কয়েক বছর ধরে পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে একটির পর একটি অমানবিক ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে আমাদের দেশ, কারণ শুধু একটি- তা হচ্ছে মাদকাসক্তি। মাদকাসক্তি! যাকে বলা হয় সব সন্ত্রাস ও অপরাধের জনক। একজন মানুষ যখন অন্ধকার ভুবনে পা বাড়ায় তখন সে প্রথম সিঁড়ির যে ধাপটিতে পা রাখে তা মাদকদ্রব্য। এই মাদকদ্রব্য তাকে টেনে নেয়, উৎসাহিত করে পরবর্তী ধাপগুলো পেরিয়ে যেতে। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান পরিপ্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকেছেও বেশি- ঠিক যেমনটি প্রত্যাশা মাদক ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশে ব্যবহৃত মাদকের ৯৫ শতাংশের বেশি আসে বিদেশ থেকে।
মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোনো তথ্য না থাকলেও বেসরকারি হিসাবে দেশে প্রায় ৭৫ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিল তাদের অধিকাংশই এখন ইয়াবা আসক্ত। সম্প্রতি ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণ যুবসমাজকে গ্রাস করেছে। প্রতিদিন যেমন ইয়াবা ধরা হচ্ছে তেমনি প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। এতে আওয়ামী লীগের ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার তুলে ধরা হয়েছে। এতে শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’-এর পর আসন্ন ৩০ডিসেম্বর নির্বাচনে ইশতেহারে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি ছিল সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি নির্মূল করে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে সুসংহত করার অঙ্গীকার। ইশতেহার ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্বার তুলে ধরেছেন এবং তিনি উল্লেখ করেছেন জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অভিযান অব্যাহত থাকবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই সম্প্রতি দেশে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে এবং তাতে বিপুলসংখ্যক মাদক পাচারকারী, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে সেই সঙ্গে বিগত ২১৫ দিনে বন্দুকযুদ্ধে ২৭২ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে।
সম্প্রতি সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে, বিষয়টি হচ্ছে : এখন থেকে সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করা হবে। যাদের ডোপ টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হবে, তিনি চাকরির জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন। সম্প্রতি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সময় সন্দেহ হওয়ায় ডোপ টেস্ট করার পর ১৮ জনকে মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এমনি আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাদকাসক্তির অভিযোগ নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং এদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে যদি নিয়োগের সময় ডোপ টেস্ট করা হয় তবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী উভয়েই সচেতন হবে, এবং তাদের মধ্যে ভীতি তৈরি হবে। তাছাড়া, নতুন যারা চাকরিতে আসবেন, তাদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক হলে এ সমস্যা অনেক কমে আসবে। এ কথা অনস্বীকার্য, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যেও মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বিঘিœত হচ্ছে ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ডোপ টেস্টের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করলে যুবসমাজের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মাদকাসক্তি থেকে তরুণদের রক্ষা করা, সেটা হচ্ছে ‘তারুণ্যের শক্তি- বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’। ইশতেহারে শেখ হাসিনা বলেছেন নির্বাচিত হলে ১ কোটি ২৮ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তিনি করবেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে ‘বেকার জীবন’। সেই হিসাবে এই ১ কোটি ২৮ লাখ তরুণ কর্মজীবী হতে পারলে মাদকের করাল গ্রাস থেকে তারা রক্ষা পাবে। তাই, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে তার এই মাদকবিরোধী জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার ও অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণাকে আমি ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাতে চাই এবং সেই সঙ্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রতিনিধিকে মাদকের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অঙ্গীকার জনগণের সামনে তুলে ধরার আহ্বান জানাই। কারণ জনপ্রতিনিধিরাই পারেন মাদকের অভিশাপ থেকে জাতিকে, সমাজকে, পরিবারকে মুক্ত করতে।