লাগামহীন উত্থান শেয়ারবাজারে
আনোয়ার ইব্রাহিম | ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
নতুন জোয়ার এসেছে দেশের শেয়ারবাজারে। এই কিছুদিন আগেও যেখানে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে পড়ে যে বাজার মরার মতো ধুঁকছিল, সে বাজারে নেমেছে বিনিয়োগের বান। বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের আনাগোনা। গত কয়েক মাস ধরে শনৈ শনৈ বাড়ছে শেয়ারদর। পরিস্থিতি এমনই যে, এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে যেখানে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজির যতটা সম্ভব তুলে নিতে মরিয়া ছিলেন বিনিয়োগকারীরা, এখন তারাই নতুন ক্রেতার ভূমিকায়। বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার চিন্তা নয়, নতুন করে বিনিয়োগের জন্য অর্থের সন্ধানে ছুটছেন তারা। এখন বিনিয়োগকারীরা সামনে স্রেফ মুনাফার হাতছানি দেখছেন।
ঠিক কী কারণে রাতারাতি বদলে গেল শেয়ারবাজার এ প্রশ্ন অনেকের। রাতারাতি অবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে কারও মধ্যে অবশ্য ‘কু’ ডাকছে। দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ ছিয়ানব্বই বা ২০১০ সালের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন। বিপরীতে কারও ভাবনা হলো- এবার হয়তো সত্যিকার অর্থেই গড়ে উঠবে শেয়ারবাজার, অর্থনীতিতে পুঁজির সংস্থানে এ বাজারই প্রধান বিকল্প হয়ে ওঠার পথে এই প্রথম নতুন যাত্রা শুরু করেছে এ বাজার। যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার মাত্র সাত মাসেই দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। এ সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জটিতে শেয়ার কেনাবেচা শত কোটি থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
করোনা অতিমারীর মধ্যে শুধু যে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন ঘটেছে, তা নয়। এ সময় বিশ্বের প্রধান প্রধান পুঁজিবাজারগুলোতেও একই ধারা দেখা গেছে। করোনাকালীন বিভিন্ন দেশে উৎপাদন সূচকের বড় ধরনের অবনতির মধ্যেই পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে গত ২৩ মার্চের পর থেকেই বিশে^র সেরা বাজারগুলো উর্ধ্বগতির ধারায় ফিরে আসে। এ সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডাউ জোনস ইন্ডাস্ট্র্রিয়াল এভারেজ সূচকটি ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। নাসডাক ১০০ সূচকটি বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে ৬৯ শতাংশের বেশি পয়েন্ট যোগ হয়েছে। যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ১০০ সূচক বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এশিয়াতে জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক গত নয় মাসে ৭৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এমনকি যে চীন থেকে করোনা ছড়িয়েছে সেই চীনের সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কম্পোজিট সূচক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এমনকি পার্শ^বর্তী দেশ ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সব সূচকের যেখানে ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে, সেই ভারতের সেনসেক্স গত মার্চের পর ৯০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উত্থান কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে।
দুঃসহ ১০ বছর
প্রথমেই আসা যাক- কী করে ঘুরে দাঁড়াল ক্রমাগত পতনের ধারায় থাকা শেয়ারবাজার। এ উত্তর খুঁজতে যেতে হবে ২০১০ সালের শেয়ারবাজারের মহাধসের প্রেক্ষাপটে। লাগাতার কারসাজি আর তালিকাভুক্ত বহু কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সরাসরি সম্পৃক্ততায় লাগামহীন বেড়েছিল শেয়ারদর। কারণে-অকারণে শেয়ারের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। সে সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজি বন্ধ তো দূরের কথা, তার লাগাম টানতেও ব্যর্থ হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানির যথেচ্ছ বিনিয়োগে ভর করে শেয়ারের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে মুনাফা বাড়িয়ে দেখিয়ে লাভের ফাঁদ ফেলে মানুষকে আকৃষ্ট করে। পাশাপাশি কারসাজি চক্র কৃত্রিম বাজার তৈরি করলে শেয়ারদর রকেট গতি পায়।
২০১০ সালের শেষে ব্যাংকের বিনিয়োগের লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক খড়গহস্ত হলে টান পড়ে বিনিয়োগে। ফলে ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর মহাপতনের সূচনা হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে সরকার শেয়ারবাজারের অনিয়ম তদন্তে বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুই মাসের মাথায় তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে অনেক কারসাজি ও অনিয়মের বিষয় সরকারের নজরে আনে। কারসাজি রুখতে তৎকালীন এসইসির নেতৃত্বকে পুনর্গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়। ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে সরকার দ্রুত কমিশনের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকারসহ তৎকালীন কমিশনারদের সরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনকে চেয়ারম্যান করে এসইসি পুনর্গঠন করে। ড. খায়রুল হোসেনের ওপর দায়িত্ব ছিল ২০১০ সালের ধসের আগের অনিয়ম ও কারসাজিকারকদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভবিষ্যতে যাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার পরিবেশ তৈরি করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
ড. এম খায়রুল হোসেনের কমিশন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় বলে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। উল্টো তার বিরুদ্ধে নতুন করে প্লেসমেন্ট শেয়ারের নামে অবৈধ শেয়ারবাজার সৃষ্টিকে উৎসাহিত করা, রুগ্ণ কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। ফলে মহাধসের পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাজার ঘুরে দাঁড়ানো দূরের কথা, বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ পুঁজি হারিয়ে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। যারা যৎসামান্য পুঁজি নিয়ে ধুঁকছিলেন, তারাও এ বাজারে আসা বন্ধ করে দেন। ফলে ব্যাপক তারল্য সংকটে পড়ে শেয়ারবাজার। সরকার বাজেটারি নানা সহায়তা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সবাই তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, অপেক্ষায় তার বিদায়ের ক্ষণের।
