পাকিস্তানের নিস্তব্ধতার বয়ান
আম্মার আলী জান | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
পাকিস্তানে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরা এখন এক বিপন্ন অবস্থায় আছেন। নিউ ইয়র্কভিত্তিক কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক কর্তৃপক্ষ ভয়ভীতি, হুমকি এমনকি বলপ্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য করছে। অক্টোবরে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা কমিয়ে আনা এবং নানা স্থানে টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সাংবাদিকরা। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের কট্টর সমালোচক বেশ কয়েকজন নামজাদা টিভি উপস্থাপককে বরখাস্তও করা হয়েছে এসব চাপের মুখে।
আমি নিজেও এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। এ মাসের শুরুতে চতুর্থ আন্তর্জাতিক ফায়েজ উৎসবে আরো তিন অধিকারকর্মীসহ আমাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আয়োজকরা জানিয়েছেন, আমাদের বাদ না দেওয়া হলে নাকি উৎসবই বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ওপর মহল। সংগীত, শিল্প-সাহিত্য ও বিতর্কের তিন দিনব্যাপী এ স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এমন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে মঞ্চে একটি আসন খালি রেখেই আয়োজকরা ওই অনুষ্ঠান করেছেন। পরিহাস হলো, এ ঘটনা ঘটে পাকিস্তানের প্রখ্যাত সমাজবাদী কবি ফায়েজ আহমদ ফায়েজের স্মরণোৎসবে। যার কাজ আর পুরো জীবনই মাথা নত না করার শিক্ষা আর কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধাচরণের অনন্য দৃষ্টান্ত। নিয়তির এর চেয়ে নির্মমতা আর কী হতে পারত।
পাকিস্তানে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর এখন যে আক্রমণ চলছে, তার ভিত্তি দেশের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক ‘পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধ’ মোকাবিলা করা। এ ‘পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধ’ দেশটির শক্তিশালী নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের তত্ত্ববিশেষ। এর মধ্য দিয়ে তারা বলতে চায়, পাকিস্তানের শত্রুরা দেশের ভেতরে সক্রিয় এবং তারা নানাভাবে দেশের ‘টলায়মান’ তরুণ প্রজন্মের মনোজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার এমন টালবাহানা যুগে যুগে দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে নানারূপে হাজির হয়। পাকিস্তানে এখন এটা ব্যবহার করা হচ্ছে মানবাধিকারকর্মী, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, সমালোচনামুখর সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কখনোই নিজের একটি একক রাজনৈতিক সত্তায় আত্মবিশ্বাসী হতে পারেনি। কেননা, নিজেদের জাতিগত বিভক্তি এবং ভূকৌশলগত অবস্থানকে সব সময়ই তারা জাতীয় সংহতির জন্য সম্ভাব্য হুমকি বলে মনে করে এসেছে। দেশটিতে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্কের মেঘ ঘনিয়ে আনা ‘নীরব সামরিক আইন’ এখন অনেকটাই আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ঢুকে গেছে। বেসামরিক সরকার এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশটিতে এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক চর্চা দেখা যাচ্ছে, যা একই সঙ্গে হাস্যরসাত্মক এবং করুণ। হাস্যরসের সৃষ্টি জনগণের ভীতির করুণ পরিস্থিতি থেকেই। সামরিক বাহিনীর সমালোচনার সময় সবাই সরাসরি তাদের নাম নিতে ভয় পায়। এই ভীতি থেকেই নানা রকম ছদ্মনাম আর নানা সাংকেতিক শব্দের ব্যবহার চালু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, লেখকরা দেশটির গোপন সংস্থার উল্লেখ করতে গিয়ে ‘ছেলেরা’, ‘দেবদূতরা’, ‘অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি’ এমনকি ‘ভিনগ্রহের প্রাণী’র মতো পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন। দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে বোঝাতে ‘ভিনগ্রহের প্রাণী’ নামটা জনপ্রিয় করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।
নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এনএর প্রার্থী ইকবাল সিরাজ এ বছরের নির্বাচনী প্রচারের সময় গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, দলের প্রতি আনুগত্য থেকে সরে আসার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাকে হুমকি দেওয়া হয় এবং তা না করায় তার গুদামে অভিযান চালানো হয়, তার লোকদের হেনস্তা করা হয়। অনুমান করা যায় ওই একই সংস্থার চাপের মুখে দুদিন পরই তিনি নিজের অবস্থান পাল্টে বলেন, কর-সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে ‘কৃষি বিভাগ’ তার গুদামে ওই অভিযান চালিয়েছিল। এরপর থেকেই নিরাপত্তা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থা বোঝাতে প্রায়ই ব্যঙ্গাত্মকভাবে ‘কৃষি বিভাগ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বলপ্রয়োগে গুম থেকে শুরু করে নির্বাচনী কারচুপিÑ সবক্ষেত্রেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো পাকিস্তানের এ নিপীড়নমূলক সামরিক নিয়ন্ত্রণ আর দৃশ্যত বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনে সব সীমারেখা ধোঁয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সরাসরি সামরিক শাসনের ‘এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না’র কঠোর বিধিনিষেধ কিংবা মুক্তভাবে মতপ্রকাশের সুরক্ষা দেওয়া ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রের কোনোটিই না থাকায়, কোন কথা গ্রহণযোগ্য আর কোন কথা গ্রহণযোগ্য নয়, তার সীমারেখা খুবই অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে।
