ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানির মেয়ে ঈশা আম্বানির বিয়ের অনুষ্ঠান দেখলাম আমরা। কিন্তু এটি শুধু একটি বিয়ে নয় বরং ধনিক শ্রেণির যোগাযোগের রাজনীতি ও বিত্তবৈভবের নগ্ন প্রদর্শন। উদয়পুর থেকে মুম্বাই- ঈশা আম্বানির বিয়ের অনুষ্ঠান এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রদর্শনী এমন এক সংস্কৃতির অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ করল, যা অর্থ-প্রতিপত্তির পূজায় রত, তারকাদের স্বপ্নের পৃথিবীর গল্পগাথা তৈরিতে ব্যস্ত এবং সম্পত্তির নগ্ন প্রদর্শনীতে বিশ্বাসী। যেখানে সকল শ্রেণির ‘মহান’ ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি- হিলারি ক্লিনটন থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায়, শচিন টেন্ডুলকার থেকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া; এই চিত্র বা ফ্যান্টাসিগুলো ইউটিউবের মাধ্যমে প্রদর্শিত হচ্ছে এবং সব ধরনের নিউজ চ্যানেলগুলোও তা প্রচার করছে। প্রচারিত এই চটকদার গল্পগুলো পলিটিকস অব নেটওয়ার্কিং বা যোগাযোগের রাজনীতির নির্দেশক, যেখানে করপোরেট বুর্জোয়া শ্রেণিই তাদের ক্ষমতা ধরে রাখে। কেবল সেটিই নয়, পাশাপাশি নবনির্মিত গণমাধ্যম-প্ররোচিত ও প্রচারিত অতিবাস্তব জগতের প্রতি আমাদের আকাক্সক্ষার কথাও ব্যক্ত হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে। পুরাতন যুগের রাজা-রানি কিংবা রাজকন্যার বদলে এখানে স্থান করে নিয়েছে ক্রিকেটার, বলিউড তারকারা এবং করপোরেট বুর্জোয়ারা; তাদের গল্প, প্রেম-বিচ্ছেদের আখ্যান; এমনকি ওজন কমানো বা হতাশা কাটানোর ‘মেডিটেশন’ চর্চা পর্যন্ত বিমোহিত করছে আমাদের! এই অবক্ষয়ের সময়ে মুক্ত সংস্কৃতির চর্চা হয়েছে অদৃশ্য।
শুরুতেই অসংবেদনশীলতা এবং অবক্ষয়ের তীব্রতা অনুভব করা যাক। স্পষ্টত আমরা সবাই জানি, যে কী বীভৎস বৈষম্যমূলক একটি সমাজে আমরা বসবাস করছি। কদাচিৎ যেখানে সমাজতন্ত্র অথবা সমস্যায় জর্জরিত পুঁজিবাদ এবং অন্তর্নিহিত বৈষম্য নিয়ে কথা বলা হয়। সবাই অবগত যে এই ‘গণতান্ত্রিক’ সমাজ ব্যবস্থায় সব মানুষই বেঁচে থাকা, ক্রয় করা, খরচ করা এমনকি অপচয় করার জন্যও ‘স্বাধীন’! এরই মধ্যে ‘অনাড়ম্বরতা’কে আমরা প্রাচীন অভ্যাস বলে বাতিল করে দিয়েছি। এ ছাড়া আমরা এও জানি যে বিয়ে একটি উৎসব আর মানুষের অর্থ-সম্পদ থাকলে মানুষ সেটিকে আড়ম্বর এবং প্রদর্শন যোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করবে। অতঃপর এভাবেই আমরা মেনে নিচ্ছি যে এতে দোষের কিছু নেই, মি. মুকেশ ও নিতা আম্বানিও তাদের মেয়ের বিয়ের আয়োজন ঠিক সেভাবেই করেছেন। কেউ বলতেই পারেন, এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার আমরা কেন সেখানে নাক গলাব?
