রেমিট্যান্সে স্বস্তি
আলতাফ মাসুদ | ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিভিন্ন দেশের লকডাউন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প পণ্যের রপ্তানিও পড়েছে চ্যালেঞ্জের মধ্যে। তবে এই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে তৈরি পোশাকের আয় কমলেও সার্বিকভাবে রপ্তানি খুব বেশি কমেনি। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৯২৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। তবে রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানিব্যয় তুলনামূলক বেশি কমেছে। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন ছাড়াও করোনা সংকটের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা থেকে প্রচুর ঋণ পাচ্ছে সরকার। ফলে নিয়মিত রেকর্ড তৈরি হয়েছে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে বিশ্বব্যাপী যখন লকডাউন চলছিল, তখন সবচেয়ে বেশি শঙ্কার মধ্যে পড়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। ভাইরাসের প্রকোপে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে গিয়ে এসব দেশের অর্থনীতি কতটা ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নেতিবাচক পূর্বাভাসও আসে। এসব পূর্বাভাসে বিদেশি বাণিজ্য বড় ধরনের সংকোচনের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বিদেশি মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে বলে জানানো হয়। তবে বেশির ভাগ দেশে প্রভাব পড়লেও পূর্বাভাস উড়িয়ে দিয়ে করোনার মধ্যেই প্রবাসী আয়ে নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে, যা মহামারীর বছরে অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে সবচেয়ে স্বস্তির সংবাদ। শুধু রেমিট্যান্সে ভর করেই মহামারীর বছরে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় আসীন হয়েছে।
মহামারীর বছরে যে পরিমাণের প্রবাসী আয় এসেছে, তা দেশের ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। সদ্য বিদায়ী ২০২০ সালে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার আয় পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। মূলত বৈধ পথে আসা রেমিট্যান্সে সরকারের দুই শতাংশ প্রণোদনা প্রবাসী আয় বাড়াতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। ২০১৯ সালে আয় এসেছিল ১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে প্রবাসীরা ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে রপ্তানিসহ অর্থনীতির নানা খারাপ খবরের মধ্যে রেমিট্যান্সের এই সূচকে বেশ ভালো করেছে বাংলাদেশ। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস যেন ইতিবাচক বার্তা নিয়ে এসেছে। যদিও এ সময়েই কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রায় আড়াই লাখ প্রবাসী শ্রমিক। বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কারণে অনেক প্রবাসী আয় হারিয়েছেন, কারও কারও বেতনও কমে গেছে। এর পরও আয় আসা বেড়েছে। কারণ, বিদেশে চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায় অবৈধ পথে আয় আসা কমে গেছে। এজন্য বৈধ পথে আয় বাড়ছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বের যেসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স আসে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী অবৈধ হয়ে আছেন সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়। করোনার মধ্যে এই দুদেশে শ্রমিকরা বিপাকে পড়লেও তারা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্র্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে যে রেমিট্যান্স আসে, তার ৭৬ শতাংশই ইতিমধ্যে এসেছে ওই সময়ে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে যে রেমিট্যান্স আসে, তার ৯৩ শতাংশ সমপরিমাণের রেমিট্যান্স চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
প্রবাসী আয় নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস
প্রবাসী আয়ে এমন উল্লম্ফনের কারণে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের আগের দেওয়া পূর্বাভাস থেকেও সরে এসেছে। গত বছরের ২২ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে আশঙ্কা করা হয়েছিল, করোনা মহামারীর ধাক্কায় বাংলাদেশে ২০২০ সালে রেমিট্যান্স আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কমে যেতে পারে। আর গত আগস্টে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক পূর্বাভাসে বলা হয়, প্রবাসী আয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়ার তিনটি দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। করোনার কারণে ২০১৮-এর চেয়ে ২০২০ সালে রেমিট্যান্স এক-চতুর্থাংশ কমে যেতে পারে। ওই বছরের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমতে পারে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অবশ্য এডিবির এই পূর্বাভাসের মধ্যেই গত জুলাইয়ে দেশে প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে। রেমিট্যান্সে উল্লম্ফনের এই ধারা দেখে পরে বিশ্ব্যাংকও