
দুরন্ত কিশোর
দুরন্ত কিশোরবেলার সুখ
ফিরে আসে নতুন বারতা নিয়ে
জীবনকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়
আরেক ফাগুনের আহ্বানে।
তবুও রঙিন প্রজাপতিরা
বিষাদের গান গেয়ে যায়
কোকিলের সুরে বেজে ওঠে
উন্মাদনার ঢেউ।
সত্তা
জীবন এক জটিল সত্তা
কখনো কাছে
কখনো দূরে
কখনো সে
জটিল সমীকরণের আঁধার।
তবুও আনন্দ বিষাদ
লেপ্টে থাকে সময়ের গায়ে গায়ে।
শতাব্দীর সমান্তরালে অভিজ্ঞতা বিলিয়ে
আরেক প্রজন্মের করতলে উজ্জীবিত হয় জীবন।
উজ্জ্বল হাসি
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে
জেগে ওঠে ভোর
ফিরে আসে মিষ্টি সকাল
ফিরে আসে রোদ।
মনের নীরবতা দেখে
ফিরে যায় শঙ্খচিল
আরেকটি উজ্জ্বল হাসির প্রত্যশায়
কেটে যায় কয়েক যুগ
অবসাদ
এক উদ্দাম হিংস্রতা
আটকে যায় কিশোরীর চোখে
তীক্ষè অপমানে জর্জরিত হয়েও
জেগে ওঠে মিষ্টি প্রেম।
না পাওয়ার অবসাদে
হারিয়ে যায় গোধূলিগুলো
তবুও ফিরে ফিরে আসে
জীবনের ঝরা পাতাগুলো
একদিন তাকে নিয়ে মতিঝিল অফিস পাড়ার এক ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছি। ভদ্রলোক অফিসের বড় কর্তা, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তার রুমে ঢুকতেই তিনি আমার সঙ্গের জনকে দেখে কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। সারাক্ষণ তিনি আমার পাশে বসেছিলেন। পরিচয়ের সুবাদে মুখে হাসি ঝুলিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে যৎসামান্য আলাপ বিনিময়। তাকে দেখে ভদ্রলোক কেমন কাঁচুমাচু হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। ভদ্রলোক অন্যদিন আমার সঙ্গে যেরকম স্বাভাবিক হয়ে কথা বলেন সেদিন আর তা করলেন না। চুপসে গেলেন টুকটাক কথা বলে তার অফিস থেকে বিদায় নিয়ে রিকশা করে পল্টনে ধ্রুব এষের বাড়িতে ফিরছি। পাশে তিনি পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসে আছেন।
এমনিতে তিনি কথা বলেন খুব কম। তার কথা বলার ভাষা একেবারে নিজস্ব। কথা বলার ভঙ্গিও আর দশজনের চেয়ে ভিন্নতর। তার কণ্ঠস্বর আশ্চর্য রকমের মাদকতাময় নেশায় মোড়ানো সেই নেশার ভেতরে কোথায় যেন পুরুষালি একটা ব্যাপারও লুকিয়ে থাকে। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে কেউ তার কথা শুনলে প্রেমে না পড়ে যাবেন না।
রিকশায় বসে তিনি রাস্তার আশপাশ দিয়ে অতিক্রান্ত হওয়া রিকশার দিকে তাকান। তিনি যখন সময় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অতিক্রান্ত হতে থাকা রিকশার দিকে তাকিয়ে থাকেন তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না রিকশা করে সুন্দর চলে যাচ্ছে।
অনেক আগে, একদিন রিকশায় যাচ্ছি। বেশ কয়েকবার তিনি ওরকম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলেন দেখে আমি জানতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বুলু ভাই, অমন কইরা কী দেখেন?
