গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সবচেয়ে জরুরি
দিলারা চৌধুরী | ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
নতুন ভোটারদের বিবেচনা করতে হবে কোনটি দেশের স্বার্থে আর কোনটি দেশের বিপক্ষে। মার্কা দেখে নয়, প্রার্থী এবং ইশতেহার দেখে বিবেচনা করাই শ্রেয় দিলারা চৌধুরী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক
দেশ রূপান্তর : মতদ্বৈধতা এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকলেও সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটা ফিরে আসবে বলে মনে করেন?
দিলারা চৌধুরী : আমার মতে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয় না। এটা নির্ভর করবে ভোটারদের ওপর। তারা ভয়ভীতি ছাড়া ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কি না এবং তাদের রায় দিতে পারবে কি না সেটাই এই প্রক্রিয়ার মূল নিয়ামক। তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই এর পূর্বশর্ত। তারা অবাধে ভোট দিতে পারলেই নির্বাচন অর্থবহ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে। আর তাহলেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যা ২০১৪ সালে ব্যাহত হয়েছিল তা আবার ফিরে আসবে।
দেশ রূপান্তর : এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটারের সংখ্যা এক কোটি ২৩ লাখ, যা মোট ভোটারের ২২ শতাংশ। তারা কি প্রথাগত দলীয় আনুগত্যে ভোট দেবে নাকি নতুন বিবেচনা কাজ করবে বলে আপনার মনে হয়?
দিলারা চৌধুরী : আমাদের দেশে মূলত মার্কা দেখে ভোট দেওয়া হয়। নৌকা না ধানের শীষ এই বিবেচনা সর্বাগ্রে কাজ করে। খুব কম লোকই প্রার্থী দেখে ভোট দেয়। দেশের অতীত নির্বাচনগুলোর ইতিহাস তাই বলে। এখন এই এক কোটি ২৩ লাখ নতুন ভোটার দলীয় আনুগত্যে ভোট দেবে নাকি নতুন বিবেচনায় ভোট দেবে তা নির্ভর করছে তাদের প্রার্থী নির্বাচনের ওপর। এদিক দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট এবার অনেক যৌক্তিক ও মৌলিক বিষয় তাদের ইশতেহারে প্রণয়ন করেছে। এ জন্য তাদের আমি সাধুবাদ জানাই। তারা ইশতেহারে সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতার ভারসাম্য, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না ইত্যাদি বিষয় যুক্ত করছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মেয়াদ দুইবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। আমরা দেখেছি খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা, সবাই দীর্ঘদিন ধরে দলীয়প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে আসছেন। এটা যেখানে গণতন্ত্র রয়েছে সেখানে দেখি না। সেখানে নেতৃত্ব বদল হয়, বিভিন্ন দল পালাক্রমে আসে। একটা নেতৃত্ব তো ৩০ বছর ধরে কর্তৃত্ব করতে পারেন না। কেননা এর মধ্যে অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। কিন্তু এখানে একই ধরনের প্রচার, একই নেতৃত্ব, একই ধরনের পারস্পরিক দোষারোপ। কোনো বৈচিত্র্য নেই। তাই ক্ষমতার প্রধান হওয়ার মেয়াদ দুইবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার মাধ্যমে একধরনের নতুনত্ব তৈরি হবে। যিনি প্রধান নেতা, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখবেন না। কেননা তিনি জানবেন তাকে একসময় চলে যেতে হবে। এটি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসারণ ঘটেছে তা থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এই ধরনের পদক্ষেপ অনুপস্থিত। তারা উল্লেখ করেনি যে তারা সংবিধান সংশোধন করে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ব হ্রাস করবে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ৫৭ ধারা বাতিলের ব্যাপারেও কিছু বলেনি। পক্ষান্তরে, ঐক্যফ্রন্ট এই আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের ইশতেহারে। সেদিক থেকে নতুন ভোটারদের বিবেচনা করতে হবে কোনটি দেশের স্বার্থে আর কোনটি দেশের বিপক্ষে। মার্কা দেখে নয়, প্রার্থী এবং ইশতেহার দেখে বিবেচনা করাই শ্রেয়। তবে এবারের নির্বাচনে তা ঘটবে বলে আমার মনে হয় না। এ জন্য দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা অনেকাংশে দায়ী।
দেশ রূপান্তর : নির্বাচনী ইশতেহারে সব রাজনৈতিক দলই অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো এগুলোর খুব কমই বাস্তবায়িত হয়। ইশতেহারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে আপনার অভিমত কী?
