পশ্চিমা স্বার্থের নির্মম বলি শিশুরা
পিটার কয়েনিগ | ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
জাতিসংঘ ঘোষিত এ বছরের বিশ্ব শিশু দিবসও নীরবে চলে গেছে কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। যে সব জাতি যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে সেখানকার শিশুদের রক্ষা করার জন্য সংস্থাটির বিশেষ পদক্ষেপের আহ্বান সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। শিশুরা আমাদের গ্রহের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তারপরও শিশুরা সবচেয়ে অরক্ষিত, বৈষম্যের শিকার এবং শোষিত ও নির্যাতিত প্রজাতি। লোভ এবং তাৎক্ষণিক মুনাফার সংস্কৃতিতে শিশুদের জন্য কোনো স্থান নেই। শিশুদের যেসব কাঠামোর মধ্যে বেড়ে ওঠা দরকার- যেমন মানবাধিকার, সুশিক্ষা, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যসেবা সেগুলোর কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের পশ্চিমা সমাজের কাছে শিশুরা আপদ হিসেবে বিবেচিত, বড়জোর সস্তা শ্রমের হাতিয়ার। বিশেষ করে পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা যখন এশিয়া এবং মধ্য আমেরিকার গরিব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া চালায় তখন শিশুরা ব্যবহৃত হয়। কেননা এসব দেশ এতই দরিদ্র যে তারা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কোনো আইন জারি করতে পারে না, বরং করপোরেট মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তিচালিত যুদ্ধযন্ত্র দুর্ভিক্ষ, বোমা, মহামারী ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শিশুদের হত্যা করছে। কিন্তু চাইলে এমনকি এসব যুদ্ধ থেকেও শিশুদের রক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞ ও দারিদ্র্য চক্রের মধ্য দিয়ে জাতিগুলোকে সমূলে উৎপাটন করার পেছনে পশ্চিমাদের একটি দমনের অভিপ্রায় আছে। তা হলো, এই শিশুরা যাতে শিক্ষিত ও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে এই জাতিগুলোকে যেন পুনর্গঠন করতে না পারে। ভবিষ্যতে যেন তারা তাদের ‘জল্লাদ’দের বিরোধিতা করতে না পারে, যারা তাদের বাড়িঘর এবং পরিবার, তাদের গ্রাম ও শহর, তাদের স্কুল এবং হাসপাতাল, তাদের পানীয় জলের ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, যারা তাদের কলেরার মহামারিতে আক্রান্ত করছে, যারা তাদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি এবং পয়ঃপ্রণালীর পরিচ্ছন্নতার অভাবে অন্যান্য রোগের শিকারে পরিণত করেছে। সুতরাং, সাম্রাজ্য এবং তাদের পুতুল মিত্রদের স্বার্থে শিশুদের চরম দুর্দশায় ফেলা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব ঘটনার অধিকাংশকেই কেউই তেমন আমলে নেয় না।
সিরিয়ার দিকে লক্ষ করুন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর প্ররোচনায় বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস আক্রমণ করা হচ্ছে, যার সঙ্গে তাদের প্রতিনিধি সৌদি আরব এবং আইএস জড়িত। তারা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ওপর এই দোষ চাপিয়ে আসল শত্রুদের আড়াল করতে চাইছে। এই আক্রমণ শিশুদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পশ্চিমা বাহিনী শিশুদের বিষপ্রয়োগে হত্যা করছে। তারা চাইছে আসাদের স্থলে তাদের পুতুল সরকার বসুক। শিশুরা এর বলি হচ্ছে। মানবতার বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের অপরাধ আরেকটি ভয়াবহ আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত করছে, জোর করে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে চাইছে। তারা বিগত ২০০০ বছর ধরে এই একই কাজ করে যাচ্ছে।
ইয়েমেনের পরিস্থিতির কথাই ধরুন। গত সাড়ে তিন বছর ধরে সেখানে সৌদি আরবের নেতৃত্বে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ চলছে। এর বৈদেশিক অর্থ জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর বড় অংশ, সম্প্রতি জার্মানিও এতে যুক্ত হয়েছে। শত শত, হাজার হাজার শিশুকে বোমা, খরা, পানীয় জলের অভাব এবং পয়ঃপ্রণালী ধ্বংসের মধ্য দিয়ে কলেরার মহামারি সৃষ্টি করে হত্যা করা হচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষে পাঁচ বছরের নিচের প্রায় ৮৫,০০০ শিশু মারা গেছে। সৌদি এবং এর গালফ মিত্ররা হুবায়াদা বন্দর অবরোধ করেছে, যেখান থেকে ৮০% থেকে ৯০% খাদ্য দেশটির ভেতরে ঢুকত। মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় শিকার হলো শিশু এবং নারীরা। এক বছর আগে জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছিল, ইয়েমেনে দ্রুত কলেরার মহামারি ছড়িয়ে পড়বে এবং এর ফলে অন্তত ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হবে, যার ছয় লাখই শিশু। এক বছর পর তাদের কতজন মারা গেছে সে সংখ্যাটি কি আমরা জানি? অতিরিক্ত খাদ্য সংকট, আশ্রয় এবং হাসপাতাল ধ্বংস, চিকিৎসার অভাব, বিশেষ করে ওষুধের ওপর অবরোধ শিশুদের প্রাকৃতিক নিরাপদ ব্যবস্থাগুলোকে ক্রমশ হ্রাস করছে।