কাদামাটি, কাদামাটি
সেই প্রথম তার কাছ থেকে আমি জানলাম কাদামাটি মানে অনিঃশেষ সুন্দর আর সুন্দরের প্রতিমা।
রিকশায় বসে তিনি পকেট থেকে তার চির পরিচিত সিগারেট বের করে ধরালেন। তিনি দুআঙুলে এমন আলতো করে সিগারেট ধরেন তাতে মনে হয় তিনি যেন সিগারেট না, ধরে আছেন পুঁই শাকের কচি ডগা। রিকশা দৈনিক বাংলা পার হয়ে বায়তুল মোকাররমের কাছাকাছি আসতেই তিনি সিগারেটের ছাই কায়দা করে ফেলে আমাকে বললেন, কার লগে দেহা করাইতে লয়া আইলেন মিয়া? ব্যাডায় দেহি কথাই কয় না
তার কথায় আমি হেসে দিয়ে বলি,
আপনারে দেইখা মনে হয় হালার পিলা-উলা কাঁইপা গেছে গা
তিনি বাচ্চা মানুষের মতো সারল্যমাখা হাসি হেসে বললেন, আপনে মিয়া আসলেই আউরা
আউরা মানে পাগল। আউরা মানে তার ছেঁড়া যার কোনো কিছুর ঠিক-ঠিকানা নেই।
আপনেরে আর ধ্রুবরে দেইখা দেইখা আমার এই দশা হইছে বলে আমি হাসতে থাকি।
বুঝলাম আমার কথায় তিনি মজা পেয়েছেন। খিলখিল হাসির শব্দ শুনি।
বেশির ভাগ মানুষ বুলবুল চৌধুরীকে নির্ণয় করে তার গল্পগ্রন্থ ‘টুকা কাহিনী’ দিয়ে। ১৯৮৭ সালে এক সাহিত্য সভায় অগ্রজ লেখক আলী ইমামের মুখে শুনেছি, ‘টুকা কাহিনী’ দিয়েই বুলবুল চৌধুরী সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি লেখালেখিতে ঢোরা সাপ না জাত কেউটে সাপ।
তখন সবে কলেজ শেষ করে ডিগ্রি ক্লাসে পড়ি। তখনও বুঝে উঠতে পারিনি লেখালেখিতে আবার জাত কেউটে সাপ কী জিনিস! পরে বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে মিশতে মিশতে আর তার লেখা, চলনবলনের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে বুঝতে পেরেছি লেখালেখিতে তিনি শুধু জাত কেউটে সাপই না, তারও অধিক কিছু। বুলবুল চৌধুরী আলাদা এক স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি নিজস্ব এক গদ্যরীতিও নির্মাণ করতে পেরেছিলেন তিনি। ছোট ছোট বাক্যে, গ্রামীণ প্রচলিত শব্দ টেনে এনে গল্পে ব্যবহার করে চমকে দিতেন পাঠক তার গ্রামীণ শব্দ আর রূপকল্পে খুঁজে পেতেন নিজেদের জীবন, অভিজ্ঞতা, স্মৃতি। বুলবুল চৌধুরীর গল্প আর গদ্যে সহজাতভাবে এসে ভর করত গ্রামীণ ছায়া- রূপরস-গন্ধ। তিনি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারে ছিলেন অনন্য জাদুকর। তিনি তার লেখায় কত অনায়াস ভঙ্গিতে ‘নিড়ান দেও কেরে’, ‘বাদাইল্লা’, ‘হেজা’, ‘কড়ূল’, ‘চেডে জানে’, ‘কান্দা জামিন’, ‘ঠেহা’সহ এ রকম প্রচুর লোকজ শব্দের শৈল্পিক প্রয়োগ করেন ভাবলে অবাক হতে হয়।
তার গল্প ‘টুকা কাহিনী’ প্রকাশ পেয়েছিল
স্বাধীনতার পর পর। আর বই হিসেবে বেরিয়েছিল ১৯৭৭ সালে। প্রথম বইতেই তিনি আমাদের কথাসাহিত্যে তার আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন।
বুলবুল চৌধুরীর সাহিত্যে ঘুরেফিরে গ্রামের জীবন উঠে এসেছে এক জীবনে তিনি যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তা ছিল অন্য লেখকদের জন্য ঈর্ষা করার মতো।