এখন এটা আর অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে, ‘বৈদেশিক উপাদান’ বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক চিন্তা এবং কর্মকাণ্ডকে চালিত করছে। সম্পদের বণ্টন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অন্যান্য বিতর্ক এর আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য এই ‘বৈদেশিক উপাদান’ হলো অভিবাসী ইস্যু, ইউরোপে তা উদ্বাস্তু ইস্যু এবং মোদির ভারতে তা ‘মুসলিম’ এবং ‘ধর্র্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ইস্যু। ক্ষমতাসীনরা বলতে চায়, এরাই জাতিরাষ্ট্রের সমজাতীয়তাকে বিপন্ন করে তুলছে। এ সম্প্রদায়গুলোকে দেশের ভেতরই জাতির এক বিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত করা হয় এবং এদের কল্পিত জুজু বানিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো হয়। এভাবেই দ্রুত পতনশীল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য বস্তুগত অনিশ্চয়তা থেকে সবার চোখ সরিয়ে নিয়ে, শাসকরা মানুষের মনোযোগ স্থির করতে চায় এসব সম্প্রদায় বা উপাদানের ওপর। আর এরা সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে নিপীড়নের মারাত্মক সব ঘটনার শিকার হতে থাকে এবং ভেঙে পড়তে থাকা জাতীয়তাবাদের টিকে থাকার যৌক্তিকতা তৈরি করতে থাকে। আমরা দেখছি যে, জাতিরাষ্ট্র এখন যেসব হুমকির মধ্যে পড়েছে, সে নিজেই সেসব বোঝার এমনকি সংজ্ঞায়িত করার সংগ্রামে লিপ্ত। ‘পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধ’, ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’ বা ‘বৈদেশিক উপাদান’-এর মতো অভিধাগুলো এমন সংকট ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অক্ষম চেষ্টা, যা আমাদের রাজনৈতিক সংকটকে সত্যিকারের ভাষাগত সংকটে ফেলে দিয়েছে।
শেয়ার করুন
আম্মার আলী জান | ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

পাকিস্তানে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরা এখন এক বিপন্ন অবস্থায় আছেন। নিউ ইয়র্কভিত্তিক কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক কর্তৃপক্ষ ভয়ভীতি, হুমকি এমনকি বলপ্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য করছে। অক্টোবরে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা কমিয়ে আনা এবং নানা স্থানে টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সাংবাদিকরা। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের কট্টর সমালোচক বেশ কয়েকজন নামজাদা টিভি উপস্থাপককে বরখাস্তও করা হয়েছে এসব চাপের মুখে।
আমি নিজেও এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। এ মাসের শুরুতে চতুর্থ আন্তর্জাতিক ফায়েজ উৎসবে আরো তিন অধিকারকর্মীসহ আমাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। আয়োজকরা জানিয়েছেন, আমাদের বাদ না দেওয়া হলে নাকি উৎসবই বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ওপর মহল। সংগীত, শিল্প-সাহিত্য ও বিতর্কের তিন দিনব্যাপী এ স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এমন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে মঞ্চে একটি আসন খালি রেখেই আয়োজকরা ওই অনুষ্ঠান করেছেন। পরিহাস হলো, এ ঘটনা ঘটে পাকিস্তানের প্রখ্যাত সমাজবাদী কবি ফায়েজ আহমদ ফায়েজের স্মরণোৎসবে। যার কাজ আর পুরো জীবনই মাথা নত না করার শিক্ষা আর কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধাচরণের অনন্য দৃষ্টান্ত। নিয়তির এর চেয়ে নির্মমতা আর কী হতে পারত।