এরই মধ্যে গত বছরের শুরুতে চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশে দেশে লকডাউন শুরু হলে অর্থনীতিতেও গভীর ক্ষত তৈরি হয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ তুলে নিতে মরিয়া ছিলেন। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত মাত্র এক মাসে ব্যাপক দরপতনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৯৭২ পয়েন্ট বা ২০ শতাংশ হারিয়ে ৩৯৭৪ পয়েন্টে নামে। শত শত শেয়ারের ক্রেতা শূন্য অবস্থা তৈরি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ড. খায়রুল হোসেনের কমিশন সব শেয়ারের সর্বনিম্ন বাজারদর (ফ্লোর প্রাইস) আরোপ করে। শেয়ারদরে নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়ার ঘটনা একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। এমন বিরল ঘটনার অবতারণা করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। উল্টো শত শত শেয়ারের ক্রেতাশূন্য অবস্থা দিনের পর দিন চলতে থাকে। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারী দেশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লে গত বছরের ২৬ মার্চ লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। লকডাউনে শেয়ারবাজারের লেনদেন কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও লকডাউনের মধ্যেও বিশ্বের প্রায় সব শেয়ারবাজারের লেনদেন চালু ছিল।
টানা দুই মাসের লকডাউন তুলে নেওয়ার পর পুনরায় ৩১ মে শেয়ারবাজারের লেনদেন শুরুর আগেই অতিরিক্ত দুই বছরের মেয়াদ শেষ করে ড. এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিদায় নেন। সরকার নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে চেয়ারম্যানকে নতুন কমিশন গঠন করে। শেয়ারবাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিবর্তনের বড় ভূমিকা রয়েছে।
ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু
অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম গত বছরের ১৭ মে এসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই স্বীকার করে নেন, এ বাজারের প্রধান সংকট সুশাসনের অভাব। আস্থা ফিরিয়ে বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করতে তার কমিশন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সব কিছু করবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। একই সঙ্গে বন্ধ শেয়ারবাজার চালুর উদ্যোগ নেন। তাছাড়া বিনিয়োগ ঝুঁকি কমাতে শেয়ারের বাইরে অন্যান্য ধরনের বিনিয়োগ পণ্য, বিশেষত কার্যকর বন্ড বাজার প্রতিষ্ঠায় সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন। শুধু কথা নয়, সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে সরকারি বন্ড কেনাবেচার শুরু করতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বৈঠক করেন। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে কিছু নীতি প্রণোদনা সরকারের কাছ থেকে আদায়ে কাজ করেন। এরই মধ্যে সরকার বাজেটের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে কালোটাকা সাদা করার সুযোগসহ কিছু প্রণোদনা ঘোষণাও করে।
কিন্তু এ ঘোষণার প্রভাব পড়ার আগে খুব খারাপ সময় কাটে গত বছরের জুনে। ফ্লোর প্রাইসে কেনাবেচা হওয়ায় সূচকের পতন কৃত্রিমভাবে থামানো গেলেও লেনদেন নেমে আসে ১৩ বছরের সর্বনিম্নে। গত বছরের ২১ জুন কেনাবেচা হয় মাত্র ৩৮ কোটি টাকার শেয়ার। ওই মাসে গড়ে প্রতিদিনের লেনদেন ১০০ কোটি টাকায় নেমে আসে।
এ পর্যায়ে শেয়ারের ক্রেতা তৈরিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের পদে থাকতে ২ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত ১০ বছর আগের বিধান কার্যকর করার সময়সীমা বেঁধে দেয় শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের কমিশন। এ ঘোষণার পর শেয়ারবাজার একটু একটু ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। বিশেষত বীমা খাতের অনেক কোম্পানির পরিচালকদের ২ শতাংশ শেয়ার না থাকায় এ খাতের শেয়ারে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। হু হু করে বাড়তে থাকে একের পর এক বীমার কোম্পানির শেয়ারদর। রাতারাতি কিছু শেয়ারের দর দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হতে দেখে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হন। শুরু হয় নতুন উত্থান পর্বের, যা এখনো চলমান। যদিও এরই মধ্যে বীমার শেয়ারদর বৃদ্ধির ধারায় ছেদ পড়ে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বড় উত্থান হয়। ওই ধারার ছেদ পড়ে এখন নানা খাতের শেয়ারদর বাড়ছে।
পরিচালকদের পদে থাকার শর্তটি পরিপালনের পর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার শর্তটিও কার্যকর করেছে এসইসি। দীর্ঘ নয় বছরে যে বিধান কার্যকর করতে পারেনি আগের কমিশন, সেখানে নতুন কমিশন মাত্র ছয় মাসে তা কার্যকর করায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখে। এছাড়া ইলেকট্রনিক জায়ান্ট কোম্পানি ওয়ালটন ও দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার তালিকাভুক্তি বাজারে গতি সঞ্চার করে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ব্রোকারেজ হাউজের বুথ খোলার অনুমোদন দেয় এসইসি। ব্রোকারেজ হাউজের শাখা খোলার ওপর এক দশকের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরায় অতি সম্প্রতি (গত ৫ জানুয়ারি) প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একদিনেই আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হয়, যা গত ১০ বছরের রেকর্ড। পুঁজিবাজারের এই চাঙ্গাভাবের কারণে করোনাকালীন সূচক বৃদ্ধির দিক দিয়ে ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এশিয়ার সেরা বাজারে পরিণত হয় ডিএসই। আর গত