বুলবুল চৌধুরী নিজের মতো করে সারাটা জীবন লেখার মধ্যেই থেকেছেন। জাগতিক কোনো বিষয়-আশয় তিনি বুঝতেন না। একে-তাকে ভাঁজ দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করা কিংবা অন্যদের মতো কখনো কোনো গোষ্ঠী কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে বন্ধক দেননি বিক্রিও করতে দেননি।
একটা জীবন খুব সাদামাটাভাবে পার করে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন তিনি। লেখালেখিতে পুরস্কার, সম্মান অনেক বিলম্বে পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এসবের জন্য কখনো কাউকে কিছু বলেননি।
দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য, জীবদ্দশায়
বুলবুল চৌধুরীর যেভাবে মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। সাহিত্য সমালোচকদের কাছে তিনি ক্ষেত্রবিশেষে অবহেলিত অনালোকিত রয়ে গেছেন। তার কারণও বোধ হয় বুলবুল চৌধুরীর মাত্রাতিরিক্ত নীরব থাকা আর প্রচারবিমুখতা। ‘টুকা কাহিনী’, ‘জল টুঙ্গি’, ‘পাপ পুণ্যি’, ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’, ‘মাছের রাত’, ‘মাছ’, ‘খরা’, ‘ঘর ছিল’, ‘সংসার’, ‘নিরবধিকাল’, ‘অচেনা নদীর ঢেউ’, ‘দ্বিতীয় বাসর’, ‘চৈতার বউ গো’, ‘পরমানুষ’, ‘তিয়াসের লেখন’সহ এ রকম আরও অনেক গল্প-উপন্যাসের ভেতরে তাঁকে মূল্যায়নের চেষ্টা হয়।
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন জানিয়েছেন, আমার দেখা প্রথম লেখক বুলবুল চৌধুরী। আমি শুরুর দিকে তাকে দেখে তার লেখা আর হাঁটাচলা অনুকরণ করতাম। কি অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে তিনি আমাদের সাহিত্যে এসেছেন অথচ আমরা তাকে সেরকম জায়গায় বসাতে পারিনি। একবার এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে বুলবুল চৌধুরীর উপস্থিতিতেই মিলন ভাই বলেছিলেন, ‘আমি একসময় লেখালেখি করে বুলবুল চৌধুরী হতে চেয়েছিলাম। গ্রাম্যজীবন বর্ণনার ক্ষেত্রে আমাদের লেখকদের মধ্যে তার ধারে কাছে কেউ নেই। আমি তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি।’
বুলবুল চৌধুরী সেই রকম একজন মানুষ, যার ঘোর দীর্ঘকাল আমাকে আকৃষ্ট করে রেখেছিল। একটা কিছু যেন ছিল তার মধ্যে। গত বত্রিশ-তেত্রিশ বছর ধরে তার সঙ্গে চলাফেরা করছি, ঘুরছি, ফিরছি, আড্ডা মারছি, পাশাপাশি হাঁটছি অথচ তাকে ঠিক মতো ঠাওর করে উঠতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি যেন কোথায় ডুবে আছেন, মজে আছেন।
কোথায় ডুবে আছেন! কোথায় মজে আছেন!
তেত্রিশ বছরের অধিককাল ধরে তাকে চিনি, জানি আর মানি। তাকে ঘিরে রয়েছে কত কত অভিজ্ঞতা আর বিচিত্র আড্ডা।
সংসার চালানোর জন্য বাজার সদাই করার টাকা-পয়সার দরকার হলে বাংলাবাজারের প্রকাশকদের কাছ থেকে কখনো পাওনা টাকা, কখনো অগ্রিম কখনোবা হাওলাত হিসেবে নিতেন। বেশির ভাগ প্রকাশকদের কাছে তিনি খুব আপনজন।
ভাবা যায়! একটা মানুষ গোটা একটা জীবন চাকরিবাকরি না করে, শুধু লেখালেখি, আড্ডাবাজি আর অকাতরে এর-তার উপকার করে করে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন!
