প্রণোদনায় প্রাণ পোশাক শিল্পে
আরিফুর রহমান তুহিন | ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
জুন থেকে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সীমিত আকারে লকডাউন প্রত্যাহার শুরু হয়। এতে ক্রেতারাও ফিরতে শুরু করেন। কিছু ক্রেতা ডিসকাউন্ট দিয়ে স্থগিত করা পণ্য কিনে নেন। অনেকে আবার পুরো দাম দেন। এছাড়া ক্রেতারা নতুন ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেন। জুলাই থেকেই রপ্তানি পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সক্ষমতার চেয়ে কম হলেও প্রায় সব কারখানাই কাজ পায়। স্বাভাবিক হতে থাকে দেশের রপ্তানি খাত। তবে মার্চ-জুনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এদের অনেকেই আবার নতুন করে শুরু কার্যক্রম শুরু করেছেন। অনেকে চেষ্টায় আছেন। তবে বেশ কয়েকটি কারখানা আর কখনো উৎপাদনে নাও যেতে পারে।
করোনার ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল দেশের তৈরি পোশাক খাত। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক আর রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের অংশীদার এই শিল্পের উৎপাদন মাসখানেক বন্ধ ছিল। স্থগিত/বাতিল হয়েছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ। ক্রয়াদেশ হারিয়ে কারখানা মালিকরা যখন চোখে সরষের ফুল দেখছিলেন তখন ত্রাতা হয়ে পাশে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। ২৭ এপ্রিল বড় শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন তিনি। জুনের শেষে ক্রেতারাও পণ্য নেওয়া শুরু করেন। প্রণোদনা ও ক্রেতাদের ফিরে আসায় আবার প্রাণ ফিরতে শুরু করে এই শিল্পে। যদিও এখনো সক্ষমতার থেকে কম এবং ৭-১০ শতাংশে পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে উৎপাদকদের। এই খাতের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, করোনাকালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনাই মূলত তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছিল। বিশেষ করে না চাইতেই শ্রমিকের বেতনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ২ শতাংশ সুদের বিশেষ ঋণ টনিক হিসেবে কাজ করেছে।
পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির পরিচালক ও ফতুল্লা অ্যাপারেলসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা করতে পারছি এর মূলে রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা। আমরা যদি সময়মতো শ্রমিকের বেতন দিতে না পারতাম তাহলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। দেশজুড়ে একটা অশান্তি সৃষ্টি হতো। করোনাকালে সবাই ধারণা করছিল লাখ লাখ শ্রমিক ছাঁটাই হবে। অথচ দেখা গেল এক লাখ শ্রমিকও ছাঁটাই হয়নি। আর এখন তো খুব কমসংখ্যক শ্রমিক আছে যাদের চাকরি নেই। আর ওই সময়ে যে অবস্থা ছিল তাতে প্রণোদনা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আমরা না চাইতেই তিনি শ্রমিকের বেতনের ব্যবস্থা করে দিলেন। এতে যেটা হলো, শ্রমিকরা করোনাকালেও বেতন পেয়ে খুবই উৎফুল্ল ছিল। তারাও টিকে থাকার সংগ্রামে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমরা উৎপাদনে ফিরে গেলাম। এই যে পদক্ষেপটা তিনি নিলেন এজন্য আমরা কারখানা মালিকরা ওনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
করোনাকালে পোশাক খাত পরিচালনার অভিজ্ঞতা জানতে দেশ রূপান্তর কথা বলেছিল নিপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খসরু চৌধুরীর সঙ্গে। রাজধানীর দক্ষিণখানে অবস্থিত রপ্তানিমুখী এই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন পর্যায়ে কোম্পানিটিতে প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক কাজ করে। বছর তিনেক আগে কোম্পানিটি কেসি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নামে আরেকটি শাখা স্থাপন করেছিল। এতে তাকে প্রায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তাই অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা টানাটানির মধ্যে ছিল নিপা গ্রুপ। এর মধ্যেই বিশ্বব্যাপী করোনা আঘাত হানে। অন্য কোম্পানিগুলোর মতো নিপা গ্রুপও সংকটের কিনারায় পৌঁছায়। কারখানা বন্ধ, ক্রেতারা পণ্য নিচ্ছে না, রপ্তানিকৃত পণ্যের টাকাও আসছে না। কোটি কোটি টাকার শ্রমিকের বেতন কীভাবে দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না খসরু চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যেই ২৫ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, ২ শতাংশ সুদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। কিছুটা স্বস্তি পেলাম। টানা ৩ মাস ২ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে শ্রমিকের বেতন দিলাম। চতুর্থ মাসেও সরকারের দেওয়া সাড়ে ৪ শতাংশ সুদের ঋণে বেতন পরিশোধ করলাম। এর মধ্যে ক্রেতারাও পণ্য নিতে শুরু করল। নতুন ক্রয়াদেশ এলো। বকেয়া টাকাও পেতে শুরু করলাম। বর্তমানে আগের চেয়ে ৩-৪ শতাংশ কম রপ্তানি করছি। দামও পাচ্ছি ৭-১০ শতাংশ কম। কিন্তু শ্রমিকের বেতন দিতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। কারণ, চার মাসের জমে থাকা পণ্যের টাকা একত্রে পেয়েছি। অধিকাংশেরই একই অবস্থা বলে আমার মনে হয়। আর শ্রমিকের বেতন সময়মতো দিতে পারা মানে মাথার ওপর থেকে ৯০ শতাংশ চাপ কমে যাওয়া। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমার অবস্থা মন্দের ভালো। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর করোনা কেটে গেলে অবস্থা আরও ভালো হবে। তবে সরকার যদি প্রণোদনার ঋণের টাকাটা আরও ৬ মাস পর নিতে শুরু করে তাহলে চাপটা কম হতো। আমরা তো এই টাকাটা ফেরত দেব।’