আগস্টে সূচক বৃদ্ধিতে বিশ^সেরার স্বীকৃতি পায় স্টক এক্সচেঞ্জটি। আবার বাজার মূলধনও প্রথমবারের মতো পাঁচ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক পার করেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির নেতৃত্বে পরিবর্তনের পাশাপাশি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের টিকা উদ্ভাবনের এবং প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতি সচল হওয়ার খবরগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে। আবার দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার যথাক্রমে নয় ও ছয় শতাংশে বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর করায় তারও বড় প্রভাব ফেলে শেয়ারবাজারে। ব্যাংকের আমানতের সুদহার হঠাৎ কমায় অনেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। এ ঘটনায়ও শেয়ারবাজারের উত্থানে বড় ভূমিকা আছে।
তাছাড়া কথায় বলে- টাকায় টাকা আনে। শেয়ারবাজারে যখন উত্থান হয়, তখন লাভের আশায় সব দেশের সব শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ে। বাড়ি-গাড়ি না করে অনেকে শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। অনেক ব্যবসায়ী, নিজের মূল ব্যবসার টাকাও শেয়ারবাজারে খাটান। ফলে তার প্রভাব শেয়ারদর, লেনদেন ও সূচককে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী করে। ওই ঊর্ধ্বমুখী টান আরও অনেককে শেয়ারবাজারে টেনে আনে। এখনকার শেয়ারবাজারে চলছে সে ধারা।
উত্থানে এসইসি চেয়ারম্যানের ভূমিকা
অন্য অনেক কারণের পাশাপাশি শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিকতম উত্থানে এসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের বিশেষ অবদান রয়েছে। প্রথমত তিনি বিনিয়োগকারীদের কাছে কার্যকরভাবে এ ধারণা তৈরি করতে পেরেছেন- তার আগের কমিশন যেখানে সুশাসন প্রশ্নে ছাড় দিয়েছে, তার কমিশন তা দেবে না। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীরাও ছাড় পাবেন না বলে জানিয়ে দেন। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা পূরণে যখন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড এবং বেক্সিমকো ফার্মা যখন এ বিধান পরিপালনে উদ্যোগ নেয়, তখনই বড় বার্তা পান বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এ ঘটনার বড় ভূমিকা আছে।
এর বাইরে বেক্সিমকো গ্রুপের লোকসানি কোম্পানি বেক্সিমকো সিনথেটিক্সের পাবলিক শেয়ার কিনে কোম্পানিটির স্বেচ্ছায় তালিকাচ্যুতির উদ্যোগের নেপথ্যেও চেয়ারম্যানের বড় ভূমিকা আছে। একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন আরও কিছু রুগ্ণ কোম্পানির ক্ষেত্রে। যুগের পর যুগ ডিবেঞ্চার ইস্যু করে টাকা নেওয়া কিছু কোম্পানির কাছ থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করে যে, শিবলী রুবাইয়াত এ বাজারে পরিবর্তন আনতে পারবেন। তালিকাভুক্তির পর এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের লভ্যাংশ না দেওয়া ঘোষণার পর কোম্পানির প্রধানদের ডেকে লভ্যাংশ প্রদানের ঘটনাকেও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
বর্তমান এসইসির চেয়ারম্যান বাজারে পরিবর্তন আনতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে বেশি জোর দেন। এ কারণে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম থেকে প্রথা ভেঙে সব ধরনের গণমাধ্যমে এসে কথা বলছেন। লকডাউনের মধ্যে টেলিভিশন টক-শো ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানাভাবে তার প্রতিশ্র“তির কথা তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে ইতিপূর্বে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আর্থিক জরিমানা আরোপ করেও এ বার্তা দেন, এখানে অন্যায় করে আর কেউ পার পাবে না। শেয়ার কারসাজি করে ধরা পড়লে মুনাফার চেয়ে বেশি অঙ্কের অর্থ জরিমানা গুনতে হবে- এমন বার্তায়ও বিশ^াস রাখেন বিনিয়োগকারীরা।
দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের বড় অংশই আসছে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে মোট লেনদেনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২০ শতাংশ। সেখানে আমাদের পুঁজিবাজারে দিনের লেনদেনের প্রায় ৯০ শতাংশ আসছে ব্যক্তিশ্রেণির কাছ থেকে। ভারতের তুলনায় এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিদেশিরাও গত দুই বছর ধরে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বিশেষ করে ব্যাংকের অংশগ্রহণ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তার প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি। পুঁজিবাজারে তারল্য সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিলেও অধিকাংশ ব্যাংক এখনো তা করেনি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১টি ব্যাংক ২ হাজার ৫০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে বাধ্য করতে পার্পিচুয়াল বন্ড অনুমোদনের ক্ষেত্রে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের শর্তারোপ করছে এসইসি। এর বাইরেও পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে কমিশনের। আইসিবির জন্য আলাদা করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ফান্ড চাওয়া হয়েছে। ব্রোকারেজ হাউজগুলোর জন্য আরও ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল জোগানে কাজ করছে এসইসি। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে দাবিহীন প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার লভ্যাংশ নিয়ে আলাদা তহবিল গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শঙ্কাও কম নয়
সব উত্থানের শুরু হয় পতনের শঙ্কাকে মাথায় নিয়ে। বিশেষত দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া কোনো কিছু সাধারনত টেকসই হয় না। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারের যে উত্থান, তা শেষ পর্যন্ত কতদিন স্থায়ী হবে- তা নিয়ে এরই মধ্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা শঙ্কা তৈরি করছে।
