শেষ পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলকই হলো। সরকারি দলের বাইরে বিএনপিসহ সবকটি নিবন্ধিত দল এতে অংশগ্রহণ করেছে। শুধু তা নয়, অনেক অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলও নিবন্ধিত কোনো দলের মার্কা নিয়ে এতে প্রার্থী দিয়েছে। শুরু থেকেই প্রায় সবার মনে একটা সন্দেহ ছিল যে বিএনপি তার দুই জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলকে নিয়ে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে, একটা অসিলা দেখিয়ে, নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে। কিন্তু এবার, তাদের দলের বা জোটের কেউ কেউ দুপুর নাগাদ নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলেও, তারা দল বা জোটগতভাবে সে-পথে হাঁটেনি।
বর্তমান সরকারের অধীনে গত দশ বছরে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার বেশিরভাগই বিএনপি ও তার সঙ্গী-সাথীরা হয় বর্জন করেছে অথবা সেগুলোতে অংশ নিয়েও নানা ওজর তুলে নির্বাচনের মাঝপথে নির্বাচনী মাঠ ছেড়ে দিয়েছে। তাদের এহেন আচরণের কারণ হিসেবে দলটির নেতারা একটি কথাই বারবার বলেছেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না তা দেখিয়ে দেওয়া এবং এ ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছেন। সন্দেহ ছিল, এবারও তারা একই উদ্দেশে একই পন্থা অবলম্বন করতে পারেন।
সন্দেহটি আরো দানা বেঁধেছিল এ কারণে যে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় দ-িত হয়ে ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই দলটির পক্ষ থেকে বেশ জোরের সঙ্গে বলা হচ্ছিল, খালেদাকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। তাছাড়া নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও ‘সহায়ক সরকার’ গঠনের ব্যাপারেও তারা বেশ সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছিল। এর পর যখন উপযুক্ত দাবিসমূহসহ তাদের সাত দফার একটি দফারও পূরণ ছাড়া ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ তারা নির্বাচনে যোগ দিলেন তখনো মনে হচ্ছিল যে আন্দোলনের একটা ইস্যু তৈরির উদ্দেশ্য মাথায় নিয়েই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরমধ্যে দলটির দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ ও বরকতুল্লাহ ভুলুর মধ্যকার যে টেলিকথোপকথন ফাঁস হয়েছে তা শুনলেও তাদের এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
যা হোক, নির্বাচনটি শুধু অংশগ্রহণমূলক নয়, বেশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটা ঠিক যে কিছু কিছু এলাকায় প্রাণঘাতী সহিংসতার কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক, এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নির্বাচনের সার্বিক ফলকে প্রভাবিত করতে পারেনি।
কেউ কেউ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার-মামলা এবং নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা ও প্রাণঘাতী ঘটনাগুলোর কথাও বলতে পারেন যা বিএনপি ও তার সহযোগীদের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে বেশ বিঘ্ন ঘটিয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, ওই সহিংসতার শিকার সরকার ও বিরোধী দল দুই শিবিরের নেতাকর্মীরাই হয়েছেন; শুধু তা-ই নয়, এসব ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই সরকারদলীয়। তাছাড়া, ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম নামে একটা সংগঠন গত ২৮ ডিসেম্বর জানিয়েছে, সহিংসতার দিক দিয়ে এবারের নির্বাচন অন্যগুলোর চেয়ে তখন পর্যন্ত অনেক শান্তিপূর্ণ ছিল। কারণ ১৯৯১ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত যে-নির্বাচনগুলোকে প্রায় সবাই আদর্শ মানেন সেগুলোর প্রত্যেকটাতেই নানা সহিংস ঘটনায় অন্তত ৪৫-এর বেশি প্রাণ ঝড়েছে। ২০০১ সালের যে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল তা ছিল সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ এবং এতে ২৪৮ জন মানুষ মারা গিয়েছিল।
আর বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের মামলা ও গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে বলতে হবে, এ দুর্গতি অনেকাংশে তারা নিজেরাই ডেকে এনেছেন। তাদের এ দুর্গতি বিশেষ করে গত ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও নির্বাচন ঠেকানোর নামে তারা এ জনপদে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল সে সবেরই ফল। এটা ঠিক যে সাম্প্রতিক সময়েও, এমনকি তফসিল ঘোষণার পরেও, তাদের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে মামলা দেওয়া হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে যেগুলো হয়তো ভিত্তিহীনও বটে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একবার কোনো কারণে জল ঘোলা হলে সে ঘোলাজলে মাছ শিকারের সুযোগ কেউই ছাড়ে না।
অনেকের ধারণা, এবারের নির্বাচনে তারা যে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না এটা বিএনপি’র অনেক প্রার্থীই, অন্তত ক্যাম্পেইন শুরুর আগে আগে, বুঝতে পেরেছেন। এ কারণে তারা তাদের নির্বাচনী বাজেটে বেশ কাটছাঁট করেছেন, যার ছাপ পড়েছে তাদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে। তা ছাড়া, অনেকে ২৪ ডিসেম্বর সেনা মোতায়েন পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ছিলেন, যে কারণে, একটি পত্রিকার দেওয়া খবর অনুসারে, অনেক বিএনপি প্রার্থী পোস্টারই ছাপাননি। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বলতে পারি, আমি ধানমন্ডির বাসিন্দা, ঢাকা-১০ আসনের বিএনপি প্রার্থী তো স্রেফ কয়েক দফা এসএমএস পাঠিয়েই ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটি সেরেছেন।
