মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণ
আজিজুল রাসেল | ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
আমার এই লেখা বাংলাদেশের ইতিহাসবিদরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছেন তা নিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের, অন্য কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসতত্ত্ব পর্যালোচনা ও এর সীমাবদ্ধতা আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য। পেশাদার এবং অপেশাদার ইতিহাসবিদসহ অনেকে এ পর্যন্ত বেশ কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলাদেশের জাতির ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই নিজেদের যুক্ত করেছেন আবেগের সঙ্গে। আবেগ থেকে বেরিয়ে প্রকৃত ইতিহাসবিদের চোখে বাংলাদেশের জাতির ইতিহাসকে কি তারা দেখতে পেরেছেন? আবার বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের কিছু কিছু সামরিক অফিসাররা তাদের মতো করে যুদ্ধের স্মৃতিকথা ও যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। অনেকে এসব স্মৃতিকথাকে ইতিহাস ভেবে থাকেন। এটা ঠিক, যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস লেখায় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। তবে এসব গ্রন্থে নিজস্ব ধ্যানধারণা, আত্মপক্ষ সমর্থন ও ঘটনা আড়াল করার প্রবণতা থাকতে পারে এবং আছে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বা জাতির ইতিহাস রচনা মূলত এসব প্রবণতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ সচেষ্ট হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস সন্ধানে। তবে যারা এসব ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন তারাও গতানুগতিক ঘটনা বর্ণনা থেকে বেরোতে পারেননি। আঞ্চলিক যোদ্ধাদের জাতীয় ইতিহাসে স্থাপন করার কোনো প্রচেষ্টা তারা নেননি বা এটি কীভাবে করতে তা যেন তাদের জানা নেই। তাদের এ ইতিহাস শুধু ঘটনার বয়ান। যুক্তি ও বিশ্লেষণের জায়গা সেখানে নেই। তবে এসব সাধারণ প্রবণতার বাইরে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অন্য আলোয় দেখতে চেষ্টা করেছেন বদরুদ্দীন উমর। দুই খ-ে রচিত ‘ঞযব ঊসবৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয’ নামের গ্রন্থে এ অঞ্চলে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে শ্রমিক এবং কৃষকের অংশগ্রহণ দেখিয়েছেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত সময়কালকে দেখেছেন তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ শ্রেণি সংগ্রাম হিসেবে। এ অংশে তিনি বিভিন্ন কলকারখানা ও ট্রেড ইউনিয়ন এবং কৃষক সংগ্রামের কথা লিখেছেন। গ্রন্থটির দ্বিতীয় খ-ে তিনি আলোচনা করেছেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে। এ কালকে তিনি চিহ্নিত করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে। তবে গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো লেখক প্রধানত একজন রাজনীতিবিদ হওয়ায় গ্রন্থের কোন কোন অংশে লেখক ঘটনা বিশ্লেষণের চেয়ে বিবৃতি আরোপ করতে যেয়ে পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন কিছু ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিকও বাংলাদেশ জাতির ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। কেউ চেষ্টা করেছেন পদ্ধতিগতভাবে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করতে। যেমন, শ্রীনাথ রাঘবনের ‘১৯৭১ : এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের একটি গভীর ও পা-িত্যপূর্ণ আলোচনা প্রদান করে। পাকিস্তানের ভাগ্য যে ১৯৫০-এর দশকেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই মতকে তিনি সমালোচনা করেছেন। লেখক বলছেন, পাকিস্তানের ভাঙন শুধু বোঝা যাবে এই ঘটনাগুলোকে বৈশ্বিক পরিসরে স্থাপন করে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও রাজনীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এ পর্যন্ত রচিত বেশির ভাগ ইতিহাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে একটি বছর, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির মধ্যে। যেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে কেবল ১৯৭১ সালের নয় মাসের যুদ্ধের ফলেই। আর কিছু কিছু ইতিহাসবিদ খুবই গতানুগতিকভাবে ঘটনা পরম্পরাকে যুক্ত করেছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি, উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে, এ অঞ্চলের কৃষক ও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষরা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং এদেশীয় অভিজাত শোষণকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর ময়দানে বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাস্ত করার মাধ্যমেই কার্যত ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু করে। এরপর