বিশেষত বীমা খাতের কোম্পানি এশিয়া, এশিয়া প্যাসিফিক, প্রভাতী, ইস্টার্ন, প্যারামাউন্ট, পিপলস, রিপাবলিক, নিটল, সেন্ট্রাল, পাইওনিয়ার, প্রাইম, নর্দানসহ অনেকগুলোর শেয়ারদর তিন থেকে ১২গুণ হওয়ার পর সেগুলোর দরপতন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ শঙ্কাকে উসকে দিয়েছে। এখন এসব শেয়ার বিক্রি করতে গিয়েও যথেষ্ট ক্রেতা না মেলায় অনেকের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে তালিকাভুক্ত মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে। এখানেও হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকা পড়েছে।
এ অবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, শাইনপুকুর সিরামিক্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সসহ নতুন তালিকাভুক্ত রবি, ওয়ালটন, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, ডমিনেজ স্টিলসহ বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারদরের মাত্রাতিরিক্ত উলম্ফন নিয়ে একদিকে নতুন আশাবাদ যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি পতনের শঙ্কাও বেজে উঠেছে। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরবৃদ্ধিতে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। দীর্ঘদিনের মন্দার কারণে অনেক শেয়ারও অবমূল্যায়িত ছিল। আবার চাঙ্গা বাজারে মৌলভিত্তির পাশাপাশি দুর্বল শেয়ারের দরও বাড়তে দেখা যায়। দেখা গেছে, গত ছয় মাসে শেয়ারদর দুই থেকে অন্তত ১২গুণ হয়েছে অন্তত ৭০ শেয়ারের।
এদিকে শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন বা করোনাভাইরাস মহামারী থেকে উত্তরণের আশা এ উত্থানের কারণ নয়। নিখাদ কারসাজিই এসব উত্থানের নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। সুশাসন ফেরাতে এসইসির কিছু পদক্ষেপ এবং করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার ও তার প্রয়োগের খবর শুধু সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। টানা উত্থানে কিছু শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ফলে চলতি উত্থান শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে কি-না, বা আবারও কোনো কেলেঙ্কারির প্লট তৈরি হচ্ছে কি-না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। মুখে কারসাজির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’র ঘোষণা দিলেও গত ছয় মাসের কারসাজির ঘটনায় কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি এসইসিকে। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আরও সতর্ক হতে হবে।
আশার দিকও আছে
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও শেয়ারবাজারের উন্নতি এখনো তেমন নয়- এ কথা অর্থনীতিবিদদের। এমনকি বিনিয়োগকারী থেকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সব পর্যায়ে এ কথা মানেন। এদেশের শেয়ারবাজারে এখনো কেবল মূলধনীর শেয়ারই কেনাবেচা হয়। বিনিয়োগ পণ্যে বৈচিত্র্য নেই। নতুন কমিশন এক্ষেত্রে বহুমুখী বিনিয়োগ পণ্য প্রচলনের নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রধানতম হলো- কার্যকর বন্ড বাজার তৈরি। শিগগিরই সরকারি বন্ড সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে কেনাবেচা হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পার্পিচুয়াল বন্ডও সেকেন্ডারি বাজারে লেনদেন হবে। ফলে ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমায় যারা বিপদে পড়েছেন, তারা এসব বন্ডে বিনিয়োগ করে তুলনামূলক বেশি মুনাফা পাওয়ার সহজ সুযোগ পাবেন। আসছে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক বন্ড বা সুকুক। ফলে ধর্মপরায়ণ মানুষও বিনিয়োগের নতুন পণ্য পাবেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বন্ড বিক্রি করে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, তারও প্রচার চালাচ্ছে এসইসি। এরই মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তার একটি প্রকল্পের অর্থের সংস্থানে বন্ড ইস্যু করার বিষয়ে সরকারের সম্মতি পেয়েছে। এসইসি বলছে, আগামীতে ঋণনির্ভর অর্থায়ন নয়, পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন নিয়ে দেশের বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে উঠবে, মানুষ পাবে বিনিয়োগের নতুন ও নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র।
যাত্রা বহুদূর, করতে হবে আরও অনেক কিছু
নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির ঘোষণা দিয়েছে- ২০২২ সালের মধ্যে, অর্থাৎ এখন থেকে দুই বছরের মধ্যে দেশের শেয়ারবাজার উন্নত বিশ্বের শেয়ারবাজারের আদলে গড়ে উঠবে। যেখানে বিনিয়োগ নিতে ও বিনিয়োগ করতে দেশ-বিদেশের সব ধরনের উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা ভিড় করবেন। তবে উন্নত শেয়ারবাজার গড়তে বিনিয়োগ পণ্যে বৈচিত্র্য আনার আগে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরি বড় কাজ। এ কাজটি করতে কারসাজির বিরুদ্ধে মুখে নয়, কাজে কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
দেশ ডিজিটাল হলেও শেয়ারবাজারে এখনো প্রযুক্তির ছোঁয়া খুব বেশি লাগেনি। স্টক এক্সচেঞ্জগুলো স্বতন্ত্র পরিচালকদের নেতৃত্বে চললেও এখনো তারা দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। বরং প্রভাবশালীদের প্রভাবেই স্টক এক্সচেঞ্জের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। লেনদেন ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণ মাত্র দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেনের ভার নিতে পারছে না লেনদেন প্লাটফর্ম। দ্রুততম সময়ে আইপিও অনুমোদনে কমিশন ব্যবস্থা নিলেও এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এখনো নিশ্চিত হয়নি। এখনো দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হচ্ছে। কারসাজি রুখতে না স্টক এক্সচেঞ্জ, না এসইসি এখনো পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য কোনো অবস্থা তৈরি করতে পারেনি।
উন্নত দেশের আদলে শেয়ারবাজার গড়তে হলে সুশাসন এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান কমিশন শুরুর ভুলভ্রান্তি ও দুর্বলতা কাটিয়ে সত্যিকার অর্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা রাখবে- এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
