একটি প্রজন্মের দ্রোহের ভাষা নিয়ে অন্য ভুবনে চলে গেলেন মৃণাল সেন। গড়পড়তা বিচারে দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন তিনি। পাঁচ বছর কম একশ বছর। এই সাড়ে নয় দশকে তিনি বিপুল কর্মযজ্ঞ করেছেন, চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক, যার নির্যাস বের করলে পাওয়া যাবে : শোষক ও সুবিধাবাদীদের প্রতি তীব্র সমালোচনা ও ঘৃণা। এর উল্টো পাঠও নেওয়া যেতে পারে : বঞ্চিত ও দরিদ্রদের প্রতি সমর্থন। পঞ্চাশের দশকে চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করা আর অন্য দুই পর্বত সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক থেকে এ জন্যই তিনি ব্যতিক্রম।
সত্যজিৎ রায় সারা জীবনই রাজনীতি বিমুখ। আর শেষ কাজ ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৭) মুক্তির আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক বক্তব্য ঋজু দেহভঙ্গি নিয়ে হাজির হয়নি ঋত্বিকের কাজে। এই দুজনের সমসাময়িক মৃণাল। স্বতন্ত্র মৃণাল। রাজনৈতিক মৃণাল। স্বদেশি আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিশ্বযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সবকিছু মিলিয়ে এক উত্তাল সময়ের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছেন তিনি। ১৯৪০ সালে যখন বাংলাদেশের ফরিদপুর ছেড়ে কলকাতায় যান, তখন তিনি সতেরো। ফরিদপুরে থাকতেই বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতায় কলেজে ভর্তির পর সেই সম্পৃক্ততা আরো বাড়ে। বোর্ডিং স্কুলের দিনগুলোতে হাজতবাসও হয় তাঁর। এমন পোড় খাওয়া মানুষ, যিনি কৈশোরে জন্মভিটা ছেড়েছেন, যুগের যন্ত্রণা দেখেছেন এবং হাজতবাস করেছেন, তাঁর হাত দিয়ে আগুনছোঁয়া ছবিই তো হবে।
যদিও প্রথম দুটি ছবি ‘রাতভোর’ (১৯৫৫) ও ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯) নিয়ে নিজেই অতটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবে তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) থেকে মৃণাল যেন রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে শুরু করেন বড় পর্দায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পান তিনি। কানাই বসুর কাহিনী থেকে নির্মিত এই ছবিতে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষকে মৃণাল দেখিয়েছেন এক দম্পতির করুণ সমাপ্তির ভেতর দিয়ে। সেই প্রিয়নাথ ও মালতির সাজানো গোছানো সংসার এক ঝড়ের ধাক্কায় শেষ হয়ে যায়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষের কারণে। এর পরিণতি মালতির আত্মহত্যা। মৃণাল এই কাহিনীর ফাঁকেই বলতে ভোলেন না, প্রিয়নাথের পূর্বপুরুষরা এক সময় ছিলেন ভোগবাদী, অত্যাচারী ও অনাচারী। তারই ফলে এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়নাথ। কী দারুণ রাজনৈতিক রূপক ব্যবহার করলেন মৃণাল।
এই ছবির পর মৃণালের বক্তব্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মাইলফলক যদি বলি তো সত্তরের দশকে এসে তাঁর কলকাতা ত্রয়ী ও অন্যান্য ছবির কথা বলতে হয়। চলচ্চিত্র পণ্ডিত মৈনাক বিশ্বাস বলছেন, “মৃণাল সেনের ছবি ব্যারোমিটারের মতো ওই জলবায়ুর চাপ মেপে চলেছে সেই সময়। ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০) থেকে ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২), ‘পদাতিক’ (১৯৭৩) হয়ে কোরাস (১৯৭৪) অবধি ওর যাত্রা চলচ্চিত্র বিতর্ককেও স্তর থেকে স্তরে টেনে নিয়ে গেছে। প্রথমটায় বিদ্রোহ, দ্বিতীয়টায় বিপ্লব, তৃতীয়টায় আত্মসমীক্ষণ, শেষে রূপকাশ্রয়ী সন্দর্ভৃ বছরে বছরে যেন উন্মোচিত হচ্ছে বাংলার দ্বিতীয় বিপ্লব প্রচেষ্টার ক্যালেন্ডার।” (বিশ্বাস ২০১৭: ৯৩)
ঔপনিবেশিক মানসিকতা ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসা, বুর্জোয়া ও পাতি বুর্জোয়া কিংবা মুৎসুদ্দিদের নির্লজ্জ লোভ-লালসাকে তীক্ষè দৃশ্যভাষায় আক্রমণ ছাড়াও মৃণাল আঙুল তুলেছেন মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা, স্বার্থপরতা ও পলায়নপর মানসিকতার দিকেও। ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) ছবিতে যে মেয়েটি সারা রাত ঘরে ফেরেনি, তাকে ঘিরে যে শঙ্কা-রাগ-সন্দেহ তাতে মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্র স্পষ্ট। অন্যদিকে ‘খারিজ’ (১৯৮২) ছবিতে কাজের ছেলেটি মারা গেলে ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত দম্পতির পালাবার পথ খুঁজবার যে দৃশ্যায়ন, সেটিও সেই শ্রেণির বৈশিষ্ট্যকেই ইঙ্গিত করে। মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা, পলায়নপর মনোবৃত্তি ও সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করার এক দারুণ আখ্যান হিসেবে হাজির করা যেতে পারে ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩) ছবিটিকে। যেখানে দেখা যায় এক শহুরে চিত্রগ্রাহক গ্রামে গিয়ে বিবাহযোগ্যা এক মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে শহরে ফিরে আসে এবং মেয়েটির তোলা একটি ছবি টাঙিয়ে রাখে নিজের স্টুডিওতে। বলা বাহুল্য নয়, যুবকটি আর গ্রামে ফিরে যায়নি, কারণ সে বন্ধুর সঙ্গে দুদিন ছুটি কাটাতে গিয়েছিল সেখানে। এভাবে ধরে ধরে মৃণাল সেনের তৈরি করা ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে হয় তো আলোচনা করা যাবে, তা থেকে ওই একটি বাণীই প্রতিধ্বনিত হবে, তা হলো প্রতিবাদ করতে পারাটাই শিল্পীর স্বাধীনতা।
এই মতের সঙ্গে যে সকলের একমত হতে হবে, তা কিন্তু মনে করতেন না মৃণাল। মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকবেই। তাই নিজের ছবি নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে মৃণাল বলেছিলেন, ‘মার্কস এঙ্গেলস লেনিনের নামে একই দেশে সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রশ্নে যদি এক ডজন দল গড়ে উঠতে পারে তাহলে আমাদের মতো ছবি-করিয়ের দলের ভাবনাচিন্তায় দেশের সমস্ত মানুষ একমত হবেন এটা আশা করা বাস্তব অবস্থাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা। বরং আমাদের কোনো ছবি যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বা সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কোনো তর্ক তুলতে পারে, তাহলে বলব ছবি করিয়ে হিসেবে আমাদের চেষ্টা সার্থক।’ (সেন ২০১৬: ৯১)
নিজেকে ‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’ বলতেন মৃণাল। তাই হেগেলের সূত্রে মার্কসবাদের প্রবেশ করা দার্শনিক দ্বান্দ্বিক বিচারকে নিজের শিল্প সৃষ্টির এক অন্যতম হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন মৃণাল। ছবি বলতেই তিনি বুঝতেন ‘ডায়ালেকটিকস’। যেখানে দর্শক ভিজুয়াল ও ওরাল পারসেপশনের ভেতর দিয়ে একটি ইন্টেলেকচুয়াল পারসেপশনে পৌঁছুবে। এই চিন্তা মৃণাল পেয়েছেন সোভিয়েত চিত্রপরিচালক আইজেনস্টাইনের কাছ থেকে। ইন্টেলেকচুয়াল পারসেপশনের বাংলা মৃণাল করছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শব্দ ধার করেÑ চৈতন্য। মৃণাল মনে করেন, দর্শক চোখে দেখা ও কানে শোনার মধ্য দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে, চৈতন্য দিয়ে একটি দৃশ্যের মর্মার্থ উদ্ধার করবে। ‘কবিতার পাঠক যেমন তাঁর বুদ্ধি খাটিয়ে, তাঁর সৃজনী শক্তি দিয়ে, তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে বইয়ের পাতার সেই আক্ষরিকতার আড়ালে আত্মিক আবহাওয়াটির আমেজ পেয়ে থাকেন, ঠিক তেমনি সিনেমার দর্শকও তাঁর বুদ্ধি ও হৃদয় দিয়ে ছবি ও শব্দের সীমানা পেরিয়ে ‘চৈতন্যে’র রাজ্যে প্রবেশ করেন। ” (সেন ২০১৬: ৫৯)
মৃণাল নিজের ছবিতে যেভাবে দ্বান্দ্বিকতাকে উপস্থাপন করেছেন, সেভাবে সকল ছবি-করিয়েদেরই করতে হবে, তা নয়, তাছাড়া দুনিয়ার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে বুঝে ওঠার এলেমও সবার হয় না। তিনি যেভাবে সমকালের রাজনীতি ও সমাজকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে জারিত করতে পেরেছেন, তা বিরলই বটে। মৃণাল এই ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছিলেন কারণ তিনি জগৎকে দেখার একটি দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন।
স্রেফ গল্প বলার লোভ থেকে তিনি ছবি তৈরি করেননি। অথবা চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে খ্যাতি অর্জনেও তাঁর মোহ ছিল না। সময়ের তাগিদে তিনি পরিচালক হয়েছেন হঠাৎ করেই। তবে তাতে তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। শেষ পর্যন্ত মৃণাল দর্শকদের স্বস্তি দেওয়ার বদলে, অস্বস্তিই উপহার দিয়েছেন। সেটাই তিনি করতে চেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন দর্শকরা যেন জড় পদার্থের মতো তাঁর ছবি না দেখে। তারা যেন ছবি দেখে চিন্তার দিক থেকে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, সেটাই চেয়েছেন মৃণাল সেন। যদিও মৃণালের মতো পরিচালক অথবা তাঁর কাক্সিক্ষত দর্শক আজকাল খুঁজে পাওয়া মুশকিল।