নির্বাচনের প্রাক্কালে জনস্বার্থের দাবি
আনু মুহাম্মদ
| ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
দেশে সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচন কতটা অর্থবহ এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হবে তা অনেকটা নির্ভর করে জনগণের ভেতর থেকে তার স্বার্থের প্রশ্ন কতটা জোরদারভাবে উত্থাপিত হচ্ছে তার ওপর। জনগণ সক্রিয় থাকলে নির্বাচন জনগণের হাতে থাকবে, জনগণ প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে, জনস্বার্থকে কেন্দ্রে রেখে প্রকৃত উন্নয়ন পথ গ্রহণ করার মতো রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটবে। এর জন্য প্রয়োজন জনস্বার্থের বিষয়গুলো রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসা, উন্নয়ন দর্শনকে নতুনভাবে হাজির করা। নির্বাচনের প্রাক্কালে বর্তমান সরকার ও সকল রাজনৈতিক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ‘তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ এ রকম কয়েকটি জনস্বার্থসংক্রান্ত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয় জনগণের সামনে হাজির করেছে। সংক্ষেপে বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা হলো :
সুন্দরবন বিনাশী সকল প্রকল্প
গত আট বছরে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প কীভাবে বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর রকম সর্বনাশা তার অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমরা সরকারের কাছে হাজির করেছি। বাংলাদেশের জন্য, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোটি কোটি মানুষের জন্য, সুন্দরবন একটি জীবন-মরণ প্রশ্ন। সবাই জানেন যে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন পরিবেশগত দিক থেকে, প্রাণবৈচিত্র্যের দিক থেকে অতুলনীয়, সে জন্য এটি ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব-ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত। শুধুু তাই নয়, এই বন বাংলাদেশের জন্য অসাধারণ একটি প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। উপকূলের কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা সম্পদ সুন্দরবনের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এরকম অতুলনীয় সম্পদ হেলায়, লোভে, দায়িত্বহীনতা দিয়ে ধ্বংস করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এই কেন্দ্রের কারণে প্রলুব্ধ হয়ে দেশের বনগ্রাসী, ভূমিগ্রাসী কতিপয় গোষ্ঠী তিন শতাধিক বাণিজ্যিক প্রকল্প নিয়ে সুন্দরবন ঘিরে ফেলেছে। এভাবে সুন্দরবনের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ, প্রবাসী বাংলাদেশিসহ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা শক্ত মত দিয়েছেন। রামপাল প্রকল্পসহ সুন্দরবন-বিনাশী সকল তৎপরতা বন্ধের দাবিতে আট বছর ধরে আমরা গবেষণা, প্রকাশনা, আলোচনা, মিছিল, গান, নাটক, সমাবেশ, হরতাল, মহাসমাবেশ, উপকূলীয় সমাবেশ, লংমার্চ, বৈশ্বিক প্রতিবাদ, বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি।
কিন্তু গত কয়েক বছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, উন্মুক্ত কয়লাখনি, এলএনজি এবং এলপিজির লবিস্ট, কোম্পানির স্বার্থে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মন্ত্রণালয় এখন তাদেরই দখলে। সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প তাই এখনো বাতিল হয়নি, উপরন্তু কোনো প্রকার পরিবেশ সমীক্ষা না করে দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে উপকূল রক্ষাকারী বন বিনাশ করে মহেশখালী, বরগুনা ও পটুয়াখালীতেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। সুন্দরবনের ঘাড়ের ওপর বসানো হচ্ছে এলএনজি প্ল্যান্ট।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় কমিটি সরকারের কাছে বারবার রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সুন্দরবন-বিনাশী সকল বাণিজ্যিক তৎপরতা বন্ধ করবার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে কমিটি সকল রাজনৈতিক দলের কাছে সুন্দরবন রক্ষায় রামপালসহ বিভিন্ন বিষাক্ত প্রকল্প বন্ধের দাবিকে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে অন্তর্ভুক্ত করবার আহ্বান জানিয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প
রূপপুরে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে, একে অভিহিত করা হচ্ছে ‘জাতীয় গৌরব’ হিসেবে। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি ও বিপদের যে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো ঘন জনবসতি, পানি ও আবাদিজমির ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল একটি দেশে এই ঝুঁকি বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি।