প্রার্থী নির্বাচন করতে গিয়েও যে বিএনপি একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি করেছে তা-ও কি অস্বীকার করা যাবে? এ ক্ষেত্রে দলটির শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্যের যে অভিযোগ উঠেছে তা যদি বাদও দেওয়া হয়, প্রার্থী নির্বাচনের আগে কোনো হোমওয়ার্ক যে তারা করেনি এটা ৩০০ আসনে প্রায় ৭০০ জনকে মনোনয়ন দানের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। আবার চূড়ান্ত প্রার্থী কে হবেন নির্বাচন কমিশনকে তা জানাতে গিয়েও তারা লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি করেছে। দেখা গেছে, একজনের পক্ষে এ চিঠি দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকজনকে তা দেওয়া হয়েছে, যা নির্বাচনী বিধির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, যেখানে বলা হয়েছে এ ধরনের চিঠি একজনকে দেওয়ার পর আর বদলানো যাবে না। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন বিষয়টা যে কোনো কারণেই হোক, উপেক্ষা করলেও, উচ্চ-আদালত প্রথম প্রার্থীকেই বৈধ বলে রায় দিয়েছে। তাছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বা পৌরসভার মেয়র পদ থেকে পদত্যাগের প্রশ্নেও দলটির অনেকে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেননি। আর এই সবকিছুর ফল দাঁড়িয়েছে, অন্তত ১৬টি আসনে বিএনপি বা তার জোটের কোনো প্রার্থী নেই, অর্থাৎ এসব আসনে সরকারি দলের প্রার্থীরা একপ্রকার ওয়াকওভার পেয়ে গেছেন।
বিএনপি ও তার মিত্ররা সর্বশেষ এ ভরসা করেছিল যে, ভোটাররা যদি দলে দলে ভোট দিতে যায় তাহলে ভোটের হাওয়া তাদের দিকে ঘুরে যাবে। এখন বাস্তবতা হলো, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন ঠিকই তবে সিলটা মেরেছেন অন্য মার্কায়। এখান থেকেও জনগণের সঙ্গে বিএনপি ও তার মিত্রদের সংযোগের গভীরতা ও ব্যাপকতা কতটুকু তা আঁচ করা যায়।
আমাদের এসব কথা বলার উদ্দেশ্য এটা দাবি করা নয় যে, নির্বাচনটি সার্বিক দিক দিয়ে নিখুঁত ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। যেমন, কোনো কোনো বিশ্লেষক এ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলে মেনে নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলতে রাজি নন। তাদের এ কথা সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ নির্বাচনটিতে সরকারদলীয় প্রার্থীরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা ভোগ করেছেন। কিন্তু তারা এসব সুবিধা পেয়ে গেছেন যতটা না সরকারে থাকার কারণে তার চেয়ে বেশি তাদের বিরোধী দল ও প্রার্থীরা দুর্বল হওয়ার কারণে, যে পরিস্থিতিটা সৃষ্টি হয়েছে প্রধানত বিএনপি ও তার প্রধান মিত্র জামায়াতের অতীতে কৃত কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড এবং অভ্যন্তরীণ কিছু দুর্বলতার কারণে।
মনে রাখতে হবে, দুনিয়ার আর সব গণতান্ত্রিক দেশে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়ে থাকে আমাদের এবারের নির্বাচনটাও সেভাবে হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ায় দুনিয়ার সব দেশেই সরকারি দল স্বাভাবিক নিয়মেই কিছু সুবিধা পেয়ে যায়, যা বিরোধী দল/দলগুলো পায় না। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটা নির্বাচনের আগে ভোটারদের নিবন্ধিত হতে হয়, আর এ কাজটা তদারক করে সংশ্লিষ্ট স্টেট বা রাজ্য সরকার। সেখানে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, বিশেষ করে রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে, যে অনেক আফ্রিকান-আমেরিকান ভোটারকে, যারা মূলত ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক, সামান্য অজুহাতে নিবন্ধন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি সাধারণত সহজভাবেই নেওয়া হয় গণতন্ত্রের স্বার্থে।
তাছাড়া, ১৯৭৩ সালের পর এ প্রথম আমাদের দেশে একটা নির্বাচিত সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। মাঝখানের সময়টাতে আমরা কখনো সামরিক সরকারের অধীনে, কখনো বেসামরিক লেবাসে সামরিক সরকারের অধীনে এবং বাকি সময়ে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেখেছি। এসব নির্বাচনের মধ্যে কেবল শেষোক্ত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো বেশিরভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ওই ব্যবস্থাটা গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি।
এ প্রেক্ষাপটে এটা স্বীকার করতে হবে যে, নানা কারণে আমাদের গণতন্ত্র যেমন এখনো পুষ্ট হয়নি তেমনি নির্বাচনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটিও এখানে শুরু হলো মাত্র। সামনের দিনগুলোতে একটা গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনের জন্য এ পদ্ধতি ভিন্ন অন্য কিছু যেহেতু আমাদের জানা নেই, সব গণতান্ত্রিক মহলকে এটাকেই পরিপক্ব হতে সহায়তা করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিএনপি ও তার মিত্ররা যেমন এবারের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থেকেছে এবং এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে আমাদের নবযাত্রায় শরিক হয়েছে, তেমনি তারা আগামী দিনগুলোতেও এ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। অতীতের নেতিবাচক রাজনীতির ধারা থেকে বের হয়ে একটা ইতিবাচক ধারার রাজনীতির সূচনা করবে। এতে শুধু যে দেশ-জাতি-জনগণ লাভবান হবে তা নয়, দল হিসেবে তারাও সংসদীয় রাজনীতির মূল ধারায় ফিরে আসতে পারবে।