
১.
শুভেচ্ছা নিও...
আর তোমার গালের জন্য রইলো একটি চুমু
আমার আর কিছুই বলার নেই
কোথা থেকে শুরু করবো?
আর কোথায় বা করবো শেষ?
সময়ের চাকা অবিরাম ঘুরে চলেছে
এবং এই নির্বাসিত জীবনে যা কিছু আমার আছে
তা হচ্ছে এক টুকরো বাসি রুটি, তীব্র আকুলতা
এবং একটি নোটবই যা বহন করে চলেছে
সেইসব জিনিস যা আমি নিজে বহন করতে পারিনি
সেইসব ঘৃণ্য বস্তু যা আমি লুকাতে পারিনি
এর পাতাগুলোর উত্তর আমি তা উগড়ে দেই
আমি কোত্থেকে শুরু করবো?
এবং ইতিমধ্যে যা কিছু বলা হয়ে গেছে
এবং যা কিছু আগামীতে বলা হবে
শুধুমাত্র একবার আলিঙ্গনেই বা হ্যান্ডশেকেই
তা সব শেষ হতে পারে না
নির্বাসিতরা কখনোই নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসিত হয় না, অথবা বৃষ্টি নামায় না, পথ হারানো পাখিদের ডানায়, পালক গজাতে পারে না, সে একটি পতিত পাখি, কোত্থেকে শুরু করবো?
শুভেচ্ছা অজস্র চুমু এবং অতঃপর
২.
আমি রেডিওকে বলি:
ওকে বলো আমি ভালো আছি
আমি সোয়ালো পাখিকে বলি:
যখন তুমি দেশান্তরিত হও, ছোট্ট পাখিটি
আমাকে ভুলে যেও না।
মনে করে বলো, সে ভালো আছে!
আমি ভালো আছি!
এখনো আমার চোখের দৃষ্টি ঠিক আছে
আকাশে এখনো জেগে আছে চাঁদ
আমার পুরনো ওভারকোটটি এখনো ঠিকঠিক আছে
যদিও ওটার হাতগুলো ছিঁড়ে গেছে
আমি ওদের রিপু করেছি,
এবং এটি একেবারে ঠিকঠাকই আছে
আমি কুড়ি বছরের একজন যুবকে পরিণত হয়েছি
মা, তুমি কি কল্পনা করতে পারো?
আমিও কুড়ি বছরে পা দিয়েছি
অন্য পুরুষদের মতোই
আমি জীবনের মুখোমুখি হই
আমি আমার নিজের বোঝা বহন করি
আর আমি কাজ করি
একটি রেস্তোরাঁয়... আমি থালাবাসন ধুই
আমি খরিদ্দারের জন্য কফি ফেটি
আর ওদেরকে খুশি করার জন্য
আমার বিষণœ মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখি
৩.
আমি খুব ভালো আছি, আমি কুড়িতে পড়েছি
মা, আমি এখন একজন পুরুষ
আমি সিগারেট ফুঁকি আর দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াই, এবং মেয়েদের পটাই
আমি বন্ধুদের বলি
‘দাদা! দেখেছো মেয়েরা কী সুন্দর!
ভেবে দ্যাখো ওদের ছাড়া জীবন, কতই না তিক্ত হতো! কতই না বিষাদময়!’
বন্ধুদের একজন আমার দিকে ফিরে জানতে চায়
‘তোমার কাছে কি এক টুকরো রুটি হবে?
আমার খুব খিদে পেয়েছে! এক টুকরো রুটি কি হবে?’
ভায়েরা! মানুষের ভেতরে কি আর ভালো থাকে
যদি তাকে প্রতি রাতেই ভুভুক্ষু অবস্থায় বিছানায় যেতে হয়? আমি ভালো আছি, একদম ঠিকঠাক!
খাওয়ার জন্য খয়েরি রুটি আছে আমার
আর রয়েছে ছোট্ট ঝুড়িভরা শাকসবজি।
৪.
আমি রেডিওতে শুনলাম, ‘বাড়ি থেকে চিঠি’
সবাই বলল, ভালো আছি, কেউ দুঃখী নয়।
বাবা ক্যামন আছেন?
তিনি কি এখনো খুব ঈশ্বর ভক্ত!
শিশুদের, জমিজিরাতের আর জলপাই
গাছগুলোর জন্যও অনুরাগী;
আমার ভাইয়েরাই বা ক্যামন আছে?
তাদের সবার কি চাকরিবাকরি আছে?
আমার বাবা একবার বলেছিলেন,
‘তারা সবাই প্রফেসর হয়ে গেছে।’
তবুও আমাদের গ্রামে এখন আর এমন কেউই নেই
যে কিনা আমার চিঠির এমনকি
একটি শব্দেরও পাঠোদ্ধার করতে পারে
আর আমার বোনটি এখন ক্যামন আছে?
ও কি দারুণ রূপসী হয়ে উঠেছে?
ওর জন্য কি অনেক সম্বন্ধ আসে?
আর দাদিই বা ক্যামন আছে?
তিনি কি এখনো দোরগোড়ায় বসে বসে
আমাদের সমৃদ্ধি, যৌবন আর ধার্মিকতা
কামনা করে দোয়া করতে থাকেন?
আর আমাদের বাড়িটির এখন কী অবস্থা?
এর রৌদ্রোজ্জ্বল প্রান্তর, অবারিত খোলা উঠোন
এর উঁচু উঁচু দরজাগুলো?
রেডিওতে শুনলাম, ‘বাড়ি থেকে চিঠি’
একজন নির্বাসিত অন্যজনকে শুভেচ্ছা বিনিময় করছে, ওরা সবাই বলছে, ওরা খুব ভালো আছে।
কিন্তু দুশ্চিন্তা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে
তোমার কোনো খবর পেলাম না, কোনো দুঃসংবাদও না, এমনকি একটা খারাপ খবরও না।
৫.
