দেশের স্বার্থে ভোট প্রদান করুন
মোহাম্মদ আলী শিকদার | ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
আর মাত্র দুই দিন পরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটগ্রহণ করা হবে। এবার ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন প্রায় সাড়ে দশ কোটি নাগরিক। ভোট প্রদান একজন নাগরিকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম অস্ত্র। প্রতি পাঁচ বছর পর এই মূল্যবান অস্ত্রটি ব্যবহার করার সুযোগ পান দেশের সব ভোটার। এটা কোনোভাবেই হেলাফেলার ব্যাপার নয়। আপনার, আমার প্রতিটি ভোটই যথেষ্ট মূল্যবান। একটা ভোটই জাতি-রাষ্ট্রের জন্য বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে। আর কিছু না পারলেও সঠিক স্থানে। একটি ভোট প্রদানই হতে পারে রাষ্ট্রের প্রতি আপনার দায়িত্ব পালনের অপূর্ব উদাহরণ। এটা নিয়ে আপনি গর্ব করতে পারেন। আমরা এমন অনেকেই আছি যারা সারা জীবন কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। অন্যের কথা ভাবার সুযোগ পাই না, রাষ্ট্র দেশ তো আরো বড় ব্যাপার। সুতরাং ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটা অপূর্ব সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। এর সদ্ব্যবহার করা আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব।
ভেবে দেখুন একবার, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিল। ভাবুন একবার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কথা। একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে এই মহান বাঙালি সন্তান সঙ্গী যোদ্ধাদের বললেন, আমার জীবনের বিনিময়ে তোমরা বেঁচে থেকে যুদ্ধ কর এবং শত্রুমুক্ত করে দেশকে স্বাধীন কর। অকাতরে স্বেচ্ছায় জীবন দান করলেন দেশের জন্য। মানুষের ভেতর এ রকম তীব্র ত্যাগের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এত বড় ত্যাগের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না। তবে আমাদের একটা ভোট যদি দেশের কল্যাণে লাগে, ৩০ লাখ শহীদের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটি পালন করা কি সকলের পবিত্রতম দায়িত্ব নয়? কিন্তু যেনতেনভাবে যাকে তাকে ভোট দিলেই দায়িত্ব পালন হবে না।
কথায় আছে, অপাত্রে পুষ্প অর্পণ মহা বিপদ ডেকে আনতে পারে। জেনে-বুঝে দেশের স্বার্থে ভোট দেওয়াটাই আসল কথা। এটা স্থানীয় নয়, জাতীয় নির্বাচন। দুয়ের পার্থক্য অনেক। এই ভোটে ব্যক্তির চাইতে মার্কা বা দলের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এখানে তাই দলকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, আমরা কেমন রাষ্ট্র এবং সরকার চাই, সেটি কোন দল দিতে পারবে।
আমরা কি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাংলাদেশ চাই, নাকি ধর্মাশ্রয়ী উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, বাংলাভাইয়ের বাংলাদেশ চাই, যেখানে সেøাগান হবে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয়বাংলাকে রক্ষা করতে চাই, নাকি পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশ জিন্দাবাদের রাষ্ট্র চাই? নিজের মনকে প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি বিস্ময়কর উন্নয়ন, অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাই, নাকি আবার ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সব কিছুতে অধগমনের পরিস্থিতিতে যেতে চাই? আমরা কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হতে চাই, নাকি জঙ্গি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে কালো তালিকাভুক্তি চাই, যেমনটি ঘটেছিল ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির সময়।
গত দশ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনা এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি কর্তৃক দেশ পরিচালনার দিকে তুলনামূলক দৃষ্টি দিলে ওপরে উল্লিখিত আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর এবং তার ফল ও পরিণতি দেখা যাবে। আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত দুই প্রধান পক্ষের পরিচয় এবং তাদের অতীত আমলনামা মানুষের হাতের মুঠোয়। এক পক্ষে রয়েছে আওয়ামী লীগ, সঙ্গে লাঙ্গল, যার নেতৃত্বে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অপর পক্ষে রয়েছে মূলত জামায়াত-বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট, যাদের প্রতীক ধানের শীষ, যার নেতৃত্বে কে আছেন তা মানুষের স্পষ্ট নয়।