তাদের আগের পূর্বাভাস থেকে সরে আসে। গত ৩০ অক্টোবর বিশ্ব রেমিট্যান্স পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘কভিড-১৯ ক্রাইসিস থ্রো মাইগ্রেশন লেন্স’ শীর্ষক হালনাগাদ প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ৮ শতাংশ বেড়ে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। যদিও মহামারীর বছর শেষে বিশ^ব্যাংকের এই পূর্বাভাস ছাড়িয়ে দেশে রেমিট্যান্স আসে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার। প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশ ২০২০ সালেও অষ্টম স্থানে থাকবে বলে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতি যেখানে চলতি বছর সংকুচিত হবে, সেখানে প্রবাসী আয়ও স্বাভাবিকভাবে কমবে। তবে বৈশ্বিক মহামারী সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবাসী আয় বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে ঈদ ও বন্যার কারণে ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে যারা টাকা পাঠাননি, তারা যেমন তৃতীয় প্রান্তিকে টাকা পাঠিয়েছেন, তেমনি মহামারীর কারণে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে এখনো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আছে। এ অবস্থায় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল দিয়েও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ সচল থাকবে। এ অঞ্চলের অপর দেশ ভারতের প্রবাসী আয়ে আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ কমে যাবে; যদিও পরিমাণের দিক থেকে তারা যথারীতি শীর্ষে থাকবে।
বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী আয় কিছুটা কমলেও ২০২১ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ওই বছর এ অঞ্চলের প্রবাসী আয় কমতে পারে ১১ শতাংশ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিত্রটা আরও খারাপ। সার্বিকভাবে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে প্রবাসী আয় কমবে ১৪ শতাংশ। বিশ^ব্যাংকের পাশাপাশি শরণার্থী ও অভিবাসী আন্দোলন গবেষণা ইউনিটও (রামরু) ২০২১ সালের রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত ২৯ ডিসেম্বর সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২০ সালে ইমিগ্রেশন ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে মহামারীর প্রভাবে অভিবাসন আগের বছরের তুলনায় তা ৭১ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমেছে। যেহেতু গত বছর অনেকেই বিদেশ যেতে পারেননি, তাই ২০২১ সালের রেমিট্যান্সপ্রবাহের ওপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বামরু জানিয়েছে, ২০১৯ সালে ৭ লাখেরও বেশি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বিদেশে যান, তবে গত বছর মাত্র ২ লাখ ২৯ হাজার বাংলাদেশি বিদেশে যেতে পারেন। বামরু জানিয়েছে, ‘কভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমাদের শ্রমবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। কারণ, গৃহকর্মী এবং নির্মাণ খাতে শ্রমিকদের চাহিদা আবার বাড়বে। এ ছাড়া রোমানিয়া, পোল্যান্ড, চীন, কম্বোডিয়ার মতো নতুন কয়েকটি শ্রমবাজার আমাদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। অবশ্য রেমিট্যান্স নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যদ্বাণী বাংলাদেশের পক্ষে কার্যকর হয়নি বলেও জানায় রামরু।’
প্রবাসী আয় বাড়ছে যে কারণে
দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে সরকার। এরপর থেকেই প্রবাসী আয়ে গতি আসে। আর করোনার সময়ে দেশের রপ্তানি আয় আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার শঙ্কায় বিদেশি মুদ্রার পর্যাপ্ত রিজার্ভ নিশ্চিত করতে রেমিট্যান্সে সরকার ঘোষিত ২ শতাংশ প্রণোদনা প্রবাসীরা যেন সহজে পান সেজন্য বেশ কিছু শর্ত শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রণোদনায় কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগত না। এখন এর আওতা বাড়ানো হয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো পাঁচ হাজার ডলার বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্সে বিনাশর্তে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই প্রণোদনার অর্থ পাচ্ছেন প্রবাসীর স্বজনরা। পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকার ওপরে কাগজপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। এত দিন প্রণোদনা পেতে হলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রাপক ওঠানোর ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হতো। এখন তা বাড়িয়ে দুই মাস করা হয়েছে। সরকারের প্রণোদনা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের লকডাউন পরিস্থিতি অবৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর পদ্ধতি ‘হুন্ডি’ অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। এটিও বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়ার একটি কারণ। সরকারি নগদ সহায়তার কারণে বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ব্যাংক খরচ মেটানোর পরও এক শতাংশ বেশি অর্থ পাচ্ছেন প্রবাসীরা।