মা, রাত হলো এক ক্ষুধার্ত নেকড়ে
নির্বাসিতরা যেখানেই যাক না কেন তাকে তাড়া করে
দিগন্তজুড়ে এর প্রেতচ্ছায়ারা আতঙ্কিত করে রাখে
এবং উইলো গাছের ঝাড়, বাতাসকে অবিরত আলিঙ্গন করতে থাকে, মা, বলো না আমরা কী এমন দোষ করেছি, যে আমাদের দু-দুবার মরতে হবে, একবার জীবিত অবস্থায় এবং আরেকবার মৃত্যুতে?
তুমি কি জানো কী সেই ব্যাপার যা আমাকে কাঁদায়?
আমার কি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া উচিত? নাকি অসুস্থতা এসে আমার গায়ের ওপর পড়া উচিত?
সন্ধ্যা কি কখনো মনে রাখে সে কথা যে কোনো শরণার্থী এখানে এসে মারা গিয়েছিল? এবং কার কাফন ছাড়াই দাফন হয়েছিল?
উইলো গাছ! তুমি কি মনে রাখবে, যে তোমার বিষণœ ছায়ার ওপর ওরা কি ছুড়ে মারে মরা পিণ্ডের মতো, যা আসলে মানুষের শরীর?
তুমি কি মনে রাখবে যে, আমিও একজন মানুষ ছিলাম? আর আমার লাশকে হিংস্র কাকদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে?
মা! তাহলে কার জন্য আমি লিখেছি সেইসব চিঠিগুলো? কোন পিয়ন তাহলে সেগুলো বিতরণ করবে? স্থল-সমুদ্র, আকাশ-বাতাস সব পথই তো কেটে দেওয়া হয়েছে।
আর মা! তুমি এবং বাবা আর ভাইয়েরা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব! হয়তো তোমরা এখনো বেঁচে আছো, হয়তো বা মরে গেছো, অথবা হয়তো আমারই মতো, তোমাদেরও আর কোনো ঠিকানা নেই! মানুষের আর কী থাকে তবে, জন্মভূমি ছাড়া
পতাকা ছাড়া
ঠিকানাবিহীন, মানুষের কী আর থাকে তবে?
এই লেখা যখন লিখছি, তখন মোহাম্মদ রফিকের নশ্বর দেহ বাগেরহাটের কোনো এক গ্রামে মাটির তলায় হয়তো বা ক্ষয়ের অবশেষ। তিনি তো লিখেইছিলেন: এই দেহ কাল হবে, কেউ তাকে ঠিক ছিঁড়ে খাবে। (কীর্তিনাশা) রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, যে বিশ্ব কোলের পরে/চিরদিবসের তরে/ তুলে নিল তারে/ তার মুখে শব্দ নাহি/প্রশান্ত সে আছে চাহি/ঢাকি আপনারে... (মৃত্যুর পরে) কিংবা রফিকের আরেক প্রিয় কবি চিলির পাবলো নেরুদা যেমন অনুভব করেন: পল্লবের ছদ্মবেশে মৃত্যু পৃথিবীর মধ্য দিয়ে চলে যায়/মৃত্যু পল্লবে মুখ ঢাকে/মৃত্যুর জিভ খোঁজে সুতো (নিঃসঙ্গ মৃত্যু) অথবা আমাদের কোনো এক প্রান্তিক পল্লীর গীতিকবি বিজয় সরকার গেয়ে ওঠেন, পোষা পাখি উড়ে যাবে/একদিন ভাবি নাই মনে... পৃথিবীর সব ধ্রুপদি ধারার মহৎ কবিদের মতো মোহাম্মদ রফিকের কবিতাও মৃত্যুমুখর, পরতে পরতে তার মৃত্যুর সতেজ উদযাপন। তবে সেই মৃত্যু কেবল ভাবুকতা বা অধ্যাত্মের চেতনার শ্বাস খেয়ে মূর্ত হওয়া নয়, বাংলার চিরবিপর্যস্ত এক জনপদের জীবনে জীবনে প্রকৃতির খেয়ালে কি হেঁয়ালিতে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যে রচিতও!