বিক্রমপুরে হ্যাডম বলে একটা শব্দ আছে। এর মানে হলো সবকিছুকে অতিক্রম করতে পারার সাহস। বুলবুল চৌধুরীর লেখালেখির শুরু থেকে সেই হ্যাডমটা ছিল। তিনি কারও কাছে মাথা নত না করে, নিজেকে বন্ধক না রেখে, বিক্রি না করে নিজের মতো করে একটা জীবন উপভোগ করে গেছেন।
দেশ ছাড়ার অনেক আগে শহীদ কাদরী তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটি লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি একই সঙ্গে গৃহী এবং বৈরাগ্য প্রিয়। ঘর এবং নির্বাসন দুটিই তার অভীষ্ট। সময় তাকে বাঁধতে পারে না, কিন্তু সময়কে তিনি প্রামাণ্য করেন। দেশও তাকে আটকাতে পারে না, কিন্তু দেশকে তিনি অন্তরে গেঁথে রাখেন।
এই নিরুদ্দেশ যাত্রা যে দেশ ছেড়ে যাওয়া নয়, বরং সমাজের ভেতরের রুগ্নতা থেকে নিজেকে দূরত্বে রাখার প্রবণতা সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার দেশ ছাড়ার আগে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’-এ লিখেছেন ‘দাঁড়াও আমি আসছি’। পরাবাস্তব এই কবিতায় তিনি বলেছেন
‘এখন আমি কোনোদিকেই যেতে পারছি না/
সে কোন সকাল থেকে শুরু হয়েছে আমার অঙ্গভঙ্গী/আমার ডুব-সাঁতার, চিৎ-সাঁতার/
উবু-সাঁতার, মৃদু-সাঁতার, মরা-সাঁতার, বাঁচা-সাঁতার/হ্যাঁ, সত্যি। সাঁতার দিতে দিতেই আমার যেন বয়োবৃদ্ধি হলো,/জলের ওপর আমার কৈশোর, আমার যৌবন/কচুরিপানার মতো ভেসে/বেড়াচ্ছে কী দারুণ সবুজ!//
‘দাঁড়াও, আমি আসছি.../ পৃথিবী তাকে ডাকছে। কিন্তু তিনি জানেন তিনি বৃত্তাবদ্ধ। বের হতে পারছেন না। প্রথমবার নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতাটি লেখার প্রায় চল্লিশ বছর পরে ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ কাব্যে শহীদ কাদরী আবার লিখলেন ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ নামে আরেকটি কবিতা। ততদিনে তিনি জার্মানি-ব্রিটেন হয়ে আমেরিকায় থিতু হয়েছেন। এবার তিনি দেশে ফিরে যেতে চান। সেই কবিতায় তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন কেন তিনি দেশে ফিরে যেতে পারেননি! ‘তিন তিনটি মহাদেশ থেকে/অন্তত ছয়বার উড়োজাহাজের টিকিট কিনেও
তোমাদের উঠোন পেরিয়ে/নিজস্ব আটচালার দিকে যাত্রা সাঙ্গ হয়নি এখনো!...// কিন্তু এই নিরুদ্দেশ যাত্রা ঘরের দিকেই-পদব্রজে, হামাগুড়ি দিয়ে, গিরগিটি বা সাপের মতো
বুকে হেঁটে হেঁটে...।
কবি যখন বলেন, ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর’, তখন মানবজীবনের দুটি সত্য উদঘাটিত হয়। এক, মানুষের আরাধ্য নয় তার নির্বাসন, দুই, তবুও মানুষকে মেনে নিতে হয় তার নির্বাসিত জীবন। এই দুই দ্বন্দ্ব মানুষের জীবনে যে টানাপড়েন তৈরি করে তার কোনো উপসংহার নেই। কারণ প্রতিটি মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা বাস করে। সে একদিকে গৃহী, অপরদিকে সে সন্ন্যাসীও। তবে প্রকৃত বিচারে প্রতিটি মানুষই নির্বাসিত। অনস্বীকার্য যে, মাতৃজঠরই মানুষের মৌলিক আবাস। সেখান থেকে স্খলনের মুহূর্ত থেকে নির্বাসনের শুরু। জীবনের বিভিন্ন স্তরে তাকে মুখোমুখি হতে হয় নির্বাসনের। ভিন্নমতের কারণে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়া সবচেয়ে কষ্টের নির্বাসন। তেমনই স্বেচ্ছা নির্বাসনের পরিণতিও শেষপর্যন্ত সচেতন মানুষের জীবনে পরোক্ষ ট্র্যাজেডি হয়ে আসে।
