আতঙ্কের রাজনীতি বনাম রাষ্ট্রনায়ক তৈরির রাজনীতি
সজীব সরকার | ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
আমরা যদি গত কয়েকদিনের রাজনীতির খবর পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে পত্রিকার শিরোনাম দেখব : ‘দেয়ালেও নেই ধানের শীষ’, ‘প্রধানমন্ত্রী গুজব ছড়াচ্ছেন : বিএনপি’ (দেশ রূপান্তর, ২২ ডিসেম্বর); ‘বিএনপির প্রচারে বাধা হামলা, আ.লীগের কার্যালয় ভাঙচুর (সমকাল, ১৭ ডিসেম্বর); ‘প্রথম নির্বাচনী জনসভায় শেখ হাসিনা : নৌকা জয়ী না হলে ওরা দেশ ধ্বংস করে দেবে’, ‘জমছে ভোটের প্রচার বাড়ছে সহিংসতা’ (সমকাল, ১৩ ডিসেম্বর)। ওই দিনের সমকাল পত্রিকায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট-এর মূল প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর গবেষণার ফলের বরাতে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল : ‘আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসছে’।
আরো দেখব, ব্যবসায়ী সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসতে চাই না’, কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে’ এবং সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘সিইসি একজন নির্বাচন কমিশনারের অস্তিত্বে আঘাত করেছেন’ (বণিক বার্তা, ২০ ডিসেম্বর)। এর দুদিন আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই’ (বণিক বার্তা, ১৮ ডিসেম্বর)। ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ বাজারে এক পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে লাশের মিছিল হবে, রক্তের দরিয়া বইবে’ (দেশ রূপান্তর অনলাইন)।
এক দশক পর দেশের শীর্ষ দুই দল ‘নৌকা’ ও ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। গেল নির্বাচনে যেখানে প্রার্থী সংকট ছিল, সেখানে এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে মনোনয়নপত্র জমা পড়ে ৩০৫৬টি। দেশের রাজনীতিতে এটি একটি সুখবর হিসেবে আসতে পারত। কিন্তু এর বদলে আমরা দেখছি পরস্পর দোষারোপ, হামলা-মামলা আর বিষোদগারের সেই পুরোনো চরিত্র থেকে কোনো দলই বেরিয়ে আসতে পারেনি। বেরিয়ে আসতে চায় বলেও বিশ্বাস করার কারণ নেই!
একসময় বিএনপির ভাষ্য ছিল, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে’। আর এখন আওয়ামী লীগের ভাষ্য হলো, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, লাশের মিছিল হবে’। আমরা জানি, সর্বাংশে সত্য না হলেও এমন শঙ্কা একেবারে অমূলক নয়; দুটি দলই নিজ স্বার্থে নানা সময়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তার স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো : নির্বাচনী বক্তব্য বা প্রচারে দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহারের ব্যাখ্যা আমরা আশা করি, কে কত খারাপÑ তা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির মাঠে এমন সংস্কৃতির চল হয়েছে, যেখানে নির্বাচনী বক্তৃতা মানেই একে অন্যের প্রতি বিষোদগার। তাতেও সমস্যা ছিল না; সমস্যা হলো, বিষোদগার করতে গিয়ে দুটি দলই জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। অন্যান্য দল বা প্রার্থীরাও এর খুব একটা ব্যতিক্রম করছেন না।
আমরা দায়িত্বশীল রাজনীতিক চাই, দায়বোধের রাজনীতি চাই; কেবল দোষারোপ বা জনগণকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে ভোট আদায়ের এ হীন চেষ্টা আদতে টেকসই নয়; এ জুজুর ভয় একসময় মানুষের কেটে যাবে; তখন এ রাজনীতিবিদরা কী ফর্মুলা নেবেন?