মোহাম্মদ রফিকের কবিতা যখন পড়ি শুধু মৃত্যু নয় আমরা এ বঙ্গের নদীবর্তী মানুষের জয়ে-পরাজয়ে গাথা লড়াকু জীবনের আনন্দ-বেদনার এক নান্দনিক উদ্ভাস দেখতে পাই। নদীবিধৌত আপন যে জন্মভূমির কথা তিনি কবিতা করে তোলেন, তার ভাঁজে-ভাঁজে চিহ্নে রেখায় বাংলা ফুটে ওঠে ভাঙনে উত্থানে উচ্ছ্বাসে নীরবতায়। এর আগেও বাংলাকে আমরা পেয়েছি, জসিমউদ্্দীন দিয়েছিলেন, কিন্তু তা ছিল গ্রামীণ জীবনের আবেগ-প্রেম-বিচ্ছেদ-শ্রেণিবিরোধের সরল কাব্যিক বয়ান, কিন্তু মুহুর্মুহু যাপিত ভূগোলের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবনের ছবি সেখানে ছিল না। জীবনানন্দের বাংলা যাপিত বাস্তবতার সত্য থেকে ঠিকরে বেরোয়নি, এক রোমান্টিক পরিদর্শক ও পরিব্রাজকের দর্শন থেকে বাংলা সেখানে আলুলায়িত, নিদ্রাতুর, স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নমদির। বাংলাকে আল মাহমুদ দেখেছিলেন আত্মকামবাসনার সঙ্গে যুক্ত করে। সেখানে সবকিছুর পরে আমি বা অহমই মুখ্য। নারী, মাটি, শস্য, নদী, জল সবকিছু তার পৌরুষিক দৃষ্টিভঙ্গির আকাক্সক্ষা ও বাসনার টানে আবর্তিত হয়েছে। কবিতার উন্মাতাল শক্তি দিয়ে আল মাহমুদ শেষাবধি পরাজিত করে গেছেন ভূগোল-বাস্তবতার জৈবনিক রূপের নিজস্ব উদ্ভাসনের আকাক্সক্ষাকে। রক্তপাত, গঞ্জনা, যন্ত্রণার কাব্যিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার খেলা আল মাহমুদে নেই। এটা একটা ঝুঁকির ব্যাপার যে কাব্যিক বিশুদ্ধতা তাতে থাকবে কী থাকবে না। কবিতার স্বার্থ কি রক্ষা হবে? ইত্যাদি। কিন্তু মোহাম্মদ রফিক সে ঝুঁকি নিয়েছেন। তিনি আমাদের আধুনিক কালক্ষেত্রপাত্রবোধহীন উদ্বাস্তু বাংলার রোমাঞ্চজাগানিয়া বাতাসে ভাসাননি কাব্যবিহারের নৌকা, তিনি বাংলাকে ছিঁড়েখুঁড়ে আনতে চেয়েছেন তার চাঁছাছোলা কাব্যবল্লমের কোপে কোপে। সে ভাষা এভাবেই প্রশ্ন করে: ‘এইভাবে ভিজে-ভিজে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে?/এই দেশে বন্যার কি শেষ আছে?’ আমরা একথা ভাবি নাই। আর কীর্তিনাশা অন্ত্যজ মানুষকে নন্দনের ভাষাভঙ্গির যে আঁটোসাঁটো গড়নে বেঁধেছে, সেটাও রীতিমতো ভাবনীয়। বাংলা কবিতায় নদী ও তার আশপাশের মানুষজন, প্রায়ই কবিমনের রোমান্টিকতার সূত্র ধরে এসেছে, এভাবে নয়। এভাবে বাস্তবতার শত চিত্রের সাথে কল্পভুবনকে জারিত করে নয়, এভাবে কবিকে সেখানকার বাস্তুভিটায় আছড়ে ফেলে নয়, যে কবি শুনতে পানজল ছুঁয়ে শেষ প্রহরের চাঁদে বলে আমি যাই.../কিংবা/জলে-জলে ভাঙা চাঁদ কেঁদে ওঠে বিদায় বিদায়../এই জলে কাদায় লেপ্টালেপ্টি ভাঙা পোড়া চাঁদ বাংলা কবিতার আকাশে দেখা মেলে নাই। অনেক গভীর থেকে ডাক এল, কেউ বুঝল না!/যে যার নির্দিষ্ট পথে পিচ্ছিল সন্ধ্যার মাঠ ভেঙে/হাট থেকে ফিরে এল দাওয়ায় বিরক্ত মুখ ক্লান্ত উপেক্ষার বোঝা বয়ে/টেমির আলোতে ভেজা অর্ধঘুমে উন্মনা ভাজা ইলিশের পোড়া ঘ্রাণে/ শুধুমাত্র একটি তারা হয়তো তারাও নয় আলোর মতন এই কিছু/ছুটে এসে ঝরে গেল/দক্ষিণের পলাশপুরের বিলে দু-ক্রোশ রাস্তায় পরপারে।//
শব্দ ব্যবহারের এক পরিমিতি ও সাচ্চামি তার ধ্রুপদি কাব্যচরিত্রকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। এ স্তবকটির শেষে পরপারে শব্দটিকে খেয়াল করুন। এত যে আলো-আঁধারি বা চেনা-না চেনা চিত্রকল্প, তার শেষে পরপারে শব্দটি সবকিছুকে আবার ভাবতে বাধ্য করে। কিন্তু কবিতার রহস্যজটিল স্পন্দনতৃষ্ণার জায়গায় সেটা কোনো বাধাই হয়ে ওঠে না। কেননা, মারি আর মড়ার দ্যাশে এইক্ষণে কবি নিজের মতন জগৎ সাজিয়ে বেড়ান, যেখানে চাঁদের ভাসানে মেঘ মেঘের ভাসানে মাঠ মাঠের ভাসানে ঘরবাড়ি... এই জন্ম শেষ জন্ম বাতাস একটু ধীরে বও/এমন ছিল না কথা এইভাবে নাও ছেড়ে ফিরে যাবে দেশে/ঘুমের ভেতরে পথ ঘুমের ভেতরে জাগরণ/স্তব্ধ রাত স্তব্ধ জল স্তব্ধ ফিরে চলে/উঠোন পেরিয়ে ঘর ঘরটা পেরিয়ে মাঠ মাঠটা পেরিয়ে/যেখানে যাত্রার শুরু ঘোড়ার খুরের ধ্বনি ঘণ্টা বাজে নির-নিরন্তর/একটি দিনের স্বপ্ন একটি যুগের ছায়া দুঃস্বপ্ন ছায়ার/পালটে যায় মানচিত্র ঢোঁড়া ঠিক উঠে আসে/জল থেকে রোদ্দুরে পোহায়...