পশ্চিমারা এই দুর্দশার জন্য দায়ী। এটা একটা বড় অপরাধ। এজন্য যেসব নেতা দায়ী তারা কখনো আদালতে বিচারের সম্মুখীন হবেন না, কেননা তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইনি ব্যবস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যদিও কোনো আইনই এই হত্যাযজ্ঞ এবং দুর্দশার সর্বোচ্চ বিচার করতে পারবে না, কিন্তু রাষ্ট্রগুলো একে বৈশ্বিক অপরাধ বলে গণ্য করতে পারে। লোভ এবং ক্ষমতার জন্য ইয়েমেন ও অন্যত্র যারা লড়ছে, তাদের কখনোই এই দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না। জাতিসংঘের উদ্ধাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক প্রতিবেদনে বলেছে, সারা বিশ্বে ৭ কোটি উদ্বাস্তু হয় ভবঘুরের মতো ঘুরছে, নয়তো উদ্ধাস্তু শিবিরে বাস করছে। এই প্রতিবেদনের বাইরেও একটি বড় অংশের কথা অজ্ঞাত, খুব সম্ভবত এই পরিসংখ্যানে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের উল্লেখ আছে। এর বড় অংশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, যেখানে পশ্চিমারা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধ লোভের, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য, ভূ-রাজনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে যাতে বিশ্ব আধিপত্য কায়েম করা করা যায়। এই যুদ্ধের শিকারদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। এরা অপুষ্ট, খরাক্রান্ত, ধর্ষিত, নির্যাতিত এবং দাসত্বের শিকার।
ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানের একটি পুরো প্রজন্ম হারিয়ে গেছে। দেশগুলোতে শিক্ষিত লোকের যথেষ্ট অভাব দেখা দিয়েছে। তারা জাতিকে পুনর্গঠন এবং উন্নত করার সার্বভৌম অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই এই দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ, দমন এবং দাসত্বের অধীন করা খুবই সহজ। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু স্কুলে যেতে পারে না। এই পরিসংখ্যানও পূর্ণাঙ্গ নয়, অপ্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সংখ্যা সম্ভবত এর দ্বিগুণ কিংবা তার চেয়েও বেশি। বিশেষ করে অনেক শিশুই রয়েছে যারা কেবলমাত্র অনিয়মিত বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। অনেক শিশুই অপহৃত হয়, দাসত্ব এবং পতিতাবৃত্তির জন্য তাদের বিক্রি করা হয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরীক্ষার জন্য তাদের বন্দি করা হয়, কিছু মাফিয়া সংগঠন তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসা করে। ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে গাজা নামক উন্মুক্ত কারাগার এবং নির্মূল শিবিরে হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। ইউক্রেনের কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে শুধুমাত্র গাজাতেই ৬০ ভাগ শিশুর অঙ্গহানি ঘটেছে।
যুক্তরাজ্যে প্রতি চারজন শিশুর একজন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬ কোটি শিশু প্রতি রাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। আমি যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন ট্রাম্পের পবিত্র ভূমি মহান যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সে দেশের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে উদ্বাস্তু শিশু এবং তাদের মায়েদের দিকে টিয়ারগ্যাস কামান থেকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করছে। ২০০১ সালের নোবেলজয়ী জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান আলেপ্পো দখলের সময় যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়ে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, আলেপ্পোতে হামলা মানে সারা বিশ্বে হামলা। যখন হাসপাতাল, স্কুল এবং ঘর-বাড়িতে বোমাবর্ষণ চলছে, শত শত নিরপরাধ শিশুকে হত্য করা হচ্ছে, এই ঘটনাগুলো আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে নাড়া দিচ্ছে। আমাদের সম্মিলিত ক্রন্দন যেন তাদের কানে পৌঁছায়, যারা এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে লিপ্ত। এই যখন সারা বিশ্বের অবস্থা তখন শিশুরা কোথায় যাবে?