তারপরও এই প্রকল্পের কোনো পরিবেশ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়নি, প্রত্যক্ষ ঝুঁকির মধ্যে বসবাসরত প্রায় এক কোটি মানুষের কাছে এর সমস্যা, বিপদ ও ঝুঁকির কথা গোপন রাখা হয়েছে, বদলে একটানা উন্নয়নের অতিরঞ্জিত প্রচার চালানো হচ্ছে। এলাকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, সংবাদ সম্মেলন, সভা-সমিতি করার ব্যাপারে জারি করা হয়েছে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। স্বাধীন মতামত প্রকাশের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা যেসব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেগুলোর কোনো সদুত্তর দেওয়া হয়নি। পারমাণবিক বর্জ্যসহ বিভিন্ন ঝুঁকির বিষয় অনিষ্পন্ন রাখা হয়েছে।
এই ২৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় তিন বছরের ব্যবধানে ৩২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে এক লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর জন্য বিপুল ঋণের ভার বহন করতে হবে বাংলাদেশকে। আগামী কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা খরচ এবং সুদসমেত ঋণ পরিশোধের খরচ মিলিয়ে এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ হবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ডিকমিশনিং-এর জন্যও আছে বিশাল খরচ, সেই সঙ্গে আছে ক্রমাগত শুকিয়ে যেতে থাকা পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাগত ঝুঁকি। অর্থাৎ যে কোনো সময়ে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঝুঁকির প্রশ্ন বাদ দিলেও শুধু অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নিলেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় কমিটি রূপপুর প্রকল্পের ব্যয়, পরিবেশ সমীক্ষা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের শে^তপত্র দাবি করেছে। এসব বিষয় সন্তোষজনকভাবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে সকল রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
নদী, সড়ক, রেলপথ ও সমুদ্রবন্দর
সরকার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে জনগণকে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের চাপ নিতে ব্যতিব্যস্ত এই বন্দরগুলো ভারতকে কী শর্তে ও কী সুবিধার বিনিময়ে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে, ব্যবস্থাপনা অগ্রাধিকার কী হবে সে বিষয়ে সবকিছু অস্বচ্ছ রেখে নেওয়া এসব উদ্যোগকে আমরা বিপজ্জনক মনে করি। বন্দর, নদী, সড়ক, রেলপথ ব্যবহারে আন্তর্জাতিক চুক্তি অবশ্যই স্বচ্ছ ও জাতীয় স্বার্থের অনুকূল যাতে হয় সে বিষয়ে নিশ্চয়তার দাবি করেছে জাতীয় কমিটি।
দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি প্রসঙ্গে
দুটো দায়মুক্তি আইন বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে রাহুর মতো চেপে আছে। এর একটি ২০১০ সালে প্রথমে চার বছরের জন্য বহাল করা হয়, এরপর তার মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে গৃহীত সকল প্রকল্প দরপত্র ছাড়া, বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে বাস্তবায়ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক আদালতের দারস্থ হতে পারবে না। এই দায়মুক্তি আইনের জোরেই কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া একের পর এক অসম্ভব ব্যয়বহুল ক্ষতিকর প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।
আরেকটি দায়মুক্তি আইন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জারি করা হয়েছে ২০১৫ সালে। এই আইন অনুযায়ী এই প্রকল্পে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয় তার দায় কোম্পানি বা কোনো কর্মকর্তা গ্রহণ করবেন না। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, জনস্বার্থ নিশ্চিত করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে দায়মুক্তি আইনের কোনো প্রয়োজন হয় না। সকল তথ্য ও প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের দায়মুক্তি আইন প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দুর্নীতি, অনিয়ম ও টাকা পাচারের মতো অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্যই করা হয়েছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি তাই মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে পরিবেশদূষণ, চোরাই টাকার বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি এ খাতের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিত। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, তিতাস গ্যাস, মাগুরছড়া-টেংরাটিলা ক্ষতিপূরণ অনাদায়ী রাখা, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল, নাইকো নিয়ে দুর্নীতি এর কিছু কিছু আভাস দেয়। জাতীয় সক্ষমতা বিপর্যস্ত করে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পথ কণ্টকিত করে এলপিজি ও এলএনজির ব্যবসা তৈরি এই দুর্নীতিমূলক তৎপরতারই অংশ বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