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ২০২০ সালের মার্চ ও এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে বড় ধাক্কা লাগে। ভাইরাসের প্রভাবে মার্চ মাসে প্রবাসী আয় প্রায় ১২ শতাংশ কমে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে নামে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরও প্রকট হলে এপ্রিলে প্রবাসী আয় আরও কমে হয় ১০৮ কোটি ডলার। তবে এরপরই বড় ধরনের উল্লম্ফন শুরু হয়, যার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। মে মাসে রেমিট্যান্স আসে ১৫০ কোটি ডলার, যা জুনে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ডলার। আর ঈদের আগের মাস জুলাইয়ে এক লাফে প্রবাসী আয় ২৬০ কোটি ডলারে ওঠে। কোনো একক মাস হিসেবে এই আয় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এরপরে আগস্টে ১৯৬ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ২১৫ কোটি ডলার, অক্টোবরে ২১০ কোটি ডলার ও নভেম্বরে ২০৭ কোটি ডলার আসে। আর পুরো ডিসেম্বরের আয় আসে ২০৫ কোটি ডলার। আর প্রবাসী আয়ে ভর করে নতুন নতুন রেকর্ড হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। ফলে অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো সূচক হিসেবেই ২০২০ সাল পার করে প্রবাসী আয় খাত।
সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে যেসব দেশ থেকে
দেশে প্রবাসী আয়ের ৯০ শতাংশ আসে বিশ্বের ১০ দেশ থেকে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের জিসিসিভুক্ত ছয় দেশ থেকে ৫৮ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ দেশ থেকে ৪০১ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল, যা আগের বছরের চেয়ে ২৯ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণের রেমিট্যান্স এসেছে তার ২২ শতাংশই আসে সৌদি আরব থেকে। এ সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৪৭ কোটি ২৫ লাখ ডলার, কুয়েত থেকে ১৩৭ কোটি ২২ লাখ, ওমান থেকে ১২৪ কোটি, কাতার থেকে ১০১ কোটি ৯৬ লাখ ও বাহরাইন থেকে ৪৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার প্রবাসী আয় আসে। দেশে প্রবাসী আয়ের তৃতীয় ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এই দুদেশ থেকে গত অর্থবছরে যথাক্রমে ২৪০ কোটি ৩৪ লাখ ডলার ও ১৩৬ কোটি ৪৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। এ ছাড়া গত অর্থবছরে দশম অবস্থানে থাকা সিঙ্গাপুর থেকে ৪৫ কোটি ৭৪ লাখ ডলার এসেছিল।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে লকডাউন থাকায় আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার ও ইতালি থেকে আসা রেমিট্যান্স কিছুটা কমেছে। তবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে লকডাউন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এই চিত্র পুরো পাল্টে যেতে দেখা গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে সৌদি আরব থেকে যে পরিমাণের রেমিট্যান্স এসেছিল, তার ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসীরা ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৯৩ শতাংশের বেশি পাঠিয়েছেন ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে। এ ছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে যে রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন, তার ৬৪ শতাংশ, কুয়েত ৬৮ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৭৪ শতাংশ ও ওমান থেকে ৭০ শতাংশ রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বিশ্বব্যাংকের এপ্রিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রবাসী আয়ের পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে। ২০২০ সালেও বাংলাদেশের অবস্থান একই থাকবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) অনুপাতে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ (জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ)। এ ক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ নিয়ে প্রথম স্থানে আছে নেপাল, ৯.১ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে পাকিস্তান, ৮.২ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে শ্রীলঙ্কা।
মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ক্রয়
করোনার সময়ে আমদানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে যায়। এ সময় বেকায়দায় পড়ে যায় ব্যাংকগুলো। যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে আসতে থাকে ব্যাংকগুলোর কাছে, তা বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। বাজারে চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো তা বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছিল। এমনই পরিস্থিতিতে ডলারের মান ধরে রাখতে গত বছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার সমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগে উপকৃত হয়েছেন রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধাভোগীরা।