শহীদ কাদরী তার প্রথম কাব্য ‘উত্তরাধিকার’-এর নাম কবিতায় স্পষ্ট করেই বলেছেন ‘জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃ জরায়ন থেকে নেমে/সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিলো যেন/ দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে’//দেশান্তরী হওয়ার বাইরেও আরেক ধরনের নির্বাসন শনাক্ত করা হয়েছে। এই নির্বাসন শারীরিকভাবে নয়, বৌদ্ধিক-মানসিক এবং চৈতন্যের। মানুষের যখন জীবনবোধ দৃঢ় হয়, স্বকীয় হয়, আত্ম পরিচয়ের ধারণা প্রবল হয়, নিজের চিন্তা যখন নিজস্ব হয়, তখন অন্য মানুষের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। এটাও এক ধরনের নির্বাসন, নিজ গৃহে পরবাসী। নির্বাসনের ধারণা এসেছে মানুষের একাকিত্ব থেকে এবং মানুষ শেষ পর্যন্ত একা। তারা সম্মিলিতভাবে হাসতে ভালোবাসে। কিন্তু কাঁদতে চায় একা, একাকী, আড়ালে। এই একাকিত্বই নির্বাসন। শহীদ কাদরী বলেন, ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর/ব্যক্তিগত গ্রাম থেকে অনাত্মীয় শহরে/পুকুরের যৌথ স্নান থেকে নিঃসঙ্গ বাথরুমে...’।
কাম্য না হলেও কবিকে এই নির্বাসন মেনে নিতে হয়েছিল। তিনি নাগরিক কবি হওয়া সত্ত্বেও ‘পুকুরের যৌথ স্নান’ যখন ফিরে পেতে চান, বোঝা যায় তিনি নস্টালজিয়া বা স্মৃতিকাতরতা দ্বারা তাড়িত। স্মৃতিকাতরতা নির্বাসনের একটি অনুষঙ্গ। অস্তিত্ববাদের মূলেও রয়েছে একাকিত্ব।
দুটি মানুষ একসঙ্গে থাকলেও আসলে তারা দুটি মানুষ। তাদের চিন্তাচেতনা, বেদনাবোধ, আনন্দের অনুভূতি একরকম নয়। মূলত যে বোধটি তাকে নিজের মতো করে বাঁচতে শেখায়, সেই বোধটি আনন্দের নয়, বেদনার।
শুধু লেখক বা শিল্পীর জন্য নয়, মানুষের জীবনের অন্যতম শক্তি তার অতৃপ্তিতে। এই অতৃপ্তি তাকে অতীতকে ভালোবাসতে শেখায়। এই অতৃপ্তি তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়। শহীদ কাদরীর মতো স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন না জীবনানন্দ দাশ। তিনি পথচলাকেই আরাধ্য করেছিলেন। সেই পথ ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ‘সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/ অনেক ঘুরেছি আমি; আরও দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে’ (বনলতা সেন)। কিন্তু শহীদ কাদরী তিনটি মহাদেশ ছুঁয়েছেন (তিন তিনটি মহাদেশ থেকে/অন্তত ছ’বার উড়োজাহাজের টিকেট কিনেও...)। জীবনানন্দ দাশ মেনেছেন ‘সব পাখি ঘরে আসে... সব নদী... ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন।’
শহীদ কাদরী এখানে সংশয়াক্রান্ত। তিনি জানতেন তার আর ঘরে ফেরা হবে না। তিনি তখন বলেন: ‘বৃষ্টিশেষের সন্ধ্যাবেলায় এই যে আমি একা একাই/গাছতলাতে দাঁড়িয়ে আছি।/
তোমার মতোন আমি কি তাই বলতে পারি/
‘যাচ্ছি বাড়ি ।...// ঘর ছেড়ে যে বেরিয়ে গেছে তার থাকে না/ ঘরবাড়ি।’