দুর্নীতি ও ভুলনীতির কারণেই বারবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পথ গ্রহণ করা হচ্ছে। সে জন্য এই খাত নিয়ে বিশেষ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের যথাযথ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। সরকার এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করলে জাতীয় কমিটি নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জ্বালানি অপরাধীদের বিরুদ্ধে গণ-আদালত গঠন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
জাতীয় কমিটি নির্বাচনের তফসিলের আগে এসব দায়মুক্তি আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে এবং সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তাদের ইশতেহারে দায়মুক্তি আইন বাতিল করে সর্বজনের সম্পদ ব্যবহারে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার দাবি যুক্ত করার।
ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া
ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার বাধ্য হয়েছিল জনগণের সঙ্গে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) বহিষ্কার ও উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধসহ ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ স্বাক্ষর করতে। সেই চুক্তির প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকার প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ দুই দফায় ১০ বছর এই সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধ করার কথা থাকলেও আবার বড়পুকুরিয়া ধরে উন্মুক্ত খনির ষড়যন্ত্র চলছে। বেআইনি হলেও কোম্পানি ফুলবাড়ী কয়লাখনি দেখিয়ে লন্ডনে শেয়ারবাজারে বছরের পর বছর ব্যবসা করে যাচ্ছে। আর পুরো এলাকায় লুটেরাদের প্রবেশ সম্ভব করতে ফুলবাড়ী আন্দোলনের নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।
জাতীয় কমিটি নির্বাচনের আগেই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে এবং সব দলকে অবিলম্বে ফুলবাড়ী চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের উৎকৃষ্ট ও নিরাপদ পথবাংলাদেশের যৌক্তিক বিদ্যুৎ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, এই চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। দেশের সকল মানুষ, শিল্প-কারখানা, শিক্ষা, চিকিৎসাকেন্দ্র যাতে ২৪ ঘণ্টা সুলভে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পায় তার জন্য আমরা চাই প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ। সরকার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের কথা বলেই পিএসএমপি ২০১৬-এর অধীনে একের পর এক ব্যয়বহুল, পরিবেশ বিধ্বংসী, ঋণনির্ভর, বিদেশি কোম্পানিনির্ভর নানা প্রকল্প গ্রহণ করছে। কিন্তু জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশ ধ্বংস অপরিহার্য নয়, এর জন্য অনেক নিরাপদ পরিবেশবান্ধব ভালো পথ আছে। এ বিষয়ে কয়েক বছরের গবেষণার মধ্য দিয়ে জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে তার একটি খসড়া প্রস্তাবনা আমরা হাজির করেছি গত বছরের জুলাই মাসে। দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা, ভারত-চীনসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা, বৈশ্বিক পর্যায়ে বিভিন্ন গবেষণা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পর্যালোচনা করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালীর মতো কোনো সর্বনাশা পথের দরকার নেই, দরকার নেই ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি কিংবা ঋণ নির্ভরতা। বরং এর জন্য দরকার পিএসএমপি ২০১৬ বাতিল করে জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত বিকল্প খসড়া মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় সক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ এবং জনগণের মালিকানার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া।
তাই জাতীয় কমিটি দাবি করেছে রামপাল-রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ পিএসএমপি-২০১৬-তে বর্ণিত ব্যয়বহুল, আমদানি ও ঋণনির্ভর, প্রাণ-প্রকৃতিবিনাশী বিদ্যুৎকেন্দ্রমুখী পরিকল্পনা বাতিল করে সুলভ, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জাতীয় কমিটির বিকল্প খসড়া প্রস্তাবনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে। নির্বাচনী ইশতেহার, অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি ও বিতর্কের মধ্যে এই দাবি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সব দলের কাছে জাতীয় কমিটি আহ্বান জানিয়েছে। বলাই বাহুল্য, জনস্বার্থের এসব দাবি বড় দলগুলোর অঙ্গীকারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু এসব দাবি যদি মানুষ একটি শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তা রাজনীতির মধ্যেও গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
লেখক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, লেখক ও কলামনিস্ট