দিলারা চৌধুরী : ইশতেহারে অনেকেই অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় না। এ ক্ষেত্রে আমি পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ টানব। ইশতেহারের সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হলেও মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হতে হবে। যেমন আওয়ামী লীগ সবার চাকরির ব্যাপারে গত ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এবার তারা জনগণের সামনে জবাবদিহি করতে পারত। কেননা তারা অধিকাংশকেই চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জবাব জনগণ দিতে পারবে কি না তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। কেননা তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত। তবে অনেকে বলছে, জনস্রোত নামবে। কিন্তু কেন জানি, আমার কাছে পরিস্থিতি খুবই থমথমে মনে হচ্ছে। খুবই ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে।
দেশ রূপান্তর : আমরা বাংলাদেশে প্রায়ই দেখে আসছি নির্বাচনী ফলাফল বিরোধীরা মেনে নেয় না। আর নির্বাচনী সহিংসতা ঘটে। এবারের নির্বাচনের পর কি এর ব্যত্যয় না পুনরাবৃত্তি ঘটবে?
দিলারা চৌধুরী : নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বা ফলাফল মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি নির্ভর করে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কি না তার ওপর। কেননা যারা বিরোধী দলে পরিণত হয় তারা যদি দেখে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি তখন তারা ফল মেনে নিতে চায় না। এটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশে একমাত্র অর্থবহ নির্বাচন হয়েছে ১৯৯১ সালে। আর বাকি সব নির্বাচনই বিতর্কিত। নির্বাচন সুষ্ঠ না হলে যারা বিজয়ী হবে তারা সরকার গঠন করতে পারবে না, তা আমি বলছি না। তবে সেই ফলাফল বিরোধী দল মেনে নিতে পারে না। আর বিরোধী দল ফল না মানলে সেই নির্বাচনের অর্থবহতা থাকে না।
দেশ রূপান্তর : সংসদে সক্রিয় বিরোধী দলের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
দিলারা চৌধুরী : সব সময়েই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের এখানে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব রয়েছে। বিরোধী দলকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়নি। এখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে সরকারের যথার্থ বিরোধিতা না করার রীতি প্রচলিত আছে। যাকে রাস্তার সংস্কৃতি বলা যায়। আর বিরোধী দলে যারা পরিণত হয়, তারা নির্বাচনকে বিতর্কিত বলে মনে করে। তাই সরকারকে সহযোগিতা করে না। সরকারও বিরোধী দলকে শত্রু মনে করে। তারা বিরোধী দলকে সুযোগ-সুবিধা দেয় না। এটা প্রথম কারণ।
দ্বিতীয় কারণ আমার কাছে মনে হয় সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ। অবশ্য আমাদের দেশের বয়স নবীন, তাই এই অনুচ্ছেদের প্রয়োজন আছে। তবে ঐক্যফ্রন্ট যেভাবে তাদের ইশতেহারে বিষয়টির সমাধান দিয়েছে তা অনুসরণ করা উচিত। অনাস্থা এবং বাজেট প্রস্তাব ছাড়া সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। তাতে সরকার ভীতসন্ত্রস্ত থাকে এবং বিরোধী দল এই সুযোগকে ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশে জাতীয় সংহতির বড়ই অভাব রয়েছে। অথচ পাশের দেশ ভারতে এটা প্রবলভাবে উপস্থিত। বিরোধী দল তো সরকারেরই অংশ। তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। যেকোনো উপায়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে না। অনেকগুলো জাতীয় প্রশ্ন যেমন জাতীয় নিরাপত্তা, বৈদেশিক নীতি সরকার এবং বিরোধী দল উভয় মিলেই সিদ্ধান্ত নেবে। যেমন ভারতে যখন কোনো জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় সামনে আসে, তখন সরকার বিরোধী দলকে ডাক দেয়। তারা উভয় মিলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিরোধীরা সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে না। কিন্তু বাংলাদেশে যারা সরকারে