শেয়ার করুন
পিটার কয়েনিগ | ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

জাতিসংঘ ঘোষিত এ বছরের বিশ্ব শিশু দিবসও নীরবে চলে গেছে কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। যে সব জাতি যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে সেখানকার শিশুদের রক্ষা করার জন্য সংস্থাটির বিশেষ পদক্ষেপের আহ্বান সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। শিশুরা আমাদের গ্রহের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তারপরও শিশুরা সবচেয়ে অরক্ষিত, বৈষম্যের শিকার এবং শোষিত ও নির্যাতিত প্রজাতি। লোভ এবং তাৎক্ষণিক মুনাফার সংস্কৃতিতে শিশুদের জন্য কোনো স্থান নেই। শিশুদের যেসব কাঠামোর মধ্যে বেড়ে ওঠা দরকার- যেমন মানবাধিকার, সুশিক্ষা, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যসেবা সেগুলোর কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের পশ্চিমা সমাজের কাছে শিশুরা আপদ হিসেবে বিবেচিত, বড়জোর সস্তা শ্রমের হাতিয়ার। বিশেষ করে পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা যখন এশিয়া এবং মধ্য আমেরিকার গরিব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া চালায় তখন শিশুরা ব্যবহৃত হয়। কেননা এসব দেশ এতই দরিদ্র যে তারা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কোনো আইন জারি করতে পারে না, বরং করপোরেট মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তিচালিত যুদ্ধযন্ত্র দুর্ভিক্ষ, বোমা, মহামারী ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শিশুদের হত্যা করছে। কিন্তু চাইলে এমনকি এসব যুদ্ধ থেকেও শিশুদের রক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞ ও দারিদ্র্য চক্রের মধ্য দিয়ে জাতিগুলোকে সমূলে উৎপাটন করার পেছনে পশ্চিমাদের একটি দমনের অভিপ্রায় আছে। তা হলো, এই শিশুরা যাতে শিক্ষিত ও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে এই জাতিগুলোকে যেন পুনর্গঠন করতে না পারে। ভবিষ্যতে যেন তারা তাদের ‘জল্লাদ’দের বিরোধিতা করতে না পারে, যারা তাদের বাড়িঘর এবং পরিবার, তাদের গ্রাম ও শহর, তাদের স্কুল এবং হাসপাতাল, তাদের পানীয় জলের ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, যারা তাদের কলেরার মহামারিতে আক্রান্ত করছে, যারা তাদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি এবং পয়ঃপ্রণালীর পরিচ্ছন্নতার অভাবে অন্যান্য রোগের শিকারে পরিণত করেছে। সুতরাং, সাম্রাজ্য এবং তাদের পুতুল মিত্রদের স্বার্থে শিশুদের চরম দুর্দশায় ফেলা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব ঘটনার অধিকাংশকেই কেউই তেমন আমলে নেয় না।
সিরিয়ার দিকে লক্ষ করুন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর প্ররোচনায় বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস আক্রমণ করা হচ্ছে, যার সঙ্গে তাদের প্রতিনিধি সৌদি আরব এবং আইএস জড়িত। তারা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ওপর এই দোষ চাপিয়ে আসল শত্রুদের আড়াল করতে চাইছে। এই আক্রমণ শিশুদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পশ্চিমা বাহিনী শিশুদের বিষপ্রয়োগে হত্যা করছে। তারা চাইছে আসাদের স্থলে তাদের পুতুল সরকার বসুক। শিশুরা এর বলি হচ্ছে। মানবতার বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের অপরাধ আরেকটি ভয়াবহ আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত করছে, জোর করে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে চাইছে। তারা বিগত ২০০০ বছর ধরে এই একই কাজ করে যাচ্ছে।
ইয়েমেনের পরিস্থিতির কথাই ধরুন। গত সাড়ে তিন বছর ধরে সেখানে সৌদি আরবের নেতৃত্বে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ চলছে। এর বৈদেশিক অর্থ জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর বড় অংশ, সম্প্রতি জার্মানিও এতে যুক্ত হয়েছে। শত শত, হাজার হাজার শিশুকে বোমা, খরা, পানীয় জলের অভাব এবং পয়ঃপ্রণালী ধ্বংসের মধ্য দিয়ে কলেরার মহামারি সৃষ্টি করে হত্যা করা হচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষে পাঁচ বছরের নিচের প্রায় ৮৫,০০০ শিশু মারা গেছে। সৌদি এবং এর গালফ মিত্ররা হুবায়াদা বন্দর অবরোধ করেছে, যেখান থেকে ৮০% থেকে ৯০% খাদ্য দেশটির ভেতরে ঢুকত। মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় শিকার হলো শিশু এবং নারীরা। এক বছর আগে জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছিল, ইয়েমেনে দ্রুত কলেরার মহামারি ছড়িয়ে পড়বে এবং এর ফলে অন্তত ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হবে, যার ছয় লাখই শিশু। এক বছর পর তাদের কতজন মারা গেছে সে সংখ্যাটি কি আমরা জানি? অতিরিক্ত খাদ্য সংকট, আশ্রয় এবং হাসপাতাল ধ্বংস, চিকিৎসার অভাব, বিশেষ করে ওষুধের ওপর অবরোধ শিশুদের প্রাকৃতিক নিরাপদ ব্যবস্থাগুলোকে ক্রমশ হ্রাস করছে।