গণমাধ্যমের খবর থেকে আমরা দেখি, সম্প্রতি পুলিশের সদর দপ্তর থেকে ৪০ হাজার ২৭৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৫ হাজার ৮২৭টি কেন্দ্রই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলা হচ্ছে। বিএনপি বলছে, তাদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে; নেতাকর্মীদের ধর-পাকড় করে কৌশলে তাদের নির্বাচন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ‘লন্ডনে বসে দেশের পুলিশ হত্যার পরিকল্পনা হচ্ছে’। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বলছেন, তারা জান-মালের নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছেন, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রশ্ন করলে তাদের ‘খামোশ’ থাকতে বলা হচ্ছে। গত ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৯ উপজেলায় সেনাবাহিনী আর ১৮ উপজেলায় নৌবাহিনী দায়িত্বে রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতাও থাকছে। সেনা মোতায়েন নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ভোটারদের মনোভাব কেউ জানার বা বোঝার চেষ্টা করেছে কি?
ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সেনা বা সেনাসমর্থিত সরকার নয়, বরং জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার চায়। প্রতিটি দল দেশকে নিয়ে তাদের ভাবনা বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তাদের ইশতেহারে উল্লেখ করবে, নির্বাচনী বক্তব্যে তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দেবে; সাধারণ মানুষ তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন যে দলের ইশতেহার ও কর্মপরিকল্পনায় দেখবে, তাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেÑএটি দল বা একক প্রার্থীর ভিত্তিতে হতে পারে।
কিন্তু এই সুস্থ, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন আমরা খুব কমই দেখতে পাচ্ছি; মূল দলগুলো পরস্পর কালিমা-লেপন করছে, তার চেয়ে উদ্বেগের কথা, ভোট পাওয়ার জন্য জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমরা আশা করব, কেবল জেতার জন্য নির্বাচনকে নিয়ে এই ‘ভয়ের রাজনীতি’ থেকে তারা একসময় বিরত হবেন; না হলে, ভুলে গেলে চলবে না, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের’ জন্য দেশে লোকের অভাব নেই! আমাদের প্রত্যাশা, দলগুলোর বোধোদয় হবে, তারা যেটিকে কেবল ভয় বা আতঙ্কের রাজনীতি করছেন বলে ভাবছেন, সেটি অনেকের জন্যে ‘পথ দেখানো’ হচ্ছে।
তাই দেশের প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য পদ্ধতিগত রাজনীতির পথ আরো উদার ও মসৃণ হোক, কেবল ভোট পাওয়ার লালসায় নির্বাচন নিয়ে ‘অপরাজনীতি’র এই সংস্কৃতি বন্ধ হোক। সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকা কেবল ‘সরকার ঠেকাও’ আন্দোলন নয়, বরং সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করার মানসিকতাও প্রতিটি দল ও ব্যক্তির মধ্যে গড়ে ওঠা খুব দরকার।
নির্বাচন প্রসঙ্গে দুজন ব্যক্তির কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই : নেতৃত্ব বিষয়ের গবেষক, লেখক ও বক্তা সিমোন সিনেক বলেছিলেন, সত্যিকার নেতৃত্ব আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নয়, আসন্ন (পরবর্তী) প্রজন্মকে নিয়ে ভাবে; আর ধর্মযাজক জেমস ফ্রিম্যান বলতেন, একজন রাজনীতিবদ কেবল পরের নির্বাচন নিয়ে ভাবেন, কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক পরের প্রজন্মকে নিয়ে ভাবেন।
আমাদের দেশে রাজনীতিবিদের অভাব নেই; আমাদের এখন রাষ্ট্রনায়ক দরকার। নির্বাচনকে ঘিরে আতঙ্কের ‘রাজনীতি’ বন্ধ হোক, রাষ্ট্রনায়ক তৈরির রাজনীতি শুরু হোক।
