর্ষতা এবং বিভূতিভূষণ সম্বন্ধে ইংরেজি কাগজগুলোর নীরবতার কারণ পথের পাঁচালির ইংরেজি অনুবাদ এবং বিভূতিভূষণের মূল্যায়ন এখন অব্দি ইংরেজিতে প্রকাশ হয়নি।’ ১৯৪৮ সালের দোসরা মার্চ এই উত্তরের শেষ বাক্যটি মোক্ষম ও নধর- ‘এমনকি বিভূতিভূষণের বন্ধু শ্রী নীরদ সি চৌধুরীও করেননি।’ গ্রামোফোন রেকর্ডে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত শুনতেন সত্যজিৎ, নীরদ বাবুর বাড়িতে বসে। সেই সূত্রে বন্ধুতা কিন্তু প্রয়োজনীয় তর্কের সময় সত্যজিৎ ছেড়ে কথা বলতেন না।
২
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে সত্যজিৎ রায় বাংলাদেশে আসেন শহীদ দিবসের আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। পল্টনের মাঠে সদ্যস্বাধীন আনন্দিত মানুষের সামনে এক হৃদয়সংবেদী ভাষণ দেন। বাংলা ভাষার লালনে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ফারাক তিনি বুঝিয়ে দেন- ‘পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতির মধ্যে আরও পাঁচরকম সংস্কৃতির প্রভাব এসে পড়ে সেটাকে একটা পাঁচমিশালি ভাব এনে দিয়েছে।’ পূর্ববঙ্গ, অধুনা বাংলাদেশ তার নিজের দেশ বলেই তিনি সে বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রচিত গানে ‘পূর্ববঙ্গের লোকসংগীতের আমেজ’ পাওয়ার কথা। পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে ঢাকার ওয়ারীর র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে দুতিনদিনের জন্য তিনি এসেছিলেন মামাবাড়িতে। প্রচুর বাঁদরের উৎপাত ছিল, তার মনে আছে। পদ্মায় স্টিমারে আসার সময় মা সুপ্রভা ভোরের পদ্মায় সূর্যোদয় দেখিয়েছিলেন। পদ্মা ও মেঘনার জল যেখানে এসে মিশেছে সেখানে এক নদীর জলের রঙের পার্থক্য দেখে শিশু সত্যজিতের মনে এক রঙিন দেশবোধের ছাপ পড়েছিল নিশ্চয়ই যা তার সারা জীবনের কাজে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সরাসরি রাজনীতি না করলেও এক বহুরঙ মানবিক বোধ সব কাজেই দেখা যায়।
‘আগন্তুক’ সত্যজিতের শেষ চলচ্চিত্র। চিকিৎসা ব্যবস্থার আদ্যোপান্ত নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের বাসনা তার ছিল। অসুস্থ দশায় চিত্রনাট্য লিখে শেষ করেছিলেন। সারা জীবনের কাজের জন্য লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কার পাওয়া ষষ্ঠ মানুষ চিরপ্রণম্য রায় বাবু। চার্লস চ্যাপলিন, গ্রেটা গার্বো, আকিরা কুরোশাওয়া, সোফিয়া লরেন এবং কেরি গ্রান্টের পর বাংলা ভাষায় সত্যজিৎ রায়। জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে, বিশ্বজুড়ে কিশোরপাঠ্য কমিক্স টিনটিনের কথা তুলেছিলেন তিনি। টিনটিন-স্রষ্টা ভারতীয় নারী আর নারকেল গাছ আঁকতে গিয়ে ভুল করেছিলেন। কারণ, সত্যজিতের মতে, প্রাচ্য যত আন্তরিকভাবে পাশ্চাত্যকে চিনতে চেয়েছে ও পেরেছে, পাশ্চাত্যের বেলায় তারা চায়নি ও পারেনি। ছেলেবেলা থেকে সংগীত শোনার অভ্যাস, সুনির্বাচিত বন্ধুসঙ্গ, প্যাশন ও স্বপ্নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবার সমন্বয়ই আজকের আমাদের হৃদয়ের খুব কাছের সত্যজিৎ রায়। জন্মদিনের স্মরণে তাঁকে প্রণাম পাঠাই।
সিরিজ ১১
মেয়েটা কী করত?
হতভাগা, নইলে এভাবে মরত?
