ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজে গিয়ে শিশু জেলালের এ কী হাল!
রওশন আলম পাপুল, গাইবান্ধা | ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের ১৩ বছরের সন্তান জেলাল মিয়া। ঢাকায় ধানম-ির এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করত। গত ৬ মে সকালে জেলালকে ঢাকা থেকে অপরিচিত এক যুবক গ্রামের বাড়ি পৌঁছে দেয়। বাড়ি পৌঁছার পর নিজের ছেলেকে চিনতে পারছিলেন না জেলালের মা গোলাপী বেগম। নির্যাতনে তার সন্তানের চেহারা দুর্ভিক্ষপীড়িত শিশুর মতো হয়ে গেছে। বুকের হাড় একটি একটি করে গোনা যাচ্ছিল। কথা বলার শক্তিটুকু ছিল না। এমনকি দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছিল তার।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে জেলাল বলে, ‘তাদের ছোট ছেলেটা হামাগুড়ি দিয়ে চলে। পড়ে গিয়ে কান্না করলে আমাকে মারে। কম করি খাবার দিচে। মাঝে মাঝে সারা দিন খাবার দেয় নাই। খিদায় একদিন ফ্রিজ থেকে ভাজা মাছ ও মিষ্টি খাচিলুম। তখন খুব মারছে। ঘরমোছা, পায়খানা পরিষ্কার করবার দিছে। করবার না পারলে লাঠি দিয়া মারছে। মেঝেতে থাকবার দিছে।’
জেলালের মা গোলাপী বেগম জানান, ১২ বছর আগে জেলালের বাবা সিরাজ উদ্দিন যক্ষ্মায় ভুগে মারা যান। ২০১৯ সালের মার্চে প্রতিবেশী গোলজার রহমানের স্ত্রী সাহিদা বেগমের মাধ্যমে ধানম-ি যায় জেলাল। কথা ছিল সেখানে সে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বরিশাল ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মফিজুল হকের ছেলে মো. রিয়াদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করবে আর এক বছর বয়সের শিশুর সঙ্গে খেলা করবে। এ জন্য প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা পাবে। যাওয়ার পর কারণে-অকারণে রিয়াদ ও তার স্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হয় জেলাল। বাড়ি যেতে চাইলে তারা বলত, সামনের মাসে যাবে। এভাবে কেটে গেছে ২৫ মাস। মা-ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় জেলালকে ভয়ভীতি দেখানো হতো, যাতে নির্যাতনের কথা না বলে। এমনকি ঢাকার ঠিকানাটাও দেওয়া হয়নি।
পরে গত ৬ মে জেলালকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামবাসী জেলালের কাছে নির্যাতনের বিবরণ শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেদিনই দুপুরে তারা কোমরপুর বাজারে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। পরে গোবিন্দগঞ্জ থানা ও হাইওয়ে পুলিশ চিকিৎসা সহায়তার আশ^াস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু চিকিৎসাসহায়তা পায়নি জেলাল। চিকিৎসার অভাবে এখন শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে দিন কাটছে তার। সে এই প্রতিবেদককে বলে, ‘এখনো বুকে-কোমরে ব্যথা করে। মাথা ঘোরে। ডান কানে কম শুনতে পাই। ভারী কাজ করতে পারি না।’
মা গোলাপী বেগম বলেন, ‘ছেলেটাকে এভাবে নির্যাতন করবে ভাবতে পারিনি। জেলালকে বগুড়ার একটি ক্লিনিকে মাত্র চার দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তারা আর কিছুই করেনি। ২৫ মাসে ৭৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দিয়েছে মাত্র ৫৪ হাজার টাকা। ওরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনগত পদক্ষেপ যাতে নিতে না পারি, সে জন্য আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে এলাকার লোকজন।’
অভিযোগ অস্বীকার করে মো. রিয়াদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জেলালের জন্মগত রক্তশূন্যতা রয়েছে। তাকে বগুড়ার একটি ক্লিনিকে ১২ দিন রেখে চিকিৎসা করা হয়। এতে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। চিকিৎসক জেলালকে সুস্থ বলার পর তার মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’
মানবাধিকারকর্মী আইনজীবী সালাহউদ্দিন কাশেম বলেন, ‘শিশু নির্যাতন একটি জামিন অযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া দরকার। যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’