মূল দলগুলো পরস্পর কালিমা-লেপন করছে, তার চেয়ে উদ্বেগের কথা, ভোট পাওয়ার জন্য জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমরা আশা করব, কেবল জেতার জন্য নির্বাচনকে নিয়ে এই ‘ভয়ের রাজনীতি’ থেকে তারা একসময় বিরত হবেন; না হলে, ভুলে গেলে চলবে না, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের’ জন্য দেশে লোকের অভাব নেই! আমাদের প্রত্যাশা, দলগুলোর বোধোদয় হবে
লেখক
সহকারী অধ্যাপক
জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
শেয়ার করুন
সজীব সরকার | ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

আমরা যদি গত কয়েকদিনের রাজনীতির খবর পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে পত্রিকার শিরোনাম দেখব : ‘দেয়ালেও নেই ধানের শীষ’, ‘প্রধানমন্ত্রী গুজব ছড়াচ্ছেন : বিএনপি’ (দেশ রূপান্তর, ২২ ডিসেম্বর); ‘বিএনপির প্রচারে বাধা হামলা, আ.লীগের কার্যালয় ভাঙচুর (সমকাল, ১৭ ডিসেম্বর); ‘প্রথম নির্বাচনী জনসভায় শেখ হাসিনা : নৌকা জয়ী না হলে ওরা দেশ ধ্বংস করে দেবে’, ‘জমছে ভোটের প্রচার বাড়ছে সহিংসতা’ (সমকাল, ১৩ ডিসেম্বর)। ওই দিনের সমকাল পত্রিকায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট-এর মূল প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর গবেষণার ফলের বরাতে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল : ‘আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসছে’।
আরো দেখব, ব্যবসায়ী সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যেনতেনভাবে ক্ষমতায় আসতে চাই না’, কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে’ এবং সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘সিইসি একজন নির্বাচন কমিশনারের অস্তিত্বে আঘাত করেছেন’ (বণিক বার্তা, ২০ ডিসেম্বর)। এর দুদিন আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই’ (বণিক বার্তা, ১৮ ডিসেম্বর)। ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ বাজারে এক পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে লাশের মিছিল হবে, রক্তের দরিয়া বইবে’ (দেশ রূপান্তর অনলাইন)।
এক দশক পর দেশের শীর্ষ দুই দল ‘নৌকা’ ও ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। গেল নির্বাচনে যেখানে প্রার্থী সংকট ছিল, সেখানে এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে মনোনয়নপত্র জমা পড়ে ৩০৫৬টি। দেশের রাজনীতিতে এটি একটি সুখবর হিসেবে আসতে পারত। কিন্তু এর বদলে আমরা দেখছি পরস্পর দোষারোপ, হামলা-মামলা আর বিষোদগারের সেই পুরোনো চরিত্র থেকে কোনো দলই বেরিয়ে আসতে পারেনি। বেরিয়ে আসতে চায় বলেও বিশ্বাস করার কারণ নেই!
একসময় বিএনপির ভাষ্য ছিল, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে’। আর এখন আওয়ামী লীগের ভাষ্য হলো, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, লাশের মিছিল হবে’। আমরা জানি, সর্বাংশে সত্য না হলেও এমন শঙ্কা একেবারে অমূলক নয়; দুটি দলই নিজ স্বার্থে নানা সময়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তার স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো : নির্বাচনী বক্তব্য বা প্রচারে দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহারের ব্যাখ্যা আমরা আশা করি, কে কত খারাপÑ তা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির মাঠে এমন সংস্কৃতির চল হয়েছে, যেখানে নির্বাচনী বক্তৃতা মানেই একে অন্যের প্রতি বিষোদগার। তাতেও সমস্যা ছিল না; সমস্যা হলো, বিষোদগার করতে গিয়ে দুটি দলই জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। অন্যান্য দল বা প্রার্থীরাও এর খুব একটা ব্যতিক্রম করছেন না।
আমরা দায়িত্বশীল রাজনীতিক চাই, দায়বোধের রাজনীতি চাই; কেবল দোষারোপ বা জনগণকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে ভোট আদায়ের এ হীন চেষ্টা আদতে টেকসই নয়; এ জুজুর ভয় একসময় মানুষের কেটে যাবে; তখন এ রাজনীতিবিদরা কী ফর্মুলা নেবেন?