পাকিস্তানে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর এখন যে আক্রমণ চলছে, তার ভিত্তি দেশের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক ‘পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধ’ মোকাবিলা করা। এ ‘পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধ’ দেশটির শক্তিশালী নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের তত্ত্ববিশেষ। এর মধ্য দিয়ে তারা বলতে চায়, পাকিস্তানের শত্রুরা দেশের ভেতরে সক্রিয় এবং তারা নানাভাবে দেশের ‘টলায়মান’ তরুণ প্রজন্মের মনোজগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার এমন টালবাহানা যুগে যুগে দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে নানারূপে হাজির হয়। পাকিস্তানে এখন এটা ব্যবহার করা হচ্ছে মানবাধিকারকর্মী, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, সমালোচনামুখর সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কখনোই নিজের একটি একক রাজনৈতিক সত্তায় আত্মবিশ্বাসী হতে পারেনি। কেননা, নিজেদের জাতিগত বিভক্তি এবং ভূকৌশলগত অবস্থানকে সব সময়ই তারা জাতীয় সংহতির জন্য সম্ভাব্য হুমকি বলে মনে করে এসেছে। দেশটিতে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্কের মেঘ ঘনিয়ে আনা ‘নীরব সামরিক আইন’ এখন অনেকটাই আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ঢুকে গেছে। বেসামরিক সরকার এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশটিতে এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক চর্চা দেখা যাচ্ছে, যা একই সঙ্গে হাস্যরসাত্মক এবং করুণ। হাস্যরসের সৃষ্টি জনগণের ভীতির করুণ পরিস্থিতি থেকেই। সামরিক বাহিনীর সমালোচনার সময় সবাই সরাসরি তাদের নাম নিতে ভয় পায়। এই ভীতি থেকেই নানা রকম ছদ্মনাম আর নানা সাংকেতিক শব্দের ব্যবহার চালু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, লেখকরা দেশটির গোপন সংস্থার উল্লেখ করতে গিয়ে ‘ছেলেরা’, ‘দেবদূতরা’, ‘অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি’ এমনকি ‘ভিনগ্রহের প্রাণী’র মতো পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন। দেশের গোয়েন্দা সংস্থাকে বোঝাতে ‘ভিনগ্রহের প্রাণী’ নামটা জনপ্রিয় করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।
নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এনএর প্রার্থী ইকবাল সিরাজ এ বছরের নির্বাচনী প্রচারের সময় গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, দলের প্রতি আনুগত্য থেকে সরে আসার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাকে হুমকি দেওয়া হয় এবং তা না করায় তার গুদামে অভিযান চালানো হয়, তার লোকদের হেনস্তা করা হয়। অনুমান করা যায় ওই একই সংস্থার চাপের মুখে দুদিন পরই তিনি নিজের অবস্থান পাল্টে বলেন, কর-সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে ‘কৃষি বিভাগ’ তার গুদামে ওই অভিযান চালিয়েছিল। এরপর থেকেই নিরাপত্তা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থা বোঝাতে প্রায়ই ব্যঙ্গাত্মকভাবে ‘কৃষি বিভাগ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বলপ্রয়োগে গুম থেকে শুরু করে নির্বাচনী কারচুপিÑ সবক্ষেত্রেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো পাকিস্তানের এ নিপীড়নমূলক সামরিক নিয়ন্ত্রণ আর দৃশ্যত বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনে সব সীমারেখা ধোঁয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সরাসরি সামরিক শাসনের ‘এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না’র কঠোর বিধিনিষেধ কিংবা মুক্তভাবে মতপ্রকাশের সুরক্ষা দেওয়া ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রের কোনোটিই না থাকায়, কোন কথা গ্রহণযোগ্য আর কোন কথা গ্রহণযোগ্য নয়, তার সীমারেখা খুবই অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে।
এখন এটা আর অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে, ‘বৈদেশিক উপাদান’ বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক চিন্তা এবং কর্মকাণ্ডকে চালিত করছে। সম্পদের বণ্টন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অন্যান্য বিতর্ক এর আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য এই ‘বৈদেশিক উপাদান’ হলো অভিবাসী ইস্যু, ইউরোপে তা উদ্বাস্তু ইস্যু এবং মোদির ভারতে তা ‘মুসলিম’ এবং ‘ধর্র্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ইস্যু। ক্ষমতাসীনরা বলতে চায়, এরাই জাতিরাষ্ট্রের সমজাতীয়তাকে বিপন্ন করে তুলছে। এ সম্প্রদায়গুলোকে দেশের ভেতরই জাতির এক বিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত করা হয় এবং এদের কল্পিত জুজু বানিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো হয়। এভাবেই দ্রুত পতনশীল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য বস্তুগত অনিশ্চয়তা থেকে সবার চোখ সরিয়ে নিয়ে, শাসকরা মানুষের মনোযোগ স্থির করতে চায় এসব সম্প্রদায় বা উপাদানের ওপর। আর এরা সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে নিপীড়নের মারাত্মক সব ঘটনার শিকার হতে থাকে এবং ভেঙে পড়তে থাকা জাতীয়তাবাদের টিকে থাকার যৌক্তিকতা তৈরি করতে থাকে। আমরা দেখছি যে, জাতিরাষ্ট্র এখন যেসব হুমকির মধ্যে পড়েছে, সে নিজেই সেসব বোঝার এমনকি সংজ্ঞায়িত করার সংগ্রামে লিপ্ত। ‘পঞ্চম-প্রজন্মের যুদ্ধ’, ‘হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’ বা ‘বৈদেশিক উপাদান’-এর মতো অভিধাগুলো এমন সংকট ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অক্ষম চেষ্টা, যা আমাদের রাজনৈতিক সংকটকে সত্যিকারের ভাষাগত সংকটে ফেলে দিয়েছে।