//আলোর ভেতর থেকে উড়ে গেলে আলো/স্বাদ থেকে অন্য অধীর বিস্বাদ/বুকের সান্নিধ্যে বুক.../ও চাঁদ এমন ভয়ে কে বলো তোমার পথে বাঁধবে না ঘর.../এ চাঁদকে আবার পাওয়া যাবে অন্য বিপর্যাসে :‘ওগো চাঁদ তোমার ধিক্কারে বাজে বিবাগী আকুল চিৎকার.../চাঁদেতে লেগেছে অগ্নি হায় সে আগুন আজ জল/চোখের আগুনে জলে পথ পেল আষাঢ়পূর্ণিমা/’ বাংলার এই চাঁদ যেন মানুষের যতেক সংকট-আনন্দের ভেতর দিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠা এক মনুষ্যবৎ অস্তি, যা কাব্যে এতকাল বিরলই ছিল। প্রকৃতি আর জনপদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ব্যুহ ছেড়ে এবার তিনি মানুষের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক বিন্যাসের নাভিশ্বাস তোলা জালটিকে ছিঁড়তে চাইলেন! বললেন‘সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;/বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই।/যদি/হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে তৃতীয় বিশ্বের গঞ্জে-গাঁয়ে/হুট করে নেমে আসে জলপাই লেবাস্যা দেবতা;/পায়ে কালো বুট; হাতে রাইফেলের উদ্যত সঙ্গিন...’ মোহাম্মদ রফিক ওভাবেই তার কবিতার বিষয়-ভঙ্গি-উদ্দেশ্য সব পাল্টিয়ে ফেলেন। নিজের তৈরি করা জগৎকে চুরমার করে ভেঙে চোখ রাঙিয়ে ফোঁসফোঁস করে দাঁড়ান। তবু কী আশ্চর্য, বক্তব্যধর্মী কবিতাটিতেও কোথাও ছন্দপতন নেই, কোথাও একেবারে নগ্ন হয়ে বের হয়ে আসেনি কাব্যবস্তু, চলন মাত্রা গড়ন সব ঠিকঠাক।
সেই খোলা কবিতার পরপরই তিনি লেখেন কপিলা। মিথ, রূপকথা, লোককথার টুকরো টুকরো সমধর্মী উপাখ্যানকে আশ্রয় করে সমকালের দৈন্য হতাশা কূটনীতি নষ্টামি ক্ষুধা দারিদ্র্য গার্হস্থ্য এবং রাষ্ট্রকে নিয়ে বিশাল এক ক্যানভাস। অনেকগুলো কন্ট্রাস্ট, আইরনি, মেটাফোর, উৎপ্রেক্ষা... কখনো সব মিলে একটা মহাকাব্যিক ভাববিস্তার; কখনো একটি আখ্যান কখনো বা একটি নাট্যকাব্য... অনেকভাবেই কপিলাকে বর্ণনা করা যায়। কিন্তু কপিলা যা বলতে চায়, তার এককেন্দ্রিক অর্থগত টানের ভেতর দিয়ে তার আধুনিক কাব্যিক টেক্সচুয়াল মর্যাদা। নানান ছন্দে নানান মাত্রাবিন্যাসে কখনো অক্ষরবৃত্তে কখনো গীতলয়ে কখনো নিখাদ কঠিন গদ্যে কপিলার কাব্যশরীর বিন্যস্ত। এত এত ভাঁজ, কিন্তু কখনোই মনে হয় না, আমরা বিচ্যুত বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। একটি বাস্তবতার রাজনৈতিক অভিমান ও ক্ষোভকে কবি অতীত ও বর্তমানের মিশেলে, অলীকপ্রায় ভাষিক পরম্পরার সাজে ঝলমলে করে তুলেছেন। বাংলা কবিতায় মলয় রায় চৌধুরীর জখম-এর কথা হয়তো মনে হতে পারে, কিন্তু সেটা শ্লেষের ধরনে, প্রেক্ষিতগুলোর ভূমি বিচারে নয়। জখম ছিল কেবল আধুনিক রাজনৈতিক মানুষের বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের শ্লেষ, ব্যঙ্গ ও রূপকল্পময় হাহাকারের কাব্য, কপিলা সে ক্ষেত্রে অনেকগুলো উপাখ্যানকে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভূগোলের প্রধান কিন্তু শ্রেণি-অর্থে তুচ্ছ মানবমণ্ডলীর ভাগ্য নিয়ে গড়া কাব্যিক মেটাফোর। বৈশ্বিক হানাহানি, যুদ্ধ ও স্নায়ুসংগ্রামের নানান ঘটনার পাশাপাশি বাংলার লৌকিক জীবনের ক্ষুধার নৈরাশ্যের অন্ধকারের পদাবলি কপিলা। এমে সেজায়ারের দেশে ফেরার খাতার সাথে কেবল তা তুলনীয় হতে পারে।
কাল রাতে জ্যোৎস্নার আদিম টানে উঠে চলে গাঙ/স্বপ্নের ভাঙনে ডোবে ঘুমের প্রাসাদ দুই পাড়.../রাতের কিনার ফুঁড়ে কালো জল চিৎকারে ফাটে/অন্ধকার নক্ষত্রের বিস্ফোরণ ছুঁয়ে ছোটো ডিঙি/গলুয়ে নিকষ মূর্তি ধরে আছে হাল/পাটাতনে ভাঙা চাল মাটির সানকি দুটো হাঁড়ি.../কপিলার জলজ সংসারে/ফোঁসে যক্ষপুরী/আন্ধা কালা কুয়োর বসত ছিঁড়ে লক্ষ-লক্ষ কেউটের ছোবল/ভেলার ভাসান জুড়ে ফণা তোলে নিশুত শিথানে/এলোকেশে ঢেকে যায় ধানখেত শস্যের আবাদ ভূমি ভুবনডাঙায়...’ কপিলার বিষাদমণ্ডল ছেড়ে আদিবাসী ধর্ষিতা মেয়ে মাতি কিসকুকে নিয়ে তার নামেই কবিতা লেখেন রফিক। জাতিরাষ্ট্রের অবক্ষয় ও দাপটকে যেন চ্যালেঞ্জ করেন তিনি। নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। সে কাঠগড়ার সামনে দাঁড়ানো একমাত্র সেই মেয়েটিই মাতি কিসকু। যে দুরন্ত স্পর্ধায়, শ্লেষে কবিকে ডাকে :/ কবি ওই দঙ্গল থেকে উঠে এসো, ওখানে তোমার কী কাজ!’ টিয়ে রং জ্যোৎস্নার উঠানে সে ডাকে কবিকে। সে তার বুকে কান পেতে শুনতে বলে মাংসের পাতিলজুড়ে যেখানে ভাত ফুটছে! কবি আহত হন, দিশাহারা হন না। তিনি আত্মশ্লাঘা ভরে বলতে পারেন: আমূল বন্য বৃক্ষের শূল বিঁধে গেছে পিঠে পাঁজরায় স্বদেশমৃত্তিকা।