শেয়ার করুন
আনোয়ার ইব্রাহিম | ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

নতুন জোয়ার এসেছে দেশের শেয়ারবাজারে। এই কিছুদিন আগেও যেখানে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে পড়ে যে বাজার মরার মতো ধুঁকছিল, সে বাজারে নেমেছে বিনিয়োগের বান। বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের আনাগোনা। গত কয়েক মাস ধরে শনৈ শনৈ বাড়ছে শেয়ারদর। পরিস্থিতি এমনই যে, এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে যেখানে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজির যতটা সম্ভব তুলে নিতে মরিয়া ছিলেন বিনিয়োগকারীরা, এখন তারাই নতুন ক্রেতার ভূমিকায়। বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার চিন্তা নয়, নতুন করে বিনিয়োগের জন্য অর্থের সন্ধানে ছুটছেন তারা। এখন বিনিয়োগকারীরা সামনে স্রেফ মুনাফার হাতছানি দেখছেন।
ঠিক কী কারণে রাতারাতি বদলে গেল শেয়ারবাজার এ প্রশ্ন অনেকের। রাতারাতি অবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে কারও মধ্যে অবশ্য ‘কু’ ডাকছে। দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ ছিয়ানব্বই বা ২০১০ সালের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন। বিপরীতে কারও ভাবনা হলো- এবার হয়তো সত্যিকার অর্থেই গড়ে উঠবে শেয়ারবাজার, অর্থনীতিতে পুঁজির সংস্থানে এ বাজারই প্রধান বিকল্প হয়ে ওঠার পথে এই প্রথম নতুন যাত্রা শুরু করেছে এ বাজার। যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার মাত্র সাত মাসেই দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। এ সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জটিতে শেয়ার কেনাবেচা শত কোটি থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
করোনা অতিমারীর মধ্যে শুধু যে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন ঘটেছে, তা নয়। এ সময় বিশ্বের প্রধান প্রধান পুঁজিবাজারগুলোতেও একই ধারা দেখা গেছে। করোনাকালীন বিভিন্ন দেশে উৎপাদন সূচকের বড় ধরনের অবনতির মধ্যেই পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে গত ২৩ মার্চের পর থেকেই বিশে^র সেরা বাজারগুলো উর্ধ্বগতির ধারায় ফিরে আসে। এ সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডাউ জোনস ইন্ডাস্ট্র্রিয়াল এভারেজ সূচকটি ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। নাসডাক ১০০ সূচকটি বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকে ৬৯ শতাংশের বেশি পয়েন্ট যোগ হয়েছে। যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ১০০ সূচক বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এশিয়াতে জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক গত নয় মাসে ৭৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এমনকি যে চীন থেকে করোনা ছড়িয়েছে সেই চীনের সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কম্পোজিট সূচক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এমনকি পার্শ^বর্তী দেশ ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সব সূচকের যেখানে ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে, সেই ভারতের সেনসেক্স গত মার্চের পর ৯০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের উত্থান কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে।
দুঃসহ ১০ বছর
প্রথমেই আসা যাক- কী করে ঘুরে দাঁড়াল ক্রমাগত পতনের ধারায় থাকা শেয়ারবাজার। এ উত্তর খুঁজতে যেতে হবে ২০১০ সালের শেয়ারবাজারের মহাধসের প্রেক্ষাপটে। লাগাতার কারসাজি আর তালিকাভুক্ত বহু কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সরাসরি সম্পৃক্ততায় লাগামহীন বেড়েছিল শেয়ারদর। কারণে-অকারণে শেয়ারের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। সে সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজি বন্ধ তো দূরের কথা, তার লাগাম টানতেও ব্যর্থ হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানির যথেচ্ছ বিনিয়োগে ভর করে শেয়ারের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে মুনাফা বাড়িয়ে দেখিয়ে লাভের ফাঁদ ফেলে মানুষকে আকৃষ্ট করে। পাশাপাশি কারসাজি চক্র কৃত্রিম বাজার তৈরি করলে শেয়ারদর রকেট গতি পায়।
২০১০ সালের শেষে ব্যাংকের বিনিয়োগের লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক খড়গহস্ত হলে টান পড়ে বিনিয়োগে। ফলে ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর মহাপতনের সূচনা হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে সরকার শেয়ারবাজারের অনিয়ম তদন্তে বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুই মাসের মাথায় তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে অনেক কারসাজি ও অনিয়মের বিষয় সরকারের নজরে আনে। কারসাজি রুখতে তৎকালীন এসইসির নেতৃত্বকে পুনর্গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়। ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে সরকার দ্রুত কমিশনের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকারসহ তৎকালীন কমিশনারদের সরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনকে চেয়ারম্যান করে এসইসি পুনর্গঠন করে। ড. খায়রুল হোসেনের ওপর দায়িত্ব ছিল ২০১০ সালের ধসের আগের অনিয়ম ও কারসাজিকারকদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভবিষ্যতে যাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার পরিবেশ তৈরি করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
ড. এম খায়রুল হোসেনের কমিশন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় বলে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। উল্টো তার বিরুদ্ধে নতুন করে প্লেসমেন্ট শেয়ারের নামে অবৈধ শেয়ারবাজার সৃষ্টিকে উৎসাহিত করা, রুগ্ণ কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। ফলে মহাধসের পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাজার ঘুরে দাঁড়ানো দূরের কথা, বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ পুঁজি হারিয়ে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। যারা যৎসামান্য পুঁজি নিয়ে ধুঁকছিলেন, তারাও এ বাজারে আসা বন্ধ করে দেন। ফলে ব্যাপক তারল্য সংকটে পড়ে শেয়ারবাজার। সরকার বাজেটারি নানা সহায়তা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের সবাই তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, অপেক্ষায় তার বিদায়ের ক্ষণের।