লেকের জলে ভাসছিল লাশ
হাওয়ায় ছিল ইশ, ফিসফাস
মেয়েটা তবে কি হিডেন কলেজে পড়ত?
স্থানীয় লোকজন তাকে চেনে না,
লেকপাড়ে তাও জমে উঠেছে শোক
চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছি, কাউকে জানাচ্ছি না
আমি সেই কলেজেরই অধ্যাপক
সিরিজ ১২
কী হয়েছে কী হয়েছে কী হয়েছে রে?
খবর যাচ্ছে খবরের দিকে তেড়ে
কীভাবে ঘটনা ঘটল? কেউ কি দেখেছে?
জানলা দিয়ে হাওয়া যাচ্ছিল নেচে
সব্বাই লড়াই করছে, যাতে থাকা যায় বেঁচে
আকাশ মেঘলা ছিল, হোস্টেল রুম একলা ছিল
শুধু হিডেন কলেজের ছাত্রীটি আত্মহত্যা করেছে
কেন? তা আমাদের জানা নেই।
যা আমাদের জানা নেই
তা মনে হয় আমরা জানিই
একজন মানুষের আত্মহত্যার দায় নিতে হবে জীবিত সবাইকে
আদতে এ রকম কোনো ভাবনাকে আমরা মানি?
হাওয়া বিষণ্ন, হাওয়া ফিসফাস, হাওয়া কানাকানি
সিরিজ ১৩
প্রজাপতির মতো ডানা ছিল তাদের
কিম্বা তারা যাচ্ছিলই প্রজাপতি সেজে
প্রজাপতিরা কি হোস্টেলে থাকত?
পড়ালেখা করত কি হিডেন কলেজে?
প্রজাপতিরা তাদের জাতীয় সংগীত গাচ্ছিল
সেই সংগীত কারা শুনবে বা ধরবে?
কোনো অধ্যাপক নেই, ক্লাস-পরীক্ষা নেই
হিডেন কলেজের ছাত্রী প্রজাপতিদের
ঠিক নেই, কে কতদিন পড়বে?
আর কেউ কি রঙমাখা ডানা মেলে দেয়
প্রজাপতি সেজে?
কোন রাস্তা কোন দিক দিয়ে গেছে
হিডেন কলেজে?
সিরিজ ১৪
রক্তাক্ত, মুখমণ্ডল থেঁতলে দেওয়া হয়েছে
শরীরের পোশাক ছিন্নভিন্ন
বুক ও নাভির নিচে বিরাট জখম
পুলিশ আসবে, সুরতহাল রিপোর্ট লিখবে
লাশ মর্গে যাবে, হত্যার মর্মান্তিক রিপোর্ট লেখা হবে
এখন আর এই মেয়েকে নিয়ে কবিতা লেখা হবে না
বড় জোর খবর লেখা হবে, টেলিভিশন খবর দেখাবে
কে? কে এই মেয়ে? কোথায় এ কি করত?
লোকের কানাকানি থেকে যেটা বোঝা গেল
পার্কে, জংলার ধারে পড়ে আছে লাশ
মেয়েটি নাকি হিডেন কলেজে পড়ত!