হিটলারের নির্যাতনের ভয়ে দলে দলে লেখক ও শিল্পী আত্মরক্ষার্থে ইউরোপে ও আমেরিকাতে আশ্রয় নেন। কেউ থেকে যান। কেউ ফিরে যান জন্মভূমিতে। কিন্তু এই লেখক ও কবিদের মধ্যে নতুন এক মনস্তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। নির্বাসনের কারণে একজন লেখকের বা শিল্পীর মনোজগতে যে ব্যাপক ভাঙচুর হয়, তার প্রতিফলন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। পাশাপাশি অনেক কবি ও লেখক নির্বাসনের ভয়ে দেশ ছাড়া না হলেও নিজ দেশে থেকেই মনোজগতে নির্বাসন ধারণ করেন। তার অনুরণন দেখা যায় তাদের সৃষ্টিকর্মে। অন্যদিকে পৃথিবীজুড়েই লাখ লাখ মানুষ স্বেচ্ছায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন নানা কারণে। এদের মধ্যে যারা লেখক-শিল্পী তাদের মনোজগতে নতুন এক ধারণা তৈরি হয়। কখনো সেটা ছেড়ে আসা দেশের জন্য আহাজারি, কখনো দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি। এই সবই তখন হয়ে ওঠে তাদের লেখার বা শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু। দেশত্যাগী লেখকদের মধ্যে দুটি ধারা বেশ প্রবল। একটি হলো দেশ থেকে যতদূরে যাক, দেশ তাকে টানে। আরেকটি হলো ধীরে ধীরে দেশ অপসৃয়মান হতে থাকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারণে।
নির্বাসনকে পশ্চিমা মনীষীরা পরিত্যক্ত করেননি। বরং নগরসভ্যতার এই কালে তাকে আধুনিক মননশীলতার অনুষঙ্গ করেছেন। জ্যাকসন পোলক সেই অর্থে নির্বাসিত না হলেও তার চিত্রকর্মকে নির্বাসিত মননের যথার্থ প্রতিফলন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চিত্রকর্মের কোনো পার্সপেকটিভ নেই, আছে সর্বজনীনতা। এঁকেছেন হোরাইজেন্টালি, কিন্তু ভার্টিকালি দেখলেও এর ইন্টার প্রিটেশনে কোনো সমস্যা হয় না। শুরুতেই যেভাবে বলেছি নির্বাসনের সূচনা মাতৃজঠর থেকে স্খলনের মুহূর্তে, জ্যাকসন পোলোকের চিত্রকর্ম যেন সেই আমৃত্যু আজীবনের চেতনাকেই ধারণ করে।
তবে নির্বাসিত শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্ট ঘরেফিরে যেতে চান। চান নির্বাসিত জীবনের সমাপ্তি। তার চিত্রকর্মেও তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যেমনটি শহীদ কাদরীর কবিতায় আমরা পাই। কিন্তু মানুষ কি পারে অতীতে ফিরে যেতে? যে জন্মভিটা, যে দেশ, যে স্বজনদের পেছনে ফেলে আসে, সেখানে আর কখনোই ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব কেবল স্বপ্নে ও কল্পনায়। তবে তা অবশ্যই অবিকৃতভাবে নয়। সেই অতীত ঝাপসা, দুমড়ানো, মোচড়ানো। কারণ সময় সবকিছু ভেঙে ফেলে। সব কিছুর বিবর্তন ঘটায়। নির্বাসনের চেতনা তাই পরাবাস্তব চেতনা হয়ে ওঠে। শহীদ কাদরীর নির্বাসন ও স্মৃতিকাতরতাও বাস্তব এবং সর্বজনীন। কবি যখন বলেন, ‘একটি আংটির মতো তোমাকে পরেছি স্বদেশ’ তখন সব সংশয় বিলীন হয়, জানিয়ে যায়, তিনি সত্যি সত্যিই নির্বাসন চাননি। দেশই তার আরাধ্য, নির্বাসন নয়।
সাড়া
ভাঙা করোটির রূপ ধরে পড়ে আছে দেশ
নিঃসীম সমুদ্রকিনারে
থেকে-থেকে ঘূর্ণিবাতাস ওঠে, উড়ে যায় ভস্মকণা
বালিতে পায়ের ছাপ পড়ে থাকে শত-শতাব্দী ধরে
এইখানে একা এসে দাঁড়িয়েছি আমি
এইখানে একা এসে দাঁড়িয়েছ তুমি
চৈত্রের অবেলায়
শান্ত হলুদ আলোয় ভাসে স্বর্ণাভ মুখ
বিষন্ন উজ্জ্বল আকাশে কি ভেসে যায় রক্তজবা
তার পাপড়িতে নেমে আসে বাদুড়ডানার মতো
ব্যাপ্ত অন্ধকার
এই দীর্ঘ ঋতু জুড়ে আমি একা কষ্ট পাই
তুমিও কি কষ্ট পাও একা?
