কেমন রূপান্তর চাই দেশের?
রোবায়েত ফেরদৌস | ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
আধুনিক মানুষ কে? নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক এবং আউটসাইডার-এর লেখক আলবেয়ার কাম্যু এর উত্তর দিয়েছিলেন; তিনি বলেছিলেন, ‘যে খবরের কাগজ পড়ে আর রমণ করে, সে-ই আধুনিক মানুষ।’ রমণ না হয় বুঝলাম, কিন্তু খবরের কাগজ তো দূরে থাক, খোদ কাগজই না-কি পৃথিবীতে আর থাকবে না। কাগজ আবিষ্কারের পর কাগজ ছাড়া সভ্যতার একটি দিনও আমরা ভাবতে পারতাম না! সেই কাগজকেন্দ্রিক সভ্যতা আজ প্রশ্নের মুখোমুখি, তার অস্তিত্বই আজ হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবীতে কোনো পেপারই থাকবে না, থাকবে শুধু একটি পেপার-টয়লেট পেপার। কাগজই যেখানে টিকছে না, সেখানে খবরের কাগজের ভবিষ্যৎ কী? আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পেপার বলছে, ২০৫০ সাল হবে পৃথিবীর শেষ বছর এবং এর পরে পৃথিবীতে ছাপার অক্ষরে আর কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ পাবে না। ডিজিটাল প্রযুক্তি, অনলাইন আর ফেইসবুক এখন সারা পৃথিবীতে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছে; প্রযুক্তির সমান্তরালে নিজেকে হালনাগাদ রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। নয়াপ্রযুক্তির এই দাম্ভিক ও দাপুটে সময়ে সংবাদপত্র নিদারুণ কোণঠাসা। সংবাদপত্রের জন্য ঠিক এরকম এক করুণ ও বিপরীত সময়ে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ অমিত হাবিব মেধাদীপ্ত সাহসী তারুণ্য আর অভিজ্ঞদের প্রজ্ঞা ও দায়িত্বশীলতার মিশেল ঘটিয়ে দেশ রূপান্তর কাগজের শুভ উদ্বোধন ঘটাচ্ছেন। সময় যেহেতু বিরূপ, চ্যালেঞ্জও তাই বেশি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষ তার সবচেয়ে ভালোটা আর সৃজনশীল কাজটা করতে পারে তখনইÑ বাধা, ঝুঁকি আর সীমাবদ্ধতা যখন সবচাইতে প্রবল থাকে। দুনিয়াব্যাপী সংবাদপত্রের যখন মৃত্যুঘণ্টা বাজছে আর অমিতদারা তখন মনে করছেন, সংবাদপত্রের ‘অবিচুয়ারি’ লেখার সময় এখনো আসেনি। আমি তাদের এই সাহসের তারিফ করি, আর তার টিমকে স্যালুট জানাই।
আমরা তো দেখি, প্রতিদিন সকালে কেমন সাপের মতো হিস্ করে দরজার নিচ দিয়ে পিছলে বাসায় ঢুকে পড়ে খবরের কাগজ। কিন্তু কই, জাত সাপের মতো বিষ কই তাদের? কাউকে দংশন করলে পাছে যদি কোনো পক্ষ হয়ে যাই; কিংবা নিদেনপক্ষে ভয় থাকে, কেউ যদি কোনো পক্ষে মার্জিন এঁকে দেয়। নিত্যদিন এতসব মুখোশে খবরের কাগজের মুখ মোড়া যে মুখোশ চিড়ে মুখ চেনাই মুশকিল হয়ে ওঠে!
দেশ রূপান্তর কি পারবে বিষ তুলে নিতে কণ্ঠে তার? সন্তরণরত হাঁস যে রকম ডানা ঝাপটিয়ে জল ঝরিয়ে ফেলে দেশ রূপান্তর কি পারবে নিরপেক্ষতার ভণিতাকে সে রকম দূরে ঝেড়ে ফেলতে! মুখোশ চিড়ে মুখ দেখাতে? পারবে কি প্রভাব ফেলতে অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, পরিবেশ-সখ্য আর নারীর প্রতি সংবেদনশীল একটি রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে? দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনা কিংবা ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে জেহাদি সাংবাদিকতার ফরমান জারি করতে? কিংবা পারবে করপোরেট বিজ্ঞাপনদেনেওয়ালার চাপ এড়াতে? হায়! সংবাদপত্র নিজেই তো করপোরেট গোলামিতে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ডুবিয়ে রাখতে ভালোবাসে। মাথা তুলে দাঁড়াবে সে কীভাবে?
অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো তাই শুরু করতে হবে আমাদের শুরু থেকেই। ছোট্ট কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান যে পরিবারÑ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নির্মিতি আর রুচির প্রতিষ্ঠা শুরু হওয়া দরকার সেখান থেকেই। পরিবারের জমিতে গণতন্ত্র আর রুচির কর্ষণে সংবাদপত্রের রয়েছে প্রভাববিস্তারকারী ভূমিকা; পাঠক-ব্যবহারকারীর ভাষাকাঠামো নির্মাণেও তার অবদান অনপনেয়। দেশ রূপান্তর-এর আছে কি কোনো দূরচিন্তার পরিকল্পনা এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার?
কেমন নিরেট সিসার ঠাঁটবুনোনে ঠাসা সব প্রাণহীন ধূসর অক্ষর নিয়ে ফি-দিন খবরের কাগজ বেরোয়। দেশ রূপান্তর কি পারবে সেসব অক্ষরে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করতে? অক্ষররাজিকে প্রেম আর জীবনের ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিতে? কাগজে শব্দ আর বাক্যের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে? রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করা, ব্যবসায়ের সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলা, দারিদ্র্যকে জয় করার দায়িত্ব থেকেও সংবাদপত্র রেহাই পেতে পারে না। এসব কোনোটাই কিন্তু সহজ চ্যালেঞ্জ নয়।
কিন্তু মুশকিল হয় তখন; কখন? সংবাদপত্র বের হওয়ার আগেই এর মালিকের সঙ্গে সম্পাদকের যখন দেন-দরবার চলে, আমার বিবেচনায় তখনই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্পাদকের মৃত্যু ঘটে। মহাআপসরফাটি তখনই সম্পাদিত হয়ে যায়। পরে আর কিচ্ছুটি করবার থাকে না, বেতনভোগী সম্পাদক তার পেশাদারিত্ব দেখাবেন কোথায়? কেমন চাই দেশ রূপান্তর? এই তো প্রশ্ন? যদি বলি এমন চাই সত্যিকার অর্থেই যা কণ্ঠ হয়ে উঠবে এ কালের; সম্ভব কি হয়ে ওঠা এমন? কেন সংশয়? ওই যে বললাম আদি আপসটি আগেই হয়ে যায়। সেখান থেকে দেশ রূপান্তর কি বেরুতে পারবে? দেশ রূপান্তর কেমন রূপান্তর ঘটায় দেশের একশো ভাগ সংশয়-ভরা-মন নিয়ে ‘দেখিবার অপেক্ষায় রইলাম’।
লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শেয়ার করুন
রোবায়েত ফেরদৌস | ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

আধুনিক মানুষ কে? নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক এবং আউটসাইডার-এর লেখক আলবেয়ার কাম্যু এর উত্তর দিয়েছিলেন; তিনি বলেছিলেন, ‘যে খবরের কাগজ পড়ে আর রমণ করে, সে-ই আধুনিক মানুষ।’ রমণ না হয় বুঝলাম, কিন্তু খবরের কাগজ তো দূরে থাক, খোদ কাগজই না-কি পৃথিবীতে আর থাকবে না। কাগজ আবিষ্কারের পর কাগজ ছাড়া সভ্যতার একটি দিনও আমরা ভাবতে পারতাম না! সেই কাগজকেন্দ্রিক সভ্যতা আজ প্রশ্নের মুখোমুখি, তার অস্তিত্বই আজ হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবীতে কোনো পেপারই থাকবে না, থাকবে শুধু একটি পেপার-টয়লেট পেপার। কাগজই যেখানে টিকছে না, সেখানে খবরের কাগজের ভবিষ্যৎ কী? আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পেপার বলছে, ২০৫০ সাল হবে পৃথিবীর শেষ বছর এবং এর পরে পৃথিবীতে ছাপার অক্ষরে আর কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ পাবে না। ডিজিটাল প্রযুক্তি, অনলাইন আর ফেইসবুক এখন সারা পৃথিবীতে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছে; প্রযুক্তির সমান্তরালে নিজেকে হালনাগাদ রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। নয়াপ্রযুক্তির এই দাম্ভিক ও দাপুটে সময়ে সংবাদপত্র নিদারুণ কোণঠাসা। সংবাদপত্রের জন্য ঠিক এরকম এক করুণ ও বিপরীত সময়ে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ অমিত হাবিব মেধাদীপ্ত সাহসী তারুণ্য আর অভিজ্ঞদের প্রজ্ঞা ও দায়িত্বশীলতার মিশেল ঘটিয়ে দেশ রূপান্তর কাগজের শুভ উদ্বোধন ঘটাচ্ছেন। সময় যেহেতু বিরূপ, চ্যালেঞ্জও তাই বেশি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানুষ তার সবচেয়ে ভালোটা আর সৃজনশীল কাজটা করতে পারে তখনইÑ বাধা, ঝুঁকি আর সীমাবদ্ধতা যখন সবচাইতে প্রবল থাকে। দুনিয়াব্যাপী সংবাদপত্রের যখন মৃত্যুঘণ্টা বাজছে আর অমিতদারা তখন মনে করছেন, সংবাদপত্রের ‘অবিচুয়ারি’ লেখার সময় এখনো আসেনি। আমি তাদের এই সাহসের তারিফ করি, আর তার টিমকে স্যালুট জানাই।
আমরা তো দেখি, প্রতিদিন সকালে কেমন সাপের মতো হিস্ করে দরজার নিচ দিয়ে পিছলে বাসায় ঢুকে পড়ে খবরের কাগজ। কিন্তু কই, জাত সাপের মতো বিষ কই তাদের? কাউকে দংশন করলে পাছে যদি কোনো পক্ষ হয়ে যাই; কিংবা নিদেনপক্ষে ভয় থাকে, কেউ যদি কোনো পক্ষে মার্জিন এঁকে দেয়। নিত্যদিন এতসব মুখোশে খবরের কাগজের মুখ মোড়া যে মুখোশ চিড়ে মুখ চেনাই মুশকিল হয়ে ওঠে!