গত দশ বছর ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। আর এর আগে দুই মেয়াদে দশ বছর ক্ষমতায় ছিল জামায়াত-বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ^াসী। তাদের মূল আদর্শগত অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধান, যার মূল কথাই হলো বাঙালি সংস্কৃতিপ্রসূত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। অন্যদিকে জামায়াত-বিএনপির আদর্শগত অবস্থান সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, ধর্মাশ্রয়ী, সাম্প্রদায়িক, যার সাদৃশ্য রয়েছে পাকিস্তানি মতাদর্শের সঙ্গে, অন্য কথায় বলা যায়, এই পক্ষ পাকিস্তানি মতাদর্শে বিশ^াসী, যার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই আমরা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের নাম ব্যবহার করে এবং সম্প্রতি ড. কামাল হোসেন ও তার দু-চারজন সঙ্গীদের দেখিয়ে একপ্রকার ধূম্রজাল তৈরি করে বলার চেষ্টা করা হচ্ছেÑ তাারও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এক বিষয় নয়। পূর্ণ পরিচয়টা যাই থাকুক না কেন, যে মুহূর্তে একজন মানুষ হত্যা করবেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্রিমিনাল হিসেবে বিবেচিত হবেন।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে হত্যা ও অবমাননা করে কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হতে পারে না। একাত্তরের গণহত্যাকারী, ধর্ষণকারী, যারা এখনো বলেÑ এদেশে কোনো ধর্ষণকারী নেই, যারা এখনো বলেÑ এদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। সেই জামায়াতের সঙ্গে যারা একাকার হয়ে যায় তারা মুক্তিযুদ্ধের কলঙ্ক বই অন্য কিছু নয়। তাই ৩০ ডিসেম্বর ভোট প্রদানের আগে, এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিম্নবর্ণিত কয়েকটি বিষয় আবার একবার ভেবে দেখুন।
এক. স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং জাতির পিতা। দুই. মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও বৈশিষ্ট্য বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। তিন. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে প্রতিষ্ঠিত গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাবলির সুবিশাল ইতিহাস। চার. যুদ্ধাপরাধের বিচার। পাঁচ. মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী সেøাগান জয় বাংলা। যারা উপরোক্ত বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে, অবমাননা করে, তার প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখায় না, বরং সেগুলোর ওপর কালিমা লেপন করে তাদের কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলা যায়? আমি বিশ^াস করি এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি ‘না’ বলবেন। তাহলে কি জামায়াত-বিএনপির ধানের শীষে ভোট দেওয়া যায়? ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্তের পূর্বে আপনি কি ৩০ লাখ শহীদের কথা একবারও ভাববেন না? কোনো ব্যক্তি ও দল শতভাগ শুদ্ধ নয়, শতভাগ সফল নয় এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাই দুই পক্ষের তুলনায় আপনাকে, আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে।
এ কথা তো সত্য, গত দশ বছর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর দেশ পরিচালিত হয়েছে বলেই বাংলাদেশ আজ বিশে^র কাছে উন্নয়নের রোল মডেল ও বিস্ময় এবং জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী দেশ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্বয়ং এবং সেখানকার বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রকাশ্যে বলছে, বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের চাইতে অনেক দূর বেশি এগিয়ে গেছে। সুতরাং পাকিস্তানি মতাদর্শের রাজনীতি যারা করছে, অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপিকে ভোট দেওয়া কি আপনার নাগরিক অধিকারের সদ্ব্যবহার হবে। যে আদর্শের জন্য খোদ পাকিস্তানই আফসোস করছে, এখন বাংলাদেশের দিকে তাকাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কী করে পাকিস্তানি আদর্শের অনুসারীদের ভোট দেব।