থাকে, তারা বিরোধীদের শত্রু মনোভাবাপন্ন মনে করে এবং বিরোধীরা সরকারকে কখন গদি থেকে নামাবে সেই সুযোগে থাকে। এখানে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ না ঘটায় শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সংস্কৃতি চালু আছে। যা আমাদেরকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের অপেক্ষায় আছি কিন্তু এখনো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা গড়ে তুলতে পারিনি। পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচনের দিন ছুটি দেওয়া হয় না। অফিসের কাজের ফাঁকে ভোটাররা ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে তো পোস্টাল ভোটের ব্যবস্থা আছে। নির্বাচন নিয়ে এত হৈ চৈ খুব কম জায়গাতেই হয়। আমাদের এখানে আসলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের সুযোগ ভোটাররা খুব কমই পেয়েছে। তাই নির্বাচনকে ঘিরে তাদের এত আগ্রহ। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার খুব কম সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : আমরা বর্তমান সরকারের সময় সিলেবাস ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন এবং প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা দেখেছি। তাতে কি শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে? নতুন সরকারের কাছে শিক্ষা বিষয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
দিলারা চৌধুরী : বাংলাদেশে এই পর্যন্ত যত সরকার এসেছে তা আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি কিংবা অন্য সরকার কেউই শিক্ষার মানকে উন্নত করতে পারেনি। বিশেষ করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একদিকে মাদ্রাসা, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমনও বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু আছে। কোচিং, দক্ষ শিক্ষকের অভাব আমাদের শিক্ষার মানকে নিচের দিকে নিয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। বিদেশিরা আমাদের এখানে এসে চাকরির শীর্ষস্থানীয় পদ দখল করছে। আমি শিক্ষার একমুখীকরণের মাধ্যমে অবশ্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে একেবারে বাদ দিতে চাচ্ছি না। তাহলে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে। এর আধুনিকীকরণ দরকার। যেমনটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে করা হয়েছে। তাই নতুন যে সরকারই আসুক, তারা শিক্ষার মান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিন্দ্য আরিফ
শেয়ার করুন
দিলারা চৌধুরী | ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

নতুন ভোটারদের বিবেচনা করতে হবে কোনটি দেশের স্বার্থে আর কোনটি দেশের বিপক্ষে। মার্কা দেখে নয়, প্রার্থী এবং ইশতেহার দেখে বিবেচনা করাই শ্রেয় দিলারা চৌধুরী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দেশ রূপান্তর : মতদ্বৈধতা এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকলেও সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটা ফিরে আসবে বলে মনে করেন?
দিলারা চৌধুরী : আমার মতে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয় না। এটা নির্ভর করবে ভোটারদের ওপর। তারা ভয়ভীতি ছাড়া ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কি না এবং তাদের রায় দিতে পারবে কি না সেটাই এই প্রক্রিয়ার মূল নিয়ামক। তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই এর পূর্বশর্ত। তারা অবাধে ভোট দিতে পারলেই নির্বাচন অর্থবহ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে। আর তাহলেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যা ২০১৪ সালে ব্যাহত হয়েছিল তা আবার ফিরে আসবে।
দেশ রূপান্তর : এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটারের সংখ্যা এক কোটি ২৩ লাখ, যা মোট ভোটারের ২২ শতাংশ। তারা কি প্রথাগত দলীয় আনুগত্যে ভোট দেবে নাকি নতুন বিবেচনা কাজ করবে বলে আপনার মনে হয়?