শেয়ার করুন
আনু মুহাম্মদ
| ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

দেশে সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচন কতটা অর্থবহ এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হবে তা অনেকটা নির্ভর করে জনগণের ভেতর থেকে তার স্বার্থের প্রশ্ন কতটা জোরদারভাবে উত্থাপিত হচ্ছে তার ওপর। জনগণ সক্রিয় থাকলে নির্বাচন জনগণের হাতে থাকবে, জনগণ প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে, জনস্বার্থকে কেন্দ্রে রেখে প্রকৃত উন্নয়ন পথ গ্রহণ করার মতো রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটবে। এর জন্য প্রয়োজন জনস্বার্থের বিষয়গুলো রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসা, উন্নয়ন দর্শনকে নতুনভাবে হাজির করা। নির্বাচনের প্রাক্কালে বর্তমান সরকার ও সকল রাজনৈতিক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ‘তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ এ রকম কয়েকটি জনস্বার্থসংক্রান্ত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয় জনগণের সামনে হাজির করেছে। সংক্ষেপে বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা হলো :
সুন্দরবন বিনাশী সকল প্রকল্প গত আট বছরে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প কীভাবে বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর রকম সর্বনাশা তার অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমরা সরকারের কাছে হাজির করেছি। বাংলাদেশের জন্য, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোটি কোটি মানুষের জন্য, সুন্দরবন একটি জীবন-মরণ প্রশ্ন। সবাই জানেন যে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন পরিবেশগত দিক থেকে, প্রাণবৈচিত্র্যের দিক থেকে অতুলনীয়, সে জন্য এটি ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব-ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত। শুধুু তাই নয়, এই বন বাংলাদেশের জন্য অসাধারণ একটি প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। উপকূলের কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা সম্পদ সুন্দরবনের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এরকম অতুলনীয় সম্পদ হেলায়, লোভে, দায়িত্বহীনতা দিয়ে ধ্বংস করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এই কেন্দ্রের কারণে প্রলুব্ধ হয়ে দেশের বনগ্রাসী, ভূমিগ্রাসী কতিপয় গোষ্ঠী তিন শতাধিক বাণিজ্যিক প্রকল্প নিয়ে সুন্দরবন ঘিরে ফেলেছে। এভাবে সুন্দরবনের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ, প্রবাসী বাংলাদেশিসহ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা শক্ত মত দিয়েছেন। রামপাল প্রকল্পসহ সুন্দরবন-বিনাশী সকল তৎপরতা বন্ধের দাবিতে আট বছর ধরে আমরা গবেষণা, প্রকাশনা, আলোচনা, মিছিল, গান, নাটক, সমাবেশ, হরতাল, মহাসমাবেশ, উপকূলীয় সমাবেশ, লংমার্চ, বৈশ্বিক প্রতিবাদ, বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি।
কিন্তু গত কয়েক বছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, উন্মুক্ত কয়লাখনি, এলএনজি এবং এলপিজির লবিস্ট, কোম্পানির স্বার্থে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মন্ত্রণালয় এখন তাদেরই দখলে। সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প তাই এখনো বাতিল হয়নি, উপরন্তু কোনো প্রকার পরিবেশ সমীক্ষা না করে দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে উপকূল রক্ষাকারী বন বিনাশ করে মহেশখালী, বরগুনা ও পটুয়াখালীতেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। সুন্দরবনের ঘাড়ের ওপর বসানো হচ্ছে এলএনজি প্ল্যান্ট।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় কমিটি সরকারের কাছে বারবার রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সুন্দরবন-বিনাশী সকল বাণিজ্যিক তৎপরতা বন্ধ করবার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে কমিটি সকল রাজনৈতিক দলের কাছে সুন্দরবন রক্ষায় রামপালসহ বিভিন্ন বিষাক্ত প্রকল্প বন্ধের দাবিকে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে অন্তর্ভুক্ত করবার আহ্বান জানিয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প রূপপুরে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে, একে অভিহিত করা হচ্ছে ‘জাতীয় গৌরব’ হিসেবে। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি ও বিপদের যে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো ঘন জনবসতি, পানি ও আবাদিজমির ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল একটি দেশে এই ঝুঁকি বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। তারপরও এই প্রকল্পের কোনো পরিবেশ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়নি, প্রত্যক্ষ ঝুঁকির মধ্যে বসবাসরত প্রায় এক কোটি মানুষের কাছে এর সমস্যা, বিপদ ও ঝুঁকির কথা গোপন রাখা হয়েছে, বদলে একটানা উন্নয়নের অতিরঞ্জিত প্রচার চালানো হচ্ছে। এলাকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, সংবাদ সম্মেলন, সভা-সমিতি করার ব্যাপারে জারি করা হয়েছে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। স্বাধীন মতামত প্রকাশের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা যেসব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেগুলোর কোনো সদুত্তর দেওয়া হয়নি। পারমাণবিক বর্জ্যসহ বিভিন্ন ঝুঁকির বিষয় অনিষ্পন্ন রাখা হয়েছে।