উপমাপ্রয়োগের ধরন, ভাষা-ব্যবহারের ভঙ্গি, রূপ-নির্মাণের কারিগরি, বিষয়-ভাবনার সূত্র কোনোটাতেই রফিক ঔপনিবেশিক নন। উপনিবেশের বর্তমান ইশারাই হলো ব্যক্তিক হীনম্মন্যতার বীজ পুষে রাখা, আত্মবিকাশ ও প্রকাশের অনুকূল-প্রতিকূলকে বুঝে নিজস্ব হতাশা ও নৈরাশ্যের বিস্তার ঘটানো এবং সর্বোপরি নিজের সবকিছুকে নিয়ে দোনোমনার অবসাদ। সে জন্যই ঔপনিবেশিক কবিরা নিজেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা ভেবে ভূগোল জমিনদেশবিহীন এক অন্ধপ্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে আত্মরতির সুধা পান করে বেদনা-ভোলানো-আনন্দ পান। মোহাম্মদ রফিক একটিবারের জন্যও সেই প্রকোষ্ঠে ঢোকেননি। বরং প্রতিমুহূর্তে সমঝোতা আর মোকাবিলা করেছেন সামষ্টিক জীবনের সুন্দর আর বৈকল্যের সঙ্গে। সে জন্য তার চাঁদ ‘পদ্মা-যমুনার বালুজল মাখামাখি খাটে বিছানো শয্যায়/মধ্যরাতে আড়াআড়ি শুয়ে থাকে (ঘাট আরিচায়) কিংবা তা তারপরওএখনও আশা নিয়ে ঝোপের আড়ালে ‘ধুতুরার বোঁটা ছুঁয়ে পাপড়ি মেলে’। তাই দেশকে তিনি নিজের (একজন কবির) কাব্যতৎপরতার নিয়ামক হিসেবে দেখেননি, কবিতার বিষয় বা ভাব হিসেবে দেশ-এর সামনে নিজেকে নান্দনিক কারিগর হিসেবে বসিয়ে তাকে রোমান্টিক বা সিম্বলিক কিছু করে তোলেননি; ক্রম সঞ্চরণশীল, ক্রিয়াশীল, জৈবনিক আধার ভূগোল হিসেবে তার সকল সংঘটনকে অবশ্যই একটি বিশেষ অঞ্চলের ভূ-সাংস্কৃতিক (Echosocial) প্রেক্ষাপটে এবং তা বাংলাদেশের প্রতীকী সামগ্রিক রূপ হিসেবে নান্দনিক ও দার্শনিক প্রেক্ষিত থেকে নতুন করে চেনানোর প্রয়াস করেছেন এবং তা করতে গিয়ে নিজের মতো করে একটি ভাষাকেও ভালোবেসেছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন এক বিষয়-আস্তীর্ণ ভাষা (Content-dominated language), বিষয়ী-শাসিত ভাষা (Form-dominated language) নয়।
সেই ভাষা আর বয়ানরীতিকে তিনি অন্তিমেও ছাড়েননি। শেষদিককার রচনা গাথাকাব্যতেও তার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায়। ‘তুমি-আমি, অভিশাপ বয়ে-বয়ে ফিরি,/লখিন্দর ও বেহুলা, নদ্যা ও মহুয়া, একই কথা,/কিংবদন্তি রূপকথা উপকাহিনির,/এক যুগে একখানে সাপ অন্য যুগে অন্যখানে ছুরি/যুগান্তরে একখানে বিষ যুগে-যুগে অন্যখানে রক্ত/অভিশাপ তবু মুক্ত হয় না কখনো...’ (অভিসার, অভিষেক)
যেন সমকালের দেশ, রাষ্ট্র, বিশ্ব, রাহুর আগ্রাস, অবিচল নঞর্থক বেগ, মানুষের অসহায়ত্ব, প্রেমের সংবেদনের পরিহাস, ব্যর্থতাই দায়ী হয়ে ওঠে কবির কলমে। মিথের ভেতর থেকে কেবল পুরাণের বা লোকায়তের প্রসঙ্গকে আপ্ত করে নয়, পুরাণের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নিজের সমস্ত বর্তমান, তার আত্মা, তার শরীর, বাসনা সবকিছুকে খুঁজে বুঝে এবং যুঝে মোহাম্মদ রফিক আধুনিককালের এই ধ্রুপদি কাব্যদ্বয় রচনা করলেন। হ্যাঁ, ধ্রুপদি তো নিশ্চয়ই। সুসংযত রীতি, গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষা আর ঐতিহ্যের অনুবর্তনের যেসব শর্তে খচিত ধ্রুপদিবাদ, তার মণিদীপ্ত স্মারক মোহাম্মদ রফিকের কাব্যে জ¦লজ¦ল করছে সততই।
অন্য অনেক নন্দনকারের মতোই রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, ক্ল্যাসিক মানে একটি সর্বাঙ্গসুন্দরতার পারফেকশনের ফর্মে অবিচল প্রতিষ্ঠা। মোহাম্মদ রফিক তার জীবনের আদি-অন্ত সেই ক্ল্যাসিক বা ধ্রুপদি ধারারই অনুবর্তী ছিলেন। তবে সেই অনুগমন চিরায়ত ঐতিহ্যের স্ফটিকবিছানো পথে পথে নয়; বাংলার মেঘ-কাদা-জলের, ঝড় ও ঝঞ্ঝার মানবান্বিত চলমান আখ্যানকে কাব্য করে তোলার ভাঙাচোরা চলন-রেখা বেয়ে।
