খুলনায় চিংড়িতে অবাধে চলছে অপদ্রব্য পুশ
সুমন্ত চক্রবর্ত্তী, খুলনা | ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০
খুলনায় অবাধে চলছে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ। জেলা প্রশাসন, র্যাব, কোস্টগার্ড, মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অভিযানেও চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে বিদেশের বাজারে সুনাম হারাচ্ছে বাংলাদেশের সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ি।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে প্রথমে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ এলাকার ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীরা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা শুরু করেন। এরপর খুলনার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পুশের কার্যক্রম। ভারত থেকে আনা দুই ধরনের পাউডার মিশিয়ে জেলি তৈরি করা হয়। এসব জেলি বাগদা ও গলদা চিংড়ির দেহে পুশ করা হয় সিরিঞ্জ দিয়ে। নগরীর বিভিন্ন ওষুধের দোকান থেকে একটি চক্র আগার ও সিএম পাউডার কিনে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। তা ছাড়া অপদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ফিটকিরির পানি, ভাতের মাড়, সাগু, অ্যারারুট, লোহা বা সিসার গুলি, মার্বেল, ম্যাজিক বল, জেলিসহ বিভিন্ন পদার্থ। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত চলে অপদ্রব্য পুশ।
এ ছাড়া, অধিকাংশ মাছ কোম্পানির মালিক চিংড়ি কেনার সময় বাটখারায় ওজন ৪০০-৫০০ গ্রাম বেশি দিয়ে ক্রয় করছে চিংড়ি। ফলে ওজনে কম দেওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। আর এ ক্ষতির পরিমাণ পোষাতে ব্যবসায়ীরা পুশ করছেন চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য। জেলার রূপসা উপজেলাধীন ন্যাশনাল সি ফুডস, সালাম সি ফুডস, বায়োনিক সি ফুডস, রোজেমকো সি ফুডস, অ্যাপোলো সি ফুডস, প্রাইমাস সি ফুডস, ফ্রেশ সি ফুডস, রুপালি সি ফুডস, নগরীর অ্যাটলাস সি ফুডস, আছিয়া সি ফুডসসহ বেশ কয়েকটি মাছ কোম্পানিতে বহাল তবিয়তে জেলি পুশ করা গলদা ও বাগদা চিংড়ি ক্রয় করা হচ্ছে।
চিংড়ি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরীর নতুন বাজার, ফুলতলার জামিরা বাজার, পূর্ব রূপসা, রূপসার আলাইপুর বাজার, শিয়ালী বাজার, ডোবা বাজার, ডুমুরিয়ার ডুমুরিয়া বাজার, খর্ণিয়া বাজার, শাহাপুর, আড়ংঘাটা, চুকনগর, ফকিরহাটের ফকিরহাট বাজার, ফলতিতা বাজার, মোংলার ফয়লা বাজার, পাইকগাছার পাইকগাছা বাজারসহ বিভিন্ন মাছের ডিপো ও আড়তে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয়।
এসব অপদ্রব্য মেশানোর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক খাত চিংড়িশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। গলদা ও বাগদা চিংড়ি দিনদিন বিদেশের বাজার হারাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি ধরাও পড়ছে। পরে এসব চিংড়ি নষ্ট এবং পুশকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হচ্ছে। জেল-জরিমানা করলেও থেমে নেই চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশ। করোনাকালেও থেমে নেই চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ। মাছ কোম্পানির মালিকরা অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের চিংড়ির একটা টার্গেট দিয়ে দেন। কিন্তু প্রান্তিক চাষিরা মাছ কোম্পানিতে চিংড়ি বিক্রি করে বছরের পর বছর তাদের টাকা পান না। ফলে চাষিরা একদিকে হারাচ্ছেন আগ্রহ; অপরদিকে হচ্ছেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আগ্রহ হারানোর কারণে চিংড়ি উৎপাদনও অনেক কমে গেছে।
এদিকে কাক্সিক্ষত উৎপাদন না হওয়ায় ডিপো মালিকরা আগের মতো আর চিংড়ি কিনতে পারছেন না। একাধিক ডিপো মালিক কোম্পানি চিংড়ি বিক্রির টাকা না দেওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। এক ধরনের জিম্মি হয়ে আছেন কতিপয় মাছ কোম্পানি মালিকের কাছে ব্যবসায়ীরা।
রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু আহাদ হাফিজ বলেন, যারা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে তারা অধিকাংশই মৌসুমি ব্যবসায়ী।
রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান শেখ বলেন, অধিকাংশ কোম্পানি মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যারা আগে কখনো এ ব্যবসায় আসেনি, তারাই চিংড়ির দেহে জেলি পুশ করছে। তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশীষ বসাক বলেন, প্রায় ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কারাদ-ও দেওয়া হচ্ছে।
খুলনা কার্যালয়ের মৎস্য পরিদর্শক ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, চিংড়ি অপদ্রব্য পুশবিরোধী আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। আগামীতে কেউ পুশ করা চিংড়িসহ ধরা পড়লে তাকে জরিমানার পাশাপাশি কারাদন্ড দেওয়া হবে।