এই ২৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় তিন বছরের ব্যবধানে ৩২ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে এক লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর জন্য বিপুল ঋণের ভার বহন করতে হবে বাংলাদেশকে। আগামী কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা খরচ এবং সুদসমেত ঋণ পরিশোধের খরচ মিলিয়ে এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ হবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ডিকমিশনিং-এর জন্যও আছে বিশাল খরচ, সেই সঙ্গে আছে ক্রমাগত শুকিয়ে যেতে থাকা পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাগত ঝুঁকি। অর্থাৎ যে কোনো সময়ে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঝুঁকির প্রশ্ন বাদ দিলেও শুধু অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নিলেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় কমিটি রূপপুর প্রকল্পের ব্যয়, পরিবেশ সমীক্ষা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের শে^তপত্র দাবি করেছে। এসব বিষয় সন্তোষজনকভাবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে সকল রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
নদী, সড়ক, রেলপথ ও সমুদ্রবন্দর সরকার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে জনগণকে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের চাপ নিতে ব্যতিব্যস্ত এই বন্দরগুলো ভারতকে কী শর্তে ও কী সুবিধার বিনিময়ে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে, ব্যবস্থাপনা অগ্রাধিকার কী হবে সে বিষয়ে সবকিছু অস্বচ্ছ রেখে নেওয়া এসব উদ্যোগকে আমরা বিপজ্জনক মনে করি। বন্দর, নদী, সড়ক, রেলপথ ব্যবহারে আন্তর্জাতিক চুক্তি অবশ্যই স্বচ্ছ ও জাতীয় স্বার্থের অনুকূল যাতে হয় সে বিষয়ে নিশ্চয়তার দাবি করেছে জাতীয় কমিটি।
দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তি প্রসঙ্গে দুটো দায়মুক্তি আইন বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে রাহুর মতো চেপে আছে। এর একটি ২০১০ সালে প্রথমে চার বছরের জন্য বহাল করা হয়, এরপর তার মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে গৃহীত সকল প্রকল্প দরপত্র ছাড়া, বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়ে বাস্তবায়ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক আদালতের দারস্থ হতে পারবে না। এই দায়মুক্তি আইনের জোরেই কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া একের পর এক অসম্ভব ব্যয়বহুল ক্ষতিকর প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।
আরেকটি দায়মুক্তি আইন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জারি করা হয়েছে ২০১৫ সালে। এই আইন অনুযায়ী এই প্রকল্পে যদি কোনো দুর্ঘটনা হয় তার দায় কোম্পানি বা কোনো কর্মকর্তা গ্রহণ করবেন না। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, জনস্বার্থ নিশ্চিত করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে দায়মুক্তি আইনের কোনো প্রয়োজন হয় না। সকল তথ্য ও প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের দায়মুক্তি আইন প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দুর্নীতি, অনিয়ম ও টাকা পাচারের মতো অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার জন্যই করা হয়েছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি তাই মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে পরিবেশদূষণ, চোরাই টাকার বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি এ খাতের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিত। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, তিতাস গ্যাস, মাগুরছড়া-টেংরাটিলা ক্ষতিপূরণ অনাদায়ী রাখা, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল, নাইকো নিয়ে দুর্নীতি এর কিছু কিছু আভাস দেয়। জাতীয় সক্ষমতা বিপর্যস্ত করে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পথ কণ্টকিত করে এলপিজি ও এলএনজির ব্যবসা তৈরি এই দুর্নীতিমূলক তৎপরতারই অংশ বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