একের পর এক ক্ষমতা ব্রিটিশরা নিজেদের হাতে নিতে শুরু করে। ভূমি রাজস্ব থেকে শুরু করে আরো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ব্রিটিশরা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। কিন্তু ব্রিটিশদের শাসন কি ফুলশয্যার মতো ছিল? কোনো প্রতিরোধের কি তারা সম্মুখীন হয়নি? যদি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে থাকে, এ প্রতিরোধ কাদের কাছ থেকে এসেছিল? উল্লেখ্য, পুরো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনজুড়েই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ জারি ছিল। বিক্ষোভ-বিদ্রোহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের এমনভাবে তাড়া করেছিল যে তারা সব সময় বিদ্রোহভূতে ভুগত। কোনো জনসমাবেশ, তীর্থযাত্রা এসবকেও সন্দেহ করত বিক্ষোভ সৃষ্টির জায়গা হিসেবে এবং গোয়েন্দাগিরি ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করত এসবের ওপর।
ব্রিটিশ শাসন শুরুর মুহূর্ত থেকেই নি¤œবৃত্তের স্বাধীনচেতা ফকির এবং কৃষকরা বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ করেছিল। বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ শাসকরাও ছিল অনেক কঠোর। অনেক সময় দেখা যেত ঠগ বা দুর্বৃত্ত আখ্যা দিয়ে বিদ্রোহরত কৃষকদের তারা হত্যা করত। উনিশ শতকে এসেও ব্যাপক ভিত্তিতে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে। বিশ শতকে এসে যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এসব বিক্ষোভ, বিদ্রোহ রূপ নিচ্ছিল আরো শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে, তখন কৃষক, শ্রমিক এবং নিম্নবর্গের মানুষ এলিট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়। তবে তাদের নিজেদের এজেন্ডা থাকে। জাতীয়তাবাদী এসব সমাবেশে কৃষক, শ্রমিক বা নি¤œবর্গের মানুষের এজেন্ডা উপেক্ষিত হলে নি¤œবর্গের মানুষও উচ্চবর্গের সমাবেশ ত্যাগ করতেন।
এবার নির্দিষ্টভাবে পূর্ববঙ্গের কৃষক, শ্রমিক ও নি¤œবর্গের মানুষদের লড়াইয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। পূর্ববঙ্গের কৃষকরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তো বটেই, উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেও তাদের অধিকার ও দাবি আদায়ে আন্দোলনে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৪০-র দশক থেকে পূর্ববঙ্গ আলোড়িত ছিল টংক, তেভাগা এবং নানকার বিদ্রোহের মতো শক্তিশালী কৃষক বিদ্রোহে। এরপর পাকিস্তান আন্দোলনের কারণে কৃষকের সংগ্রাম সাময়িক সময়ের জন্য ম্লান হয়ে গেলেও তা একেবারে থেমে যায়নি। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কাঠামোয় তা চলতে থাকে। কৃষক এবং নিম্নবর্গের মানুষেরা উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেও পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা রাখে। শোষিত কৃষকরা মনে করেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র হবে তাদের প্রত্যাশিত রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে হিন্দু জমিদার-জোতদারদের শোষণ থেকে তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু এ প্রত্যাশার মোহভঙ্গ ঘটতে তাদের বেশি দেরি হয়নি।
উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এবং উচ্চবর্গের রাজনৈতিক সমাবেশেও কৃষক ও শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করত। যুক্তফ্রন্ট, আওয়ামী লীগ এসব দলের সঙ্গে মিশেও তারা তাদের দাবিদাওয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। যে মুসলিম লীগ ঔপনিবেশিক ভারতের শেষ নির্বাচনে বাংলায় বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছিল, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ১৯৫৪ সালে সেই মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। এরপর মুসলিম লীগ বাংলায় আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেই প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক সবাই ভোটাধিকার পেয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগই তখন ছিলেন কৃষক। কৃষকরা তাদের মোহভঙ্গের প্রথম প্রতিশোধ নিলেন ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের কবর রচনা করে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কৃষক এবং শ্রমিকদের যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আরেকটি কারণও ছিল। কৃষকদের সমাবেশে যুক্ত করতে কৃষকদের অনেক দাবিদাওয়াই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করতে হয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৬ সালের ছয় দফার ক্ষেত্রে। মোদ্দা কথায় কৃষক-শ্রমিক অন্যকথায় নিম্নবর্গের মানুষরাই শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে বড় শক্তি ছিল। কিন্তু জাতির ইতিহাসচর্চায় তারা বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে।