[১৯৮৮ সালে নোবেলজয়ী মিসরীয় লেখক নাগিব মাহফুজ আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, আধুনিক আরবি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচয়িতা এবং নাট্যকার। নাগিব মাহফুজের মৃত্যু হয় ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট, কায়রোতে। মৃত্যুর বারো বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে, লেখকের স্বহস্তে লেখা গল্পের পা-ুলিপি ড্রয়ারের ভেতর খুঁজে পাওয়া যায়। পা-ুলিপি সুতায় বাঁধা ছিল এবং সংযুক্ত লেবেলে লেখা ছিল ‘১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হবে।’ আততায়ীর হাতে জখম হওয়ার কারণে তিনি গল্পগুলো সময়মতো প্রকাশ করতে পারেননি। সেখানে ১৮টি গল্প ছিল এবং প্রতিটি গল্প লেখকের স্মৃতিবিজড়িত কায়রোর বিখ্যাত গামালিয়া মহল্লার বাসিন্দাদের ঘিরে রচিত হয়েছে। গল্পগুলো লেখকের অন্যতম অনুবাদক রজার অ্যালেনের ইংরেজি অনুবাদে ‘দ্য কোয়ার্টার : স্টোরিজ বাই নাগিব মাহফুজ’ শিরোনামে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘পুরনো দুর্গে নাবকা’ গল্পটি ‘দ্য কোয়ার্টার: স্টোরিজ বাই নাগিব মাহফুজ’ গ্রন্থের ‘নাবকা ইন দ্য ওল্ড ফোর্ট’ গল্পের অনুবাদ। উল্লেখ্য, গল্পটি আগে বাংলায় অনূদিত হয়নি।]
পানি বিক্রেতা অ্যাডামের কনিষ্ঠ পুত্র নাবকা। মহামারী প্লেগে নয় সন্তান মারা যাওয়ার পর তিনি নাবকার বাবা হয়েছেন। তিনি ছেলেকে স্থানীয় মসজিদের সেবায় নিয়োজিত করার অঙ্গীকার করেন, যদি সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচিয়ে রাখেন। তিনি তার অঙ্গীকার পালন করেন। ছেলের বয়স যখন সাত বছর, তখন তিনি ছেলেকে মসজিদের ইমামের হাতে তুলে দেন। ‘সৃষ্টিকর্তার আপন ঘর পরিচর্যা করা হলো সবচেয়ে ভালো কাজ,’ তিনি তার বন্ধুদের বললেন। ‘নামাজের মাঝে, দোয়া-দরুদ ও পড়াশোনার ফাঁকে তার হৃদয় আলো এবং আশীর্বাদ উভয়ই আত্মস্থ করবে।’
নাবকা অধিকাংশ সময় মসজিদে ব্যয় করে। সে খুব অল্প সময় বাড়িতে অথবা মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটায়। ইমাম তার ওপর অত্যন্ত খুশি। তিনি নাবকার কর্মশক্তি ও নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশংসা করেন। তার বয়স এখন প্রায় দশ বছর এবং এ বয়সে সে তার বাবা এবং মাকে হারায়। ভূগর্ভস্থ জায়গার ওপর পুরনো দুর্গটি বিশেষভাবে পছন্দ করার জন্য সে সবার কাছে পরিচিত ছিল।
‘কখন ভূগর্ভস্থ জায়গার মধ্যে দুর্গটি খুলবে?’ সে পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারী সবাইকে জিজ্ঞেস করত। ‘সাধারণত দুর্গটি বছরে একবার খোলে, যখন প্রতœতত্ত্ববিদ আসেন,’ সবার একই প্রতিক্রিয়া, ‘তবে এখন দুর্গটি শয়তানদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।’
যখন নাবকার বয়স দশ বছর, তখন ইমাম তাকে তার বাবা ও মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি দেন। ‘এখন কবর জিয়ারত করার মৌসুম নয়,’ তিনি ছেলেটিকে বললেন।
তবে নাবকা জোরাজুরি করে এবং সে স্বপ্ন দেখার অজুহাত দাঁড় করায়। সে কবরস্থানে যায়, কিন্তু সময়মতো ফিরে আসেনি; তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে। ইমাম সতর্ক হন এবং ধারণা করেন যে, ছেলেটি হয়তো তার জীবনের নতুন কোনো চলার পথ পছন্দ করেছে অথবা অন্য কোনো কারণ, হয়তো ছেলেটির কিছু একটা ঘটেছে। তিনি তার দুশ্চিন্তার কথা মহল্লার প্রধানকে বলেন এবং ছেলেটিকে খুঁজে আনার জন্য শেইখ একজন প্রহরীকে পাঠান। কিন্তু তৃতীয় দিন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে প্রহরী দেখে যে, ছেলেটি ভূগর্ভস্থ ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। তার চোখেমুখে ফুটে আছে নির্মল অভিব্যক্তি, যা তার ব্যবহারের সঙ্গে মিলে না। ‘তুমি কোথায় ছিলে?’ ইমাম রাগী গলায় জিজ্ঞেস করেন।
‘আমি মৃতদের সঙ্গে ছিলাম,’ ছেলেটি শান্তভাবে বলল। ‘তারা আমাকে জ্ঞান এবং শক্তি দিয়ে পরিপূর্ণ করেছেন।’
‘তুমি কী উন্মাদ হয়ে গিয়েছ, নাবকা?’ ইমাম জিজ্ঞেস করেন। তাকে বিস্মিত দেখাচ্ছে। ‘নাকি কোনো শয়তান তোমার ওপর ভর করেছে?’
