হাওরে মাছ কম, মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন জেলেরা
মোস্তাফিজ আমিন, ভৈরব | ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
কিশোরগঞ্জের ভৈরব-কুলিয়ারচরের হাওর এলাকায় প্রাকৃতিক উৎসে মাছের পরিমাণ কমেছে। মিঠাপানির মাছের ভা-ার হিসেবে পরিচিত এখানকার নদী-নালার মাছ কমে যাওয়ায় জেলেদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তবে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ বলছে, মুক্ত জলাশয় অর্থাৎ নদী-নালায় মাছ কমে এলেও, বাড়ছে বদ্ধ জলাশয়ে মাছের আবাদ।
ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কালী, গোড়াউত্রাসহ অসংখ্য হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল আর পুকুরে ভরা কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চলসহ ভৈরব-কুলিয়ারচর এক সময় মাছের ভা-ার বলে পরিচিত ছিল। খেতে বেশ সুস্বাদু হওয়ায় এখানকার মাছের কদর ছিল দেশব্যাপী। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে এখানকার মাছের ভা-ার কমে যাচ্ছে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানায়, বর্তমানে আগের তুলনায় চার ভাগের একভাগ মাছও নেই নদী-নালা, খাল-বিলে। তাই তারা সারা দিন শিকার করেও এক-দেড়শ টাকার বেশি মাছ শিকার করতে পারেন না। ফলে এখানকার কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পরিবার নিয়ে কষ্টে আছেন।
ভৈরবের নয়াহাটি জেলেপল্লীর বিসা চন্দ্র বর্মণ (৭০), সুরেশ বর্মণ (৭০), তরণি বর্মণ (৬০) ও অরুণ চন্দ্র বর্মণ (৫০) এবং মহেশপুরের জালাল উদ্দিন (৭৫), সাদির মিয়া (৬৫), হরলাল দাস (৬০) ও অরিত্র লাল দাস (৬২) জানান, ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও এক ঘণ্টা জাল টানলে এক-দেড় মণ মাছ উঠত। এখন ২৪ ঘণ্টায়ও এর সিকি ভাগ মাছ ধরা যায় না।
কুলিয়ারচরের জেলে সুচিন্দ্র বর্মণ (৭৫), পীযূষ চন্দ্র দাস (৬২) ও নিতাই চন্দ্র দাস (৭২) জানান, নদ-নদীতে এমনিতেই আগের মতো মাছ নেই। তার ওপর প্রভাবশালী মহল মাঝনদীতে বাঁধ দিয়ে এবং পাটিজাল পেতে মাছ শিকার করে। তাই সাধারণ জেলেরা নির্বিঘেœ মাছ শিকার করতে পারে না।
জেলেদের জালে মাছ কম পড়ায় আড়তগুলোতেও মাছ উঠছে কম। ফলে মৎস্য ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই বলে জানালেন কুলিয়ারচর মৎস্য আড়তের মৎস্যজীবী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শহিদ মিয়া। তিনি বলেন, বহু প্রজাতির মাছ এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় মাছের সরবরাহ কমে গেছে।
আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ মাছও এখন এখানকার আড়তগুলোতে আমদানি হয় না জানিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ী ইয়াকুব মিয়া ও হাজি মুর্শিদ মিয়া জানান, তাদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছে। একেক জন ৪০/৪৫ বছর যাবৎ মাছের ব্যবসায় জড়িত থাকার কথা জানিয়ে তারা বলেন, মাছের এমন আকাল এই অঞ্চলে তাদের চোখে আর পড়েনি। দিন যতই যাচ্ছে, দেশীয় মাছের সংকট তীব্রতর হচ্ছে।
ভৈরবের জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল নদী-নালায় মাছ কমে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কতগুলো সুনির্দিষ্ট কারণকে দায়ী করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, কল-কারখানার বর্জ্য, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, মাছের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়া, সেচে মাছ ধরে ফেলা এবং ছোট ফাঁসের জালসহ নানা ধরনের অবৈধ জাল ব্যবহার করা। তবে পুকুর ও বদ্ধ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বাড়ছে।
কুলিয়ারচরের জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, এই অঞ্চলের জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পালনসহ তাদের খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য মৎস্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
এ ছাড়া মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা ছেড়ে মাছের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে এ বিভাগ।