বেদনায় কালো হয়ে ওঠে কোটি কোটি মানুষের মুখ...
যদি হাত রাখি মাটিতে ও পাতার মর্মরে
যদি তোমাকেই ছুঁয়ে থাকি
যদি নাম ধরে ডাকি
সাড়া কি দেবে না ভাঙাচোরা অন্ধ চরাচর
সাড়া কি দেবে না বুকের স্তব্ধ জলস্রোতগুলি!
অনিঃশেষ
মেঘ ও মৃত্যুছায়ার ভেতর থমথম করে দিন
বুকে চেপে থাকে বোবাকষ্ট ও রাত্রিপাথর
প্রেম আর পরিচর্যার কাছে বেড়ে যায় ঋণ
কে কাকে পরিশোধ করে, যে ক্ষুৎকাতর
হাতগুলি জলস্রোত ভেঙে শূন্য আঁকড়ে থাকে
স্তব্ধ আকাশ কি তাদের সান্ত্বনা দেয়, নাকি শোক
শোকের ওপার থেকে মায়াবী ভাতের গন্ধ ডাকে
আহা ভাত আর মাটির গন্ধে খসে পড়ে নির্মোক
শতাব্দী পেরিয়ে সারি সারি কঙ্কাল হেঁটে আসে
ভয়ে নয়, ত্রাসে নয়, লজ্জায় আমার স্বদেশ
দুই হাতে ঢাকে মুখ, তবুও কে ভালোবাসে
এই জল হাওয়া মাটির সন্তান আর স্বপ্ন অনিঃশেষ
ক্ষত
ছিন্ন পলাশপাতা চৈত্রঝড়ে উড়ে যেতে যেতে
আমার বুকের উপর পড়ে থাকে স্থির হয়ে,
তার শিরা-উপশিরা ছুঁয়ে যত জলকণা, রৌদ্রকণারা
দুলে দুলে উঠেছিল প্রাণপ্রবাহে, তারা আজ মৃত?
ছিন্ন পাতাটির ক্ষতে রাখি ঠোঁট
একদিন ভোরবেলা যারা এনেছিল গান
দুপুরের আগুনশিখায় তারা ত্রস্ত মুখ ঢেকে রাখে
চৈত্রের নিঃসঙ্গ ইতিহাসে,
গোপন অস্ত্রের নিচে শুয়ে থাকে আমার আয়ুষ্কাল
স্বদেশ-সীমানা আর ব্যক্তিগত আদরের লুপ্ত চিহ্নগুলি...
পাতাটির ক্ষত থেকে উঠে আসে বিষ
নীল হয়ে ওঠে আমার দু-ঠোঁট আর অবরুদ্ধ মাটি,
দু-পাশে দাঁড়িয়ে থাকে মৃত গাছেদের সারি
মৃত মানুষের সারি
শনশন চৈত্রঝড়ে উড়ে যায় মৃতদের গান
শুশ্রুষা
বাজাও বাজাও রুদ্র ভোরের স্মরণীয় আলো
ভাঙাও এ খণ্ড পৃথিবীর অন্ধকারভরা ঘুম
শরীরে লেগে আছে অযুত রাত্রির কালো
চারপাশে এত নীরবতা মৃত্যুর মতো নিঃঝুম
বুঝি না এ পাথর কি আমার স্বদেশ, এ কবরভূমি
এ শ্মশানপথ, শনশন বাতাসের গায়ে লেগে থাকা ভয়...
জাগাও জাগাও ফুল বারুদের স্তূপে, পূর্বে-পশ্চিমে তুমি
আমিও দেখব জবাকুসুমের মতো মহাদ্যুতি, অপূর্ব বাক্সময়
এত ভস্ম পথে পথে আর শত শত চিতার আগুন
ভাসাও ভাসাও আমর্ম বৃষ্টিজলে, পাপড়িও মেলুক পাথর
সহ্য হয় না এ বিদ্বেষ বিষ দাহ, এত রক্ত, খুন
নিজেরই ছায়ার কাছে ঝুঁকে পড়ে মাথা, বিষাদকাতর
এমনই আর্ত আলোহীন দেশ জেগে ওঠে সুড়ঙ্গমুখে
তুমি তাকে দীপ্যমান হৃদয়ে জাগাও, শুশ্রƒষা দাও গভীর অসুখে
‘টুকা কাহিনী’র লেখক বুলবুল চৌধুরির পুরান ঢাকার কোন এলাকায় থাকতেন?