শেয়ার করুন
সুমন্ত চক্রবর্ত্তী, খুলনা | ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০

খুলনায় অবাধে চলছে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ। জেলা প্রশাসন, র্যাব, কোস্টগার্ড, মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অভিযানেও চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে বিদেশের বাজারে সুনাম হারাচ্ছে বাংলাদেশের সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ি।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে প্রথমে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ এলাকার ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীরা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা শুরু করেন। এরপর খুলনার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পুশের কার্যক্রম। ভারত থেকে আনা দুই ধরনের পাউডার মিশিয়ে জেলি তৈরি করা হয়। এসব জেলি বাগদা ও গলদা চিংড়ির দেহে পুশ করা হয় সিরিঞ্জ দিয়ে। নগরীর বিভিন্ন ওষুধের দোকান থেকে একটি চক্র আগার ও সিএম পাউডার কিনে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। তা ছাড়া অপদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ফিটকিরির পানি, ভাতের মাড়, সাগু, অ্যারারুট, লোহা বা সিসার গুলি, মার্বেল, ম্যাজিক বল, জেলিসহ বিভিন্ন পদার্থ। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত চলে অপদ্রব্য পুশ।
এ ছাড়া, অধিকাংশ মাছ কোম্পানির মালিক চিংড়ি কেনার সময় বাটখারায় ওজন ৪০০-৫০০ গ্রাম বেশি দিয়ে ক্রয় করছে চিংড়ি। ফলে ওজনে কম দেওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। আর এ ক্ষতির পরিমাণ পোষাতে ব্যবসায়ীরা পুশ করছেন চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য। জেলার রূপসা উপজেলাধীন ন্যাশনাল সি ফুডস, সালাম সি ফুডস, বায়োনিক সি ফুডস, রোজেমকো সি ফুডস, অ্যাপোলো সি ফুডস, প্রাইমাস সি ফুডস, ফ্রেশ সি ফুডস, রুপালি সি ফুডস, নগরীর অ্যাটলাস সি ফুডস, আছিয়া সি ফুডসসহ বেশ কয়েকটি মাছ কোম্পানিতে বহাল তবিয়তে জেলি পুশ করা গলদা ও বাগদা চিংড়ি ক্রয় করা হচ্ছে।
চিংড়ি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরীর নতুন বাজার, ফুলতলার জামিরা বাজার, পূর্ব রূপসা, রূপসার আলাইপুর বাজার, শিয়ালী বাজার, ডোবা বাজার, ডুমুরিয়ার ডুমুরিয়া বাজার, খর্ণিয়া বাজার, শাহাপুর, আড়ংঘাটা, চুকনগর, ফকিরহাটের ফকিরহাট বাজার, ফলতিতা বাজার, মোংলার ফয়লা বাজার, পাইকগাছার পাইকগাছা বাজারসহ বিভিন্ন মাছের ডিপো ও আড়তে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয়।
এসব অপদ্রব্য মেশানোর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক খাত চিংড়িশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। গলদা ও বাগদা চিংড়ি দিনদিন বিদেশের বাজার হারাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন স্থানে অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি ধরাও পড়ছে। পরে এসব চিংড়ি নষ্ট এবং পুশকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হচ্ছে। জেল-জরিমানা করলেও থেমে নেই চিংড়ির দেহে অপদ্রব্য পুশ। করোনাকালেও থেমে নেই চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ। মাছ কোম্পানির মালিকরা অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের চিংড়ির একটা টার্গেট দিয়ে দেন। কিন্তু প্রান্তিক চাষিরা মাছ কোম্পানিতে চিংড়ি বিক্রি করে বছরের পর বছর তাদের টাকা পান না। ফলে চাষিরা একদিকে হারাচ্ছেন আগ্রহ; অপরদিকে হচ্ছেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আগ্রহ হারানোর কারণে চিংড়ি উৎপাদনও অনেক কমে গেছে।
এদিকে কাক্সিক্ষত উৎপাদন না হওয়ায় ডিপো মালিকরা আগের মতো আর চিংড়ি কিনতে পারছেন না। একাধিক ডিপো মালিক কোম্পানি চিংড়ি বিক্রির টাকা না দেওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। এক ধরনের জিম্মি হয়ে আছেন কতিপয় মাছ কোম্পানি মালিকের কাছে ব্যবসায়ীরা।
রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু আহাদ হাফিজ বলেন, যারা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে তারা অধিকাংশই মৌসুমি ব্যবসায়ী।
রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান শেখ বলেন, অধিকাংশ কোম্পানি মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যারা আগে কখনো এ ব্যবসায় আসেনি, তারাই চিংড়ির দেহে জেলি পুশ করছে। তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশীষ বসাক বলেন, প্রায় ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কারাদ-ও দেওয়া হচ্ছে।
খুলনা কার্যালয়ের মৎস্য পরিদর্শক ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, চিংড়ি অপদ্রব্য পুশবিরোধী আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। আগামীতে কেউ পুশ করা চিংড়িসহ ধরা পড়লে তাকে জরিমানার পাশাপাশি কারাদন্ড দেওয়া হবে।