দিলারা চৌধুরী : আমাদের দেশে মূলত মার্কা দেখে ভোট দেওয়া হয়। নৌকা না ধানের শীষ এই বিবেচনা সর্বাগ্রে কাজ করে। খুব কম লোকই প্রার্থী দেখে ভোট দেয়। দেশের অতীত নির্বাচনগুলোর ইতিহাস তাই বলে। এখন এই এক কোটি ২৩ লাখ নতুন ভোটার দলীয় আনুগত্যে ভোট দেবে নাকি নতুন বিবেচনায় ভোট দেবে তা নির্ভর করছে তাদের প্রার্থী নির্বাচনের ওপর। এদিক দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট এবার অনেক যৌক্তিক ও মৌলিক বিষয় তাদের ইশতেহারে প্রণয়ন করেছে। এ জন্য তাদের আমি সাধুবাদ জানাই। তারা ইশতেহারে সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতার ভারসাম্য, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না ইত্যাদি বিষয় যুক্ত করছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মেয়াদ দুইবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। আমরা দেখেছি খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা, সবাই দীর্ঘদিন ধরে দলীয়প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে আসছেন। এটা যেখানে গণতন্ত্র রয়েছে সেখানে দেখি না। সেখানে নেতৃত্ব বদল হয়, বিভিন্ন দল পালাক্রমে আসে। একটা নেতৃত্ব তো ৩০ বছর ধরে কর্তৃত্ব করতে পারেন না। কেননা এর মধ্যে অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। কিন্তু এখানে একই ধরনের প্রচার, একই নেতৃত্ব, একই ধরনের পারস্পরিক দোষারোপ। কোনো বৈচিত্র্য নেই। তাই ক্ষমতার প্রধান হওয়ার মেয়াদ দুইবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার মাধ্যমে একধরনের নতুনত্ব তৈরি হবে। যিনি প্রধান নেতা, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখবেন না। কেননা তিনি জানবেন তাকে একসময় চলে যেতে হবে। এটি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসারণ ঘটেছে তা থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এই ধরনের পদক্ষেপ অনুপস্থিত। তারা উল্লেখ করেনি যে তারা সংবিধান সংশোধন করে এক ব্যক্তির কর্তৃত্ব হ্রাস করবে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ৫৭ ধারা বাতিলের ব্যাপারেও কিছু বলেনি। পক্ষান্তরে, ঐক্যফ্রন্ট এই আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের ইশতেহারে। সেদিক থেকে নতুন ভোটারদের বিবেচনা করতে হবে কোনটি দেশের স্বার্থে আর কোনটি দেশের বিপক্ষে। মার্কা দেখে নয়, প্রার্থী এবং ইশতেহার দেখে বিবেচনা করাই শ্রেয়। তবে এবারের নির্বাচনে তা ঘটবে বলে আমার মনে হয় না। এ জন্য দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা অনেকাংশে দায়ী।
দেশ রূপান্তর : নির্বাচনী ইশতেহারে সব রাজনৈতিক দলই অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো এগুলোর খুব কমই বাস্তবায়িত হয়। ইশতেহারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে আপনার অভিমত কী?
দিলারা চৌধুরী : ইশতেহারে অনেকেই অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় না। এ ক্ষেত্রে আমি পাশের দেশ ভারতের উদাহরণ টানব। ইশতেহারের সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হলেও মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হতে হবে। যেমন আওয়ামী লীগ সবার চাকরির ব্যাপারে গত ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এবার তারা জনগণের সামনে জবাবদিহি করতে পারত। কেননা তারা অধিকাংশকেই চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জবাব জনগণ দিতে পারবে কি না তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। কেননা তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত। তবে অনেকে বলছে, জনস্রোত নামবে। কিন্তু কেন জানি, আমার কাছে পরিস্থিতি খুবই থমথমে মনে হচ্ছে। খুবই ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে।
দেশ রূপান্তর : আমরা বাংলাদেশে প্রায়ই দেখে আসছি নির্বাচনী ফলাফল বিরোধীরা মেনে নেয় না। আর নির্বাচনী সহিংসতা ঘটে। এবারের নির্বাচনের পর কি এর ব্যত্যয় না পুনরাবৃত্তি ঘটবে?
