এই যুদ্ধে দুর্গের ভূমিকা পালন করছে দেশের হাসপাতালগুলো
ডা. লেলিন চৌধুরী | ২৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
করোনার সময় দেশে প্রচুর ডাক্তার করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট ১২৯ জন ডাক্তার (২১ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) মারা গেছেন। করোনার মতো উপসর্গে আরও অনেক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা কয়েক হাজার। নার্সসহ অন্য কর্মীদের ক্ষেত্রে একই ধরনের চিত্র। সব মিলিয়ে করোনাকালে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীদের ওপর প্রবল একটি মানসিক চাপ তৈরি হয়। এর ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কেউ কেউ মানসিক অসুখের শিকার হয়। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগের করা এক জরিপে দেখা যায়, এখনো দেশের ২১ শতাংশ চিকিৎসক মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। অন্যদের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মরতরা এই শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন।
১৯১৮ সালে শুরু হয় স্প্যানিশ ফ্লু, শেষ হয় ১৯২০ সালে। এই ফ্লুতে প্রাণ হারায় ৫ কোটির বেশি মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি, অর্থাৎ তৎকালীন পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ জনগোষ্ঠী। স্প্যানিশ ফ্লুর এক শ বছর পরে করোনা মহামারীর আবির্ভাব। বিশ্বের ২১৮টির মতো দেশ এবং অঞ্চল এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। সারা বিশ্ব এখন করোনা মহামারী বা অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইরত। করোনার ভয়ংকর ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশ। তাই করোনাবিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশ শামিল হয়েছে। এই যুদ্ধে ইতিমধ্যে সাড়ে ১০ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে আমাদের চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তাদের লড়াই এখনো অবিরত। এই যুদ্ধে দুর্গের ভূমিকা পালন করেছে দেশের হাসপাতালগুলো। এখন সময় এসেছে হাসপাতালগুলোর এই ভূমিকার একটি প্রাথমিক ও সরলরৈখিক বিশ্লেষণ করার।
চিকিৎসকদের সামনে কভিড-১৯ যে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আসে, সেগুলো হচ্ছে : ১. এটি একটি নতুন রোগ যার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। ফলে প্রতিরোধের সঠিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল ছিল না। ২. এই রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই চিকিৎসার প্রক্রিয়া নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে বহু মত রয়েছে। সংকটাপন্ন সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাই অত্যন্ত কঠিন। ৩. খুব দ্রুত হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এদের একটি অংশকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। এতে খুব দ্রুতই হাসপাতালে শয্যাসংকট দেখা দেয়। ৪. বিপুলসংখ্যক রোগীর জন্য নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে আইসিইউ বেডের সংকট তৈরি হয়। ৫. হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব দেখা দেয়। ৬. ডাক্তারসহ প্রচুরসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় সংক্রমিত হন। ফলে হাসপাতালগুলোতে সেবাদানকারীর স্বল্পতা তৈরি হয়। নিজের এবং পরিবারের সুস্থতা নিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়। ৭. সর্বোপরি মানুষজন ছিল আতঙ্কগ্রস্ত। ফলে হাসপাতালের ওপর প্রবল চাপ তৈরি হয়। মূলত এমনটাই ছিল বৈশ্বিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশের চিকিৎসা পরিস্থিতি কমবেশি বৈশ্বিক চিত্রের অনুরূপ।