শেয়ার করুন
রওশন আলম পাপুল, গাইবান্ধা | ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের ১৩ বছরের সন্তান জেলাল মিয়া। ঢাকায় ধানম-ির এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করত। গত ৬ মে সকালে জেলালকে ঢাকা থেকে অপরিচিত এক যুবক গ্রামের বাড়ি পৌঁছে দেয়। বাড়ি পৌঁছার পর নিজের ছেলেকে চিনতে পারছিলেন না জেলালের মা গোলাপী বেগম। নির্যাতনে তার সন্তানের চেহারা দুর্ভিক্ষপীড়িত শিশুর মতো হয়ে গেছে। বুকের হাড় একটি একটি করে গোনা যাচ্ছিল। কথা বলার শক্তিটুকু ছিল না। এমনকি দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছিল তার।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে জেলাল বলে, ‘তাদের ছোট ছেলেটা হামাগুড়ি দিয়ে চলে। পড়ে গিয়ে কান্না করলে আমাকে মারে। কম করি খাবার দিচে। মাঝে মাঝে সারা দিন খাবার দেয় নাই। খিদায় একদিন ফ্রিজ থেকে ভাজা মাছ ও মিষ্টি খাচিলুম। তখন খুব মারছে। ঘরমোছা, পায়খানা পরিষ্কার করবার দিছে। করবার না পারলে লাঠি দিয়া মারছে। মেঝেতে থাকবার দিছে।’
জেলালের মা গোলাপী বেগম জানান, ১২ বছর আগে জেলালের বাবা সিরাজ উদ্দিন যক্ষ্মায় ভুগে মারা যান। ২০১৯ সালের মার্চে প্রতিবেশী গোলজার রহমানের স্ত্রী সাহিদা বেগমের মাধ্যমে ধানম-ি যায় জেলাল। কথা ছিল সেখানে সে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বরিশাল ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মফিজুল হকের ছেলে মো. রিয়াদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করবে আর এক বছর বয়সের শিশুর সঙ্গে খেলা করবে। এ জন্য প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা পাবে। যাওয়ার পর কারণে-অকারণে রিয়াদ ও তার স্ত্রীর নির্যাতনের শিকার হয় জেলাল। বাড়ি যেতে চাইলে তারা বলত, সামনের মাসে যাবে। এভাবে কেটে গেছে ২৫ মাস। মা-ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় জেলালকে ভয়ভীতি দেখানো হতো, যাতে নির্যাতনের কথা না বলে। এমনকি ঢাকার ঠিকানাটাও দেওয়া হয়নি।
পরে গত ৬ মে জেলালকে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামবাসী জেলালের কাছে নির্যাতনের বিবরণ শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সেদিনই দুপুরে তারা কোমরপুর বাজারে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। পরে গোবিন্দগঞ্জ থানা ও হাইওয়ে পুলিশ চিকিৎসা সহায়তার আশ^াস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু চিকিৎসাসহায়তা পায়নি জেলাল। চিকিৎসার অভাবে এখন শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে দিন কাটছে তার। সে এই প্রতিবেদককে বলে, ‘এখনো বুকে-কোমরে ব্যথা করে। মাথা ঘোরে। ডান কানে কম শুনতে পাই। ভারী কাজ করতে পারি না।’
মা গোলাপী বেগম বলেন, ‘ছেলেটাকে এভাবে নির্যাতন করবে ভাবতে পারিনি। জেলালকে বগুড়ার একটি ক্লিনিকে মাত্র চার দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তারা আর কিছুই করেনি। ২৫ মাসে ৭৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দিয়েছে মাত্র ৫৪ হাজার টাকা। ওরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনগত পদক্ষেপ যাতে নিতে না পারি, সে জন্য আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে এলাকার লোকজন।’
অভিযোগ অস্বীকার করে মো. রিয়াদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জেলালের জন্মগত রক্তশূন্যতা রয়েছে। তাকে বগুড়ার একটি ক্লিনিকে ১২ দিন রেখে চিকিৎসা করা হয়। এতে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। চিকিৎসক জেলালকে সুস্থ বলার পর তার মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।’
মানবাধিকারকর্মী আইনজীবী সালাহউদ্দিন কাশেম বলেন, ‘শিশু নির্যাতন একটি জামিন অযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া দরকার। যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’