অথচ গত এপ্রিলে দেশে ডলারের বিনিময় হার ও পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার ডলার বিক্রির পদক্ষেপ নেয়। এ সময় প্রায় ১৮ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অনেক ব্যাংক ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারের চেয়ে দেড় থেকে দুই টাকা বেশিতে আমদানির মূল্য পরিশোধ করে। কিন্তু মে মাস থেকে রেমিট্যান্স বাড়তে থাকায় চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। ডলার বাজারে ছাড়ার পরিবর্তে মান ধরে রাখতে উল্টো কোটি কোটি ডলার কেনা শুরু করে।
প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে মজুদ করে রাখতে পারে না। ব্যাংকগুলোর মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত মজুদ থাকলে দিন শেষে হয় তাকে বাজারে বিক্রি করতে হবে, নতুবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোকে জরিমানা গুনতে হয়। করোনার প্রভাবে বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের চাহিদা কমে যায়। বাজারে বিক্রি করতে না পারায় ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দরে ডলার না কিনলে ডলারের মান পড়ে যেত। এতে শক্তিশালী হতো টাকার মান। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা। সাধারণত টাকার মান বাড়লে আমদানি ব্যয় কমে যায়। এতে স্থানীয় বাজারে পণ্যের উৎপাদনব্যয় কমে যায়। সস্তায় জিনসপত্র পাওয়া যায়। কিন্তু করোনার প্রভাবে দেশে ও বিদেশে ভোগব্যয় কমে যায়। এতে অভ্যন্তরীণ বাজারে কমে যায় পণ্যের চাহিদা। ভোগ কমে যাওয়ায় স্থানীয় শিল্প-কারখানার উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। ফলে টাকা বেড়ে গেলেও তেমন কোনো সুফল পাওয়া যেত না। কিন্তু বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তেন প্রবাসী শ্রমিক ও রপ্তানিকারকরা।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কিনেছে প্রায় ৫৫০ কোটি ডলার। গত ১ জুলাই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার না কিনলে তা ৮০ টাকার নিচে নেমে যেত। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজার থেকে ডলার কেনা রপ্তানিকারক ও প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয়।
রেমিট্যান্সে ভর করে নতুন উচ্চতায় রিজার্ভ
মহামারীর মধ্যে প্রবাসী আয়ের উল্লম্ফনে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হতে দেখা গেছে। এ সময়ে আমদানিব্যয় কিছুটা কমে যাওয়ায় ডিসেম্বর শেষে দেশের রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত মার্চ শেষে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২৩৯ কোটি ডলার। এরপর ৯ মাসে রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসের মধ্যে আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ, অনুদান ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রবাসী আয় ছাড়া বিদেশি মুদ্রা আয়ের অন্য খাতগুলো ছিল নেতিবাচক পরিস্থিতিতে। রিজার্ভের ব্যয়ের বড় জায়গা হচ্ছে আমদানিব্যয়, নানা ধরনের ঋণ ও দায় পরিশোধ। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা দেয় বাংলাদেশ। দেশের ঋণমান নির্ধারণে রিজার্ভের গুরুত্ব রয়েছে। রিজার্ভ ভালো থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হারে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিভিন্ন দেশের লকডাউন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প পণ্যের রপ্তানিও পড়েছে চ্যালেঞ্জের মধ্যে। তবে এই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে তৈরি পোশাকের আয় কমলেও সার্বিকভাবে রপ্তানি খুব বেশি কমেনি। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৯২৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। তবে রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানিব্যয় তুলনামূলক বেশি কমেছে। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন ছাড়াও করোনা সংকটের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা থেকে প্রচুর ঋণ পাচ্ছে সরকার। ফলে নিয়মিত রেকর্ড তৈরি হয়েছে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে।
দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে আটকে ছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিলে রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এরপর মে মাসে ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ও জুন মাস শেষে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নতুন রেকর্ড তৈরি হয় রিজার্ভে। আর ২৭ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। রেমিট্যান্সে উল্লম্ফনের কারণে চলতি বছরের আগস্টে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। গত ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর অক্টোবরের শুরুতে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। একই মাসের শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ বিলিয়ন ডলারে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানিব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশের কাছে এখন যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ আছে তা দিয়ে ১০ মাসের আমদানিব্যয় মেটানো সম্ভব।