করোনার প্রথম ধাক্কায় আমাদের হাসপাতালগুলোতে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়; বিশেষ করে করোনা উপসর্গের রোগী এবং করোনা টেস্ট পজিটিভ রোগীর ভর্তির বিষয়ে কোনো গাইডলাইন প্রস্তুত ছিল না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব ছিল প্রকট। এ রকম অবস্থায় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধা ও ধীরভাব পরিলক্ষিত হয়। সে সময় কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়; কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে এ রকম অবস্থা থেকে উত্তরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় কিছু সরকারি হাসপাতালকে আলাদাভাবে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য নিবেদিত করা হয়। অনেকগুলো হাসপাতালে আলাদা করোনা ইউনিট গঠন করা হয়। ক্রমবর্ধমান রোগীর সংখ্যা সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পঞ্চাশোর্ধ্ব শয্যার বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনা ওয়ার্ড খোলার নির্দেশ প্রদান করে। ইতিমধ্যে করোনা চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় গাইডলাইন প্রণীত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বিভিন্ন সোসাইটি নিজ নিজ ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রটোকল তৈরি করে নেয়; বিশেষ করে মেডিসিন, সার্জারি, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা, শিশুরোগের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা তাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিয়ে অগ্রসর ভূমিকা পালন করে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাত দৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। হাসপাতালগুলো, বিশেষ করে করোনা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত হাসপাতালগুলো সংগঠিতভাবে যুদ্ধ শুরু করে।
হাসপাতালের দুটো অংশ। একটি হলো বিল্ডিং ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। অন্যটি হচ্ছে দক্ষ জনবল। হঠাৎ ধেয়ে আসা করোনার তাণ্ডব মোকাবিলায় দরকারি যন্ত্রপাতি ও উপকরণের অতিরিক্ত জোগান পাওয়া প্রথম দিকে সম্ভব ছিল না। অবশ্য পরে সে জোগান কিছুটা বাড়ে। এ রকম একটি অবস্থায় ডাক্তার, নার্সসহ সব চিকিৎসাকর্মীরা সেবার কাজটি সচল রাখেন। এ সময়ে যা আছে তা-ই নিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার দৃঢ়তা নিয়ে তাদের অগ্রসর হতে হয়। করোনা নিবেদিত হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্সসহ সবার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার দুটো জায়গা ছিল। একটি হলো নিজের সুস্থ ও করোনামুক্ত থাকা। অন্যটি পরিবারের সদস্যদের সুস্থতা। এ অবস্থায় করোনা নিবেদিত হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্সদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অন্যান্য হাসপাতাল যাদের করোনা ইউনিট রয়েছে, সেখানকার ডাক্তার, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য এ ধরনের অসহনীয় অবস্থা তৈরি হয়। অনেক বাড়িওয়ালা এদের বাড়িভাড়া চলমান রাখতে অস্বীকার করেন। ঢাকার পান্থপথের একটি হাসপাতালের একজন ওয়ার্ডবয় রাতের ডিউটি শেষ করে সকালে বাসায় ফিরে ঘরে প্রবেশ করতে পারেননি। বাড়িওয়ালা তাকে জানিয়ে দেন, করোনা হাসপাতালে ডিউটি করায় তাকে ভাড়াটে হিসেবে রাখা হবে না। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে দুজন চিকিৎসকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে। সারা দেশে এজাতীয় ঘটনার সংখ্যা অনেক।
করোনার আতঙ্কে সারা দেশ একসময় আতঙ্কিত ছিল। তখন করোনাকে নিয়ে সামাজিক কলঙ্কায়ন বা স্টিগমা প্রবল। স্বামী সিঁড়িতে মরে পড়ে আছে, স্ত্রী তার কাছে যাচ্ছে না। মাকে ফেলে সন্তান পালিয়েছে। পিতার লাশের অন্তিম সৎকারে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে না। সারা দেশে এ রকম প্রচুর ঘটনা ঘটতে থাকে। এ অবস্থায় করোনা হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারসহ সবাইকে তাদের আত্মীয়স্বজনরা এড়িয়ে চলতে থাকে। অনেকে ছোট শিশুকে রেখে হাসপাতালে এসেছে। সেখানে একনাগাড়ে তিন দিন ডিউটি করেছেন। চিকিৎসক বা নার্স মায়ের জন্য শিশুসন্তানের আকুতি সত্যি কষ্টকর। ঘরে ফেরার পরেও তিনি সন্তানকে কাছে টেনে নিতে পারেননি। অনেকে বাসায় বৃদ্ধ মা-বাবাকে রেখে হাসপাতালে ডিউটি করেছেন। ডিউটি শেষে বাসায় এসে বাসার সবচেয়ে দূরের ঘরে ঘুমাতে হয়েছে। দিনের পর দিন খাবার পানি ইত্যাদি ঘরের সামনে রেখে দেওয়া হতো।