করোনার কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে বড় ধস নামে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতে ওই অর্থবছরে মোট রপ্তানি হয়েছিল ২৭ দশমিক ৯৪৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে ৩৪ দশমিক ১৩৩ বিলিয়ন ডলারের। বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়া ও বিভিন্ন কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পেরে উঠতে না পারায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরু থেকেই এই খাতের রপ্তানি কমতে থাকে। ওই অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে যায়। আর জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি কমে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
রূপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত ৫ বছরের বিশ্ববাজার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নিয়মিতভাবে বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষের চাহিদা এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে। কম মূল্যে আমরা বানাতে পারি বলে এখনো অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পোশাক রপ্তানিতে যে ধস নেমেছিল সেটাও মূলত বৈশ্বিক চাহিদা কমার কারণে। এর কিছুদিন আগেই শ্রমিকদের নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা হলো। তাদের বেতন বাড়ল অথচ পোশাকের চাহিদা ও দাম দুটোই কমল। আমরা প্রবল চাপের মধ্যে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছিলাম।’
ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমে যাওয়ায় কারখানা মালিকরা যখন প্রবল চাপের মধ্যে ছিলেন ঠিক তখনই করোনা হানা দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এ ভাইরাস যে এতটা ভয়াবহ হবে তা শুরুতে কোনো ব্যবসায়ী আঁচ করতে পারেননি। তাদের ধারণা ছিল, ইবোলার মতো হয়তো এটিও চীন বা তার আশপাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। দিন যত যায়, পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। করোনার বিস্তার পৃথিবীব্যাপী ঘটে যায়। বাড়তে থাকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান। এক পর্যায়ে জ্যামিতিক হারে এর বিস্তার ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতি সামাল দিতে লকডাউনে চলার ঘোষণা করতে থাকে। ১১ মার্চ, ২০১৯ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এটিকে মহামারী হিসেবে আখ্যা দেয়। একইসঙ্গে ক্রেতাদের আসল চরিত্রও বেরিয়ে আসে। ক্রেতারা কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একের পর এক ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল করতে থাকে। শিপমেন্টগুলো পিছিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে পণ্য নেওয়া বন্ধই করে দেয়।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পণ্য খাতে রপ্তানি আয় আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ, ৮২ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও ৬১ দশমিক ৮৭ শতাংশ কমেছে। আর পোশাক খাতে মার্চে আয় কমে যায় ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ, এপ্রিলে ৮৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, মে মাসে ৬২ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং জুনে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক খাতে মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ দশমকি ৯৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ১৩৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি কমে ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
আশুলিয়ার জিরাবোর ফ্যাশন ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর মিডিয়া স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান খান মনিরুল আলম শুভ বলেন, ‘এটা ছিল এক প্রকার অবিশ্বাস্য কিন্তু চরম সত্য। ক্রেতারা এতদিন আমাদের নিয়মনীতির কথা শুনিয়ে আসছিল। সামান্য অজুহাত দেখিয়ে তারা আমাদের সব সময় চাপে রাখত। অথচ তারাই কিনা কোনো নিয়মের বালাই মানল না। পণ্য নেওয়া, রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা বন্ধ করে দিল। আমাদের মতো ছোট কারখানা মালিকদের জন্য এটা ছিল একটা টর্নেডোর মতো। মনে হচ্ছিল একটি ঝড় সব দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেল। আমরা কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ক্রেতাদের সঙ্গে বিজিএমইএ ও আমরা আলাদাভাবে যোগাযোগ করতে থাকলাম। অবশ্য অনেক ক্রেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা পরে পণ্য নেবেন। কথা রেখেছেনও। কিন্তু অনেকে আবার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট চেয়ে বসলেন। কেউ কেউ তো পণ্য নেয়ইনি। সত্যি এটা ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মতো।’
দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটে। দেশজুড়ে একটা আতঙ্ক বিরাজ করে। অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যান। শ্রমিকরা ভয়ে নিয়মিত কাজে আসছিল না। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কারখানা বন্ধ ঘোষণার একটা চাপ ছিল। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় মালিকরাও কিছু করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ বাতিল করতে থাকেন। শিপমেন্ট বন্ধ হতে থাকে। এরইমধ্যে সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। তারাও নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যায়। ২৩ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি থাকবে। প্রথম পর্যায়ে সেই ছুটি ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে দফায় দফায় তা বাড়ানো হয়। অন্যদিকে ২৪ মার্চের আরেক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৫ মার্চ রাত থেকে সারা দেশে দূরপাল্লার সড়ক, রেল ও নৌ চলাচল বন্ধ থাকবে। কিন্তু পোশাক কারখানার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় মালিকরা তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করতে পারছিলেন না। আবার তাদের দুই সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছিল না। এদিকে আতঙ্কিত শ্রমিকদের উপস্থিতিও ক্রমেই কমতে থাকে। অনেকেই বিভিন্ন উপায়ে গ্রামে চলে যায়। শেষমেশ ২৯ মার্চ বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যম জানায়, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। সরকার সাধারণ ছুটি ৪ এপ্রিল থেকে বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল করে। তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। কারখানা মালিকরাও শ্রমিকদের কিছু জানাননি। বিভ্রান্ত শ্রমিকরা চাকরি রক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কারখানামুখী হয়। পরিবহন বন্ধ থাকায় যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই কর্মস্থলের দিকে ছুটেছে। অনেকে সে সময় পায়ে হেঁটেও কর্মস্থলে উপস্থিত হয়েছিল। অসহায় লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মস্থলমুখী যাতায়াতে মহাসড়কে ঢল নামে। এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক এ সময়ে ব্যাপক সমালোচিত হন। শেষ পর্যন্ত বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ায়।
বিষয়টি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘ওই সময়টা আমাদের জন্য ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে কী করব। যদিও সংগঠনের পক্ষ থেকে সব কারখানা মালিকদের বলে দেওয়া হয়েছিল কোনো শ্রমিককেই যেন জোর করে ঢাকামুখী করা না হয়। কিন্তু দেখা গেল শ্রমিকরা ঠিকই ঢাকায় চলে এলো। তারা হয়তো ভাবছিল, চাকরি চলে গেলে কীভাবে জীবন চালাবে। যাই হোক, আল্লাহর রহমতে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছি।’
২৫ এপ্রিল থেকে কারখানাগুলো আবার চালুর সিদ্ধান্ত নেয় মালিকরা। সে সময় কয়েকটি কারখানা খুলতে পেরেছিল। যদিও সাধারণ ছুটি চলাকালেও পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ও মাস্ক উৎপাদনকারী কারখানাগুলো খোলা ছিল। ১ মে থেকে প্রায় সবগুলো কারখানা সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া হয়। প্রথম কয়েকদিন সীমিত পরিসরে খুললেও পরে কেবল স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিই গুরুত্ব পায়।
বিজিএমইএর সহসভাপতি আসিফ ইব্রাহীম বলেন, আমরা যখন কারখানা খোলার পরিকল্পনা করালাম তখন বড় একটি অংশ এর বিরোধিতা করল। তারা বলতে থাকল এর মাধ্যমে দেশে করোনা আরও ভয়বহ রূপ নেবে। কিন্তু আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল আমরা শৃঙ্খলার সঙ্গে কারখানা চালাতে পারব। আমরা করোনা পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর স্থাপন করলাম। হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করলাম। শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করলাম। নিয়মিত কারখানাগুলোকে নজরদারিতেও রেখেছি। কেউ আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যারা ছিল তাদের পৃথক করে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছি। নিয়মিত তাদের খোঁজখবর ও চিকিৎসা ব্যয় বহন করেছি। শ্রমিকরাও শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করল। আর এর ফলাফল তো আপনারা দেখতেই পারছেন। এখনো আমাদের শ্রমিকরা সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করে। তাই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি।’