‘আমাদের এই প্রিয় গ্রহ পৃথিবীটাই তো শূন্যে ভাসমান এক বিশাল কারাগার।’
ইচক দুয়েন্দের বড় গল্প ‘লালঘর’-এর প্রধান এগারো চরিত্রের নাম : ১. চিকচাক রুই, ২. পুঁই চুলভি, ৩. রজেট চিনচুই, ৪. মিয়ান টিনটুই, ৫. ফ্লিজ ফ্যাল, ৬. জিয়াফ ব্যানব্যাট, ৭. লালু পাঞ্জুমম, ৮. তিয়াস ঠিসটক, ৯. ইমুস ক্যাটস, ১০. ফিটিক চ্যাক, ১১. শ্যামল চিল।
এই এগারোজনের এক দিনের হাজতবাসের কাহিনি ইচক দুয়েন্দে তার ‘লালঘর’-এ লিখেছেন। বড়গল্প না বলে আমি অবশ্য ‘লালঘর’কে অভিহিত করব একটি ছোট উপন্যাস বলে। লালঘরে এই ১১ জনের বাইরে আরও বিশটি চরিত্র আছে। ‘লালঘর’ মার্চ-এপ্রিল ২০০৭ সালে রচিত। ওই বছরেই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় হাতে লেখা পা-ুলিপি সংস্করণ হিসেবে ‘পেঁচা’ থেকে। এর পরের বছর ‘বাংলায়ন’ হতে ‘লালঘর’-এর প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
বইয়ের শুরু থেকেই উদ্বেগ বা সংকট তৈরি হয় এই ১১ জনকে ঘিরে, যা বইয়ের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তাদের হাজতে নিয়ে আসা হয়। উদ্বেগ হলো তারা মুক্তি পাবে কখন, বা আদৌ মুক্তি পাবে তো? চরিত্রগুলোর জীবনযাপনে হঠাৎ ছন্দপতনের বিষয়টা পাঠক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন একদম প্রথম পৃষ্ঠা থেকে যখন লেখক আমাদের শুরুতেই জানান যে, ৯ ফুট বাই ৯ ফুট এক বর্গাকৃতি ঘর; যার উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট, সেখানে আটক ১১ জন মানুষ। এই ঘরের এক কোণে একটা দরজা দিয়ে ৩ ফুট বাই ৩ ফুট ছোট্ট এক ঘরে যাওয়া যায় প্রকৃতির ডাকে।
বইয়ের ভাষার দিকটা এখানে লক্ষণীয় এ কারণে যে, এগিয়ে যেতে থাকা এই বড় গল্প বা ছোট উপন্যাসে লেখক যা যা দেখিয়েছেন হালকা স্যাটায়ার করে, একদম শুরুতে নিথর ভাব তৈরি করে পাঠককে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দিয়ে তার পরেই গতি এনে, শেষের দিকে দার্শনিকতা মুড়ে দিয়ে তাতে বইটা নিমিষে পড়ে ফেলা যায়।
তবে বইয়ের মোট ৩১টি চরিত্রের অভিনব নাম আপনাকে কিছুটা বিপন্ন করতে পারে এবং আপনি খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন মাঝে মাঝে। কে কোন চরিত্র বুঝে মনে রাখা কঠিন হয়। চরিত্রদের নামগুলো আমি বা আপনি কেউই আগে শুনি নাই। এজন্য ‘লালঘর’ পাঠের সময় চরিত্রদের নাম টুকে রাখতে পারেন। এইটুকু পরিশ্রম করলে, এই বইয়ের রস আস্বাদন করা আরও সহজ হতে পারে। এই বইতে ভাষার গাম্ভীর্য নেই, জটিলতা নেই। চরিত্রদের সংলাপে আপনি পাতায় পাতায় পাবেন মজা।
গল্পের সঙ্গে পাঠক একাত্ম হয়ে যায় গল্পের শুরুতেই রাত তিনটার সময়ের এমন বর্ণনা পাঠ করে, ‘জনাকীর্ণ শহরটায় দিনের কর্মব্যস্ততার শেষে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। দূরে দ্রুতগামী যানবাহনের শব্দ এখন ভীষণ প্রকট হয়ে কানে বাজছে, যা দিনে অন্যসব শব্দের ভিড়ে থাকে ম্রিয়মাণ। ঘড়ির টিক টিক ঠিক ঠিক ধ্বনি, বুকের ভেতরের ধুকপুক ধ্বনির সঙ্গে একাকার হয়ে ছলাৎ ছলাৎ করে বাজে।’
গল্পের প্রায় শেষ দিকে চরিত্রদের মিলিত অনুভূতি বর্ণনা করেন এভাবে, ‘যদি তাদের পাখা থাকত, তবে শোনা যেত তাদের পাখার ব্যর্থ ঝটপট ধ্বনি। তাদের মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আসন্ন মুক্তির উদগ্র আকাক্সক্ষায় তাদের মন ছটফট করছিল। কিন্তু অজানা এক আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন তারা আনন্দ প্রকাশে ছিল সঙ্কুচিত।’
আলতো লয়ে নিথর অবয়ব দেখিয়ে মাঝে সাঝে স্বস্তির বারতা দিয়ে আরও চরিত্র এনে বইটার শেষ প্রান্তে যখন লেখক আমাদের নিয়ে যান তখন আমরা মুখোমুখি হই কারাগার নিয়ে দর্শনালোচনার। যা ভাবায়, যা দেখায় এই পৃথিবীর একটি জঘন্য বাস্তবতাকে। সেই বাস্তবতা এমন শব্দরাজি দিয়ে লেখক ফুটিয়ে তোলেন যে তা চাপ হয়ে আসে না, মৃদুভাবে গভীরতায় ঠেলে ভাবতে উৎসাহী করে পাঠককে। ‘পৃথিবীতে যে কারাগার নামে একটা জিনিস আছে, এ আমার জানাই ছিল না। বহুবার শুনেছিলাম। বর্ণনা শুনেছিলাম বহু মানুষের মুখ থেকে। বর্ণনাগুলো কি মনে রেখেছিলাম? এ রকম একটা মর্মান্তিক জিনিস পৃথিবীতে আছে, সিরিয়াসলি কি তা নিয়ে ভেবেছিলাম?