যাই হোক না কেন, এই যুক্তি একেবারেই ভ্রান্ত। কমনীয়তা, সংবেদনশীলতা এবং নৈতিক ভিত্তি ছাড়া কোনো সমাজই এর বৈধতা ধরে রাখতে পারে না। একটু লক্ষ করুন, বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতি যেখানে কৃষকরা উৎকণ্ঠিত এবং হতাশাগ্রস্ত; পথশিশুরা বাধ্য হয়ে ভিক্ষে করছে; রিকশাচালক, চা বিক্রেতা, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা আশ্রয় হিসেবে বেছে নিচ্ছে বাস স্টপ কিংবা রেলওয়ে স্টেশন; মুম্বাই এবং দিল্লির বস্তিবাসীরা প্রচ- অনিশ্চয়তা-অনিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা অভিজাত শ্রেণির কাছে ন্যূনতম সৌজন্যতা কি আশা করতে পারি? অত্যন্ত দুঃখজনক যে ধনিক শ্রেণি এবং ক্ষমতাবানরা তাদের জীবনের কমনীয়তাবোধ হারিয়ে ফেলেছে, এতটাই আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছে যে সম্পত্তির নগ্ন প্রদর্শন তাদের কাছে দোষণীয় বলে মনে হচ্ছে না অথচ এখানে অনাহারে মারা যাওয়া কোনো বিরল বা অপরিচিত ঘটনা নয়। দেখুন এই অশুচি মৈত্রী-অর্থের ফাঁদ যেখানে মানুষকে একত্রিত করে; গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রি প্রলুব্ধ করে; সামাজিক পুঁজি এবং নেটওয়ার্কিংয়ের ব্যবসাকে করে তোলে আরো শক্তপোক্ত। কেউই মিস্টার ও মিসেস আম্বানিকে উপদেশ দেওয়ার সৎসাহস পর্যন্ত দেখায় না যে, মানবিক কমনীয়তা অনাড়ম্বরতার মধ্যেই নিহিত এবং নোংরা অর্থের প্রদর্শন তার নৈতিক দারিদ্র্যেরই প্রকাশক। তার পরিবর্তে বরং সবাই একই তালে তাল মেলাচ্ছে- যখন ‘ভারতরত্ন’ শচিন টেন্ডুলকার তার আনুগত্য প্রকাশ করছে, ঠিক তখনই ঐশ্বরিয়া রাই তার ক্যামেরাম্যানকে আহ্বান করছে আরেকটি মুহূর্ত ধরে রাখতে, বলিউড খানেরাও নাচের প্রতি তাদের ভালোবাসা ব্যক্ত করতে ব্যস্ত। কার্ল মার্কস যথার্থই লিখেছিলেন যে অর্থ সব কিছুকেই বিপরীতধর্মী করে তোলে। হ্যাঁ, এখানে কুৎসিতই সৌন্দর্য; নেটওয়ার্কিংই সম্পর্ক; ক্ষমতাই ভালোবাসা এবং এর সবগুলোই শিল্প ও সৌন্দর্যের স্বীকৃতি হিসেবে অতি আবশ্যক।
গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু আমরাও এই ব্যাপারটিকে উপভোগ করতে শিখি, মোটেও অবাক হই না। বরং এর পরিবর্তে বলা শুরু করি আমি কেন নই? কলকাতা সেক্রেটারিয়েটের একজন সেকশন অফিসার, দিল্লির একজন ব্যাংক অ্যাকাউনট্যান্ট, মাদুরির একজন অধ্যাপক, গোয়ার একজন ফুটবল কোচ অথবা আলীগড়ের একজন ছোট্ট ব্যবসায়ী- এরা সবাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে; আমরাও সমান উত্তেজনা চাই ‘অর্থ, যৌনতা এবং গ্ল্যামার’-এর; যতটা সম্ভব তাদেরকে অনুকরণ করতে শুরু করি; ইতিবাচকভাবে দেখা শুরু করি তাদের সকল কার্যকলাপ। যে কোনো মধ্যবিত্ত লোকালয়ে প্রবেশ করলেই দেখতে পাবেন নতুন ট্রেন্ডÑ একটা ইভেন্ট ম্যানেজারকে ভাড়া করা, নিজের সন্তানের বিয়ের অনুষ্ঠান আরো জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলা, অতিকষ্টের উপার্জন দিয়ে সব ধরনের ‘নক্ষত্র ডায়মন্ড’ অলংকার কেনা, বিরাট কোহলি ও আনুশকা শর্মার মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা, সর্বোপরি নিজের ‘অবস্থান’ প্রমাণ করা- যতকিছু ‘অতিরঞ্জন’ আমাদের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করেছে এরই মধ্যে। তার মানে কি আমাদের মধ্যে একজন করে মুকেশ আম্বানি লুকিয়ে আছে- সম্পদ আহরণ, নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা করে দেখানো কিংবা প্রদর্শন এর স্নায়বিক তাড়নায় প্রলুব্ধতা? এটা কি তাদের মতো হয়ে উঠতে প্রলুব্ধ করছে যা আমরাও ভালোবাসছি? এভাবেই আমরা গান্ধী এবং মার্কস, যিশু এবং কবীরের মৃত্যু রচনা করে ফেলেছি। প্রদর্শনীর এই সময়ে অনাড়ম্বরতার আর কোনো অর্থ নেই। কমনীয়তা চাপা পড়েছে বিশ্রী সম্পদের হট্টগোলে। বিয়ে হলো দুটি আত্মার বন্ধন। সুন্দর ও পবিত্র। এটি পর্বতের শিখরে আরোহণের মতো; এটি সেই অভিজ্ঞতা যার মধ্য দিয়ে অনুভূত হয় স্বর্গীয় সুখ; ঠিক যেভাবে অন্ধকার নেমে আসে তেমনি জীবন হয়ে পড়ে রহস্যপূর্ণ। কিন্তু পুঁজিবাদ কিংবা ভোগবাদী অর্থ-ব্যবস্থা এর কিছুই বাকি রাখেনি। মিস্টার এবং মিসেস আম্বানি বিশ্বাস করুন-এটি কেবল আপনাদের কন্যার বিয়ে নয়; বরং এটি আপনাদের সম্পত্তি এবং ক্ষমতারই এক বিবৃতিনামা। এমনকি যদি আপনাদের টাকা জগতের সকল পুরোহিতকেও কিনে ফেলে এবং সকল ধরনের পূজাপাঠ করিয়েও থাকেন, তবুও এটি অবশ্যই সেই পবিত্রতার মৃত্যু। যখন সমাজের একটি বড় অংশ দুর্বিপাক এবং দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে ঠিক তখনই আপনাদের টাকার জোরালো শব্দ যেন অপবিত্রতারই ঝঙ্কার তুলছে!
দ্য নিউ লিম থেকে ভাষান্তর : তানিয়াহ মাহমুদা তিন্নি