‘সৃষ্টিকর্তা আপনাকে বিদায় জানিয়েছেন! আমি চললাম।’ ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
‘আপনার ভৃত্য হয়ে থাকা কিংবা আপনি আমার মনিব হন, তা আমার জন্য কিছুতেই ঠিক হবে না।’ ‘সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আরোগ্য দান করুক!’ ইমাম চিৎকার করে বললেন।
তখন থেকে মহল্লার সবাই পানি বিক্রেতার ছেলে নাবকার জীবনের অন্যদিক সম্পর্কে জানতে পারে।
ছেলেটির আচার-আচরণ কতটা বেহায়া হয়ে উঠেছে, তা দেখে লোকজন হতবাক হয়ে যায়। তার মতো দশ বছরের একটা ছেলের, এমনকি কোনো উন্মাদের কাছ থেকেও তারা কেউ আশা করেনি। ছেলেটি মহল্লার সম্মানিত লোকজনের মুখোমুখি হতে শুরু করে এবং সাধারণত এ ধরনের বাক্য দিয়ে তাদের সম্বোধন করে :
‘আপনার নিজেকে নিয়ে লজ্জিত হওয়া উচিত!’
‘কীভাবে আপনি এ ধরনের কাজ করেন?’
‘আপনি কী এখনও আত্ম-সম্মানের অভিনয় করেন?’ এ ধরনের সম্বোধন দিয়ে শুরু করার পরে ছেলেটি লোকজনের নৈতিকতা অথবা আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করে। ফলাফল দেখা যায় যে, সবাই রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি করে। লোকজন ভেবে পায় না যে, ছেলেটি কোন সূত্র থেকে এসব গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সমস্ত সম্ভাব্য রূপ নিয়েছে : ষড়যন্ত্র ও শত্রুতা এবং দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্ক। কথাটা বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, মহল্লায় শয়তান ছেলেটির ওপর ভর করেছে। মসজিদের ইমামের জন্য সম্পূর্ণ ঘটনাটি বেশ কঠিন হয়ে পড়ে; তিনি ঘটনার জন্য কোনোভাবে নিজেকে দায়ী করেন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়া নেতিবাচক মন্তব্য তার ওপর প্রভাব ফেলে এবং তিনি নাবকার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন।
‘তুমি তোমার মসজিদে ফিরে যাও!’ তিনি চিৎকার করে বললেন।
‘তুমি তোমার মসজিদে ফিরে যাও!’ ছেলেটি ইমামের চেয়েও আরও জোরে চিৎকার করে বলল। ‘আমার আর কোনো মসজিদ নেই।’
ইমাম তার বিরুদ্ধে ধর্মের বিরোধিতা করার অভিযোগ করেন। তিনি ছেলেটিকে সব শক্তি দিয়ে জোরে ঘুষি মারেন। যা হোক, ছেলেটি অচেনা নতুন শক্তির বদৌলতে ইমামকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পেরেছে। নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ইমাম পেছন দিকে পড়ে যান এবং আতঙ্কে কাঁপতে থাকেন। তড়িঘড়ি করে মহল্লার প্রধান ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন।
‘চিরকালের জন্য সুনাম হারানোর আগে তাড়াতাড়ি মহল্লায় যাও,’ ইমাম ছেলেটিকে বললেন। ‘আমি কখনো একটি মিথ্যা শব্দ উচ্চারণ করব না,’ ছেলেটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জোর গলায় বলল। ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে,’ জবাবে মহল্লার প্রধান চিৎকার করে বললেন। ‘আপনি নিজেকেই সম্মান করেন না,’ ছেলেটি উন্মাদের ভঙ্গিতে বলল। ‘সুতরাং আপনি কীভাবে লোকজনকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথা বলেন?’ আর এ কথাটাই মহল্লার প্রধানকে অগ্নিমূর্তি করে তোলে এবং তিনি বেতের লাঠি দিয়ে ছেলেটিকে প্রহার করেন। তিনি প্রথমে হালকাভাবে আঘাত করেন, কিন্তু ছেলেটি তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি এবং একটুও নড়েনি। যখন তিনি ছেলেটিকে জোরে প্রহার করেন, ছেলেটি তখন স্থবির হয়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই হতাশা নিয়ে দেখছিল। মনে হচ্ছিল ছেলেটি যেন ক্রমশ শক্তি অর্জন করছে এবং আঘাত হজম করার জন্য আরও সক্ষম হচ্ছে। সবার সম্মুখে অন্য জগতের অলৌকিক একটা কিছু ঘটছে।
পরে নাবকা সম্পর্কে আমি যা শুনেছি, তা তার কঠিন আচরণের খণ্ডিত এবং অতিরঞ্জিত বিবরণ। তবে মহল্লায় সংঘটিত কোনো এক লড়াই সম্পর্কে বিভ্রান্তকর বিবরণ পাওয়া যায়, যেখানে সমস্ত ধরনের লোক জড়িয়ে পড়েছিল। তা সারাদিন ধরে চলেছিল এবং বিকেলের দিকে ব্যর্থ হয়, যখন অন্ধকার নেমে এসেছিল। লোকজন বলাবলি করছিল যে, নাবকাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জনগণ তাকে পদদলিত করেছে। যা হোক, কবরের বাসিন্দারা নিশ্চিত করেছে যে, সে এখনো বেঁচে আছে। তারা তাকে ভূগর্ভস্থ এলাকার আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। তার প্রত্যেকটি কদমে সে বড় থেকে আরও বড় হতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে বিশাল জায়গা দখল করেছে। একসময় তারা তার মাথা আর দেখতে পায় না, যা স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।
আর আজও লোকজন বিশ্বাস করে যে, নাবকা পুরনো দুর্গে বসবাস করছে।
লাতিন আমেরিকান সাহিত্য নিয়ে মোহাম্মদ রফিকের গদ্যগ্রন্থটির নাম কী?