শহিদুল হক বলেন, ‘কারখানা খোলার কয়েকদিন পরেই দেখা গেল প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমিক কারখানায় এসে উপস্থিত হচ্ছে। তখন আমরা লাইনগুলোকে (সুইং মেশিনের সারি) নতুন করে সাজালাম। একটি মেশিন থেকে আরেকটি মেশিনের মধ্যে কমপক্ষে দুই ফুট দূরত্ব রাখলাম। এতে যেটা হলো, শ্রমিক টু শ্রমিকের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৪ ফিট দাঁড়াল। আর মাস্ক, হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম জারি করলাম। দেখা গেল এতে কাজ হচ্ছে। একটা বিষয় লক্ষ করবেন, আল্লাহর রহমতে করোনায় সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়েছে পোশাক কারখানায় কর্মরতরা। আর মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজন। এর কারণ, আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে সচেতন ছিলাম।’
জুন থেকে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সীমিত আকারে লকডাউন প্রত্যাহার শুরু হয়। এতে ক্রেতারাও ফিরতে শুরু করেন। কিছু ক্রেতা ডিসকাউন্ট দিয়ে স্থগিত করা পণ্য কিনে নেন। অনেকে আবার পুরো দাম দেন। এছাড়া ক্রেতারা নতুন ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেন। জুলাই থেকেই রপ্তানি পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সক্ষমতার চেয়ে কম হলেও প্রায় সব কারখানাই কাজ পায়। স্বাভাবিক হতে থাকে দেশের রপ্তানি খাত। তবে মার্চ-জুনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এদের অনেকেই আবার নতুন করে শুরু কার্যক্রম শুরু করেছেন। অনেকে চেষ্টায় আছেন। তবে বেশ কয়েকটি কারখানা আর কখনো উৎপাদনে নাও যেতে পারে।
করোনাকালের ক্রেতাদের দ্বৈতনীতি ও তিক্ত অভিজ্ঞতায় বিজিএমইএ একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করার উদ্যোগ নেয়। ওই প্ল্যাটফর্মটি এমন হবে যেখানে উৎপাদকরা তাদের পণ্য ডিসপ্লে করবে। ক্রেতারা সেখান থেকে নিজেদের মতো করে পণ্য পছন্দ করে নিতে পারবেন। অনেকটা ই-কমার্সের মতোই এই প্ল্যাটফর্ম। এখানে কেবল বাংলাদেশি উৎপাদকরাই পণ্য ডিসপ্লে করতে পারবেন। বিজিএমইএ মনে করছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এতে আগের চেয়ে ঝুঁকিও অনেকটা কমবে। মনিরুল আলম শুভর কাছে এই প্ল্যাটফর্মের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা এটি নিয়ে এখনো পরিকল্পনার মধ্যেই আছি। সরকারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আশা করছি এটি বাস্তবায়ন হলে পোশাক রপ্তানিতে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হবে।’
কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার মধ্যে সব খারাপের মধ্যেও ভালো খবর ৩টি। প্রথমত, সবগুলো রপ্তানিমুখী কারখানাই শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন দিয়েছে এবং দিচ্ছে। সব কারখানায়ই এখন কাজ আছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে পোশাক খাতের সূচক সবচেয়ে ভালো। এর প্রথম দুটি কারণ হলো সরকার ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেন। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো ২ শতাংশ সুদে শ্রমিকের এপ্রিল-জুন মাসের বেতন পরিশোধের জন্য এই টাকা ঋণ পাবে। শ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে এই টাকা পরিশোধ হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কারখানাগুলো শ্রমিকের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকে হিসাব খুলে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই টাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেয়। তারা কারখানা মালিকদের দেওয়া বেতন নথির ওপর ভিত্তি করে শ্রমিকের ব্যাংক/মোবাইল ব্যাংক হিসাবে প্রেরণ করে। দ্বিতীয় মাসেই ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকা ফুরিয়ে গেলে সরকার আরও টাকা দেয়। এছাড়া বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর বিশেষ আবেদনের ভিত্তিতে জুলাইয়ের বেতনের জন্য সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে প্রণোদনা দেওয়া হয়।
২৭ এপ্রিল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব উত্তরণে নতুন করে ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। প্যাকেজ-১ এ ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা ঘোষণা করা হয়। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেওয়া। ৯ শতাংশ সুদের এই ঋণের ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। প্যাকেজ-২ এ ক্ষুদ্র (কুটিরশিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল-সুবিধা প্রদান: ব্যাংক-ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এ ঋণসুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। মূলত এই দুটি প্যাকেজ ও শ্রমিকের বেতন পরিশোধের জন্য দেওয়া প্যাকেজের অধিকাংশই পোশাক খাতের মালিকরা পেয়েছেন। এছাড়া কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, তাদের মোটামুটি সবারই কমবেশি কাজ আছে।
শহিদুল হক বলেন, ‘নিট-ওভেনে কাজ থাকলেও সোয়েটারে খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। অন্যান্য বছর জানুয়ারিতেই শীতকালীন কাজ শুরু হয়। কিন্তু এবার এখনো আসছে না। কিছু কিছু কারখানা পাচ্ছে। তবে সেগুলোর দামও কম। এটা একটা বড় চিন্তার বিষয়। সোয়েটার কারখানায় মূলত শীতকালীন সময়েই কাজ থাকে। বছরে ৪ মাস তেমন কাজ থাকে না। এখন যদি এই মৌসুমেও কাজ না পাই তাহলে বড় আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা সরকারকে বলছিলাম, আমাদের ঋণের কিস্তির গ্রেস পিরিয়ড যেন আরও ৬ মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। আমি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি শিল্পের স্বার্থে বাস্তবতার আলোকে আমাদের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বাড়িয়ে দিন। অন্যথায় অনেক কারখানারই টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’