শেয়ার করুন
আলতাফ মাসুদ | ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে বিশ্বব্যাপী যখন লকডাউন চলছিল, তখন সবচেয়ে বেশি শঙ্কার মধ্যে পড়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। ভাইরাসের প্রকোপে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে গিয়ে এসব দেশের অর্থনীতি কতটা ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নেতিবাচক পূর্বাভাসও আসে। এসব পূর্বাভাসে বিদেশি বাণিজ্য বড় ধরনের সংকোচনের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বিদেশি মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে বলে জানানো হয়। তবে বেশির ভাগ দেশে প্রভাব পড়লেও পূর্বাভাস উড়িয়ে দিয়ে করোনার মধ্যেই প্রবাসী আয়ে নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে, যা মহামারীর বছরে অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে সবচেয়ে স্বস্তির সংবাদ। শুধু রেমিট্যান্সে ভর করেই মহামারীর বছরে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নতুন উচ্চতায় আসীন হয়েছে।
মহামারীর বছরে যে পরিমাণের প্রবাসী আয় এসেছে, তা দেশের ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। সদ্য বিদায়ী ২০২০ সালে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার আয় পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। মূলত বৈধ পথে আসা রেমিট্যান্সে সরকারের দুই শতাংশ প্রণোদনা প্রবাসী আয় বাড়াতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। ২০১৯ সালে আয় এসেছিল ১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে প্রবাসীরা ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন।
করোনাভাইরাসের প্রকোপে রপ্তানিসহ অর্থনীতির নানা খারাপ খবরের মধ্যে রেমিট্যান্সের এই সূচকে বেশ ভালো করেছে বাংলাদেশ। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস যেন ইতিবাচক বার্তা নিয়ে এসেছে। যদিও এ সময়েই কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রায় আড়াই লাখ প্রবাসী শ্রমিক। বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কারণে অনেক প্রবাসী আয় হারিয়েছেন, কারও কারও বেতনও কমে গেছে। এর পরও আয় আসা বেড়েছে। কারণ, বিদেশে চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায় অবৈধ পথে আয় আসা কমে গেছে। এজন্য বৈধ পথে আয় বাড়ছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বের যেসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স আসে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী অবৈধ হয়ে আছেন সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়। করোনার মধ্যে এই দুদেশে শ্রমিকরা বিপাকে পড়লেও তারা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্র্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে যে রেমিট্যান্স আসে, তার ৭৬ শতাংশই ইতিমধ্যে এসেছে ওই সময়ে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে যে রেমিট্যান্স আসে, তার ৯৩ শতাংশ সমপরিমাণের রেমিট্যান্স চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
প্রবাসী আয় নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস
প্রবাসী আয়ে এমন উল্লম্ফনের কারণে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের আগের দেওয়া পূর্বাভাস থেকেও সরে এসেছে। গত বছরের ২২ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে আশঙ্কা করা হয়েছিল, করোনা মহামারীর ধাক্কায় বাংলাদেশে ২০২০ সালে রেমিট্যান্স আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কমে যেতে পারে। আর গত আগস্টে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক পূর্বাভাসে বলা হয়, প্রবাসী আয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়ার তিনটি দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। করোনার কারণে ২০১৮-এর চেয়ে ২০২০ সালে রেমিট্যান্স এক-চতুর্থাংশ কমে যেতে পারে। ওই বছরের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমতে পারে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অবশ্য এডিবির এই পূর্বাভাসের মধ্যেই গত জুলাইয়ে দেশে প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে। রেমিট্যান্সে উল্লম্ফনের এই ধারা দেখে পরে বিশ্ব্যাংকও তাদের আগের পূর্বাভাস থেকে সরে আসে। গত ৩০ অক্টোবর বিশ্ব রেমিট্যান্স পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘কভিড-১৯ ক্রাইসিস থ্রো মাইগ্রেশন লেন্স’ শীর্ষক হালনাগাদ প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ৮ শতাংশ বেড়ে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। যদিও মহামারীর বছর শেষে বিশ^ব্যাংকের এই পূর্বাভাস ছাড়িয়ে দেশে রেমিট্যান্স আসে ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার। প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশ ২০২০ সালেও অষ্টম স্থানে থাকবে বলে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতি যেখানে চলতি বছর সংকুচিত হবে, সেখানে প্রবাসী আয়ও স্বাভাবিকভাবে কমবে। তবে বৈশ্বিক মহামারী সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রবাসী আয় বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে ঈদ ও বন্যার কারণে ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থনীতির শ্লথগতির কারণে যারা টাকা পাঠাননি, তারা যেমন তৃতীয় প্রান্তিকে টাকা পাঠিয়েছেন, তেমনি মহামারীর কারণে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে এখনো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আছে। এ অবস্থায় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল দিয়েও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ সচল থাকবে। এ অঞ্চলের অপর দেশ ভারতের প্রবাসী আয়ে আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ কমে যাবে; যদিও পরিমাণের দিক থেকে তারা যথারীতি শীর্ষে থাকবে।
বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী আয় কিছুটা কমলেও ২০২১ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ওই বছর এ অঞ্চলের প্রবাসী আয় কমতে পারে ১১ শতাংশ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিত্রটা আরও খারাপ। সার্বিকভাবে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে প্রবাসী আয় কমবে ১৪ শতাংশ। বিশ^ব্যাংকের পাশাপাশি শরণার্থী ও অভিবাসী আন্দোলন গবেষণা ইউনিটও (রামরু) ২০২১ সালের রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত ২৯ ডিসেম্বর সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২০ সালে ইমিগ্রেশন ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে মহামারীর প্রভাবে অভিবাসন আগের বছরের তুলনায় তা ৭১ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমেছে। যেহেতু গত বছর অনেকেই বিদেশ যেতে পারেননি, তাই ২০২১ সালের রেমিট্যান্সপ্রবাহের ওপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বামরু জানিয়েছে, ২০১৯ সালে ৭ লাখেরও বেশি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বিদেশে যান, তবে গত বছর মাত্র ২ লাখ ২৯ হাজার বাংলাদেশি বিদেশে যেতে পারেন। বামরু জানিয়েছে, ‘কভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমাদের শ্রমবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। কারণ, গৃহকর্মী এবং নির্মাণ খাতে শ্রমিকদের চাহিদা আবার বাড়বে। এ ছাড়া রোমানিয়া, পোল্যান্ড, চীন, কম্বোডিয়ার মতো নতুন কয়েকটি শ্রমবাজার আমাদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। অবশ্য রেমিট্যান্স নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যদ্বাণী বাংলাদেশের পক্ষে কার্যকর হয়নি বলেও জানায় রামরু।’
প্রবাসী আয় বাড়ছে যে কারণে
দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে সরকার। এরপর থেকেই প্রবাসী আয়ে গতি আসে। আর করোনার সময়ে দেশের রপ্তানি আয় আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার শঙ্কায় বিদেশি মুদ্রার পর্যাপ্ত রিজার্ভ নিশ্চিত করতে রেমিট্যান্সে সরকার ঘোষিত ২ শতাংশ প্রণোদনা প্রবাসীরা যেন সহজে পান সেজন্য বেশ কিছু শর্ত শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রণোদনায় কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগত না। এখন এর আওতা বাড়ানো হয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো পাঁচ হাজার ডলার বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্সে বিনাশর্তে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই প্রণোদনার অর্থ পাচ্ছেন প্রবাসীর স্বজনরা। পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকার ওপরে কাগজপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়েছে। এত দিন প্রণোদনা পেতে হলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রাপক ওঠানোর ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হতো। এখন তা বাড়িয়ে দুই মাস করা হয়েছে। সরকারের প্রণোদনা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের লকডাউন পরিস্থিতি অবৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর পদ্ধতি ‘হুন্ডি’ অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। এটিও বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়ার একটি কারণ। সরকারি নগদ সহায়তার কারণে বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ব্যাংক খরচ মেটানোর পরও এক শতাংশ বেশি অর্থ পাচ্ছেন প্রবাসীরা।