এরই মধ্যে গত বছরের শুরুতে চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেশে দেশে লকডাউন শুরু হলে অর্থনীতিতেও গভীর ক্ষত তৈরি হয়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ তুলে নিতে মরিয়া ছিলেন। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত মাত্র এক মাসে ব্যাপক দরপতনে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৯৭২ পয়েন্ট বা ২০ শতাংশ হারিয়ে ৩৯৭৪ পয়েন্টে নামে। শত শত শেয়ারের ক্রেতা শূন্য অবস্থা তৈরি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ড. খায়রুল হোসেনের কমিশন সব শেয়ারের সর্বনিম্ন বাজারদর (ফ্লোর প্রাইস) আরোপ করে। শেয়ারদরে নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়ার ঘটনা একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। এমন বিরল ঘটনার অবতারণা করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। উল্টো শত শত শেয়ারের ক্রেতাশূন্য অবস্থা দিনের পর দিন চলতে থাকে। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারী দেশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়লে গত বছরের ২৬ মার্চ লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। লকডাউনে শেয়ারবাজারের লেনদেন কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও লকডাউনের মধ্যেও বিশ্বের প্রায় সব শেয়ারবাজারের লেনদেন চালু ছিল।
টানা দুই মাসের লকডাউন তুলে নেওয়ার পর পুনরায় ৩১ মে শেয়ারবাজারের লেনদেন শুরুর আগেই অতিরিক্ত দুই বছরের মেয়াদ শেষ করে ড. এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিদায় নেন। সরকার নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে চেয়ারম্যানকে নতুন কমিশন গঠন করে। শেয়ারবাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিবর্তনের বড় ভূমিকা রয়েছে।
ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু
অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম গত বছরের ১৭ মে এসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই স্বীকার করে নেন, এ বাজারের প্রধান সংকট সুশাসনের অভাব। আস্থা ফিরিয়ে বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করতে তার কমিশন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সব কিছু করবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। একই সঙ্গে বন্ধ শেয়ারবাজার চালুর উদ্যোগ নেন। তাছাড়া বিনিয়োগ ঝুঁকি কমাতে শেয়ারের বাইরে অন্যান্য ধরনের বিনিয়োগ পণ্য, বিশেষত কার্যকর বন্ড বাজার প্রতিষ্ঠায় সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন। শুধু কথা নয়, সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে সরকারি বন্ড কেনাবেচার শুরু করতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বৈঠক করেন। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে কিছু নীতি প্রণোদনা সরকারের কাছ থেকে আদায়ে কাজ করেন। এরই মধ্যে সরকার বাজেটের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে কালোটাকা সাদা করার সুযোগসহ কিছু প্রণোদনা ঘোষণাও করে।
কিন্তু এ ঘোষণার প্রভাব পড়ার আগে খুব খারাপ সময় কাটে গত বছরের জুনে। ফ্লোর প্রাইসে কেনাবেচা হওয়ায় সূচকের পতন কৃত্রিমভাবে থামানো গেলেও লেনদেন নেমে আসে ১৩ বছরের সর্বনিম্নে। গত বছরের ২১ জুন কেনাবেচা হয় মাত্র ৩৮ কোটি টাকার শেয়ার। ওই মাসে গড়ে প্রতিদিনের লেনদেন ১০০ কোটি টাকায় নেমে আসে।
এ পর্যায়ে শেয়ারের ক্রেতা তৈরিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের পদে থাকতে ২ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত ১০ বছর আগের বিধান কার্যকর করার সময়সীমা বেঁধে দেয় শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের কমিশন। এ ঘোষণার পর শেয়ারবাজার একটু একটু ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। বিশেষত বীমা খাতের অনেক কোম্পানির পরিচালকদের ২ শতাংশ শেয়ার না থাকায় এ খাতের শেয়ারে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। হু হু করে বাড়তে থাকে একের পর এক বীমার কোম্পানির শেয়ারদর। রাতারাতি কিছু শেয়ারের দর দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হতে দেখে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হন। শুরু হয় নতুন উত্থান পর্বের, যা এখনো চলমান। যদিও এরই মধ্যে বীমার শেয়ারদর বৃদ্ধির ধারায় ছেদ পড়ে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বড় উত্থান হয়। ওই ধারার ছেদ পড়ে এখন নানা খাতের শেয়ারদর বাড়ছে।
পরিচালকদের পদে থাকার শর্তটি পরিপালনের পর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার শর্তটিও কার্যকর করেছে এসইসি। দীর্ঘ নয় বছরে যে বিধান কার্যকর করতে পারেনি আগের কমিশন, সেখানে নতুন কমিশন মাত্র ছয় মাসে তা কার্যকর করায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখে। এছাড়া ইলেকট্রনিক জায়ান্ট কোম্পানি ওয়ালটন ও দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার তালিকাভুক্তি বাজারে গতি সঞ্চার করে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ব্রোকারেজ হাউজের বুথ খোলার অনুমোদন দেয় এসইসি। ব্রোকারেজ হাউজের শাখা খোলার ওপর এক দশকের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরায় অতি সম্প্রতি (গত ৫ জানুয়ারি) প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একদিনেই আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হয়, যা গত ১০ বছরের রেকর্ড। পুঁজিবাজারের এই চাঙ্গাভাবের কারণে করোনাকালীন সূচক বৃদ্ধির দিক দিয়ে ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এশিয়ার সেরা