শেয়ার করুন
আরিফুর রহমান তুহিন | ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

করোনার ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল দেশের তৈরি পোশাক খাত। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক আর রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের অংশীদার এই শিল্পের উৎপাদন মাসখানেক বন্ধ ছিল। স্থগিত/বাতিল হয়েছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ। ক্রয়াদেশ হারিয়ে কারখানা মালিকরা যখন চোখে সরষের ফুল দেখছিলেন তখন ত্রাতা হয়ে পাশে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। ২৭ এপ্রিল বড় শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন তিনি। জুনের শেষে ক্রেতারাও পণ্য নেওয়া শুরু করেন। প্রণোদনা ও ক্রেতাদের ফিরে আসায় আবার প্রাণ ফিরতে শুরু করে এই শিল্পে। যদিও এখনো সক্ষমতার থেকে কম এবং ৭-১০ শতাংশে পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে উৎপাদকদের। এই খাতের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, করোনাকালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনাই মূলত তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছিল। বিশেষ করে না চাইতেই শ্রমিকের বেতনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ২ শতাংশ সুদের বিশেষ ঋণ টনিক হিসেবে কাজ করেছে।
পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির পরিচালক ও ফতুল্লা অ্যাপারেলসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা করতে পারছি এর মূলে রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা। আমরা যদি সময়মতো শ্রমিকের বেতন দিতে না পারতাম তাহলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। দেশজুড়ে একটা অশান্তি সৃষ্টি হতো। করোনাকালে সবাই ধারণা করছিল লাখ লাখ শ্রমিক ছাঁটাই হবে। অথচ দেখা গেল এক লাখ শ্রমিকও ছাঁটাই হয়নি। আর এখন তো খুব কমসংখ্যক শ্রমিক আছে যাদের চাকরি নেই। আর ওই সময়ে যে অবস্থা ছিল তাতে প্রণোদনা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আমরা না চাইতেই তিনি শ্রমিকের বেতনের ব্যবস্থা করে দিলেন। এতে যেটা হলো, শ্রমিকরা করোনাকালেও বেতন পেয়ে খুবই উৎফুল্ল ছিল। তারাও টিকে থাকার সংগ্রামে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমরা উৎপাদনে ফিরে গেলাম। এই যে পদক্ষেপটা তিনি নিলেন এজন্য আমরা কারখানা মালিকরা ওনার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
করোনাকালে পোশাক খাত পরিচালনার অভিজ্ঞতা জানতে দেশ রূপান্তর কথা বলেছিল নিপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খসরু চৌধুরীর সঙ্গে। রাজধানীর দক্ষিণখানে অবস্থিত রপ্তানিমুখী এই প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন পর্যায়ে কোম্পানিটিতে প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক কাজ করে। বছর তিনেক আগে কোম্পানিটি কেসি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নামে আরেকটি শাখা স্থাপন করেছিল। এতে তাকে প্রায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তাই অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা টানাটানির মধ্যে ছিল নিপা গ্রুপ। এর মধ্যেই বিশ্বব্যাপী করোনা আঘাত হানে। অন্য কোম্পানিগুলোর মতো নিপা গ্রুপও সংকটের কিনারায় পৌঁছায়। কারখানা বন্ধ, ক্রেতারা পণ্য নিচ্ছে না, রপ্তানিকৃত পণ্যের টাকাও আসছে না। কোটি কোটি টাকার শ্রমিকের বেতন কীভাবে দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না খসরু চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যেই ২৫ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, ২ শতাংশ সুদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। কিছুটা স্বস্তি পেলাম। টানা ৩ মাস ২ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে শ্রমিকের বেতন দিলাম। চতুর্থ মাসেও সরকারের দেওয়া সাড়ে ৪ শতাংশ সুদের ঋণে বেতন পরিশোধ করলাম। এর মধ্যে ক্রেতারাও পণ্য নিতে শুরু করল। নতুন ক্রয়াদেশ এলো। বকেয়া টাকাও পেতে শুরু করলাম। বর্তমানে আগের চেয়ে ৩-৪ শতাংশ কম রপ্তানি করছি। দামও পাচ্ছি ৭-১০ শতাংশ কম। কিন্তু শ্রমিকের বেতন দিতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। কারণ, চার মাসের জমে থাকা পণ্যের টাকা একত্রে পেয়েছি। অধিকাংশেরই একই অবস্থা বলে আমার মনে হয়। আর শ্রমিকের বেতন সময়মতো দিতে পারা মানে মাথার ওপর থেকে ৯০ শতাংশ চাপ কমে যাওয়া। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমার অবস্থা মন্দের ভালো। ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর করোনা কেটে গেলে অবস্থা আরও ভালো হবে। তবে সরকার যদি প্রণোদনার ঋণের টাকাটা আরও ৬ মাস পর নিতে শুরু করে তাহলে চাপটা কম হতো। আমরা তো এই টাকাটা ফেরত দেব।’