প্রশ্নটির সঠিক উত্তর হাতে লিখে পাঠান ধ্রুপদির ঠিকানায়। নির্বাচিত সঠিক উত্তরদাতাদের একজন পাবেন ধ্রুপদির সৌজন্যে মূল্যবান বই। উত্তর ধ্রুপদির ডেস্কে পৌঁছাতে হবে ২৩ আগস্টের আগে।
ধ্রুপদি জিজ্ঞাসা ২৭-এর সঠিক উত্তর
কপিলার লেখক কবি মোহাম্মদ রফিক
অজস্র সঠিক উত্তরের মধ্যে ভাগ্যপরীক্ষা পেরিয়ে মূল্যবান বই জিতেছেন ঢাকার আগারগাঁওয়ের আবদুল বাতেন শরীফ। আপনাকে অভিনন্দন।
ধ্রুপদিতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা : বিভাগীয় সম্পাদক, ধ্রুপদি, দৈনিক দেশ রূপান্তর, পঞ্চমতলা, রূপায়ণ ট্রেড সেন্টার, ১১৪ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, বাংলা মোটর, ঢাকা-১০০০ ।
লেখা পাঠানো যাবে ইমেইলেও [email protected] ঠিকানায়।
যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে ভিসানীতি আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় তারা ভিসানীতি ঘোষণার কার্যকারিতার কথা জানালো। এই ভিসানীতি কার্যকারিতার কথা তারা তখন জানালো যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার এক বৈঠকে আবারও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকের পর আজরা জেয়া নিজেই এক্সে (সাবেক টুইটার) সচিত্র একটি পোস্ট দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি সাইড ইভেন্টের আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আবারও যুক্ত হতে পেরে সম্মানিতবোধ করছি। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, অংশীদারত্বের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি এবং ৯ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উদারতার সঙ্গে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছি।’
বৈঠকে আজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেয়া রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন।
জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত, অন্যথায় এই অঞ্চল নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক কারবার। রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কারণ তাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে এবং তারা সেখানে কোনো ভবিষ্যৎ অনুভব করছে না।
একটা বিষয় খেয়াল করলে বুঝা যাবে, উজারা জেয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর পরই বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি ছিলো, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, তাদেরকে নিজ দেশ ফিরিয়ে নিতে যত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।এ থেকে বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে, রোহিঙ্গাদের কর্মসংসস্থানের প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হয়েছে। এই প্রস্তাব ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আর কী কী প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিল তা আমরা জানি না। মনে হচ্ছে, এমন কিছু প্রস্তাব হয়তো প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছিল যেগুলো তিনি নাকচ করে দিয়েছেন।এবার আসা যাক বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। অনেকদিন ধরে তারা সেটি বলে আসছে। বাংলাদেশের তরফ থেকেও বার বার জানানো হয়েছে যে, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হবে। তারপরও তারা ভিসানীতি আরোপ করে সেটি কার্যকর করতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- নির্বাচন তো এখনও হয়নি। তার আগেই কেন ভিসানীতি আরোপ ও কার্যকর করা হলো?
এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই এসব ভিসানীতি, নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। গণতন্ত্র, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট শুধুমাত্র ইস্যু। নিজের দেশেই আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে নানান কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। নিজের দেশেই যেখানে বাইডেন প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে অন্যদেশের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের এতো মাথা ব্যাথা কেন?
বাংলাদেশেই যে তারা প্রথম ভিসানীতি আরোপ বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক অতীত ঘাটলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র আরও বহু দেশের সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদদের উপর একইভাবে ভিসানীতি এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এটা নতুন কিছু নয়। যেখানেই তাদের স্বার্থ জড়িত সেখানেই তারা একই পথে হেঁটেছে। কিন্তু কোথাও তারা সফল হতে পারেনি। সব জায়গা থেকেই ফিরেছে শূন্য হাতে। আমরা যদি ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে সিরিয়া, ইরান, মিশর, তুরস্ক, রাশিয়া, বেলারুশের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এদের সবার উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি কিংবা ভিসানীতি আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু খুব একটা ফল হয়নি।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সেদেশে সামরিক অভ্যূত্থান হয়েছিল। সেই অভ্যূত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ইন্ধন দিয়েছিল। ২০২১ সালে তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমান সৌলু যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনের বিষয়টি স্পষ্ট করেন। ভেনিজুয়েলায় নিজেদের পছন্দের লোক গুইদুকে প্রেসিডেন্ট করতে না পেরে মাদুরোকে বার বার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।পাঠকদেরকে হালের একটা তথ্য দিয়ে রাখি। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের উপরও। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। বারাক ওবামা ভারত সফরের পর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তার সফরের বেশ কিছু দিন পর ভারত নাসার সঙ্গে চুক্তি করল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গুজরাট দাঙ্গার কারণে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। পরবর্তিতে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, কারা সরকার পরিচালনা করবে- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক শুধুই বাংলাদেশের জনগণ। এখানে বাইরের রাষ্ট্র সে যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা অন্য কোনো দেশ হোক কারোরই হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। যখনই বাইরের কোনো রাষ্ট্র কোনো অজুহাতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে তখনই বুঝতে হবে ওই দেশের বৃহত্তর স্বার্থ আছে। আর এসব নিষেধাজ্ঞা, ভিসানীতি আরোপে এদেশের সাধারণ মানুষের কিছুই যায় আসে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্ত করেছে এবং করছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী নিজামুল হক বিপুল
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’