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ২০২০ সালের মার্চ ও এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে বড় ধাক্কা লাগে। ভাইরাসের প্রভাবে মার্চ মাসে প্রবাসী আয় প্রায় ১২ শতাংশ কমে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে নামে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরও প্রকট হলে এপ্রিলে প্রবাসী আয় আরও কমে হয় ১০৮ কোটি ডলার। তবে এরপরই বড় ধরনের উল্লম্ফন শুরু হয়, যার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। মে মাসে রেমিট্যান্স আসে ১৫০ কোটি ডলার, যা জুনে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ডলার। আর ঈদের আগের মাস জুলাইয়ে এক লাফে প্রবাসী আয় ২৬০ কোটি ডলারে ওঠে। কোনো একক মাস হিসেবে এই আয় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এরপরে আগস্টে ১৯৬ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ২১৫ কোটি ডলার, অক্টোবরে ২১০ কোটি ডলার ও নভেম্বরে ২০৭ কোটি ডলার আসে। আর পুরো ডিসেম্বরের আয় আসে ২০৫ কোটি ডলার। আর প্রবাসী আয়ে ভর করে নতুন নতুন রেকর্ড হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। ফলে অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো সূচক হিসেবেই ২০২০ সাল পার করে প্রবাসী আয় খাত।
সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে যেসব দেশ থেকে
দেশে প্রবাসী আয়ের ৯০ শতাংশ আসে বিশ্বের ১০ দেশ থেকে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের জিসিসিভুক্ত ছয় দেশ থেকে ৫৮ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ দেশ থেকে ৪০১ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল, যা আগের বছরের চেয়ে ২৯ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণের রেমিট্যান্স এসেছে তার ২২ শতাংশই আসে সৌদি আরব থেকে। এ সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৪৭ কোটি ২৫ লাখ ডলার, কুয়েত থেকে ১৩৭ কোটি ২২ লাখ, ওমান থেকে ১২৪ কোটি, কাতার থেকে ১০১ কোটি ৯৬ লাখ ও বাহরাইন থেকে ৪৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার প্রবাসী আয় আসে। দেশে প্রবাসী আয়ের তৃতীয় ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এই দুদেশ থেকে গত অর্থবছরে যথাক্রমে ২৪০ কোটি ৩৪ লাখ ডলার ও ১৩৬ কোটি ৪৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। এ ছাড়া গত অর্থবছরে দশম অবস্থানে থাকা সিঙ্গাপুর থেকে ৪৫ কোটি ৭৪ লাখ ডলার এসেছিল।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে লকডাউন থাকায় আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার ও ইতালি থেকে আসা রেমিট্যান্স কিছুটা কমেছে। তবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে লকডাউন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এই চিত্র পুরো পাল্টে যেতে দেখা গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে সৌদি আরব থেকে যে পরিমাণের রেমিট্যান্স এসেছিল, তার ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আর মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসীরা ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৯৩ শতাংশের বেশি পাঠিয়েছেন ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে। এ ছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে যে রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন, তার ৬৪ শতাংশ, কুয়েত ৬৮ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৭৪ শতাংশ ও ওমান থেকে ৭০ শতাংশ রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বিশ্বব্যাংকের এপ্রিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রবাসী আয়ের পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে। ২০২০ সালেও বাংলাদেশের অবস্থান একই থাকবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) অনুপাতে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ (জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ)। এ ক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ নিয়ে প্রথম স্থানে আছে নেপাল, ৯.১ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে পাকিস্তান, ৮.২ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে শ্রীলঙ্কা।
মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ক্রয়
করোনার সময়ে আমদানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে যায়। এ সময় বেকায়দায় পড়ে যায় ব্যাংকগুলো। যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে আসতে থাকে ব্যাংকগুলোর কাছে, তা বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। বাজারে চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো তা বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছিল। এমনই পরিস্থিতিতে ডলারের মান ধরে রাখতে গত বছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৫৫০ কোটি ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার সমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগে উপকৃত হয়েছেন রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধাভোগীরা।