করোনার কারণে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে বড় ধস নামে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতে ওই অর্থবছরে মোট রপ্তানি হয়েছিল ২৭ দশমিক ৯৪৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে ৩৪ দশমিক ১৩৩ বিলিয়ন ডলারের। বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়া ও বিভিন্ন কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পেরে উঠতে না পারায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরু থেকেই এই খাতের রপ্তানি কমতে থাকে। ওই অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে যায়। আর জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি কমে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
রূপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত ৫ বছরের বিশ্ববাজার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নিয়মিতভাবে বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষের চাহিদা এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে। কম মূল্যে আমরা বানাতে পারি বলে এখনো অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পোশাক রপ্তানিতে যে ধস নেমেছিল সেটাও মূলত বৈশ্বিক চাহিদা কমার কারণে। এর কিছুদিন আগেই শ্রমিকদের নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা হলো। তাদের বেতন বাড়ল অথচ পোশাকের চাহিদা ও দাম দুটোই কমল। আমরা প্রবল চাপের মধ্যে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছিলাম।’
ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমে যাওয়ায় কারখানা মালিকরা যখন প্রবল চাপের মধ্যে ছিলেন ঠিক তখনই করোনা হানা দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এ ভাইরাস যে এতটা ভয়াবহ হবে তা শুরুতে কোনো ব্যবসায়ী আঁচ করতে পারেননি। তাদের ধারণা ছিল, ইবোলার মতো হয়তো এটিও চীন বা তার আশপাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। দিন যত যায়, পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। করোনার বিস্তার পৃথিবীব্যাপী ঘটে যায়। বাড়তে থাকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান। এক পর্যায়ে জ্যামিতিক হারে এর বিস্তার ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতি সামাল দিতে লকডাউনে চলার ঘোষণা করতে থাকে। ১১ মার্চ, ২০১৯ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এটিকে মহামারী হিসেবে আখ্যা দেয়। একইসঙ্গে ক্রেতাদের আসল চরিত্রও বেরিয়ে আসে। ক্রেতারা কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একের পর এক ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল করতে থাকে। শিপমেন্টগুলো পিছিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে পণ্য নেওয়া বন্ধই করে দেয়।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে পণ্য খাতে রপ্তানি আয় আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ, ৮২ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও ৬১ দশমিক ৮৭ শতাংশ কমেছে। আর পোশাক খাতে মার্চে আয় কমে যায় ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ, এপ্রিলে ৮৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, মে মাসে ৬২ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং জুনে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক খাতে মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ দশমকি ৯৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ১৩৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি কমে ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
আশুলিয়ার জিরাবোর ফ্যাশন ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর মিডিয়া স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান খান মনিরুল আলম শুভ বলেন, ‘এটা ছিল এক প্রকার অবিশ্বাস্য কিন্তু চরম সত্য। ক্রেতারা এতদিন আমাদের নিয়মনীতির কথা শুনিয়ে আসছিল। সামান্য অজুহাত দেখিয়ে তারা আমাদের সব সময় চাপে রাখত। অথচ তারাই কিনা কোনো নিয়মের বালাই মানল না। পণ্য নেওয়া, রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা বন্ধ করে দিল। আমাদের মতো ছোট কারখানা মালিকদের জন্য এটা ছিল একটা টর্নেডোর মতো। মনে হচ্ছিল একটি ঝড় সব দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেল। আমরা কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ক্রেতাদের সঙ্গে বিজিএমইএ ও আমরা আলাদাভাবে যোগাযোগ করতে থাকলাম। অবশ্য অনেক ক্রেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা পরে পণ্য নেবেন। কথা রেখেছেনও। কিন্তু অনেকে আবার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট চেয়ে বসলেন। কেউ কেউ তো পণ্য নেয়ইনি। সত্যি এটা ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মতো।’
দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটে। দেশজুড়ে একটা আতঙ্ক বিরাজ করে। অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যান। শ্রমিকরা ভয়ে নিয়মিত কাজে আসছিল না। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কারখানা বন্ধ ঘোষণার একটা চাপ ছিল। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় মালিকরাও কিছু করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ বাতিল করতে থাকেন। শিপমেন্ট বন্ধ হতে থাকে। এরইমধ্যে সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। তারাও নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যায়। ২৩ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি থাকবে। প্রথম পর্যায়ে সেই ছুটি ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে দফায় দফায় তা বাড়ানো হয়। অন্যদিকে ২৪ মার্চের আরেক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৫ মার্চ রাত থেকে সারা দেশে দূরপাল্লার সড়ক, রেল ও নৌ চলাচল বন্ধ থাকবে। কিন্তু পোশাক কারখানার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় মালিকরা তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করতে পারছিলেন না। আবার তাদের দুই সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছিল না। এদিকে আতঙ্কিত শ্রমিকদের উপস্থিতিও ক্রমেই কমতে থাকে। অনেকেই বিভিন্ন উপায়ে গ্রামে চলে যায়। শেষমেশ ২৯ মার্চ বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যম জানায়, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। সরকার সাধারণ ছুটি ৪ এপ্রিল থেকে বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল করে। তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। কারখানা মালিকরাও শ্রমিকদের কিছু জানাননি। বিভ্রান্ত শ্রমিকরা চাকরি রক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কারখানামুখী হয়। পরিবহন বন্ধ থাকায় যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই কর্মস্থলের দিকে ছুটেছে। অনেকে সে সময় পায়ে হেঁটেও কর্মস্থলে উপস্থিত হয়েছিল। অসহায় লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মস্থলমুখী যাতায়াতে মহাসড়কে ঢল নামে। এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক এ সময়ে ব্যাপক সমালোচিত হন। শেষ পর্যন্ত বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ায়।
বিষয়টি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘ওই সময়টা আমাদের জন্য ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে কী করব। যদিও সংগঠনের পক্ষ থেকে সব কারখানা মালিকদের বলে দেওয়া হয়েছিল কোনো শ্রমিককেই যেন জোর করে ঢাকামুখী করা না হয়। কিন্তু দেখা গেল শ্রমিকরা ঠিকই ঢাকায় চলে এলো। তারা হয়তো ভাবছিল, চাকরি চলে গেলে কীভাবে জীবন চালাবে। যাই হোক, আল্লাহর রহমতে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছি।’
২৫ এপ্রিল থেকে কারখানাগুলো আবার চালুর সিদ্ধান্ত নেয় মালিকরা। সে সময় কয়েকটি কারখানা খুলতে পেরেছিল। যদিও সাধারণ ছুটি চলাকালেও পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ও মাস্ক উৎপাদনকারী কারখানাগুলো খোলা ছিল। ১ মে থেকে প্রায় সবগুলো কারখানা সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া হয়। প্রথম কয়েকদিন সীমিত পরিসরে খুললেও পরে কেবল স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিই গুরুত্ব পায়।
বিজিএমইএর সহসভাপতি আসিফ ইব্রাহীম বলেন, আমরা যখন কারখানা খোলার পরিকল্পনা করালাম তখন বড় একটি অংশ এর বিরোধিতা করল। তারা বলতে থাকল এর মাধ্যমে দেশে করোনা আরও ভয়বহ রূপ নেবে। কিন্তু আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল আমরা শৃঙ্খলার সঙ্গে কারখানা চালাতে পারব। আমরা করোনা পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর স্থাপন করলাম। হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করলাম। শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করলাম। নিয়মিত কারখানাগুলোকে নজরদারিতেও রেখেছি। কেউ আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যারা ছিল তাদের পৃথক করে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছি। নিয়মিত তাদের খোঁজখবর ও চিকিৎসা ব্যয় বহন করেছি। শ্রমিকরাও শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করল। আর এর ফলাফল তো আপনারা দেখতেই পারছেন। এখনো আমাদের শ্রমিকরা সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করে। তাই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি।’
শহিদুল হক বলেন, ‘কারখানা খোলার কয়েকদিন পরেই দেখা গেল প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমিক কারখানায় এসে উপস্থিত হচ্ছে। তখন আমরা লাইনগুলোকে (সুইং মেশিনের সারি) নতুন করে সাজালাম। একটি মেশিন থেকে আরেকটি মেশিনের মধ্যে কমপক্ষে দুই ফুট দূরত্ব রাখলাম। এতে যেটা হলো, শ্রমিক টু শ্রমিকের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৪ ফিট দাঁড়াল। আর মাস্ক, হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম জারি করলাম। দেখা গেল এতে কাজ হচ্ছে। একটা বিষয় লক্ষ করবেন, আল্লাহর রহমতে করোনায় সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়েছে পোশাক কারখানায় কর্মরতরা। আর মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজন। এর কারণ, আমরা সবাই স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে সচেতন ছিলাম।’