দিলারা চৌধুরী : নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বা ফলাফল মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি নির্ভর করে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কি না তার ওপর। কেননা যারা বিরোধী দলে পরিণত হয় তারা যদি দেখে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়নি তখন তারা ফল মেনে নিতে চায় না। এটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশে একমাত্র অর্থবহ নির্বাচন হয়েছে ১৯৯১ সালে। আর বাকি সব নির্বাচনই বিতর্কিত। নির্বাচন সুষ্ঠ না হলে যারা বিজয়ী হবে তারা সরকার গঠন করতে পারবে না, তা আমি বলছি না। তবে সেই ফলাফল বিরোধী দল মেনে নিতে পারে না। আর বিরোধী দল ফল না মানলে সেই নির্বাচনের অর্থবহতা থাকে না।
দেশ রূপান্তর : সংসদে সক্রিয় বিরোধী দলের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
দিলারা চৌধুরী : সব সময়েই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের এখানে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব রয়েছে। বিরোধী দলকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়নি। এখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে সরকারের যথার্থ বিরোধিতা না করার রীতি প্রচলিত আছে। যাকে রাস্তার সংস্কৃতি বলা যায়। আর বিরোধী দলে যারা পরিণত হয়, তারা নির্বাচনকে বিতর্কিত বলে মনে করে। তাই সরকারকে সহযোগিতা করে না। সরকারও বিরোধী দলকে শত্রু মনে করে। তারা বিরোধী দলকে সুযোগ-সুবিধা দেয় না। এটা প্রথম কারণ।
দ্বিতীয় কারণ আমার কাছে মনে হয় সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ। অবশ্য আমাদের দেশের বয়স নবীন, তাই এই অনুচ্ছেদের প্রয়োজন আছে। তবে ঐক্যফ্রন্ট যেভাবে তাদের ইশতেহারে বিষয়টির সমাধান দিয়েছে তা অনুসরণ করা উচিত। অনাস্থা এবং বাজেট প্রস্তাব ছাড়া সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন। তাতে সরকার ভীতসন্ত্রস্ত থাকে এবং বিরোধী দল এই সুযোগকে ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশে জাতীয় সংহতির বড়ই অভাব রয়েছে। অথচ পাশের দেশ ভারতে এটা প্রবলভাবে উপস্থিত। বিরোধী দল তো সরকারেরই অংশ। তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। যেকোনো উপায়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে না। অনেকগুলো জাতীয় প্রশ্ন যেমন জাতীয় নিরাপত্তা, বৈদেশিক নীতি সরকার এবং বিরোধী দল উভয় মিলেই সিদ্ধান্ত নেবে। যেমন ভারতে যখন কোনো জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় সামনে আসে, তখন সরকার বিরোধী দলকে ডাক দেয়। তারা উভয় মিলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিরোধীরা সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে না। কিন্তু বাংলাদেশে যারা সরকারে থাকে, তারা বিরোধীদের শত্রু মনোভাবাপন্ন মনে করে এবং বিরোধীরা সরকারকে কখন গদি থেকে নামাবে সেই সুযোগে থাকে। এখানে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ না ঘটায় শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সংস্কৃতি চালু আছে। যা আমাদেরকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের অপেক্ষায় আছি কিন্তু এখনো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা গড়ে তুলতে পারিনি। পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচনের দিন ছুটি দেওয়া হয় না। অফিসের কাজের ফাঁকে ভোটাররা ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে তো পোস্টাল ভোটের ব্যবস্থা আছে। নির্বাচন নিয়ে এত হৈ চৈ খুব কম জায়গাতেই হয়। আমাদের এখানে আসলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের সুযোগ ভোটাররা খুব কমই পেয়েছে। তাই নির্বাচনকে ঘিরে তাদের এত আগ্রহ। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার খুব কম সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : আমরা বর্তমান সরকারের সময় সিলেবাস ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন এবং প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা দেখেছি। তাতে কি শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে? নতুন সরকারের কাছে শিক্ষা বিষয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
দিলারা চৌধুরী : বাংলাদেশে এই পর্যন্ত যত সরকার এসেছে তা আওয়ামী লীগ হোক আর বিএনপি কিংবা অন্য সরকার কেউই শিক্ষার মানকে উন্নত করতে পারেনি। বিশেষ করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একদিকে মাদ্রাসা, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমনও বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু আছে। কোচিং, দক্ষ শিক্ষকের অভাব আমাদের শিক্ষার মানকে নিচের দিকে নিয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। বিদেশিরা আমাদের এখানে এসে চাকরির শীর্ষস্থানীয় পদ দখল করছে। আমি শিক্ষার একমুখীকরণের মাধ্যমে অবশ্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে একেবারে বাদ দিতে চাচ্ছি না। তাহলে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে। এর আধুনিকীকরণ দরকার। যেমনটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে করা হয়েছে। তাই নতুন যে সরকারই আসুক, তারা শিক্ষার মান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেবে এটাই আমার প্রত্যাশা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিন্দ্য আরিফ