প্রশ্নটির সঠিক উত্তর হাতে লিখে পাঠান ধ্রুপদির ঠিকানায়। নির্বাচিত সঠিক উত্তরদাতাদের
একজন পাবেন এডুসেন্ট্রিক, মুন্সিয়ানা ও ধ্রুপদির সৌজন্যে মূল্যবান বই।
উত্তর ধ্রুপদির ডেস্কে পৌঁছাতে হবে ৬ সেপ্টেম্বরের আগে।
ধ্রুপদি জিজ্ঞাসা ২৯-এর সঠিক উত্তর
হেলাল হাফিজের দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের নাম কবিতা একাত্তর অজস্র সঠিক উত্তরের মধ্যে ভাগ্যপরীক্ষা পেরিয়ে মূল্যবান বই জিতেছেন মুক্তি হাউজিং, মিরপুরের মো. শরিফুল ইসলাম। অভিনন্দন আপনাকে। আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে পুরস্কারের বই।
ধ্রুপদিতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা : বিভাগীয় সম্পাদক, ধ্রুপদি, দৈনিক দেশ রূপান্তর, পঞ্চমতলা, রূপায়ণ ট্রেড সেন্টার, ১১৪ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, বাংলা মোটর, ঢাকা-১০০০ ।
লেখা পাঠানো যাবে ইমেইলেও [email protected] ঠিকানায়।
জুলাইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হারে বাংলাদেশ দল। যে সিরিজে চট্টগ্রামে ঘরের মাঠে টাইগাররা ২-১ ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল। আর এই সিরিজে পরাজয়ের পেছনে বড় কারণ অধিনায়ক তামিম ইকবাল! এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশ দলের বর্তমান অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।
আফগানদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ শেষে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তামিম। একদিন পরে অবশ্য অবসর ভাঙলেও সেই সিরিজ আর খেলেননি তিনি। একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় কিস্তিতে সাকিব সেই সিরিজ হারের দায় দিলেন তামিমের ওপরই।
'আফগানিস্তানের সঙ্গে সিরিজ হারটা আমি পুরোপুরি একজনকে দায় দেব, অধিনায়ক। এক ম্যাচ পরে আমাদের হাতে আরও দুই ম্যাচ ছিল। আমরা তৃতীয় ম্যাচে ঠিকই কামব্যাক করেছি কিন্তু একটা ম্যাচ সময় লেগেছে আমাদের। সুতরাং এটা আর কারো দায় নয়, পুরো সিরিজটায় দায় একজনের ওপর। বিশ্বের কোথাও অন্তত দেখিনি যে এক ম্যাচ পরেই এরকম অধিনায়ক এসে ইমোশনালি বলে ফেলেন যে আমি ভাই খেলব না আর ক্রিকেট।’
সাকিব বলেন, 'আমার ধারণা যদি কোনো অধিনায়কের দায়িত্ববোধ থাকত, সে এটা করতে পারত না। আমার কাছে মনে হয়, এটা দলকে অনেক বাজে একটা পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে এবং আমার মনে হয় ওইটাই এখনো রিকভার করতে সময় লাগছে, যেটা আমি অনুভব করি।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। রাতটা পোহালেই বাংলাদেশ দল উড়াল দেবে ভারতের গোয়াহাটিতে। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি দল। বিসিবি জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলমান তৃতীয় ওয়ানডের ম্যাচ শেষেই জানানো হবে বিশ্বকাপের দল।
প্রচুর আলোচনা ও জল্পনা–কল্পনার পর আজ বিশ্বকাপে নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির ফেসবুক পেজে আজ দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে দেখা যায় বিসিবির লোগোসংবলিত বক্সে করে গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিও–র শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, বলুন তো ভেতরে কি?
বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঘোষণা করা হবে দল। কিন্তু ৫টা ৪০ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় তৃতীয় ওয়ানডের শেষেই দল ঘোষনা করা হবে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।