বাজারে পরিণত হয় ডিএসই। আর গত আগস্টে সূচক বৃদ্ধিতে বিশ^সেরার স্বীকৃতি পায় স্টক এক্সচেঞ্জটি। আবার বাজার মূলধনও প্রথমবারের মতো পাঁচ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক পার করেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির নেতৃত্বে পরিবর্তনের পাশাপাশি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের টিকা উদ্ভাবনের এবং প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতি সচল হওয়ার খবরগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে। আবার দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার যথাক্রমে নয় ও ছয় শতাংশে বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর করায় তারও বড় প্রভাব ফেলে শেয়ারবাজারে। ব্যাংকের আমানতের সুদহার হঠাৎ কমায় অনেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। এ ঘটনায়ও শেয়ারবাজারের উত্থানে বড় ভূমিকা আছে।
তাছাড়া কথায় বলে- টাকায় টাকা আনে। শেয়ারবাজারে যখন উত্থান হয়, তখন লাভের আশায় সব দেশের সব শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ে। বাড়ি-গাড়ি না করে অনেকে শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। অনেক ব্যবসায়ী, নিজের মূল ব্যবসার টাকাও শেয়ারবাজারে খাটান। ফলে তার প্রভাব শেয়ারদর, লেনদেন ও সূচককে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী করে। ওই ঊর্ধ্বমুখী টান আরও অনেককে শেয়ারবাজারে টেনে আনে। এখনকার শেয়ারবাজারে চলছে সে ধারা।
উত্থানে এসইসি চেয়ারম্যানের ভূমিকা
অন্য অনেক কারণের পাশাপাশি শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিকতম উত্থানে এসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের বিশেষ অবদান রয়েছে। প্রথমত তিনি বিনিয়োগকারীদের কাছে কার্যকরভাবে এ ধারণা তৈরি করতে পেরেছেন- তার আগের কমিশন যেখানে সুশাসন প্রশ্নে ছাড় দিয়েছে, তার কমিশন তা দেবে না। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীরাও ছাড় পাবেন না বলে জানিয়ে দেন। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা পূরণে যখন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেড এবং বেক্সিমকো ফার্মা যখন এ বিধান পরিপালনে উদ্যোগ নেয়, তখনই বড় বার্তা পান বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এ ঘটনার বড় ভূমিকা আছে।
এর বাইরে বেক্সিমকো গ্রুপের লোকসানি কোম্পানি বেক্সিমকো সিনথেটিক্সের পাবলিক শেয়ার কিনে কোম্পানিটির স্বেচ্ছায় তালিকাচ্যুতির উদ্যোগের নেপথ্যেও চেয়ারম্যানের বড় ভূমিকা আছে। একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন আরও কিছু রুগ্ণ কোম্পানির ক্ষেত্রে। যুগের পর যুগ ডিবেঞ্চার ইস্যু করে টাকা নেওয়া কিছু কোম্পানির কাছ থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করে যে, শিবলী রুবাইয়াত এ বাজারে পরিবর্তন আনতে পারবেন। তালিকাভুক্তির পর এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের লভ্যাংশ না দেওয়া ঘোষণার পর কোম্পানির প্রধানদের ডেকে লভ্যাংশ প্রদানের ঘটনাকেও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
বর্তমান এসইসির চেয়ারম্যান বাজারে পরিবর্তন আনতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে বেশি জোর দেন। এ কারণে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম থেকে প্রথা ভেঙে সব ধরনের গণমাধ্যমে এসে কথা বলছেন। লকডাউনের মধ্যে টেলিভিশন টক-শো ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানাভাবে তার প্রতিশ্র“তির কথা তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে ইতিপূর্বে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আর্থিক জরিমানা আরোপ করেও এ বার্তা দেন, এখানে অন্যায় করে আর কেউ পার পাবে না। শেয়ার কারসাজি করে ধরা পড়লে মুনাফার চেয়ে বেশি অঙ্কের অর্থ জরিমানা গুনতে হবে- এমন বার্তায়ও বিশ^াস রাখেন বিনিয়োগকারীরা।
দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের বড় অংশই আসছে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে মোট লেনদেনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২০ শতাংশ। সেখানে আমাদের পুঁজিবাজারে দিনের লেনদেনের প্রায় ৯০ শতাংশ আসছে ব্যক্তিশ্রেণির কাছ থেকে। ভারতের তুলনায় এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিদেশিরাও গত দুই বছর ধরে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বিশেষ করে ব্যাংকের অংশগ্রহণ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তার প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি। পুঁজিবাজারে তারল্য সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিলেও অধিকাংশ ব্যাংক এখনো তা করেনি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১টি ব্যাংক ২ হাজার ৫০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে বাধ্য করতে পার্পিচুয়াল বন্ড অনুমোদনের ক্ষেত্রে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের শর্তারোপ করছে এসইসি। এর বাইরেও পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে কমিশনের। আইসিবির জন্য আলাদা করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ফান্ড চাওয়া হয়েছে। ব্রোকারেজ হাউজগুলোর জন্য আরও ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল জোগানে কাজ করছে এসইসি। এছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে দাবিহীন প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার লভ্যাংশ নিয়ে আলাদা তহবিল গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শঙ্কাও কম নয়
সব উত্থানের শুরু হয় পতনের শঙ্কাকে মাথায় নিয়ে। বিশেষত দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া কোনো কিছু সাধারনত টেকসই হয় না। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারের যে উত্থান, তা শেষ পর্যন্ত কতদিন স্থায়ী হবে- তা নিয়ে এরই মধ্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা শঙ্কা তৈরি করছে।