জামায়াত-বিএনপি এবং তার সঙ্গে কথিত ঐক্যফ্রন্ট মিলে সরল সোজা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বলছেন, তারা গণতন্ত্র উদ্ধার করবেন। গণতন্ত্র হচ্ছে উন্নয়নের সোপান। সুতরাং গণতন্ত্র না থাকলে গত দশ বছরে বিস্ময়কর উন্নতি হলো কী করে। দ্বিতীয়ত, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তারা কী ধরনের গণতন্ত্র উদ্ধার করবে, যে জামায়াতের মৌলিক আদর্শের কথাই হলোÑ গণতন্ত্র হারাম ও কুফরি মতবাদ। তারপর গত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন যে আচরণ করেছেন তাতে কি প্রত্যাশা করা যায় তারা ক্ষমতায় গেলে গণতান্ত্রিক আচরণ করবেন, সামান্য ভিন্নমত সহ্য করতে পারছেন না স্বয়ং ড. কামাল হোসেন।
গত কয়েক বছর দেশের সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিজ নিজ কাজ-কর্ম করতে পেরেছেন বলেই প্রত্যেকটি মানুষ আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। দেশে খাদ্যাভাব নেই। এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশের পরিবর্তে জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় এনে ২০০১-২০০৬ মেয়াদের মতো আবার সহিংস এবং সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের পরিবেশের মধ্যে মানুষ পড়তে চাইবে না সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং ৩০ ডিসেম্বর আপনি, আমি, আমরা সবাই ভোট কেন্দ্রে যাব এবং যৌক্তিকতার বিচারে এবং দেশের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ভোট প্রদান করব।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিল। ভাবুন একবার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কথা। একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে এই মহান বাঙালি সন্তান সঙ্গী যোদ্ধাদের বললেন, আমার জীবনের বিনিময়ে তোমরা বেঁচে থেকে যুদ্ধ কর এবং শত্রুমুক্ত করে দেশকে স্বাধীন কর। অকাতরে স্বেচ্ছায় জীবন দান করলেন দেশের জন্য। মানুষের ভেতর এ রকম তীব্র ত্যাগের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এত বড় ত্যাগের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না। তবে আমাদের একটা ভোট যদি দেশের কল্যাণে লাগে, ৩০ লাখ শহীদের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটি পালন করা কি সকলের পবিত্রতম দায়িত্ব নয়?
লেখক
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও কলামনিস্ট
শেয়ার করুন
মোহাম্মদ আলী শিকদার | ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

আর মাত্র দুই দিন পরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটগ্রহণ করা হবে। এবার ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন প্রায় সাড়ে দশ কোটি নাগরিক। ভোট প্রদান একজন নাগরিকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম অস্ত্র। প্রতি পাঁচ বছর পর এই মূল্যবান অস্ত্রটি ব্যবহার করার সুযোগ পান দেশের সব ভোটার। এটা কোনোভাবেই হেলাফেলার ব্যাপার নয়। আপনার, আমার প্রতিটি ভোটই যথেষ্ট মূল্যবান। একটা ভোটই জাতি-রাষ্ট্রের জন্য বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে। আর কিছু না পারলেও সঠিক স্থানে। একটি ভোট প্রদানই হতে পারে রাষ্ট্রের প্রতি আপনার দায়িত্ব পালনের অপূর্ব উদাহরণ। এটা নিয়ে আপনি গর্ব করতে পারেন। আমরা এমন অনেকেই আছি যারা সারা জীবন কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। অন্যের কথা ভাবার সুযোগ পাই না, রাষ্ট্র দেশ তো আরো বড় ব্যাপার। সুতরাং ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের একটা অপূর্ব সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। এর সদ্ব্যবহার করা আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব।
ভেবে দেখুন একবার, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিল। ভাবুন একবার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কথা। একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে এই মহান বাঙালি সন্তান সঙ্গী যোদ্ধাদের বললেন, আমার জীবনের বিনিময়ে তোমরা বেঁচে থেকে যুদ্ধ কর এবং শত্রুমুক্ত করে দেশকে স্বাধীন কর। অকাতরে স্বেচ্ছায় জীবন দান করলেন দেশের জন্য। মানুষের ভেতর এ রকম তীব্র ত্যাগের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এত বড় ত্যাগের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না। তবে আমাদের একটা ভোট যদি দেশের কল্যাণে লাগে, ৩০ লাখ শহীদের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটি পালন করা কি সকলের পবিত্রতম দায়িত্ব নয়? কিন্তু যেনতেনভাবে যাকে তাকে ভোট দিলেই দায়িত্ব পালন হবে না।