করোনার সময় দেশে প্রচুর ডাক্তার করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট ১২৯ জন ডাক্তার (২১ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) মারা গেছেন। করোনার মতো উপসর্গে আরও অনেক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা কয়েক হাজার। নার্সসহ অন্য কর্মীদের ক্ষেত্রে একই ধরনের চিত্র। সব মিলিয়ে করোনাকালে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীদের ওপর প্রবল একটি মানসিক চাপ তৈরি হয়। এর ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কেউ কেউ মানসিক অসুখের শিকার হয়। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগের করা এক জরিপে দেখা যায়, এখনো দেশের ২১ শতাংশ চিকিৎসক মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। অন্যদের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মরতরা এই শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন।
করোনা নিবেদিত হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ সবার থাকাখাওয়া নিয়ে দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব হাসপাতালের চিকিৎসকদের করোনাকালীন আবাসস্থল থেকে অবিবেচক সিদ্ধান্তে বের করে দেওয়া হয়েছে। করোনায় প্রয়াত চিকিৎসকদের পরিবারকে প্রদেয় অর্থ দু-একটি ক্ষেত্র ব্যতীত পরিশোধের কচ্ছপগতি এখনো বিদ্যমান। অন্য কর্মীদের অভিজ্ঞতা তথৈবচ। এসব কারণে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইরত সম্মুখযোদ্ধাদের মনোবল আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এত সবের পরও আমাদের হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসায় অনেক উন্নতমানের সেবা প্রদান করেছে। সীমিত উপকরণাদির সামর্থ্য নিয়ে সর্বোচ্চ অর্জনযোগ্য চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিরলসভাবে নিবেদিত থেকেছেন। করোনায় আমাদের দেশের মৃত্যুহার অনেক কম এবং সুস্থতার হার বেশি। এই অর্জনে করোনা নিবেদিত হাসপাতালগুলো অসামান্য অবদান রেখেছে। ডাক্তার, নার্সসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এটি সম্ভব হয়েছে। এরা আমাদের সত্যিকারের বীর। বীরদের জন্য অনিঃশেষ ভালোবাসা।
লেখক: প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশ, শিশু ও স্বাস্থ্য অধিকারকর্মী
ই-মেইল:[email protected]
শেয়ার করুন
ডা. লেলিন চৌধুরী | ২৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

১৯১৮ সালে শুরু হয় স্প্যানিশ ফ্লু, শেষ হয় ১৯২০ সালে। এই ফ্লুতে প্রাণ হারায় ৫ কোটির বেশি মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি, অর্থাৎ তৎকালীন পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ জনগোষ্ঠী। স্প্যানিশ ফ্লুর এক শ বছর পরে করোনা মহামারীর আবির্ভাব। বিশ্বের ২১৮টির মতো দেশ এবং অঞ্চল এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। সারা বিশ্ব এখন করোনা মহামারী বা অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইরত। করোনার ভয়ংকর ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশ। তাই করোনাবিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশ শামিল হয়েছে। এই যুদ্ধে ইতিমধ্যে সাড়ে ১০ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে আমাদের চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তাদের লড়াই এখনো অবিরত। এই যুদ্ধে দুর্গের ভূমিকা পালন করেছে দেশের হাসপাতালগুলো। এখন সময় এসেছে হাসপাতালগুলোর এই ভূমিকার একটি প্রাথমিক ও সরলরৈখিক বিশ্লেষণ করার। চিকিৎসকদের সামনে কভিড-১৯ যে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আসে, সেগুলো হচ্ছে : ১. এটি একটি নতুন রোগ যার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। ফলে প্রতিরোধের সঠিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল ছিল না। ২. এই রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই চিকিৎসার প্রক্রিয়া নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে বহু মত রয়েছে। সংকটাপন্ন সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাই অত্যন্ত কঠিন। ৩. খুব দ্রুত হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এদের একটি অংশকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। এতে খুব দ্রুতই হাসপাতালে শয্যাসংকট দেখা দেয়। ৪. বিপুলসংখ্যক রোগীর জন্য নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে আইসিইউ বেডের সংকট তৈরি হয়। ৫. হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব দেখা দেয়। ৬. ডাক্তারসহ প্রচুরসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় সংক্রমিত হন। ফলে হাসপাতালগুলোতে সেবাদানকারীর স্বল্পতা তৈরি হয়। নিজের এবং পরিবারের সুস্থতা নিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়। ৭. সর্বোপরি মানুষজন ছিল আতঙ্কগ্রস্ত। ফলে হাসপাতালের ওপর প্রবল চাপ তৈরি হয়। মূলত এমনটাই ছিল বৈশ্বিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশের চিকিৎসা পরিস্থিতি কমবেশি বৈশ্বিক চিত্রের অনুরূপ।
করোনার প্রথম ধাক্কায় আমাদের হাসপাতালগুলোতে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়; বিশেষ করে করোনা উপসর্গের রোগী এবং করোনা টেস্ট পজিটিভ রোগীর ভর্তির বিষয়ে কোনো গাইডলাইন প্রস্তুত ছিল না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব ছিল প্রকট। এ রকম অবস্থায় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধা ও ধীরভাব পরিলক্ষিত হয়। সে সময় কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়; কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে এ রকম অবস্থা থেকে উত্তরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় কিছু সরকারি হাসপাতালকে আলাদাভাবে করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য নিবেদিত করা হয়। অনেকগুলো হাসপাতালে আলাদা করোনা ইউনিট গঠন করা হয়। ক্রমবর্ধমান রোগীর সংখ্যা সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পঞ্চাশোর্ধ্ব শয্যার বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনা ওয়ার্ড খোলার নির্দেশ প্রদান করে। ইতিমধ্যে করোনা চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় গাইডলাইন প্রণীত হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বিভিন্ন সোসাইটি নিজ নিজ ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রটোকল তৈরি করে নেয়; বিশেষ করে মেডিসিন, সার্জারি, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা, শিশুরোগের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা তাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিয়ে অগ্রসর ভূমিকা পালন করে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাত দৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। হাসপাতালগুলো, বিশেষ করে করোনা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত হাসপাতালগুলো সংগঠিতভাবে যুদ্ধ শুরু করে।
হাসপাতালের দুটো অংশ। একটি হলো বিল্ডিং ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। অন্যটি হচ্ছে দক্ষ জনবল। হঠাৎ ধেয়ে আসা করোনার তাণ্ডব মোকাবিলায় দরকারি যন্ত্রপাতি ও উপকরণের অতিরিক্ত জোগান পাওয়া প্রথম দিকে সম্ভব ছিল না। অবশ্য পরে সে জোগান কিছুটা বাড়ে। এ রকম একটি অবস্থায় ডাক্তার, নার্সসহ সব চিকিৎসাকর্মীরা সেবার কাজটি সচল রাখেন। এ সময়ে যা আছে তা-ই নিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার দৃঢ়তা নিয়ে তাদের অগ্রসর হতে হয়। করোনা নিবেদিত হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্সসহ সবার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার দুটো জায়গা ছিল। একটি হলো নিজের সুস্থ ও করোনামুক্ত থাকা। অন্যটি পরিবারের সদস্যদের সুস্থতা। এ অবস্থায় করোনা নিবেদিত হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্সদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অন্যান্য হাসপাতাল যাদের করোনা ইউনিট রয়েছে, সেখানকার ডাক্তার, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য এ ধরনের অসহনীয় অবস্থা তৈরি হয়। অনেক বাড়িওয়ালা এদের বাড়িভাড়া চলমান রাখতে অস্বীকার করেন। ঢাকার পান্থপথের একটি হাসপাতালের একজন ওয়ার্ডবয় রাতের ডিউটি শেষ করে সকালে বাসায় ফিরে ঘরে প্রবেশ করতে পারেননি। বাড়িওয়ালা তাকে জানিয়ে দেন, করোনা হাসপাতালে ডিউটি করায় তাকে ভাড়াটে হিসেবে রাখা হবে না। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে দুজন চিকিৎসকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে। সারা দেশে এজাতীয় ঘটনার সংখ্যা অনেক।
করোনার আতঙ্কে সারা দেশ একসময় আতঙ্কিত ছিল। তখন করোনাকে নিয়ে সামাজিক কলঙ্কায়ন বা স্টিগমা প্রবল। স্বামী সিঁড়িতে মরে পড়ে আছে, স্ত্রী তার কাছে যাচ্ছে না। মাকে ফেলে সন্তান পালিয়েছে। পিতার লাশের অন্তিম সৎকারে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে না। সারা দেশে এ রকম প্রচুর ঘটনা ঘটতে থাকে। এ অবস্থায় করোনা হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারসহ সবাইকে তাদের আত্মীয়স্বজনরা এড়িয়ে চলতে থাকে। অনেকে ছোট শিশুকে রেখে হাসপাতালে এসেছে। সেখানে একনাগাড়ে তিন দিন ডিউটি করেছেন। চিকিৎসক বা নার্স মায়ের জন্য শিশুসন্তানের আকুতি সত্যি কষ্টকর। ঘরে ফেরার পরেও তিনি সন্তানকে কাছে টেনে নিতে পারেননি। অনেকে বাসায় বৃদ্ধ মা-বাবাকে রেখে হাসপাতালে ডিউটি করেছেন। ডিউটি শেষে বাসায় এসে বাসার সবচেয়ে দূরের ঘরে ঘুমাতে হয়েছে। দিনের পর দিন খাবার পানি ইত্যাদি ঘরের সামনে রেখে দেওয়া হতো।
করোনার সময় দেশে প্রচুর ডাক্তার করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট ১২৯ জন ডাক্তার (২১ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত) মারা গেছেন। করোনার মতো উপসর্গে আরও অনেক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা কয়েক হাজার। নার্সসহ অন্য কর্মীদের ক্ষেত্রে একই ধরনের চিত্র। সব মিলিয়ে করোনাকালে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীদের ওপর প্রবল একটি মানসিক চাপ তৈরি হয়। এর ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কেউ কেউ মানসিক অসুখের শিকার হয়। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক রোগ বিভাগের করা এক জরিপে দেখা যায়, এখনো দেশের ২১ শতাংশ চিকিৎসক মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। অন্যদের ক্ষেত্রে এ রকম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মরতরা এই শারীরিক ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন।
করোনা নিবেদিত হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ সবার থাকাখাওয়া নিয়ে দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব হাসপাতালের চিকিৎসকদের করোনাকালীন আবাসস্থল থেকে অবিবেচক সিদ্ধান্তে বের করে দেওয়া হয়েছে। করোনায় প্রয়াত চিকিৎসকদের পরিবারকে প্রদেয় অর্থ দু-একটি ক্ষেত্র ব্যতীত পরিশোধের কচ্ছপগতি এখনো বিদ্যমান। অন্য কর্মীদের অভিজ্ঞতা তথৈবচ। এসব কারণে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইরত সম্মুখযোদ্ধাদের মনোবল আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এত সবের পরও আমাদের হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসায় অনেক উন্নতমানের সেবা প্রদান করেছে। সীমিত উপকরণাদির সামর্থ্য নিয়ে সর্বোচ্চ অর্জনযোগ্য চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিরলসভাবে নিবেদিত থেকেছেন। করোনায় আমাদের দেশের মৃত্যুহার অনেক কম এবং সুস্থতার হার বেশি। এই অর্জনে করোনা নিবেদিত হাসপাতালগুলো অসামান্য অবদান রেখেছে। ডাক্তার, নার্সসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এটি সম্ভব হয়েছে। এরা আমাদের সত্যিকারের বীর। বীরদের জন্য অনিঃশেষ ভালোবাসা।
লেখক: প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশ, শিশু ও স্বাস্থ্য অধিকারকর্মী
ই-মেইল:[email protected]