গণমাধ্যমের খবর থেকে আমরা দেখি, সম্প্রতি পুলিশের সদর দপ্তর থেকে ৪০ হাজার ২৭৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২৫ হাজার ৮২৭টি কেন্দ্রই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলা হচ্ছে। বিএনপি বলছে, তাদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে; নেতাকর্মীদের ধর-পাকড় করে কৌশলে তাদের নির্বাচন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ‘লন্ডনে বসে দেশের পুলিশ হত্যার পরিকল্পনা হচ্ছে’। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বলছেন, তারা জান-মালের নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছেন, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রশ্ন করলে তাদের ‘খামোশ’ থাকতে বলা হচ্ছে। গত ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮৯ উপজেলায় সেনাবাহিনী আর ১৮ উপজেলায় নৌবাহিনী দায়িত্বে রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতাও থাকছে। সেনা মোতায়েন নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
ভোটারদের মনোভাব কেউ জানার বা বোঝার চেষ্টা করেছে কি?
ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সেনা বা সেনাসমর্থিত সরকার নয়, বরং জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার চায়। প্রতিটি দল দেশকে নিয়ে তাদের ভাবনা বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তাদের ইশতেহারে উল্লেখ করবে, নির্বাচনী বক্তব্যে তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দেবে; সাধারণ মানুষ তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন যে দলের ইশতেহার ও কর্মপরিকল্পনায় দেখবে, তাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেÑএটি দল বা একক প্রার্থীর ভিত্তিতে হতে পারে।
কিন্তু এই সুস্থ, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন আমরা খুব কমই দেখতে পাচ্ছি; মূল দলগুলো পরস্পর কালিমা-লেপন করছে, তার চেয়ে উদ্বেগের কথা, ভোট পাওয়ার জন্য জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমরা আশা করব, কেবল জেতার জন্য নির্বাচনকে নিয়ে এই ‘ভয়ের রাজনীতি’ থেকে তারা একসময় বিরত হবেন; না হলে, ভুলে গেলে চলবে না, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের’ জন্য দেশে লোকের অভাব নেই! আমাদের প্রত্যাশা, দলগুলোর বোধোদয় হবে, তারা যেটিকে কেবল ভয় বা আতঙ্কের রাজনীতি করছেন বলে ভাবছেন, সেটি অনেকের জন্যে ‘পথ দেখানো’ হচ্ছে।
তাই দেশের প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য পদ্ধতিগত রাজনীতির পথ আরো উদার ও মসৃণ হোক, কেবল ভোট পাওয়ার লালসায় নির্বাচন নিয়ে ‘অপরাজনীতি’র এই সংস্কৃতি বন্ধ হোক। সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকা কেবল ‘সরকার ঠেকাও’ আন্দোলন নয়, বরং সরকারের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করার মানসিকতাও প্রতিটি দল ও ব্যক্তির মধ্যে গড়ে ওঠা খুব দরকার।
নির্বাচন প্রসঙ্গে দুজন ব্যক্তির কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই : নেতৃত্ব বিষয়ের গবেষক, লেখক ও বক্তা সিমোন সিনেক বলেছিলেন, সত্যিকার নেতৃত্ব আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নয়, আসন্ন (পরবর্তী) প্রজন্মকে নিয়ে ভাবে; আর ধর্মযাজক জেমস ফ্রিম্যান বলতেন, একজন রাজনীতিবদ কেবল পরের নির্বাচন নিয়ে ভাবেন, কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক পরের প্রজন্মকে নিয়ে ভাবেন।
আমাদের দেশে রাজনীতিবিদের অভাব নেই; আমাদের এখন রাষ্ট্রনায়ক দরকার। নির্বাচনকে ঘিরে আতঙ্কের ‘রাজনীতি’ বন্ধ হোক, রাষ্ট্রনায়ক তৈরির রাজনীতি শুরু হোক।
মূল দলগুলো পরস্পর কালিমা-লেপন করছে, তার চেয়ে উদ্বেগের কথা, ভোট পাওয়ার জন্য জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমরা আশা করব, কেবল জেতার জন্য নির্বাচনকে নিয়ে এই ‘ভয়ের রাজনীতি’ থেকে তারা একসময় বিরত হবেন; না হলে, ভুলে গেলে চলবে না, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের’ জন্য দেশে লোকের অভাব নেই! আমাদের প্রত্যাশা, দলগুলোর বোধোদয় হবে
লেখক
সহকারী অধ্যাপক
জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