কথায় আছে, অপাত্রে পুষ্প অর্পণ মহা বিপদ ডেকে আনতে পারে। জেনে-বুঝে দেশের স্বার্থে ভোট দেওয়াটাই আসল কথা। এটা স্থানীয় নয়, জাতীয় নির্বাচন। দুয়ের পার্থক্য অনেক। এই ভোটে ব্যক্তির চাইতে মার্কা বা দলের গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এখানে তাই দলকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, আমরা কেমন রাষ্ট্র এবং সরকার চাই, সেটি কোন দল দিতে পারবে।
আমরা কি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাংলাদেশ চাই, নাকি ধর্মাশ্রয়ী উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, বাংলাভাইয়ের বাংলাদেশ চাই, যেখানে সেøাগান হবে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয়বাংলাকে রক্ষা করতে চাই, নাকি পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশ জিন্দাবাদের রাষ্ট্র চাই? নিজের মনকে প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি বিস্ময়কর উন্নয়ন, অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চাই, নাকি আবার ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সব কিছুতে অধগমনের পরিস্থিতিতে যেতে চাই? আমরা কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হতে চাই, নাকি জঙ্গি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে কালো তালিকাভুক্তি চাই, যেমনটি ঘটেছিল ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির সময়।
গত দশ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনা এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি কর্তৃক দেশ পরিচালনার দিকে তুলনামূলক দৃষ্টি দিলে ওপরে উল্লিখিত আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর এবং তার ফল ও পরিণতি দেখা যাবে। আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত দুই প্রধান পক্ষের পরিচয় এবং তাদের অতীত আমলনামা মানুষের হাতের মুঠোয়। এক পক্ষে রয়েছে আওয়ামী লীগ, সঙ্গে লাঙ্গল, যার নেতৃত্বে আছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অপর পক্ষে রয়েছে মূলত জামায়াত-বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট, যাদের প্রতীক ধানের শীষ, যার নেতৃত্বে কে আছেন তা মানুষের স্পষ্ট নয়।
গত দশ বছর ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। আর এর আগে দুই মেয়াদে দশ বছর ক্ষমতায় ছিল জামায়াত-বিএনপি সরকার। আওয়ামী লীগ পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ^াসী। তাদের মূল আদর্শগত অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধান, যার মূল কথাই হলো বাঙালি সংস্কৃতিপ্রসূত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। অন্যদিকে জামায়াত-বিএনপির আদর্শগত অবস্থান সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, ধর্মাশ্রয়ী, সাম্প্রদায়িক, যার সাদৃশ্য রয়েছে পাকিস্তানি মতাদর্শের সঙ্গে, অন্য কথায় বলা যায়, এই পক্ষ পাকিস্তানি মতাদর্শে বিশ^াসী, যার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই আমরা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের নাম ব্যবহার করে এবং সম্প্রতি ড. কামাল হোসেন ও তার দু-চারজন সঙ্গীদের দেখিয়ে একপ্রকার ধূম্রজাল তৈরি করে বলার চেষ্টা করা হচ্ছেÑ তাারও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এক বিষয় নয়। পূর্ণ পরিচয়টা যাই থাকুক না কেন, যে মুহূর্তে একজন মানুষ হত্যা করবেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্রিমিনাল হিসেবে বিবেচিত হবেন।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে হত্যা ও অবমাননা করে কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হতে পারে না। একাত্তরের গণহত্যাকারী, ধর্ষণকারী, যারা এখনো বলেÑ এদেশে কোনো ধর্ষণকারী নেই, যারা এখনো বলেÑ এদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। সেই জামায়াতের সঙ্গে যারা একাকার হয়ে যায় তারা মুক্তিযুদ্ধের কলঙ্ক বই অন্য কিছু নয়। তাই ৩০ ডিসেম্বর ভোট প্রদানের আগে, এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিম্নবর্ণিত কয়েকটি বিষয় আবার একবার ভেবে দেখুন।