জুন থেকে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সীমিত আকারে লকডাউন প্রত্যাহার শুরু হয়। এতে ক্রেতারাও ফিরতে শুরু করেন। কিছু ক্রেতা ডিসকাউন্ট দিয়ে স্থগিত করা পণ্য কিনে নেন। অনেকে আবার পুরো দাম দেন। এছাড়া ক্রেতারা নতুন ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেন। জুলাই থেকেই রপ্তানি পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সক্ষমতার চেয়ে কম হলেও প্রায় সব কারখানাই কাজ পায়। স্বাভাবিক হতে থাকে দেশের রপ্তানি খাত। তবে মার্চ-জুনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এদের অনেকেই আবার নতুন করে শুরু কার্যক্রম শুরু করেছেন। অনেকে চেষ্টায় আছেন। তবে বেশ কয়েকটি কারখানা আর কখনো উৎপাদনে নাও যেতে পারে।
করোনাকালের ক্রেতাদের দ্বৈতনীতি ও তিক্ত অভিজ্ঞতায় বিজিএমইএ একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করার উদ্যোগ নেয়। ওই প্ল্যাটফর্মটি এমন হবে যেখানে উৎপাদকরা তাদের পণ্য ডিসপ্লে করবে। ক্রেতারা সেখান থেকে নিজেদের মতো করে পণ্য পছন্দ করে নিতে পারবেন। অনেকটা ই-কমার্সের মতোই এই প্ল্যাটফর্ম। এখানে কেবল বাংলাদেশি উৎপাদকরাই পণ্য ডিসপ্লে করতে পারবেন। বিজিএমইএ মনে করছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এতে আগের চেয়ে ঝুঁকিও অনেকটা কমবে। মনিরুল আলম শুভর কাছে এই প্ল্যাটফর্মের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা এটি নিয়ে এখনো পরিকল্পনার মধ্যেই আছি। সরকারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে। আশা করছি এটি বাস্তবায়ন হলে পোশাক রপ্তানিতে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হবে।’
কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার মধ্যে সব খারাপের মধ্যেও ভালো খবর ৩টি। প্রথমত, সবগুলো রপ্তানিমুখী কারখানাই শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন দিয়েছে এবং দিচ্ছে। সব কারখানায়ই এখন কাজ আছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে পোশাক খাতের সূচক সবচেয়ে ভালো। এর প্রথম দুটি কারণ হলো সরকার ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেন। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো ২ শতাংশ সুদে শ্রমিকের এপ্রিল-জুন মাসের বেতন পরিশোধের জন্য এই টাকা ঋণ পাবে। শ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে এই টাকা পরিশোধ হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কারখানাগুলো শ্রমিকের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকে হিসাব খুলে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই টাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেয়। তারা কারখানা মালিকদের দেওয়া বেতন নথির ওপর ভিত্তি করে শ্রমিকের ব্যাংক/মোবাইল ব্যাংক হিসাবে প্রেরণ করে। দ্বিতীয় মাসেই ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকা ফুরিয়ে গেলে সরকার আরও টাকা দেয়। এছাড়া বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর বিশেষ আবেদনের ভিত্তিতে জুলাইয়ের বেতনের জন্য সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে প্রণোদনা দেওয়া হয়।
২৭ এপ্রিল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব উত্তরণে নতুন করে ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। প্যাকেজ-১ এ ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা ঘোষণা করা হয়। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেওয়া। ৯ শতাংশ সুদের এই ঋণের ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। প্যাকেজ-২ এ ক্ষুদ্র (কুটিরশিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল-সুবিধা প্রদান: ব্যাংক-ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এ ঋণসুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। মূলত এই দুটি প্যাকেজ ও শ্রমিকের বেতন পরিশোধের জন্য দেওয়া প্যাকেজের অধিকাংশই পোশাক খাতের মালিকরা পেয়েছেন। এছাড়া কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, তাদের মোটামুটি সবারই কমবেশি কাজ আছে।
শহিদুল হক বলেন, ‘নিট-ওভেনে কাজ থাকলেও সোয়েটারে খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। অন্যান্য বছর জানুয়ারিতেই শীতকালীন কাজ শুরু হয়। কিন্তু এবার এখনো আসছে না। কিছু কিছু কারখানা পাচ্ছে। তবে সেগুলোর দামও কম। এটা একটা বড় চিন্তার বিষয়। সোয়েটার কারখানায় মূলত শীতকালীন সময়েই কাজ থাকে। বছরে ৪ মাস তেমন কাজ থাকে না। এখন যদি এই মৌসুমেও কাজ না পাই তাহলে বড় আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা সরকারকে বলছিলাম, আমাদের ঋণের কিস্তির গ্রেস পিরিয়ড যেন আরও ৬ মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। আমি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি শিল্পের স্বার্থে বাস্তবতার আলোকে আমাদের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বাড়িয়ে দিন। অন্যথায় অনেক কারখানারই টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’