দুর্নীতি ও ভুলনীতির কারণেই বারবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পথ গ্রহণ করা হচ্ছে। সে জন্য এই খাত নিয়ে বিশেষ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের যথাযথ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। সরকার এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করলে জাতীয় কমিটি নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জ্বালানি অপরাধীদের বিরুদ্ধে গণ-আদালত গঠন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
জাতীয় কমিটি নির্বাচনের তফসিলের আগে এসব দায়মুক্তি আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে এবং সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তাদের ইশতেহারে দায়মুক্তি আইন বাতিল করে সর্বজনের সম্পদ ব্যবহারে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার দাবি যুক্ত করার।
ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০০৬ সালের ৩০ আগস্ট তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার বাধ্য হয়েছিল জনগণের সঙ্গে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) বহিষ্কার ও উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধসহ ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ স্বাক্ষর করতে। সেই চুক্তির প্রতি পূর্ণ অঙ্গীকার প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ দুই দফায় ১০ বছর এই সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধ করার কথা থাকলেও আবার বড়পুকুরিয়া ধরে উন্মুক্ত খনির ষড়যন্ত্র চলছে। বেআইনি হলেও কোম্পানি ফুলবাড়ী কয়লাখনি দেখিয়ে লন্ডনে শেয়ারবাজারে বছরের পর বছর ব্যবসা করে যাচ্ছে। আর পুরো এলাকায় লুটেরাদের প্রবেশ সম্ভব করতে ফুলবাড়ী আন্দোলনের নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।
জাতীয় কমিটি নির্বাচনের আগেই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে এবং সব দলকে অবিলম্বে ফুলবাড়ী চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের উৎকৃষ্ট ও নিরাপদ পথবাংলাদেশের যৌক্তিক বিদ্যুৎ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, এই চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। দেশের সকল মানুষ, শিল্প-কারখানা, শিক্ষা, চিকিৎসাকেন্দ্র যাতে ২৪ ঘণ্টা সুলভে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ পায় তার জন্য আমরা চাই প্রয়োজনীয় নীতিমালা গ্রহণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ। সরকার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের কথা বলেই পিএসএমপি ২০১৬-এর অধীনে একের পর এক ব্যয়বহুল, পরিবেশ বিধ্বংসী, ঋণনির্ভর, বিদেশি কোম্পানিনির্ভর নানা প্রকল্প গ্রহণ করছে। কিন্তু জ¦ালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য দেশ ধ্বংস অপরিহার্য নয়, এর জন্য অনেক নিরাপদ পরিবেশবান্ধব ভালো পথ আছে। এ বিষয়ে কয়েক বছরের গবেষণার মধ্য দিয়ে জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে তার একটি খসড়া প্রস্তাবনা আমরা হাজির করেছি গত বছরের জুলাই মাসে। দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা, ভারত-চীনসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা, বৈশ্বিক পর্যায়ে বিভিন্ন গবেষণা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি পর্যালোচনা করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালীর মতো কোনো সর্বনাশা পথের দরকার নেই, দরকার নেই ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি কিংবা ঋণ নির্ভরতা। বরং এর জন্য দরকার পিএসএমপি ২০১৬ বাতিল করে জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত বিকল্প খসড়া মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় সক্ষমতা, জাতীয় স্বার্থ, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ এবং জনগণের মালিকানার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া।
তাই জাতীয় কমিটি দাবি করেছে রামপাল-রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ পিএসএমপি-২০১৬-তে বর্ণিত ব্যয়বহুল, আমদানি ও ঋণনির্ভর, প্রাণ-প্রকৃতিবিনাশী বিদ্যুৎকেন্দ্রমুখী পরিকল্পনা বাতিল করে সুলভ, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জাতীয় কমিটির বিকল্প খসড়া প্রস্তাবনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে। নির্বাচনী ইশতেহার, অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি ও বিতর্কের মধ্যে এই দাবি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সব দলের কাছে জাতীয় কমিটি আহ্বান জানিয়েছে। বলাই বাহুল্য, জনস্বার্থের এসব দাবি বড় দলগুলোর অঙ্গীকারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু এসব দাবি যদি মানুষ একটি শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তা রাজনীতির মধ্যেও গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
লেখক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, লেখক ও কলামনিস্ট