পশ্চিমারা এই দুর্দশার জন্য দায়ী। এটা একটা বড় অপরাধ। এজন্য যেসব নেতা দায়ী তারা কখনো আদালতে বিচারের সম্মুখীন হবেন না, কেননা তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইনি ব্যবস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যদিও কোনো আইনই এই হত্যাযজ্ঞ এবং দুর্দশার সর্বোচ্চ বিচার করতে পারবে না, কিন্তু রাষ্ট্রগুলো একে বৈশ্বিক অপরাধ বলে গণ্য করতে পারে। লোভ এবং ক্ষমতার জন্য ইয়েমেন ও অন্যত্র যারা লড়ছে, তাদের কখনোই এই দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না। জাতিসংঘের উদ্ধাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক প্রতিবেদনে বলেছে, সারা বিশ্বে ৭ কোটি উদ্বাস্তু হয় ভবঘুরের মতো ঘুরছে, নয়তো উদ্ধাস্তু শিবিরে বাস করছে। এই প্রতিবেদনের বাইরেও একটি বড় অংশের কথা অজ্ঞাত, খুব সম্ভবত এই পরিসংখ্যানে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের উল্লেখ আছে। এর বড় অংশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে, যেখানে পশ্চিমারা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এই যুদ্ধ লোভের, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য, ভূ-রাজনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে যাতে বিশ্ব আধিপত্য কায়েম করা করা যায়। এই যুদ্ধের শিকারদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। এরা অপুষ্ট, খরাক্রান্ত, ধর্ষিত, নির্যাতিত এবং দাসত্বের শিকার।
ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানের একটি পুরো প্রজন্ম হারিয়ে গেছে। দেশগুলোতে শিক্ষিত লোকের যথেষ্ট অভাব দেখা দিয়েছে। তারা জাতিকে পুনর্গঠন এবং উন্নত করার সার্বভৌম অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই এই দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ, দমন এবং দাসত্বের অধীন করা খুবই সহজ। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু স্কুলে যেতে পারে না। এই পরিসংখ্যানও পূর্ণাঙ্গ নয়, অপ্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সংখ্যা সম্ভবত এর দ্বিগুণ কিংবা তার চেয়েও বেশি। বিশেষ করে অনেক শিশুই রয়েছে যারা কেবলমাত্র অনিয়মিত বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। অনেক শিশুই অপহৃত হয়, দাসত্ব এবং পতিতাবৃত্তির জন্য তাদের বিক্রি করা হয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরীক্ষার জন্য তাদের বন্দি করা হয়, কিছু মাফিয়া সংগঠন তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসা করে। ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে গাজা নামক উন্মুক্ত কারাগার এবং নির্মূল শিবিরে হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। ইউক্রেনের কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে শুধুমাত্র গাজাতেই ৬০ ভাগ শিশুর অঙ্গহানি ঘটেছে।
যুক্তরাজ্যে প্রতি চারজন শিশুর একজন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬ কোটি শিশু প্রতি রাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। আমি যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন ট্রাম্পের পবিত্র ভূমি মহান যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সে দেশের পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে উদ্বাস্তু শিশু এবং তাদের মায়েদের দিকে টিয়ারগ্যাস কামান থেকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করছে। ২০০১ সালের নোবেলজয়ী জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান আলেপ্পো দখলের সময় যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়ে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, আলেপ্পোতে হামলা মানে সারা বিশ্বে হামলা। যখন হাসপাতাল, স্কুল এবং ঘর-বাড়িতে বোমাবর্ষণ চলছে, শত শত নিরপরাধ শিশুকে হত্য করা হচ্ছে, এই ঘটনাগুলো আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে নাড়া দিচ্ছে। আমাদের সম্মিলিত ক্রন্দন যেন তাদের কানে পৌঁছায়, যারা এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে লিপ্ত। এই যখন সারা বিশ্বের অবস্থা তখন শিশুরা কোথায় যাবে?