প্রথম পর্ব
একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক প্রফেসর ড. লুতফুল কবিরের বড় ছেলে একরামুল কবির বাবলু চৌধুরী যিনি মায়ের সূত্রে কক্সবাজারের উখিয়ায় নানার বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। বর্তমান বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুর্বদিকে মিয়ানমার সংলগ্ন নাফ খালের পশ্চিম দিক পর্যন্ত প্রায় ছয় শ বিঘার বিশাল স্টেট তার। ভদ্রলোক ছাপোষা মানুষ। ঢাকার বনানীতে পরিবারের স্থায়ী নিবাস হলেও তিনি থাকেন কুতুপালং বাজারের প্রধান সড়ক সংলগ্ন একটি প্রৌঢ় দ্বিতল বাড়িতে। বাবলু চৌধুরী রোহিঙ্গাদের নিয়ে তার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন এভাবে, তখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের প্রতাপশালী শাসন চলছে দেশে। ঢাকা থেকে দেশের সীমান্তবর্তী উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলের যোগাযোগ পরিস্থিতি এতই নাজুক ছিল যে জন্মের ৭ বছর পর্যন্ত তার এখানে আসাই হয়নি। ১৯৬১ সালে তিনি প্রথম কুতুপালং আসেন। তখন তার নানা নানী জীবিত ছিলেন। পরিবারের বড় নাতি হিসেবে তার জন্য নানীর আয়োজনের কমতি ছিল না। বাড়ির ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিলেন পুরাতন বালুখালী বাজারে (মিয়ানমার বর্ডার থেকে দু’শ গজের মধ্যে) দেশী মুরগী কিনতে। ম্যানেজার খালী হাতে ফিরলে নানী উত্তর চাইলেন, বিষয় কি? ম্যানেজার বিরক্তি নিয়ে বললেন রোহিঙ্গাদের যন্ত্রণায় বাজারে যাওয়াই মুশকিল। বাবলু চৌধুরী বলছিলেন, ম্যানেজারের মুখে রোহিঙ্গা নামটি এভাবে শুনে প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন রোহিঙ্গারা বোধ হয় মনুষ্য শ্রেণীর বাইরের কোনো প্রাণী! ফলে নানীর কাছে বায়না ধরেছিলেন রোহিঙ্গা দেখার জন্য। এখন অবশ্য তিনি রোহিঙ্গা জীবনের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। দেশ, ভিটে মাটি ছাড়া নির্যাতিত দরিদ্র এসব মানুষের জন্য আপনার আমার যে ভালোবাসা তার চেয়ে বাবলু চৌধুরীর মমতা অনেক গুণে বেশি। কাজে বাস্তবের অভিজ্ঞতাও তার ঢের বেশি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ যাত্রা সবগুলোই হাতে কলমে দেখেছেন। তিনি যে তথ্য দিলেন তাতে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে । বালুখালী এলাকার বেশিরভাগ জমি যেহেতু তার ফলে তার ওপর রোহিঙ্গাদের ভিন্ন দৃষ্টি আছে বলে বলে সন্দেহ করেন তিনি। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা গ্রামমুখী না হওয়ায় নিজের অবর্তমানে স্টেটের দেখাশোনা নিয়ে সমস্যা হবে এমন আশংকা আছে বাবলু চৌধুরীর। আর এতে রোহিঙ্গারা যদি বুঝে ফেলে তাকে সরাতে পারলে বড় সুবিধা তাহলে যেকোন মহুর্তে প্রাণনাশের আশংকা করেন তিনি। এসব কথা অনেকটা শংকা নিয়েই বলছিলেন বাবলু চৌধুরী। কারণ তার যে কাজের ছেলেটি আছে সেও রোহিঙ্গা। নাম মুহাম্মদ জালাল। জানা গেলো জালাল রোহিঙ্গা হলেও সে কখনো মিয়ানমার দেখেনি। ১৯৯২ সালের একজোডাসের (দেশত্যাগ) সময় তার মা তাকে গর্ভে নিয়ে মংডুর কাছাকাছি কোনো এক গ্রাম থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। জালাল দীর্ঘদিন ধরে বাবলু চৌধুরীর বিশ্বস্ত হিসেবে কাজ করলেও রোহিঙ্গা হিসেবে তার ওপরেও কিছুটা বিশ্বাসের ঘাটতি আছে বাবলু চৌধুরীর।
এটা তো গেলো একটা ঘটনা। সমধর্মী বহু ঘটনা আছে উখিয়া টেকনাফ এলাকায়। রোহিঙ্গারা যেখানে বাস করছেন উখিয়া উপজেলার প্রায় ১ হেক্টর সামাজিক বনায়নের জমিতে এর মধ্যে আবার স্থানীয়দের বসবাস আছে। তবে আগের দশা এখন আর নেই। দুখী রোহিঙ্গারা স্থান নিয়েছেন তাদের উঠোন পর্যন্ত। ফলে বিরক্তিটাও চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে স্থানীয়দের। অল্প জায়গায় ক্যাম্পের ভিতর এতো মানুষের গাদাগাদিতে এমন পরিবেশ হয়েছে যে শুষ্ক দিনে ধুলাবালি আর বৃষ্টিতে কাদা পানির মহারণ সৃষ্টি হবার উপক্রম। এতে মানুষের স্বস্তিকর বসবাসের দিনগুলো এরই মধ্যে ইতিহাস হয়েছে। এখানকার পরিবেশ এমন যে না ভালো রোহিঙ্গারা না ভালো স্থানীয়রা। প্রত্যকেই নিরুপায় আর অসহায়ের মতো চাওয়া চাওয়ি করে একে অন্যের দিকে। তারকাটা নামক ভয়ংকর এক জুয়া যাদের নিত্য মশামাছি জ্ঞান করছে। যাহোক এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো প্রশ্ন করেছিলেন বাবলু চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা এককভাবে উখিয়া, টেকনাফের নাকি সারা বাংলাদেশের? বাংলাদেশের। এমন উত্তরে তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন, তাহলে ১২ লাখ মানুষের বিশাল চাপ কেন শুধু দুই উপজেলার মানুষ নেবে?
স্থানীয়দের ব্যক্তিগত জমি রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার কথা বলে। যেমন জমিদাতার স্বল্প শিক্ষিত সন্তানের এনজিও গুলোতে কিছুটা মানের চেয়ে ভালো বেতনের চাকরি। রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে মোটা দাগে কিছু টাকা দেয়া ইত্যাদি। এতো কিছুর মধ্যেও চূড়ান্ত অস্বস্তি আর বিরক্তির দীর্ঘ রেখা দেখা গেছে স্থানীয়দের মাঝে। বালুখালী ক্যাম্পে জমিদাতা ৩৫ বছর বয়সী এক যুবকের সাথে কথা হচ্ছিলো, তিনি লাভ ক্ষতির হিসেব বোঝাচ্ছিলেন এভাবে- রোহিঙ্গারা আসায় স্থানীয় অন্য অনেকের মতো তারও কিছুটা আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তবে ক্লাস থ্রি পড়ুয়া তার মেয়েটির পড়ালেখা, কথা বার্তা, ব্যবহারে বিরাট পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন তিনি। সেটা কি ধরনের? জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিলেন রোহিঙ্গা ছেলে মেয়েদের সাথে মেলামেশা, শিক্ষকরা রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িয়ে পড়া, স্কুলে ঠিক মত ক্লাস না হওয়া ইত্যাদি। তিনি জানালেন তার ছোট একটি ছেলেও আছে। এখন ছেলে মেয়ের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত সর্বোপরি মানুষের মত মানুষ করতে গেলে তাকে এ এলাকা ছেড়ে হয় কক্সবাজার না হয় চট্টগ্রামে যেতে হবে। তার ব্যাখ্যাটি ছিল পুরোপুরি অর্থনীতি নির্ভর। বলেছিলেন সাময়িক কিছু টাকা অর্জন করে আমার দুটি বড় সম্পদ মানবশক্তিকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিতে চাই না। রোহিঙ্গা জীবনের সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের ধারণা এভাবেই নেতিবাচক হতে থাকলে স্বেচ্ছায় এসব মানুষ উখিয়া টেকনাফ ছেড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চল বিশেষ করে ঢাকা চট্টগ্রামমুখী হবে। ফলে আপাতত স্থিতিশীল থাকলেও রোহিঙ্গা সংকট ক্রমশ খারাপ পথে ধাবিত হচ্ছে। সমাধানের আগে সমস্যা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমরা বড় ধরণের যে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি তা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে না গেলে গভীরভাবে অনুমান করা কঠিন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দেশটির পক্ষ থেকে যত বড় প্রস্তুতি দরকার তার চেয়েও বড় প্রস্তুতি দরকার বাংলাদেশের। মানে ব্যাপারটা হচ্ছে, এই মহুর্তে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কারণে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া যতটা কঠিন নিকট ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি যেন বাংলাদেশের দিকেই ধেয়ে আসছে। পরিস্থিতি এমন দাড়াচ্ছে যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফেরত যেতে পারছে না! বিষয়টা সহজে বুঝতে মাঠ পর্যায়ের এ অভিজ্ঞতার কথা শুরুতে বলা। এর সাথে আমাদের রাজনীতির ভারসাম্য এবং কক্সবাজারসহ রাখাইন অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থার ওপর আরও বিশ্লেষণ করা দরকার। আর এসব বিশ্লেষণ শেষে দেখা যাবে যে রোহিঙ্গাদের আপাতত মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই বরং তারা হয় আমাদের সমস্যার সাথে জুড়ে গিয়ে সমস্যা বাড়াবে নতুবা উখিয়া টেকনাফের অধিবাসীদের অঞ্চল ছাড়া করবে। ইতোমধ্যে এ সন্দেহ দুই উপজেলার ৪ লাখ বাসিন্দার মধ্যে গভীরভাবে গেঁড়ে বসতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় যে কথাটি বলছি তা কি করে সম্ভব? সেটি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন। ৪ লাখ মানুষকে বিতাড়িত করবে ১২ লাখ মানুষ, শক্তিতে এটা কঠিন কিছু নয়। তবে রোহিঙ্গারা জোর করে যতটা না স্থানীয়দের বিতাড়িত করবে উপদ্রপ করে তার চেয়ে বেশি সফলতা পাবে।