বইয়ের এক জায়গায় হাজতখানায় এক সান্ত্রির বয়ানে শুনতে পাই আমরা, ‘বুঝলেন। অর্ডার। অর্ডার হল আমি এখানে দাঁড়ায়ে থাকলাম। অর্ডার হল আমি ঘুমালাম। অর্ডার হল আমি খালাম। অর্ডার হল আমি বদলি হলাম। অর্ডার হল আপনাক ধরলাম। ... অর্ডার হইল ফাঁসি হইল। অর্ডার আসিল ফাঁসি থামিয়া গেল। অর্ডার হইল বডি চেঞ্জ হইল। ফাঁসির আসামি বাঁচিয়া গেল। আপনার বডিতে গাঞ্জা পাওয়া গেল। ... অর্ডারই সব। অর্ডারই মা-বাপ। যে-দিন অর্ডার কম হয়, যে-দিন কোন অর্ডার আসে না, মনে হয় সব ফাঁকা। খাবার বিস্বাদ। খামাকা। অর্ডার হইব। খাড়ায় দাঁড়াইব। স্যালুট দিব। বলিব, ইয়েস স্যার। কিন্তু সবই নিয়মের মধ্যে। এক চুল নড়িবার উপায় নাই। আপনারা প্রফেসর। কিন্তু এই বিষয়গুলি আপনারা বুঝেন না, আমি আশ্চর্য হইয়া যাই। যাই।’
এখানে দেখতে পাওয়া যায় এই পৃথিবীর মূল সিস্টেমটাকে যা অবলম্বন করেই এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা হয় মূলত আধমরা করে। ‘লালঘর’ পড়তে আরম্ভ করে শেষ না করে উঠে আসা কঠিন। এই গল্পে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু অবলীলায় প্রকাশিত হয়, পাঠকের মনে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি না করে, খেলাচ্ছলে। আমার এই লেখাটি শেষ করি গল্পের প্রধান ১১ চরিত্রের ১ জন চিকচাক রুই এর চিন্তা দিয়ে, “আইনভঙ্গ করলেই প্রায় বিনা ব্যতিক্রমে মানুষের হাতে কেন পরাতে হবে হাতকড়া? কেন করতে হবে বন্দি? এই নিয়ম তো চালু হয়েছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’ যখন চালু ছিল পৃথিবীতে তখন। জয়ীরা বন্দি করত পরাজিতদের। জয়ীদের দাসে পরিণত হতো পরাজিতরা। সাম্য, মৈত্রী, গণতন্ত্রে পরিচালিত একটি রাষ্ট্র কী করে তার নাগরিকদের শাস্তি দেওয়ার জন্য কারাগার রাখে? সুস্থ, সুখী মানুষেরা কখনো অপরাধ করে না। অপরাধ করে যারা অসুস্থ ও অসুখী। সেই তথাকথিত অপরাধীদের দরকার সুচিকিৎসা, শাস্তি নয়।” এই বইয়ের ঘটনাবলী দৌড়ে আগায় না বরং ধীরলয়ে কারাগারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে অন্যরকম এক অনুভূতিতে নিয়ে যায়, চিন্তার ভিন্ন লোকে। লালঘর এক টানটান সার্থক ছোট উপন্যাস বা বড় গল্প। ৬২ পৃষ্ঠার এ বইটি প্রকাশ করেছে বাংলায়ন, বইটি কেনা যাবে মাত্র একশ টাকায়।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।