বিশেষত বীমা খাতের কোম্পানি এশিয়া, এশিয়া প্যাসিফিক, প্রভাতী, ইস্টার্ন, প্যারামাউন্ট, পিপলস, রিপাবলিক, নিটল, সেন্ট্রাল, পাইওনিয়ার, প্রাইম, নর্দানসহ অনেকগুলোর শেয়ারদর তিন থেকে ১২গুণ হওয়ার পর সেগুলোর দরপতন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ শঙ্কাকে উসকে দিয়েছে। এখন এসব শেয়ার বিক্রি করতে গিয়েও যথেষ্ট ক্রেতা না মেলায় অনেকের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে তালিকাভুক্ত মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে। এখানেও হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকা পড়েছে।
এ অবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, শাইনপুকুর সিরামিক্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সসহ নতুন তালিকাভুক্ত রবি, ওয়ালটন, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, ডমিনেজ স্টিলসহ বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারদরের মাত্রাতিরিক্ত উলম্ফন নিয়ে একদিকে নতুন আশাবাদ যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি পতনের শঙ্কাও বেজে উঠেছে। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরবৃদ্ধিতে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। দীর্ঘদিনের মন্দার কারণে অনেক শেয়ারও অবমূল্যায়িত ছিল। আবার চাঙ্গা বাজারে মৌলভিত্তির পাশাপাশি দুর্বল শেয়ারের দরও বাড়তে দেখা যায়। দেখা গেছে, গত ছয় মাসে শেয়ারদর দুই থেকে অন্তত ১২গুণ হয়েছে অন্তত ৭০ শেয়ারের।
এদিকে শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন বা করোনাভাইরাস মহামারী থেকে উত্তরণের আশা এ উত্থানের কারণ নয়। নিখাদ কারসাজিই এসব উত্থানের নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। সুশাসন ফেরাতে এসইসির কিছু পদক্ষেপ এবং করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার ও তার প্রয়োগের খবর শুধু সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। টানা উত্থানে কিছু শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ফলে চলতি উত্থান শেষ পর্যন্ত টেকসই হবে কি-না, বা আবারও কোনো কেলেঙ্কারির প্লট তৈরি হচ্ছে কি-না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। মুখে কারসাজির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’র ঘোষণা দিলেও গত ছয় মাসের কারসাজির ঘটনায় কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি এসইসিকে। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আরও সতর্ক হতে হবে।
আশার দিকও আছে
দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও শেয়ারবাজারের উন্নতি এখনো তেমন নয়- এ কথা অর্থনীতিবিদদের। এমনকি বিনিয়োগকারী থেকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সব পর্যায়ে এ কথা মানেন। এদেশের শেয়ারবাজারে এখনো কেবল মূলধনীর শেয়ারই কেনাবেচা হয়। বিনিয়োগ পণ্যে বৈচিত্র্য নেই। নতুন কমিশন এক্ষেত্রে বহুমুখী বিনিয়োগ পণ্য প্রচলনের নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রধানতম হলো- কার্যকর বন্ড বাজার তৈরি। শিগগিরই সরকারি বন্ড সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে কেনাবেচা হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পার্পিচুয়াল বন্ডও সেকেন্ডারি বাজারে লেনদেন হবে। ফলে ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমায় যারা বিপদে পড়েছেন, তারা এসব বন্ডে বিনিয়োগ করে তুলনামূলক বেশি মুনাফা পাওয়ার সহজ সুযোগ পাবেন। আসছে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক বন্ড বা সুকুক। ফলে ধর্মপরায়ণ মানুষও বিনিয়োগের নতুন পণ্য পাবেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বন্ড বিক্রি করে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, তারও প্রচার চালাচ্ছে এসইসি। এরই মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তার একটি প্রকল্পের অর্থের সংস্থানে বন্ড ইস্যু করার বিষয়ে সরকারের সম্মতি পেয়েছে। এসইসি বলছে, আগামীতে ঋণনির্ভর অর্থায়ন নয়, পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন নিয়ে দেশের বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে উঠবে, মানুষ পাবে বিনিয়োগের নতুন ও নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র।
যাত্রা বহুদূর, করতে হবে আরও অনেক কিছু
নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির ঘোষণা দিয়েছে- ২০২২ সালের মধ্যে, অর্থাৎ এখন থেকে দুই বছরের মধ্যে দেশের শেয়ারবাজার উন্নত বিশ্বের শেয়ারবাজারের আদলে গড়ে উঠবে। যেখানে বিনিয়োগ নিতে ও বিনিয়োগ করতে দেশ-বিদেশের সব ধরনের উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা ভিড় করবেন। তবে উন্নত শেয়ারবাজার গড়তে বিনিয়োগ পণ্যে বৈচিত্র্য আনার আগে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরি বড় কাজ। এ কাজটি করতে কারসাজির বিরুদ্ধে মুখে নয়, কাজে কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
দেশ ডিজিটাল হলেও শেয়ারবাজারে এখনো প্রযুক্তির ছোঁয়া খুব বেশি লাগেনি। স্টক এক্সচেঞ্জগুলো স্বতন্ত্র পরিচালকদের নেতৃত্বে চললেও এখনো তারা দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। বরং প্রভাবশালীদের প্রভাবেই স্টক এক্সচেঞ্জের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। লেনদেন ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণ মাত্র দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেনের ভার নিতে পারছে না লেনদেন প্লাটফর্ম। দ্রুততম সময়ে আইপিও অনুমোদনে কমিশন ব্যবস্থা নিলেও এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এখনো নিশ্চিত হয়নি। এখনো দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হচ্ছে। কারসাজি রুখতে না স্টক এক্সচেঞ্জ, না এসইসি এখনো পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য কোনো অবস্থা তৈরি করতে পারেনি।
উন্নত দেশের আদলে শেয়ারবাজার গড়তে হলে সুশাসন এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান কমিশন শুরুর ভুলভ্রান্তি ও দুর্বলতা কাটিয়ে সত্যিকার অর্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা রাখবে- এমনটাই প্রত্যাশা সবার।