শেয়ার করুন
আজিজুল রাসেল | ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

আমার এই লেখা বাংলাদেশের ইতিহাসবিদরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছেন তা নিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের, অন্য কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসতত্ত্ব পর্যালোচনা ও এর সীমাবদ্ধতা আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য। পেশাদার এবং অপেশাদার ইতিহাসবিদসহ অনেকে এ পর্যন্ত বেশ কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলাদেশের জাতির ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই নিজেদের যুক্ত করেছেন আবেগের সঙ্গে। আবেগ থেকে বেরিয়ে প্রকৃত ইতিহাসবিদের চোখে বাংলাদেশের জাতির ইতিহাসকে কি তারা দেখতে পেরেছেন? আবার বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের কিছু কিছু সামরিক অফিসাররা তাদের মতো করে যুদ্ধের স্মৃতিকথা ও যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। অনেকে এসব স্মৃতিকথাকে ইতিহাস ভেবে থাকেন। এটা ঠিক, যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস লেখায় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে। তবে এসব গ্রন্থে নিজস্ব ধ্যানধারণা, আত্মপক্ষ সমর্থন ও ঘটনা আড়াল করার প্রবণতা থাকতে পারে এবং আছে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ বা জাতির ইতিহাস রচনা মূলত এসব প্রবণতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ সচেষ্ট হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস সন্ধানে। তবে যারা এসব ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন তারাও গতানুগতিক ঘটনা বর্ণনা থেকে বেরোতে পারেননি। আঞ্চলিক যোদ্ধাদের জাতীয় ইতিহাসে স্থাপন করার কোনো প্রচেষ্টা তারা নেননি বা এটি কীভাবে করতে তা যেন তাদের জানা নেই। তাদের এ ইতিহাস শুধু ঘটনার বয়ান। যুক্তি ও বিশ্লেষণের জায়গা সেখানে নেই। তবে এসব সাধারণ প্রবণতার বাইরে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অন্য আলোয় দেখতে চেষ্টা করেছেন বদরুদ্দীন উমর। দুই খ-ে রচিত ‘ঞযব ঊসবৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয’ নামের গ্রন্থে এ অঞ্চলে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে শ্রমিক এবং কৃষকের অংশগ্রহণ দেখিয়েছেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত সময়কালকে দেখেছেন তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ শ্রেণি সংগ্রাম হিসেবে। এ অংশে তিনি বিভিন্ন কলকারখানা ও ট্রেড ইউনিয়ন এবং কৃষক সংগ্রামের কথা লিখেছেন। গ্রন্থটির দ্বিতীয় খ-ে তিনি আলোচনা করেছেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে। এ কালকে তিনি চিহ্নিত করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে। তবে গ্রন্থটির অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো লেখক প্রধানত একজন রাজনীতিবিদ হওয়ায় গ্রন্থের কোন কোন অংশে লেখক ঘটনা বিশ্লেষণের চেয়ে বিবৃতি আরোপ করতে যেয়ে পদ্ধতিগত ইতিহাস চর্চা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের নাগরিক নন এমন কিছু ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিকও বাংলাদেশ জাতির ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। কেউ চেষ্টা করেছেন পদ্ধতিগতভাবে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা করতে। যেমন, শ্রীনাথ রাঘবনের ‘১৯৭১ : এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের একটি গভীর ও পা-িত্যপূর্ণ আলোচনা প্রদান করে। পাকিস্তানের ভাগ্য যে ১৯৫০-এর দশকেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই মতকে তিনি সমালোচনা করেছেন। লেখক বলছেন, পাকিস্তানের ভাঙন শুধু বোঝা যাবে এই ঘটনাগুলোকে বৈশ্বিক পরিসরে স্থাপন করে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও রাজনীতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এ পর্যন্ত রচিত বেশির ভাগ ইতিহাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছে একটি বছর, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির মধ্যে। যেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে কেবল ১৯৭১ সালের নয় মাসের যুদ্ধের ফলেই। আর কিছু কিছু ইতিহাসবিদ খুবই গতানুগতিকভাবে ঘটনা পরম্পরাকে যুক্ত করেছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি, উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে, এ অঞ্চলের কৃষক ও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষরা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং এদেশীয় অভিজাত শোষণকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর ময়দানে বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাস্ত করার মাধ্যমেই কার্যত ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু করে। এরপর