অথচ গত এপ্রিলে দেশে ডলারের বিনিময় হার ও পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার ডলার বিক্রির পদক্ষেপ নেয়। এ সময় প্রায় ১৮ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অনেক ব্যাংক ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারের চেয়ে দেড় থেকে দুই টাকা বেশিতে আমদানির মূল্য পরিশোধ করে। কিন্তু মে মাস থেকে রেমিট্যান্স বাড়তে থাকায় চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। ডলার বাজারে ছাড়ার পরিবর্তে মান ধরে রাখতে উল্টো কোটি কোটি ডলার কেনা শুরু করে।
প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে মজুদ করে রাখতে পারে না। ব্যাংকগুলোর মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত মজুদ থাকলে দিন শেষে হয় তাকে বাজারে বিক্রি করতে হবে, নতুবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোকে জরিমানা গুনতে হয়। করোনার প্রভাবে বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের চাহিদা কমে যায়। বাজারে বিক্রি করতে না পারায় ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দরে ডলার না কিনলে ডলারের মান পড়ে যেত। এতে শক্তিশালী হতো টাকার মান। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা। সাধারণত টাকার মান বাড়লে আমদানি ব্যয় কমে যায়। এতে স্থানীয় বাজারে পণ্যের উৎপাদনব্যয় কমে যায়। সস্তায় জিনসপত্র পাওয়া যায়। কিন্তু করোনার প্রভাবে দেশে ও বিদেশে ভোগব্যয় কমে যায়। এতে অভ্যন্তরীণ বাজারে কমে যায় পণ্যের চাহিদা। ভোগ কমে যাওয়ায় স্থানীয় শিল্প-কারখানার উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। ফলে টাকা বেড়ে গেলেও তেমন কোনো সুফল পাওয়া যেত না। কিন্তু বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তেন প্রবাসী শ্রমিক ও রপ্তানিকারকরা।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কিনেছে প্রায় ৫৫০ কোটি ডলার। গত ১ জুলাই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮৫ পয়সা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার না কিনলে তা ৮০ টাকার নিচে নেমে যেত। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজার থেকে ডলার কেনা রপ্তানিকারক ও প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয়।
রেমিট্যান্সে ভর করে নতুন উচ্চতায় রিজার্ভ
মহামারীর মধ্যে প্রবাসী আয়ের উল্লম্ফনে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হতে দেখা গেছে। এ সময়ে আমদানিব্যয় কিছুটা কমে যাওয়ায় ডিসেম্বর শেষে দেশের রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত মার্চ শেষে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২৩৯ কোটি ডলার। এরপর ৯ মাসে রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসের মধ্যে আছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ, অনুদান ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রবাসী আয় ছাড়া বিদেশি মুদ্রা আয়ের অন্য খাতগুলো ছিল নেতিবাচক পরিস্থিতিতে। রিজার্ভের ব্যয়ের বড় জায়গা হচ্ছে আমদানিব্যয়, নানা ধরনের ঋণ ও দায় পরিশোধ। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা দেয় বাংলাদেশ। দেশের ঋণমান নির্ধারণে রিজার্ভের গুরুত্ব রয়েছে। রিজার্ভ ভালো থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হারে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিভিন্ন দেশের লকডাউন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প পণ্যের রপ্তানিও পড়েছে চ্যালেঞ্জের মধ্যে। তবে এই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে তৈরি পোশাকের আয় কমলেও সার্বিকভাবে রপ্তানি খুব বেশি কমেনি। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৯২৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। তবে রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানিব্যয় তুলনামূলক বেশি কমেছে। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন ছাড়াও করোনা সংকটের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা থেকে প্রচুর ঋণ পাচ্ছে সরকার। ফলে নিয়মিত রেকর্ড তৈরি হয়েছে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে।
দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে আটকে ছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিলে রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এরপর মে মাসে ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ও জুন মাস শেষে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নতুন রেকর্ড তৈরি হয় রিজার্ভে। আর ২৭ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। রেমিট্যান্সে উল্লম্ফনের কারণে চলতি বছরের আগস্টে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। গত ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর অক্টোবরের শুরুতে রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। একই মাসের শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ বিলিয়ন ডলারে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানিব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশের কাছে এখন যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ আছে তা দিয়ে ১০ মাসের আমদানিব্যয় মেটানো সম্ভব।