শেয়ার করুন
মোস্তাফিজ আমিন, ভৈরব | ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

কিশোরগঞ্জের ভৈরব-কুলিয়ারচরের হাওর এলাকায় প্রাকৃতিক উৎসে মাছের পরিমাণ কমেছে। মিঠাপানির মাছের ভা-ার হিসেবে পরিচিত এখানকার নদী-নালার মাছ কমে যাওয়ায় জেলেদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তবে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ বলছে, মুক্ত জলাশয় অর্থাৎ নদী-নালায় মাছ কমে এলেও, বাড়ছে বদ্ধ জলাশয়ে মাছের আবাদ।
ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কালী, গোড়াউত্রাসহ অসংখ্য হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল আর পুকুরে ভরা কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চলসহ ভৈরব-কুলিয়ারচর এক সময় মাছের ভা-ার বলে পরিচিত ছিল। খেতে বেশ সুস্বাদু হওয়ায় এখানকার মাছের কদর ছিল দেশব্যাপী। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে এখানকার মাছের ভা-ার কমে যাচ্ছে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানায়, বর্তমানে আগের তুলনায় চার ভাগের একভাগ মাছও নেই নদী-নালা, খাল-বিলে। তাই তারা সারা দিন শিকার করেও এক-দেড়শ টাকার বেশি মাছ শিকার করতে পারেন না। ফলে এখানকার কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পরিবার নিয়ে কষ্টে আছেন।
ভৈরবের নয়াহাটি জেলেপল্লীর বিসা চন্দ্র বর্মণ (৭০), সুরেশ বর্মণ (৭০), তরণি বর্মণ (৬০) ও অরুণ চন্দ্র বর্মণ (৫০) এবং মহেশপুরের জালাল উদ্দিন (৭৫), সাদির মিয়া (৬৫), হরলাল দাস (৬০) ও অরিত্র লাল দাস (৬২) জানান, ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও এক ঘণ্টা জাল টানলে এক-দেড় মণ মাছ উঠত। এখন ২৪ ঘণ্টায়ও এর সিকি ভাগ মাছ ধরা যায় না।
কুলিয়ারচরের জেলে সুচিন্দ্র বর্মণ (৭৫), পীযূষ চন্দ্র দাস (৬২) ও নিতাই চন্দ্র দাস (৭২) জানান, নদ-নদীতে এমনিতেই আগের মতো মাছ নেই। তার ওপর প্রভাবশালী মহল মাঝনদীতে বাঁধ দিয়ে এবং পাটিজাল পেতে মাছ শিকার করে। তাই সাধারণ জেলেরা নির্বিঘেœ মাছ শিকার করতে পারে না।
জেলেদের জালে মাছ কম পড়ায় আড়তগুলোতেও মাছ উঠছে কম। ফলে মৎস্য ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই বলে জানালেন কুলিয়ারচর মৎস্য আড়তের মৎস্যজীবী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শহিদ মিয়া। তিনি বলেন, বহু প্রজাতির মাছ এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় মাছের সরবরাহ কমে গেছে।
আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ মাছও এখন এখানকার আড়তগুলোতে আমদানি হয় না জানিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ী ইয়াকুব মিয়া ও হাজি মুর্শিদ মিয়া জানান, তাদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছে। একেক জন ৪০/৪৫ বছর যাবৎ মাছের ব্যবসায় জড়িত থাকার কথা জানিয়ে তারা বলেন, মাছের এমন আকাল এই অঞ্চলে তাদের চোখে আর পড়েনি। দিন যতই যাচ্ছে, দেশীয় মাছের সংকট তীব্রতর হচ্ছে।
ভৈরবের জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল নদী-নালায় মাছ কমে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কতগুলো সুনির্দিষ্ট কারণকে দায়ী করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, কল-কারখানার বর্জ্য, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, মাছের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়া, সেচে মাছ ধরে ফেলা এবং ছোট ফাঁসের জালসহ নানা ধরনের অবৈধ জাল ব্যবহার করা। তবে পুকুর ও বদ্ধ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বাড়ছে।
কুলিয়ারচরের জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, এই অঞ্চলের জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পালনসহ তাদের খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য মৎস্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
এ ছাড়া মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা ছেড়ে মাছের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে এ বিভাগ।