দেশ রূপান্তর কি পারবে বিষ তুলে নিতে কণ্ঠে তার? সন্তরণরত হাঁস যে রকম ডানা ঝাপটিয়ে জল ঝরিয়ে ফেলে দেশ রূপান্তর কি পারবে নিরপেক্ষতার ভণিতাকে সে রকম দূরে ঝেড়ে ফেলতে! মুখোশ চিড়ে মুখ দেখাতে? পারবে কি প্রভাব ফেলতে অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, পরিবেশ-সখ্য আর নারীর প্রতি সংবেদনশীল একটি রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে? দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনা কিংবা ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে জেহাদি সাংবাদিকতার ফরমান জারি করতে? কিংবা পারবে করপোরেট বিজ্ঞাপনদেনেওয়ালার চাপ এড়াতে? হায়! সংবাদপত্র নিজেই তো করপোরেট গোলামিতে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ডুবিয়ে রাখতে ভালোবাসে। মাথা তুলে দাঁড়াবে সে কীভাবে?
অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো তাই শুরু করতে হবে আমাদের শুরু থেকেই। ছোট্ট কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান যে পরিবারÑ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নির্মিতি আর রুচির প্রতিষ্ঠা শুরু হওয়া দরকার সেখান থেকেই। পরিবারের জমিতে গণতন্ত্র আর রুচির কর্ষণে সংবাদপত্রের রয়েছে প্রভাববিস্তারকারী ভূমিকা; পাঠক-ব্যবহারকারীর ভাষাকাঠামো নির্মাণেও তার অবদান অনপনেয়। দেশ রূপান্তর-এর আছে কি কোনো দূরচিন্তার পরিকল্পনা এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার?
কেমন নিরেট সিসার ঠাঁটবুনোনে ঠাসা সব প্রাণহীন ধূসর অক্ষর নিয়ে ফি-দিন খবরের কাগজ বেরোয়। দেশ রূপান্তর কি পারবে সেসব অক্ষরে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করতে? অক্ষররাজিকে প্রেম আর জীবনের ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিতে? কাগজে শব্দ আর বাক্যের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে? রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করা, ব্যবসায়ের সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলা, দারিদ্র্যকে জয় করার দায়িত্ব থেকেও সংবাদপত্র রেহাই পেতে পারে না। এসব কোনোটাই কিন্তু সহজ চ্যালেঞ্জ নয়।
কিন্তু মুশকিল হয় তখন; কখন? সংবাদপত্র বের হওয়ার আগেই এর মালিকের সঙ্গে সম্পাদকের যখন দেন-দরবার চলে, আমার বিবেচনায় তখনই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্পাদকের মৃত্যু ঘটে। মহাআপসরফাটি তখনই সম্পাদিত হয়ে যায়। পরে আর কিচ্ছুটি করবার থাকে না, বেতনভোগী সম্পাদক তার পেশাদারিত্ব দেখাবেন কোথায়? কেমন চাই দেশ রূপান্তর? এই তো প্রশ্ন? যদি বলি এমন চাই সত্যিকার অর্থেই যা কণ্ঠ হয়ে উঠবে এ কালের; সম্ভব কি হয়ে ওঠা এমন? কেন সংশয়? ওই যে বললাম আদি আপসটি আগেই হয়ে যায়। সেখান থেকে দেশ রূপান্তর কি বেরুতে পারবে? দেশ রূপান্তর কেমন রূপান্তর ঘটায় দেশের একশো ভাগ সংশয়-ভরা-মন নিয়ে ‘দেখিবার অপেক্ষায় রইলাম’।
লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।