এক. স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং জাতির পিতা। দুই. মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও বৈশিষ্ট্য বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। তিন. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে প্রতিষ্ঠিত গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাবলির সুবিশাল ইতিহাস। চার. যুদ্ধাপরাধের বিচার। পাঁচ. মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী সেøাগান জয় বাংলা। যারা উপরোক্ত বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে, অবমাননা করে, তার প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখায় না, বরং সেগুলোর ওপর কালিমা লেপন করে তাদের কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলা যায়? আমি বিশ^াস করি এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি ‘না’ বলবেন। তাহলে কি জামায়াত-বিএনপির ধানের শীষে ভোট দেওয়া যায়? ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্তের পূর্বে আপনি কি ৩০ লাখ শহীদের কথা একবারও ভাববেন না? কোনো ব্যক্তি ও দল শতভাগ শুদ্ধ নয়, শতভাগ সফল নয় এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাই দুই পক্ষের তুলনায় আপনাকে, আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে।
এ কথা তো সত্য, গত দশ বছর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর দেশ পরিচালিত হয়েছে বলেই বাংলাদেশ আজ বিশে^র কাছে উন্নয়নের রোল মডেল ও বিস্ময় এবং জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী দেশ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্বয়ং এবং সেখানকার বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রকাশ্যে বলছে, বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের চাইতে অনেক দূর বেশি এগিয়ে গেছে। সুতরাং পাকিস্তানি মতাদর্শের রাজনীতি যারা করছে, অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপিকে ভোট দেওয়া কি আপনার নাগরিক অধিকারের সদ্ব্যবহার হবে। যে আদর্শের জন্য খোদ পাকিস্তানই আফসোস করছে, এখন বাংলাদেশের দিকে তাকাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কী করে পাকিস্তানি আদর্শের অনুসারীদের ভোট দেব।
জামায়াত-বিএনপি এবং তার সঙ্গে কথিত ঐক্যফ্রন্ট মিলে সরল সোজা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বলছেন, তারা গণতন্ত্র উদ্ধার করবেন। গণতন্ত্র হচ্ছে উন্নয়নের সোপান। সুতরাং গণতন্ত্র না থাকলে গত দশ বছরে বিস্ময়কর উন্নতি হলো কী করে। দ্বিতীয়ত, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তারা কী ধরনের গণতন্ত্র উদ্ধার করবে, যে জামায়াতের মৌলিক আদর্শের কথাই হলোÑ গণতন্ত্র হারাম ও কুফরি মতবাদ। তারপর গত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন যে আচরণ করেছেন তাতে কি প্রত্যাশা করা যায় তারা ক্ষমতায় গেলে গণতান্ত্রিক আচরণ করবেন, সামান্য ভিন্নমত সহ্য করতে পারছেন না স্বয়ং ড. কামাল হোসেন।
গত কয়েক বছর দেশের সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিজ নিজ কাজ-কর্ম করতে পেরেছেন বলেই প্রত্যেকটি মানুষ আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। দেশে খাদ্যাভাব নেই। এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশের পরিবর্তে জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় এনে ২০০১-২০০৬ মেয়াদের মতো আবার সহিংস এবং সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের পরিবেশের মধ্যে মানুষ পড়তে চাইবে না সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং ৩০ ডিসেম্বর আপনি, আমি, আমরা সবাই ভোট কেন্দ্রে যাব এবং যৌক্তিকতার বিচারে এবং দেশের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ভোট প্রদান করব।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিল। ভাবুন একবার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কথা। একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে এই মহান বাঙালি সন্তান সঙ্গী যোদ্ধাদের বললেন, আমার জীবনের বিনিময়ে তোমরা বেঁচে থেকে যুদ্ধ কর এবং শত্রুমুক্ত করে দেশকে স্বাধীন কর। অকাতরে স্বেচ্ছায় জীবন দান করলেন দেশের জন্য। মানুষের ভেতর এ রকম তীব্র ত্যাগের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এত বড় ত্যাগের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার সুযোগ হয়তো আর পাওয়া যাবে না। তবে আমাদের একটা ভোট যদি দেশের কল্যাণে লাগে, ৩০ লাখ শহীদের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটি পালন করা কি সকলের পবিত্রতম দায়িত্ব নয়?
লেখক
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও কলামনিস্ট