একের পর এক ক্ষমতা ব্রিটিশরা নিজেদের হাতে নিতে শুরু করে। ভূমি রাজস্ব থেকে শুরু করে আরো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ব্রিটিশরা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। কিন্তু ব্রিটিশদের শাসন কি ফুলশয্যার মতো ছিল? কোনো প্রতিরোধের কি তারা সম্মুখীন হয়নি? যদি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে থাকে, এ প্রতিরোধ কাদের কাছ থেকে এসেছিল? উল্লেখ্য, পুরো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনজুড়েই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ জারি ছিল। বিক্ষোভ-বিদ্রোহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের এমনভাবে তাড়া করেছিল যে তারা সব সময় বিদ্রোহভূতে ভুগত। কোনো জনসমাবেশ, তীর্থযাত্রা এসবকেও সন্দেহ করত বিক্ষোভ সৃষ্টির জায়গা হিসেবে এবং গোয়েন্দাগিরি ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করত এসবের ওপর।
ব্রিটিশ শাসন শুরুর মুহূর্ত থেকেই নি¤œবৃত্তের স্বাধীনচেতা ফকির এবং কৃষকরা বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ করেছিল। বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ শাসকরাও ছিল অনেক কঠোর। অনেক সময় দেখা যেত ঠগ বা দুর্বৃত্ত আখ্যা দিয়ে বিদ্রোহরত কৃষকদের তারা হত্যা করত। উনিশ শতকে এসেও ব্যাপক ভিত্তিতে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে। বিশ শতকে এসে যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এসব বিক্ষোভ, বিদ্রোহ রূপ নিচ্ছিল আরো শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে, তখন কৃষক, শ্রমিক এবং নিম্নবর্গের মানুষ এলিট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়। তবে তাদের নিজেদের এজেন্ডা থাকে। জাতীয়তাবাদী এসব সমাবেশে কৃষক, শ্রমিক বা নি¤œবর্গের মানুষের এজেন্ডা উপেক্ষিত হলে নি¤œবর্গের মানুষও উচ্চবর্গের সমাবেশ ত্যাগ করতেন।
এবার নির্দিষ্টভাবে পূর্ববঙ্গের কৃষক, শ্রমিক ও নি¤œবর্গের মানুষদের লড়াইয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। পূর্ববঙ্গের কৃষকরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তো বটেই, উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেও তাদের অধিকার ও দাবি আদায়ে আন্দোলনে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৪০-র দশক থেকে পূর্ববঙ্গ আলোড়িত ছিল টংক, তেভাগা এবং নানকার বিদ্রোহের মতো শক্তিশালী কৃষক বিদ্রোহে। এরপর পাকিস্তান আন্দোলনের কারণে কৃষকের সংগ্রাম সাময়িক সময়ের জন্য ম্লান হয়ে গেলেও তা একেবারে থেমে যায়নি। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কাঠামোয় তা চলতে থাকে। কৃষক এবং নিম্নবর্গের মানুষেরা উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেও পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা রাখে। শোষিত কৃষকরা মনে করেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র হবে তাদের প্রত্যাশিত রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে হিন্দু জমিদার-জোতদারদের শোষণ থেকে তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু এ প্রত্যাশার মোহভঙ্গ ঘটতে তাদের বেশি দেরি হয়নি।
উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এবং উচ্চবর্গের রাজনৈতিক সমাবেশেও কৃষক ও শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করত। যুক্তফ্রন্ট, আওয়ামী লীগ এসব দলের সঙ্গে মিশেও তারা তাদের দাবিদাওয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। যে মুসলিম লীগ ঔপনিবেশিক ভারতের শেষ নির্বাচনে বাংলায় বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছিল, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ১৯৫৪ সালে সেই মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। এরপর মুসলিম লীগ বাংলায় আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেই প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক সবাই ভোটাধিকার পেয়েছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগই তখন ছিলেন কৃষক। কৃষকরা তাদের মোহভঙ্গের প্রথম প্রতিশোধ নিলেন ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের কবর রচনা করে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কৃষক এবং শ্রমিকদের যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আরেকটি কারণও ছিল। কৃষকদের সমাবেশে যুক্ত করতে কৃষকদের অনেক দাবিদাওয়াই তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করতে হয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৬ সালের ছয় দফার ক্ষেত্রে। মোদ্দা কথায় কৃষক-শ্রমিক অন্যকথায় নিম্নবর্গের মানুষরাই শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে বড় শক্তি ছিল। কিন্তু জাতির ইতিহাসচর্চায় তারা বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে।