
দ্য সানডে টাইমস, জাম্বিয়া
২২ আগস্ট ১৯৭১ তারিখের প্রতিবেদন
মুজিবের রাষ্ট্রদ্রোহের প্রকৃতি?
১১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার শুরু হয়েছে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছেÑ পাকিস্তানের শুরু থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহের ধরন ও ইতিহাস বোঝা প্রয়োজন। ১৯৬৬ সালে যখন মুজিবুর স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা ঘোষণা করলেন তখনই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হলো। ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে গত নির্বাচনে তার নিরঙ্কুশ বিজয় ঘটল। সরকারের সমর্থনপুষ্ট সাক্ষীরা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করলেন, তাদের উদ্ভাবিত অভিযোগ এক সময় ঝেড়ে ফেলতে হয়। স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো নতুন কিছু নয়। এমনকি পাকিস্তানের ভিত্তি হিসেবে খ্যাত লাহোর প্রস্তাব, যার খসড়া জিন্নাহ নিজেই প্রণয়ন করেছিলেন তাতে বলা হয়েছে, ভারতকে এমনভাবে ভাগ করতে হবে পূর্বে ও উত্তর-পশ্চিমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে একের অধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে যার ইউনিটগুলো হবে স্ব-শাসিত ও স্বায়ত্তশাসিত। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় ইউনিট রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্বাঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাধান্য বিস্তার করে শাসন করে গেছে। কিন্তু পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ১৯৭০ সালে মুজিব ও তার দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী করে নিয়ে আসে। তারপর গণহত্যা শুরু হয়, মুজিব আবার বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লাহোর প্রস্তাবে যে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে, মুজিবের ছয় দফায় তা-ও চাওয়া হয়নি। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
পাকিস্তান বলেছে এক সপ্তাহ আগে মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে
ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউনের ১৯ আগস্ট ১৯৭১ এর প্রতিবেদন
ঢাকা, পাকিস্তান, ১৮ আগস্ট : একজন সরকারি মুখপাত্র আজ বলেছেন বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে। পাকিস্তানি মুখপাত্র চারদিকে ছড়িয়ে পড়া সংবাদটি নিশ্চিত করে বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী এক সপ্তাহ আগে শুরু হয়েছে। সপ্তাহান্তের ছুটির পর এ সপ্তাহে তা অব্যহত রাখা হয়েছে। কোথায় বিচার হচ্ছে তিনি তা প্রকাশ করেননি। বিচারের কার্যক্রম গোপন রাখা হয়েছে, কবে নাগাদ রায় প্রকাশ করা হতে পারে সরকার তা জানায়নি।
২৬ মার্চ সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনে বিচার করা হচ্ছে, তা হচ্ছেÑ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো গুরুতর অপরাধ। আরও একটি অগ্রগতি রয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ৩০ জন সদস্যের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ থেকে শুরু করে ধর্ষণ ও খুনের প্ররোচনার অভিযোগ এনেছেন।
দু’সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ৭৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা-ের জন্য সদস্য পদে অযোগ্য ঘোষণা করেছেন এবং উপনির্বাচনের মাধ্যমে তাদের শূন্য আসন পূরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন। গত ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের প্রায় সবগুলো আসন পেয়েছে এবং কার্যত জাতীয় পরিষদে দৃঢ় সংখ্যাগরিষ্ঠতাই লাভ করেছে। কিন্তু কখনো আর পরিষদ ডাকা হয়নি এবং ২৫ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক দখলে যাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগকে দমন করা হচ্ছে। এদিকে, দু’সপ্তাহ আগে পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রে সামরিক দখলদারি শুরুর আগে আওয়ামী লীগের সদস্যরা ১,০০,০০০ অবাঙালিকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে
ডের স্পিগেল
‘তার অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড হবে’
বন, ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি, ৩০ আগস্ট ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়তি পশ্চিম-পাকিস্তানি সামরিক ট্রাইব্যুনাল গোপনে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। বিচারক শফি এরই মধ্যে তা জেনে গেছেন : ‘অবশ্যই তাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হবে।’ গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলা থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে লায়ালপুর জেলে গোপনে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন বাংলার জন্য পর্যাপ্ত স্বায়ত্তশাসনের দাবিদার মুজিবুর রহমান। তার অপরাধ, গত বছর একটি অবাধ নির্বাচনে তিনি তার দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা যারা এতদিন ধরে শাসন করে আসছে, পাকিস্তানে বাঙালিদের আধিপত্য তাদের ভালো লাগার কথা নয়। তারা একটি রক্তাক্ত গণযুদ্ধ চাপিয়ে বাঙালিদের আক্রমণ করেছে। অভিযোগ হচ্ছে : ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা দেওয়া।’ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ইয়াহিয়া খান রায়টি অনুমান করে নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি মিস্টার কারগিল প্রেসিডেন্টকে অভিযোগ প্রত্যাহারের অনুরোধ করলে জেনারেল ইয়াহিয়া বিষোদগার করে বলেন, ‘এই লোকটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মহা-অপরাধ করেছে। তার ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়া উচিত।’
বিচার প্রক্রিয়াটি যে যথার্থ তা দেখানোর জন্য ইয়াহিয়া খান অভিযুক্তকে নিজের আইনজীবী পছন্দ করতে বললেন। মুজিবের পছন্দ এ কে ব্রোহী, কিন্তু তিনি আতঙ্কে মামলাটি প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিলেন; মর্নিং নিউজ এর সমালোচনা করে লিখেছে : পাকিস্তানে মুজিবকে সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য এবং ন্যায়বিচার ও পক্ষপাতহীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য আসামিপক্ষের মামলা গ্রহণ করতে সরকার ব্রোহীকে বাধ্য করেছে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক শফি জানেন কী হবে মুজিবের মামলায় সামরিক রায়! ‘অবশ্যই তাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হবে, পরে তা ক্ষমা করে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হবে।’ এই সর্বোচ্চ শাস্তি পাকিস্তানে বৈধ আইনি বিচারকে প্রতিষ্ঠা করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্রোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। আর মৃত্যুদ- মার্জনা করে আমরা বিশ্বব্যাপী সুনাম ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারব।’ আওয়ামী লীগের ১৬৭ জন জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যের মধ্যে মাত্র ৮৮ জন পশ্চিমের সঙ্গে সহযোগিতার কথা ব্যক্ত করেছেন। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের ২৮৮ জন মুজিব অনুগামীর মধ্যে মাত্র ৯৪ জন নতুন পরিস্থিতি মেনে নিয়েছেন। বাকি যারা শেখ ও তার দলের প্রতি এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি বিশ্বস্ত রয়েছেন তাদের ২৬ আগস্ট ৮টার মধ্যে স্ব স্ব জেলার সামরিক প্রশাসকের দপ্তরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে দাপ্তরিক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। সেখানে পছন্দের উকিলবিহীন একটি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত তাদের অপেক্ষায় আছে। যদি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা সত্যিই এই আদালতে হাজির হন তাহলে কী ঘটবে তার ধারণা মেজর ইফতেখার দিয়েছেনÑ ‘একেক জন এমন আতঙ্ক ছড়াবে যে পর্যায়ক্রমে তার তিন পুরুষকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে।’
জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি
১৪ আগস্ট ১৯৭১
পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সামরিক আদালত পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু করেছে। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ মুজিবের দল জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ ও সরাসরি বিদ্রোহের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সংবাদ জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকে গভীর আশঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, এই বিচার নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম দলের প্রধান নেতার জীবন নিয়ে শঙ্কা ব্যক্ত করে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বর উচ্চকিত করেছেন। এই দেশের জনগণ পাকিস্তান সরকারের কাছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ও মানবতার বিষয়টি মাথায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অনুরোধ জানিয়েছেন। সামরিক আদালতে বিচার অব্যাহত রাখা এবং লীগের নেতাকে দ-িত করলে তা যে কেবল সন্দেহাতীতভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে দেবে তা-ই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তা ভয়ংকর প্রভাব বিস্তার করবে। এ ধরনের পরিস্থিতির অভ্যুদয় ঘটলে তা শান্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিঘিœত করে তুলবে।
গোপন বিচার বন্ধ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিন
ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল
১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট হেলসিঙ্কিতে অবস্থিত সংস্থাটির পাকিস্তান সরকারের কাছে প্রেরিত আবেদন :
মানব আচরণের সব বিধিমালা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং বিশ্ব জনমত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত নেতার বিচারের আয়োজন করেছে। গোপনে বিচার হচ্ছে, কেউ জানে না সামরিক শাসকরা কী ঘটাতে যাচ্ছে। ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের এই কথিত বিচার হচ্ছে। আসলে এ ধরনের শব্দগুচ্ছ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে নেওয়া। ঔপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোতে শত শত ভারতীয় দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযোদ্ধার বিচার হয়েছে, ‘রাজা-সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে বিচার কখনো গোপনে হয়নি।
আর সব হত্যাকা- ও ধ্বংসযজ্ঞের মতো ইয়াহিয়ার একনায়কত্ব বিশ্বের কাছে এটাই প্রকাশ করেছে যে, এটাও জনবিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারীর অনুকারক। যে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতে বহিরাগত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন আর দোসররা আনুগত্যের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সেবা করেছেন, সেই মানুষটির একমাত্র অপরাধ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ তাকে ও তার দলকে ১৬৯-এর মধ্যে ১৬৭টি আসন উপহার দিয়েছে।
গণতন্ত্রের যে কোনো চর্চায় শেখ মুজিবুর রহমানের আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকার কথা, ইয়াহিয়া খানের আমলাতান্ত্রিক-সামরিক-সামন্ততান্ত্রিক গোষ্ঠী তাকে ক্ষমতা অর্পণ করতে এবং জনগণের প্রকাশ্য রায় মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। কাজেই জাতীয় আচরণ ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ ব্যত্যয় আচরণ ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ ব্যত্যয় ঘটিয়ে সঙ্গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বসানো হয়েছেÑ উদ্দেশ্য, ক্ষমতালোভী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা, যারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর মধ্যে শত-সহস্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ পৃথিবীর সর্বত্র জনমত পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যায় বিহ্বল হয়ে পড়েছে এবং এই ট্র্যাজেডি অবিলম্বে যদি বন্ধ না করা হয় তাহলে এটা সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিতে সমগ্র অঞ্চল বড় মাপের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে, যা হয়ে উঠবে বিশ্বশান্তির জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। পৃথিবীর বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন মতের মানুষ সর্বসম্মতভাবে জানিয়েছেন এখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান।
কেবল শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তার ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমাধান বের করা সম্ভব। কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন। গোপনে তার বিচার করে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- দেওয়ার মতো অভিযোগ দায়ের করা বরং অকারণে ধ্বংসযজ্ঞকেই ডেকে আনা হবে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
হাতে ক্যানুলা বসানো। মাথার নিচে হাত রেখে হাসপাতালের বেডে ঘুমিয়ে থাকা ছয় বছর বয়সী ছেলের ছবি দিয়ে ফেইসবুকে এক বাবার হৃদয়ভাঙা কথা, ‘আমার ছেলের এই ঘুম ভাঙাতে পারলাম না। কতটা অসহায় ছিলাম আমি। আজও আমি কতটা অসহায় যে, ছেলের জন্য বুক ফেটে গেলেও চিৎকার করে কাঁদতে পারি না।’
ঢাকা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট ইয়াসিন মিয়া যিনি ঢাকা বারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন, তার একমাত্র ছেলেটি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় ১১ জুলাই। ‘ছোট পাঞ্জাবিটা পরবে কে এখন’! ৩৪ দিন বয়সী সন্তানের মৃত্যুর পর এক মায়ের আক্ষেপ নিয়ে এই শিরোনামে নিউজ ছেপেছে দৈনিক প্রথম আলো। ঠিক করা ছিল, সন্তানের বয়স ৪০ দিন পূর্ণ হলে আনন্দ অনুষ্ঠান করবেন। সে অনুষ্ঠানে পরার জন্য ওই ছোট্ট শিশুর মাপে পাঞ্জাবিও বানিয়ে রেখেছিলেন। তার সঙ্গে ম্যাচ করে একই কালারের ড্রেস বানিয়েছিলেন মা, বাবা ও বড় বোন। কিন্তু ৪০ দিনের অনুষ্ঠান আর করা হলো না। ৩৪ দিন বয়সেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০ জুলাই মারা যায় ছোট্ট শিশু মুসা। মাত্র এক দিনের জ্বরেই মা-বাবার সব স্বপ্ন শেষ! এমনি মৃত্যু যে কত হৃদয়বিদারক! এ পর্যন্ত অন্তত চারজন চিকিৎসকসহ অর্ধশত মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের স্ত্রীও আছেন এ মৃত্যুর তালিকায়। গতকাল ৩১ জুলাই রাতেই ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেলেন পুলিশের এক নারী এসআই। ডেঙ্গুর কবলে পড়ে যারা পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, তাদের কারও কারও কথা হয়তো আমরা জানি। কিন্তু যে অসংখ্য মানুষ এ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্টে ভুগছেন, তার কয়জনের খোঁজ রাখি আমরা? ডেঙ্গু জ্বর থেকে উঠে এসে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল দৈনিক ইত্তেফাকের এক সিনিয়র নারী সাংবাদিক তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ফুল হাতে দুই মেয়রের যুগল ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তা তুমি কি এদের একজনকেও দেখতে পাও না?’ এটিএন বাংলার আরেকজন নারী সাংবাদিক তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ডেঙ্গুতে আজও মৃত্যু। দুই মেয়র সব কাজ বাদ দিন। কোষাগারের টাকায় সত্যিকার ওষুধ আনুন এবং ছিটান। মানুষ বাঁচান। নয়তো কে জানে, হয়তো আপনিও...’। এমন কথা কতটা কষ্ট আর ক্ষোভ জমা হলে একজন মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, তা বোঝার ক্ষমতা কি ক্ষমতাসীনদের থাকে! মশা তো আর আওয়ামী লীগ, বিএনপি বোঝে না। জামায়াত, জাতীয় পার্টি বোঝে না। ডান, বাম বোঝে না। বোঝে না ধনী গরিবও। এ সমস্যাটা যে সবার, সেটা বুঝতে চাননি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-মেয়ররা। মেয়ররা বলেছেন, এসব গুজব, সরকারবিরোধীরা গুজব ছড়াচ্ছে। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তো বিষয়টাকে পাত্তাই দিতে চাননি। তিনি বলে দিলেন, ‘হঠাৎ করে এডিস মশা বেড়ে যাওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা রোহিঙ্গাদের মতো, যে কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এই মশাগুলো অনেক হেলদি ও সফিস্টিকেটেড। এডিস মশার প্রোডাকশন অনেক বেশি। যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন আমাদের দেশে এসে বেড়েছে, সেভাবেই এই মসকিউটো পপুলেশনও বেড়েছে। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তবে মশা নিধন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ না, এটি সিটি করপোরেশনের কাজ।’ তিনি সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫-২০ জন মারা যায়, সাপের কামড়ে মারা যায় ১০ জন, হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় শত শত লোক। সুতরাং ডেঙ্গুতে এই কজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে এত হইচইয়ের কিছু নেই। এই কথাগুলো তিনি কোনো মেঠো বক্তৃতায় বলেননি। বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আয়োজিত ডেঙ্গু : চেঞ্জিং ট্রেন্ডস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট আপডেট শীর্ষক এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে। একজন মন্ত্রী কতটা অমানবিক হলে এই বক্তব্য দিতে পারেন সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তবে তার সুরাহা হওয়ার আগেই মন্ত্রী মহোদয় স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সবার ঈদের ছুটি বাতিল করেছেন এবং অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার্থে মালয়েশিয়া গেছেন। ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে আছে লুকোচুরি খেলা। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, এ সংখ্যা ব্যাপক। কিন্তু তাতে নাখোশ মেয়র সাহেবরা। উল্টো হুমকি দিয়ে রেখেছেন। বলেছেন, ছেলেধরার গুজবের মতোই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যু নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। যদি কেউ এ ধরনের অতিরঞ্জিত তথ্য প্রচার করে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, তার ধারণা পাওয়া গিয়েছিল আগেই। চলতি বছরের শুরুতেই এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির শঙ্কা প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। সেই শঙ্কার কথা দুই সিটি করপোরেশনকে জানানো হলেও প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়নি তারা। ঢাকা শহরে বসবাসকারীরাও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিলেন। সংবাদমাধ্যমেও নিয়মিত আসছিল এ ভয়াবহতার খবর। কিন্তু তাতে সায় ছিল না এক ঢাকার দুই মেয়রের। সংবাদমাধ্যম বলছে পরিস্থিতি খারাপ, হাইকোর্ট বলছে পরিস্থিতি মহামারী হতে আর বাকি নেই। কিন্তু দুই মেয়র এই বিষয়ে ভিন্নমতে অনড়। দক্ষিণের মেয়র সাইদ খোকন উল্টো ধমক দিয়ে বলেছেন, ছেলেধরার মতোই গুজব ছড়ানো হচ্ছে ঢাকার ডেঙ্গু নিয়ে। এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম ডেঙ্গুর দায় অবলীলায় নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেছেন, কারও বাসাবাড়িতে ডেঙ্গু মশা জন্মানোর আলামত পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভাবখানা এমন, তারা তাদের সব দায়িত্ব পালন করছেন, শুধু নাগরিকদের অসহযোগিতার কারণেই পারছেন না ঢাকাকে মশামুক্ত করতে। একপর্যায়ে লাইনে এসেছেন দক্ষিণের মেয়র। অবশেষে তিনি বলেছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। বিদেশে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী মশা মারার ‘কার্যকর ওষুধ’ ছিটাতে নির্দেশ দেওয়ার পর এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে ঘোষণার পর অবস্থান পাল্টান খোকন। কিন্তু তত দিনে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এই যে ডেঙ্গু মহামারী হওয়ার মতো করে ছড়িয়ে পড়ল, এক আতঙ্কময় বিভীষিকা হয়ে এলো, তার দায়টা কার? স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার দায় এড়িয়ে বলেছেন, মশা নিধন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ না, এটি সিটি করপোরেশনের কাজ। আর সিটি মেয়ররা দায় চাপাতে চেষ্টা করছেন নগরবাসীর ওপর। তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাসাবাড়ির ভেতরে জমে থাকা পানিতে জন্মানো মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বটাও নগরবাসীর। কিন্তু এই নগরের পথে-ঘাটে রাস্তায় বা উন্নয়নকাজে ব্যবহৃত ফেলে রাখা পাত্রে কি পানি জমে না? তাতে কি মশা জন্মায় না? সে মশা কি তারা নিয়ন্ত্রণ করেছেন? তাদের কি দায় নেই মশা নিয়ন্ত্রণের? এ বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘মশা নিধনে সঠিক সময়ে দুটো সিটি করপোরেশনের কাজের ব্যর্থতার কারণেই ডেঙ্গু এতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই ডেঙ্গুর উৎপাত তো নতুন কিছু না। গত ১০ বছর ধরেই চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে তো তাদের আগে থেকেই একটা পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল। সুতরাং এখানে দুই সিটির অগ্রিম পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টি স্পষ্ট। যখন শুরু হয়ে গেছে, তখনো তাদের বেসামাল দেখা গেছে। তারা কী করবেন, সেটা যেন বুঝতে পারছেন না।’ তবে এই বিশৃঙ্খল অবস্থার পেছনে যে ভয়াবহ দুর্নীতি সে কথাটি বলেছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের স্বজনরাই এর ব্যথা বোঝেন। এতে দুর্নীতিবাজদের খারাপ লাগার কথা নয়। কারণ তাদের সন্তানরা এ দেশে থাকে না। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নিধনে অকার্যকর ওষুধ আমদানি, সরবরাহ ও কেনায় দুর্নীতি ও জড়িতদের ব্যাপারে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশও দিয়েছে হাইকোর্ট। মশা মারতে কামান দাগানোর নামে যে দুর্নীতি হয়েছে, ঢাকায় তার কিছুটা চিত্র পাওয়া যায় ২৯ জুলাই ২০১৯ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টে। পত্রিকাটি লিখেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মশা নিধনে বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামান্য কমে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, উত্তর সিটিতে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ হয় ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, উত্তর সিটিতে ২০ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে কিছুটা কমেছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মশক নিধন খাতে ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশন করেছে ২১ কোটি টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চলতি অর্থবছরে ২৮ কোটি টাকার ওষুধ কেনার কথা ভাবছে। অন্যদিকে ডিএনসিসিতে গত অর্থবছরে ১৮ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক নগরবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি দুই সংস্থার গবেষণায় সিটি করপোরেশনের মশা নিধনের ওষুধ যে অকার্যকর তা প্রমাণিত। তারপরও এই অকার্যকর ওষুধ কিনে আসলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা জলে ফেলা হয়েছে। মশা মারা ওষুধ কেনার নামে দুর্নীতির আরও ভয়াবহ চিত্র দিয়েছেন সাংবাদিক শিশির মোড়ল ৩১ জুলাই প্রথম আলোতে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) মশকনিধনের ওষুধ পরীক্ষা করে বলেছে, এটি অকার্যকর। একই ওষুধ পরীক্ষা করে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখাও (সিডিসি) বলেছে অকার্যকর। উত্তর সিটি করপোরেশন লিমিটেডের ওষুধ মাঠ পরীক্ষায় অকার্যকর বলে বাতিল করেছে। উত্তরের বাতিল করা ওষুধ দক্ষিণে ব্যবহৃত হচ্ছে।’ এই যে জনগণের ট্যাক্সের টাকা চুরি, দায়িত্বে অবহেলা, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা, মৃত্যু, ভোগান্তিÑ এর বিচার কি কোনো দিন দেখবে না এ দেশের মানুষ? লেখক : চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
তবে এই বিশৃঙ্খল অবস্থার পেছনে যে ভয়াবহ দুর্নীতি, সে কথাটি বলেছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের স্বজনরাই এর ব্যথা বোঝেন। এতে দুর্নীতিবাজদের খারাপ লাগার কথা নয়। কারণ তাদের সন্তানরা এ দেশে থাকে না। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নিধনে অকার্যকর ওষুধ আমদানি, সরবরাহ ও কেনায় দুর্নীতি ও জড়িতদের ব্যাপারে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশও দিয়েছে হাইকোর্ট।
লেখক
চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
সংবিধানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, সব ক্ষেত্রে সাংবিধানিক শর্ত পূরণে সক্ষম হইনি আমরা। এই সক্ষমতা রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দীর্ঘ প্রচেষ্টার বিষয়ও বটে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নাগরিকে অধিকারের ন্যূনতম সুফল থেকেও বঞ্চিত হয় মানুষ। মুমূর্ষু ব্যক্তিকে চিকিৎসায় সহায়তা করা, সড়কে চলাচলে অ্যাম্বুলেন্সকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এমন বিষয় যা দেশে দেশে সব সমাজে স্বাভাবিক মানবিক বোধ হিসেবেই চর্চিত। এজন্য কোনো রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যখন কেউ রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের অপব্যবহার করে অগ্রাধিকার নেওয়ার নামে সাধারণের অধিকার হরণ করেন তখন বিপত্তি বাধে। আর এই তথাকথিত অগ্রাধিকারের চর্চায় যখন সাধারণ মানবিকতাও বিসর্জন দেওয়া হয় তখন সমাজে ধিক্কার ওঠাই স্বাভাবিক। একজন ভিআইপির জন্য তিন ঘণ্টা ফেরি আটকে রাখার কারণে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা মুমূর্ষু কিশোর তিতাস ঘোষের মৃত্যুতে সম্প্রতি সারা দেশে যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে; তার অন্তর্নিহিত কারণ সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এমন অগ্রাধিকারের অপব্যবহার।
নড়াইলের কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষ মামাতো ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিল। প্রথমে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আইসিইউ সুবিধা সংবলিত একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছিল। ২৫ জুলাই রাত ৮টার দিকে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্সটি। তখন ‘কুমিল্লা’ নামে একটি ফেরিঘাটে যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। অনেক অনুরোধের পর ওই ফেরিতে ওঠানো হয় অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু সরকারের এটুআই প্রকল্পের এক যুগ্ম সচিবের পিরোজপুর থেকে ঢাকায় ফেরার জন্য ওই ফেরিটি প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ঘাটে আটকে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। মস্তিষ্কে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়ে অপেক্ষারত ফেরিতেই মারা যায় কিশোর তিতাস। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তিতাসের মৃত্যু নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে তদন্তের দাবি ওঠে। একইসঙ্গে ভিআইপি প্রটোকলের অপব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা স্পষ্ট করারও দাবি ওঠে।
তদন্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা তদন্তে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে তা ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও ১৭তম বিসিএসের এক কর্মকর্তাকে। অথচ অভিযুক্ত কর্মকর্তা ১৩তম বিসিএসের কর্মকর্তা। একজন জুনিয়র অফিসারের নেতৃত্বে সিনিয়র অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রশাসনিক বিধিবিধানের বরখেলাপ এবং এতে তদন্ত সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য ইতিমধ্যে বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে। তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে, উচ্চ আদালত বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে তিন সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে ‘অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদার নিচে নন’ এমন কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
ভিআইপিরা রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন; কিন্তু সেটা কখন, কীভাবে এবং কোথায় কতটুকু সুবিধা বা অগ্রাধিকার পাবে তা অবশ্যই স্পষ্ট হওয়া উচিত। সেটা স্পষ্ট না থাকায় কারা ‘ভিআইপি’ মর্যাদা পাচ্ছেন, কোন মাপকাঠিতে তারা ‘ভিআইপি’ হচ্ছেন এবং কোন ক্ষেত্রে কারা কী অগ্রাধিকার পাচ্ছেন তার সীমারেখা স্পষ্ট করাটা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত কিশোর তিতাসের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা রিটের শুনানিতে বুধবার যে মন্তব্য করেছে তা বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। উচ্চ আদালত বলেছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কেউই ‘ভিভিআইপি’ নন, আর ‘ভিআইপিরা’ শুধু নিরাপত্তা সুবিধা ভোগ করবেন। আশা করা যায় এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভিআইপিদের প্রাপ্য সুবিধা বা অগ্রাধিকারগুলো স্পষ্ট করবে। একই সঙ্গে কোনো ভিআইপি নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি হবে, তা স্পষ্ট করাও সরকারের দায়িত্ব। তবে সবচেয়ে জরুরি বিবেচনা হলো, এমন বিশেষ কাউকে কোনো বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বিঘœ ঘটানো কিংবা সাধারণ নাগরিকদের হয়রানি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
১৮৪৫ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন কলকাতার সুবিদিত জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবসায় বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তার জন্ম ১৭৯৪ সালে। তার জীবনযাপন ছিল রাজসিক ও জাঁকজমকপূর্ণ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা। তিনি প্রথমে ইংরেজদের স্কুল এবং পরে উইলিয়াম অ্যাডামসের কাছে ইংরেজি শেখেন। কিছুদিন আইন ব্যবসা করেছেন। পরে সুপ্রিম কোর্টে জমিদারের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। এভাবে নিজেও অর্থকড়ির মালিক হন এবং বিপুল জমিজমা কেনেন। ব্রিটেনে অবস্থানকালে তার সমকালীনরা তাকে প্রিন্স নামে অভিহিত করে এবং কলকাতায়ও তিনি প্রিন্স হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮২৩ সালে চব্বিশ পরগনার নিমক মহলের দেওয়ান নিযুক্ত হন। ছয় বছর পর শুল্ক, লবণ ও অহিফেন বোর্ডের দেওয়ান হন। তিনি ‘ম্যাকিনটোশ অ্যান্ড কোং’-এর অংশীদার ও কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন। ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও ছিলেন। কয়েকটি বীমা কোম্পানিরও পরিচালক হন। রেশম ও নীল রপ্তানি, কয়লাখনি, চিনিকল ও জাহাজ নির্মাণ ব্যবসা করেছেন। জনহিতকর অনেক কাজও তিনি করেছেন। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৮১৯ সালে তিনি রামমোহন রায়ের ‘আত্মীয় সভা’র সদস্য হন। তার বিশ্বাস ছিল, ইংরেজরা এ দেশে উপনিবেশ করলে ভারতবর্ষের উন্নতিই হবে। ১৮২৯ সালে তিনি রামমোহনের সঙ্গে ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’ ও ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। কলকাতায় পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনেও তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৮৩৩ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি হিন্দু কলেজের অন্যতম পরিচালক ছিলেন। ভারত সরকার তাকে ‘জাস্টিস অব দ্য পিস’ খেতাবে ভূষিত করে।
গত সোমবার ২৩ জানুয়ারি আয়কর আইন-২০২৩-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, এই আইনের ফলে আয়কর নির্ধারণে কর্মকর্তার ক্ষমতা কিছুটা কমানো হয়েছে। সেই সঙ্গে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন প্রদান আরও সহজ করা হবে। ব্যবসায়ীদের আয়কর নির্ধারণে আগে ২৯টি বিষয় মানদ- ছিল। এখন তা কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। মানুষ যাতে ট্যাক্স দিতে উৎসাহিত হন এবং ট্যাক্সের পরিধি যাতে বাড়ে সেজন্য এই আইনটি করা হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, করদাতার করের পরিমাণ আয়কর কর্মকর্তার নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকছে না এই আইনে। করদাতার দেওয়ার তথ্যের ভিত্তিতেই কর নির্ধারিত হবে। ফলে কর্মকর্তার চাপিয়ে দেওয়া করের পরিমাণ ঠিক করার ফলে আপিলের পরিমাণ কমবে, কমবে করদাতার হয়রানি।
বাংলাদেশের আয়কর আইনের যদি সুরতহাল রিপোর্ট করা যায় তাহলে বিদ্যমান আয়কর আইনটি জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে এখনো নিবর্তন ও প্রতিরোধাত্মক প্রতীয়মান হয়। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদান, বিভিন্ন সেবার বিনিময়, কিংবা উৎপাদন বা সম্পদ ব্যবহার বাবদ নানান নামে নানান উপায়ে রাজস্ব বা টোল বা ট্যাক্স আদায়ের প্রথা সেই আদি যুগ থেকে চলে এলেও আধুনিক আয়কর বলতে যে বিশেষ কর রাজস্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত, এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে তার প্রবর্তন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, সাত সাগর তেরো নদীর পাড় থেকে আসা বিদেশি বেনিয়াদের দ্বারা। তাদের তৎকালীন সমাজে শিল্পবিপ্লবের পর পুঁজির প্রসার ঘটে এবং সেখানে সম্পদের ওপর, সম্পদ সৃষ্টি ও বিনিময় প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত আয় অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ওই অতিরিক্ত আয়ের ওপর একটা হিস্যা দাবি করে বসে, যুক্তি এই, তুমি রাষ্ট্রের তৈরি অবকাঠামো ব্যবহার করে আয়-উপার্জন করছো, রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধা ভোগ করে লাভবান হচ্ছো সুতরাং এসব অবকাঠামো নির্মাণ, এসব সুযোগ-সুবিধার সমাহার বাবদ রাষ্ট্রের বিনিয়োগে তোমার অংশগ্রহণ চাই।
এ দেশে যারা আয়কর আইন আমদানি করেছিলেন, যে সময় এনেছিলেন, যাদের জন্য এনেছিলেন এবং যাদের ওপর অর্পিত হয়েছিল এর প্রয়োগ-প্রবর্তনের ভার তাদের প্রত্যেকের নাড়ি-নক্ষত্র পরীক্ষা-পর্যালোচনায় বিদ্যমান আয়কর আইনের চরিত্র ও চারিত্র্য, এর শরীর ও শারীর শনাক্তকরণ সহজ হতে পারে। আমরা জানি এ দেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। রেজা খান, সেতাব রায়দের মাধ্যমে রাজস্ব মাসোহারাপ্রাপ্তির পর্ব পেরিয়ে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতি পদ্ধতিতেই চালিয়েছিল শাসনকার্য।
কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল এক্সপোর্ট বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে ইমপোর্ট পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যার হাউজ অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলেই শাসকের সঙ্গে শাসিতের দায়-দায়িত্ব পালনের প্রশ্ন সামনে আসে এবং ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এ দেশের অর্থনীতি।
এই প্রেক্ষাপটেই উৎপাদন, বিপণন, বাণিজ্য ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের যৌক্তিকতা দেখা দেয়। প্রথমে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত সীমিত অবয়বে আয়কর আদায়ের আয়োজন চলে। মাঝে বন্ধ হয় কার্যক্রম। আবার ১৮৮০-এর পর কয়েক বছর পরীক্ষামূলকভাবে চলে। সরকার স্থায়ীভাবে কোনো আইন না করে, স্থানীয়ভাবে এসআরও বা সার্কুলার জারি করে আয়কর আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে এসব সার্কুলার ব্রিটিশ আইনের আদলে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রণীত হলেও এ দেশীয় করদাতাদের প্রতি তাদের বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা প্রতিরোধমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেই সার্কুলারের বাকপ্রতিমায় প্রাধান্য পায়।
করযোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধিবিধানের ভাষায় এমন এক ধরনের মনোভাবের প্রকাশ পায়, যা জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক হয়ে ওঠে। এ ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতিতে, তৎকালীন প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে করদাতাদের শলাপরামর্শ দেওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই একটি ব্যবহারজীবী বিজ্ঞ সহায়ক সমাজও গড়ে ওঠে। কিন্তু তাদেরও অগোচরে, কর আইনকে সহজ ও করদাতাবান্ধবকরণে তাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পরামর্শ সত্ত্বেও এ দেশে প্রবর্তিত আয়কর-সংক্রান্ত সার্কুলারসমূহে জটিলতা যুগলবন্দি হয়ে ওঠে সময়ের প্রেক্ষাপটে।
ঔপনিবেশিক সরকারের তরফে করদাতাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় না এলেও কর আদায়ের ক্ষেত্রে জমিদারদের পাইক-পেয়াদাসুলভ যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে। উদ্দেশ্য থেকে যায় ‘তোমার আয় হোক আর না হোক অর্থাৎ বাঁচো বা মরো রাজস্ব আমার চাই’। এ ধরনের আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে কর আদায়কারী বিভাগের সঙ্গে করদাতাদের সম্পর্ক যুক্তিসংগতভাবে দর-কষাকষি বা কিছুটা জবরদস্তিমূলক, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার কৌশলাভিমুখী হয়ে পড়ে। অন্তরালে ব্রিটিশ প্রশাসনে বহুল কথিত একটা সাধারণ নির্দেশনা ছিল যেন এ রকম, ‘চোর তো চুরি করিবেই কিন্তু গৃহস্থকে সজাগ থাকিতে হইবেই’। করদাতাদের এরূপ বিরূপ ধারণায় বিবেচনা এবং তাদের ধরার ইন্ধন কর আইনের ভাষ্যে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরূপ পরস্পর অবিশ্বাসের ও প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবেশে কর নির্ধারণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার এবং সে লক্ষ্যে অনৈতিক আঁতাতের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতিরও সূত্রপাত ঘটে।
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ততার এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টিতে সেই সময়কার আয়কর আইনের ভাষায় যেন ছিল পরোক্ষ প্রেরণা। এমন অনেক আইন আছে যা বেআইনি আচরণকে উসকে দেয়। এ রকমই পরিবেশে আঁতাতের মাধ্যমে কর ফাঁকি কার্যক্রমে একটা অনভিপ্রেত সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। এই জটিল, অনভিপ্রেত ব্যবস্থাদি আয়কর সার্কুলারের ভাষায় যেন প্রতিফলিত হতে থাকে। তদানীন্তন ব্রিটেনে বিদ্যমান আয়কর আইন ও প্রয়োগ পদ্ধতি প্রক্রিয়া থেকে সে সময় এ দেশে প্রণীত ও প্রবর্তিত আইন ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বিচ্যুতি ও পরিবর্তন পরীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তাই-ই ‘ভারতীয় আয়কর আইন’ আকারে ১৯২২ সালে সংকলিত ও প্রবর্তিত হয়।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও, এক যুগেরও বেশি সময় সেই ১৯২২ সালের আয়কর আইন ভারত স্থলে পাকিস্তান, পাকিস্তান স্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত ও নামাঙ্কিত হওয়া ছাড়া প্রায় একই মেজাজে বলবৎ ও প্রযোজ্য থাকে। আয়কর অধ্যাদেশ (১৯৮৪ সালের ৩৬ নম্বর অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয়। তবে তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও গণগুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। দাবি উঠেছে অধ্যাদেশের স্থলে আয়কর আইন প্রণয়নের। আইনসভার অনুমোদনে প্রণীত না হওয়ায় লক্ষ করা যায় অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা, উপধারাসমূহ তথা বিধানাবলি মূলত ১৯২২ সালের মূল আইনেরই স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রদত্ত প্রেসক্রিপশনের আলোকে প্রণীত এবং এটি সে হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বছর বছর অর্থ আইনে যেসব ছিটেফোঁটা শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন অনুমোদিত হয়েছে তা ধারণ করা ছাড়া ১৯২২-এর মূল আইনের ভাব, ভাষায় দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দৃশ্যগোচর হয় না। বরং প্রতি বছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার-আচারে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ, নিষ্কৃতি তথা ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করতে অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃৃতিও সুবিধা-সংক্রান্ত মৌল দর্শন হয়েছে কখনো বা বিভ্রান্ত, কখনো বিকৃত ও ক্ষেত্রবিশেষে বিস্মৃত। পক্ষান্তরে, যুগধর্মের সঙ্গে সংগতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায়-সংক্রান্ত বিধানাবলি সহজীকরণ, সরলীকরণ তথা করদাতাবান্ধবকরণের পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে আরও জটিল হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতির সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে আয়কর ব্যবস্থাকে সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ-সংবলিত সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন প্রয়াস বারবার যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাস্তব ও বাস্তবায়ন যোগ্যতার বিবেচনাকে সামনে রেখেই নতুন আয়কর আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, যা মন্ত্রিপরিষদ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। নির্বাহী বিভাগ প্রণীত, প্রস্তাবিত খসড়া আইনটিকে প্রকৃত প্রস্তাবে আইনে পরিণত করার দায় এবং দায়িত্ব এখন আইন পরিষদের ওপর। জাতীয় সংসদে এটিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যুগোপযোগী তথা প্রকৃত প্রস্তাবে বাস্তবায়নযোগ্য করেই অনুমোদিত হবেএটিই বিধিসংগত প্রত্যাশা। এটি যেন শতাব্দী ধরে চলে আসা ঔপনিবেশিক অসম্মান হয়রানির হেতুতে পরিণত না হয়, এটির মধ্যে যেন গণপ্রজাতন্ত্রী মনোভঙ্গির প্রকাশ পায়।
এ ক্ষেত্রে ২০১২ সালে পাস করা নয়া ভ্যাট আইন প্রবর্তনে অনাকাক্সিক্ষত বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতা স্মর্তব্য। করদাতাদের কাছে সেবাধর্মী মনোভাব নিয়ে না গেলে, তাদের আস্থায় যেমন আনা হবে না এবং তাদের স্থায়ী করদাতা হিসেবেও পাওয়া যাবে না। আস্থা সৃষ্টির জন্য কর বিভাগে আপিল শোনার জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচার বিভাগীয় সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার ব্যবস্থা এবং করদাতাদের আস্থা সৃষ্টিতে হয়রানি কমাতে কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা হ্রাস পরিকল্পনার পদক্ষেপ হিসেবে এ আইনের মধ্যে প্রতিবিধানের ব্যবস্থার নিশ্চয়তা কল্পে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটিও উঠে আসবে। উঠে আসবে কর প্রদানে সবাইকে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে করের টাকা ব্যয়বণ্টনে স্বচ্ছতা বিধানের বিষয়টিও।
লেখক: উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক
বাংলাদেশের যে কয়টি গর্ব করার বিষয়, তার মধ্যে অন্যতম পাট ও পাটশিল্প। বহুকাল বিশ্বের বুকে এ ভূখণ্ডের মর্যাদার অন্যতম প্রতীক ছিল সোনালি আঁশ নামে পরিচিত এ কৃষিপণ্য। কেবল অর্থকরী ফসল বলে নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে পাটের ভূমিকা একটি স্বীকৃত ইতিহাস। সেই গর্বের অতীত না থাকলেও পাট এখনো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি হয়েছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ২৬ লাখ ডলার। এর মধ্যে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। যা ওই বছর মোট রপ্তানি আয়ের ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পণ্যের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১২৮ কোটি ডলার। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় হলেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রথম। বর্তমানে বাংলাদেশ পাট দিয়ে ২৮২টি পণ্য উৎপাদন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। চলতি অর্থবছরে পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে ৫৮ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পাট ও পাটজাত পণ্য বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরে ‘সোনালি আঁশে অফুরান আশা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগামী ৫ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক সিটিতে ‘এনওয়াই নাও উইন্টার শো’ নামে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বাণিজ্যমেলায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ১৪টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পাটজাত পণ্য প্রদর্শন করা হবে। এটি আমাদের জন্য দারুণ একটি সুযোগ। পাট ও প্রাকৃতিক আঁশ জাতীয় পণ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলার পাশাপাশি রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে। পাটজাত পণ্য পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশে প্রচুর পাট উৎপাদন হলেও পাটজাত পণ্য প্রস্তুতকারকদের মধ্যে বৈশি^ক বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও এর প্রয়োগের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে পাটের উৎপাদনও কমছে। ফলে অনেক এসএমই উদ্যোক্তা পাটভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করলেও বিবাজারে তাদের প্রবেশাধিকার সীমিত। বাংলাদেশ হর্টিকালচার অ্যাকটিভিটির এই উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় এসএমই প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বাজার উপযোগী পণ্য দেখার, এ-সম্পর্কে শেখার এবং পণ্যের ডিজাইন করা ছাড়াও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরমে বাংলাদেশি পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন। এই আয়োজনে বাংলাদেশের পাটপণ্য প্রদর্শনের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া সংস্থা ও উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ ধরনের আন্তর্জাতিক পরিম-লে উদ্যোগ ও আয়োজন আরও প্রয়োজন।
একুশ শতকে এসে সারা বিশ্বে সিনথেটিক ফাইবারের বদলে পাট এবং পাটের মতো অর্গানিক ফাইবারের কদর এবং চাহিদা দুটোই উত্তরোত্তর বাড়ছে। অথচ এই যুগে এসেই একদা সোনালি আঁশের দেশ খ্যাত বাংলাদেশে সব সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাটশিল্পের ধারাবাহিক ক্রমাবনতি কোনো যুক্তিতেই ধোপে টেকে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এবং দেশের বেসরকারি পাটকলগুলোও লাভজনক। আর প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে লোকসানের অজুহাতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাট খাত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, যে দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কার করতে পারেন, যে দেশকে বহির্বিশ্ব সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে চেনে, সেই দেশে ফের পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা কঠিন নয়। অন্যদিকে, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ এর প্রয়োগ পাটশিল্পকে বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারে। পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকার বহুমুখী পাটজাত পণ্যের উদ্ভাবন, ব্যবহার সম্প্রসারণে গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করতে পাট ও পাটজাত পণ্য অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। কারণ আমাদের আছে দক্ষ পাটচাষি, আছে আধুনিক উপযোগী জাত, উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা, আর আছে বহুমুখী ব্যবহারের বিভিন্ন পাটপণ্য এবং ব্যবহারের বিভিন্ন উপযোগী ক্ষেত্র। সরকারি-বেসরকারি সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পাট চাষ ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যম দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, দারিদ্র্যবিমোচন এবং সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরও বহুদূর। পাটের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। পাটের উৎপাদক, পাটকল মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থ সমুন্নত রেখে পাট খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যেসব গণহামলার ঘটনা ঘটেছে তার অর্ধেক ক্ষেত্রে হামলাকারী ব্যক্তিগত সংকট, ঘরে অশান্তি এবং কর্মক্ষেত্রে জটিলতায় ভুগছিলেন বলে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার নতুন একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। আগেই সতর্ক সংকেতগুলো চিহ্নিত করে সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ওই প্রতিবেদনটি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রয়টার্স বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ‘ন্যাশনাল থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট সেন্টার’ বুধবার ৭০ পাতার ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তারা ১৭৩টি ঘটনা যেখানে তিন বা তার বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখে। যেখানে কর্মক্ষেত্র, স্কুল, উপাসনালয়, গণ-পরিবহনসহ আরও কয়েকটি স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। ওই সব হামলায় ৫১৩ জন নিহত এবং এক হাজার ২৩৪ জন আহত হয়েছেন।
সেন্টারের প্রধান লিনা আলথারি বলেন, সাধারণত অপরাধীদের মধ্যে এমন আচরণ দেখা গেছে যা অন্যদের আগে থেকে সমস্যা চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে সহিংসতার প্রতি আগ্রহ, পূর্ববর্তী গণহামলাকারীদের প্রতি আগ্রহ, তাদের সম্পর্কে পোস্ট করা, তাদের সম্পর্কে অন্যদের সঙ্গে কথা বলা, নিজের কর্মক্ষেত্রে অস্ত্র আনা, স্কুলে অস্ত্র আনা, সহকর্মীরা তাকে ভয় করা এবং ক্রমাগত অভিযোগ করে যাওয়া, ইত্যাদি আচরণ দেখা যায়।
ঘুরে-ফিরে আমরা বারবার এসবই দেখতে পেয়েছি।
হামলাকারীদের মনোরোগে ভোগার ইতিহাসও অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে, তারা আর্থিকভাবে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন অথবা গার্হস্থ্য সহিংসতায় জড়িত। বেশিরভাগ হামলাতেই অস্ত্র হিসেবে বন্দুককে বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে হামলার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এসব হামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলাকারী পুরুষ।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় চলতি সপ্তাহেও তিনদিনে দুইবার বন্দুক হামলায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন। উভয় হামলাতেই হামলাকারী বয়স্ক পুরুষ ছিলেন। কী কারণে তারা এভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করলেন তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ।
অথচ, ভয়াবহ এই সংকট সমাধানে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে সে বিষয়ে দেশটির আইনপ্রণেতারা এখনো একমত হতে পারেননি।
জেলা প্রশাসক সম্মেলন শুরুর ঠিক আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময়ের পাশাপাশি দিকনির্দেশনা দিতে প্রতি বছর জেলা প্রশাসক বা ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সম্মেলন বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি অধিবেশনে মন্ত্রী বা সচিবরা দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য গড়ে এক মিনিটের বেশি সময় পান না। এই স্বল্প সময়ে নীতিনির্ধারকরা যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারেন না। তারা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে গেলেও সময়ের অভাবে কথা বলতে পারেন না।
নির্ধারিত সময়ে দিনের প্রথম অধিবেশন শুরু হলেও আর কোনো অধিবেশনই সময়মতো শুরু হয় না। এক অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই পরের অধিবেশনসংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিব-মহাপরিচালকসহ অন্যরা হাজির হয়ে যান। অনেক সময় পরবর্তী দুই-তিন অধিবেশনের নীতিনির্ধারকরাও উপস্থিত হয়ে যান। সম্মেলনে অধিবেশনের জট লেগে যায়। অধিবেশন শেষে তারা রাতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ভোজে অংশ নেন। এ কারণে দিনে শুরুর সময় এবং রাতে শেষের সময় ঠিক রাখতে হয়। এই ঠিক রাখতে গিয়ে অধিবেশন সংক্ষিপ্ত করা হয়। অধিবেশনে উপস্থিত থাকলেও বেশিরভাগ অতিথি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। অথচ তারা বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ডিসি সম্মেলনের প্রস্তুতি নেন এবং সম্মেলনে গিয়ে বসে থাকেন।
গত বুধবার চলতি বছরের ডিসি সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশন ছিল শিল্প, বাণিজ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে। এই তিন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ সময় ছিল মাত্র ৪৫ মিনিট। ১২টা থেকে শুরু হয়ে এই অধিবেশন চলার কথা ছিল ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। এই অধিবেশন যথাসময়ে শুরু হতে পারেনি, তাই শেষ হওয়ারও সুযোগ নেই। এই অধিবেশনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ১৭ জন। অধিবেশনগুলোতে সাধারণত ৪-৫ জন ডিসি, ১ জন বিভাগীয় কমিশনার এবং অধিবেশন সভাপতি হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বক্তব্য রাখেন। সব মিলিয়ে দ্বিতীয় দিনের চতুর্থ অধিবেশনে ২৩ জনের কথা বলার কথা। ৪৫ মিনিটের অধিবেশনে সব অতিথি এবং রেওয়াজ অনুযায়ী ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার বক্তব্য রাখলে একজনের ভাগে দুই মিনিটের কম সময় পড়ে।
স্বল্প সময় কথা বলার জন্য আমন্ত্রিত অতিথি তালিকায় ছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তিন মন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন ছিলেন প্রধান অতিথি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবং প্রধানন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এই অধিবেশনে অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ওই অধিবেশনে মন্ত্রিবৃন্দ ও উপদেষ্টা কথা বলার পর আর সময়ই ছিল না। শুধু দ্বিতীয় দিনের চতুর্থ অধিবেশনই নয়, সব অধিবেশনই এভাবে শেষ হয়। দিনের প্রথম অধিবেশন সময়মতো শুরু হয়। বাকিগুলো শুরু হয় না তো শেষ হবে কীভাবে? তিনি আরও জানান, পুরো ডিসি সম্মেলনটাই তাড়াহুড়ার মধ্যে শেষ হয়। নীতিনির্ধারণী কথা কি এক-দুই মিনিটে শেষ হয়? যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে মন্ত্রীরাই কথা বলেন। অন্য অতিথিরা বহর হিসেবে থাকেন।
দ্বিতীয় দিবসের প্রথম অধিবেশন ছিল চার মন্ত্রণালয় নিয়ে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব, চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক, সিইও, পরিচালক এ অধিবেশনে বিভিন্ন অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি অধিবেশনই এভাবে ঠাসা থাকে অতিথিদের ভারে।
একজন ডিসি জানিয়েছেন, ডিসি সম্মেলনে তাদের যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয় তার মধ্যে অনেক বিষয়ের সঙ্গেই ডিসিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। তারপরও নানা ধরনের নির্দেশনা তারা পান। একইভাবে ডিসিরাও নানা কাজের এখতিয়ার চান। যদিও শেষ পর্যন্ত এসব নির্দেশনা বা প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হয় না বলে ওই ডিসির মত।
গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া ডিসি সম্মেলন শেষ হয় গতকাল বৃহস্পতিবার।
বিরোধী দল থেকে ছিটকে পড়া বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসুক আওয়ামী লীগ চাইলেও দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও সমমনা অন্য দলগুলো তা চায় না। নির্বাচনী মিত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসুক তা চায় না। আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস মিলেছে। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও শরিক দলের এমন চাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ওই নেতারা দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, ভোটে বিএনপি অংশ নিলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকা অন্য দলগুলোর চাওয়া-পাওয়ায় অপূর্ণতা থেকে যাবে বলে তারা মনে করছেন। আসন ভাগাভাগিসহ শরিক দলের নানা চাওয়ায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে এটাও ভাবছেন তারা।
জাতীয় পার্টি নির্বাচনে বিএনপিকে না চাওয়ার কারণ সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতারা বলেন, সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা নিশ্চিত রাখতে তারাও বিএনপিকে নির্বাচনে দেখতে চায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি যেসব দাবি-দাওয়া জানিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাদের ক্ষমতার চেয়ারে বসাতে হবে। সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে বিএনপির সংবিধানের বাইরে চাওয়া মেনে নেওয়া অসম্ভব। ওই নেতা বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি যা চায় তা মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৯ আসন নিয়ে বিএনপি বিরোধী দলের আসনে বসলেও ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে নির্বাচন ঠেকানোর জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ফলে জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দলীয় আসনে বসে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপি সাতটি আসন পায়।
১৪ দলীয় জোটের শরিক ধর্মভিত্তিক দলের শীর্ষ এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচনে বিএনপি এলে অংশগ্রহণমূলক হবে, না এলে হবে না এ ধারণা থেকে দেশি-বিদেশি সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি ছাড়াও এ দেশে নির্বাচন হয়েছে, আগামী নির্বাচনও হবে। এ নেতা বলেন, জোটের অনেক বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগকে এ পরামর্শ দিয়েছেন। কারও অন্যায় চাওয়া মেনে নিয়ে তাদের নির্বাচনে আনার পদক্ষেপ নিতে তার দল ও জোটের আরও কয়েকটি দল আওয়ামী লীগকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা শরিক দলের এ পরামর্শ আমলে নেননি। তারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে। সরকারও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। এ জন্য দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক এ প্রত্যাশা করেন তারা। নির্বাচন প্রশ্নে শরিক দলগুলোর অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বলে দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিম-লীর এক সদস্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ চায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলই অংশগ্রহণ করুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ, সুষ্ঠুু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক।’ তিনি বলেন, কোন দল নির্বাচনে আসবে, কোন দল আসবে না সেটা একেবারেই নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
জানা গেছে, বিএনপিকে ভোটে না চাওয়ার কারণ একেবারেই ওই দলগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থে। বিএনপি ভোটে না এলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন নিয়ে দরকষাকষিতে যাওয়া সহজ হবে এমনটাই মনে করে শরিকরা। বিএনপি ভোটে এলে জয়ের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছোট দলগুলোর দরকষাকষি ঠিক জমে উঠবে না। কারণ, তখন আওয়ামী লীগের মাথায় জয়ের হিসাব-নিকাশই থাকবে বেশি।
জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতাও দেশ রূপান্তরকে বলেন, জাতীয় পার্টির সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা অনিশ্চিত হয়ে যাবে এ শঙ্কায় বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসুক তা চায় না। বিএনপি নির্বাচনে এলে সংসদে বিরোধী দলের আসন হারাবে জাতীয় পার্টি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সবাই সবার মতো করে রাজনৈতিক স্বার্থ দেখছে। জাতীয় পার্টিসহ আমাদের শরিক দলগুলোর ভেতরে এমন কিছু চাওয়া রয়েছে সেটা তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় ও বৈঠকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।’ তারা বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপিকে বাইরে রেখে এবারে নির্বাচন করা ঠিক সহজ হবে না। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে সরকারের ওপর চাপ আছে বিদেশিদের। আছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপও। কোনো রাষ্ট্র এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে সরকারকেই। এ পরিস্থিতিতে সে চাপ কাটিয়ে যেনতেন নির্বাচনের সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির ভেতরে ইতিবাচক দিকে থাকতে বিদেশি চাপ আছে। আবার বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও মনে করেন, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে বিএনপির। তাই নির্বাচন বর্জন নয়, নির্বাচন ঠেকাতে চাইবে তারা। নির্বাচন ঠেকাতে না পারলে বর্জন করবে না বিএনপি। নির্বাচন বর্জন করে রাজনীতি থেকে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার রিস্ক এবার আর বিএনপি নেবে না। সভাপতিম-লীর ওই সদস্য আরও বলেন, বিএনপি তাদের দাবি আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। সম্ভব না হলে শেষমেশ নির্বাচনে আসবে। কারণ, বিএনপি সরকারে না আসতে পারলেও সংসদের বাইরে আর থাকতে চায় না। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিয়ে মাঠে থাকতে পারলে সফলতা আসবে এ চিন্তায় নির্বাচনে আসবেই বিএনপি।
ফলে ক্ষমতাসীন দলের জোটসঙ্গী ও সমমনারা বিএনপি ভোটে আসুক তা না চাইলেও রাজনৈতিক পূর্বাপর পরিস্থিতিতে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন তুলতে অনাগ্রহী আওয়ামী লীগও। সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে একেবারেই সব ছেড়ে-ছুড়ে দেওয়ার মানসিকতাও দেখাবে না আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, সত্য হলো, নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশি চাপ যেমন সরকারের ওপর আছে, তেমনি বিএনপির ওপরও থাকবে। গত দুই দফার সংসদ নির্বাচনে বিদেশি শক্তিগুলোর নানা মত থাকলেও বিএনপি এবার নির্বাচনের বাইরে থাকুক তেমন ‘ব্যবস্থাপত্র’ নেই। ফলে বিএনপিও নির্বাচন বর্জন করবে না। আবার নির্বাচনে থাকবে সেই ঘোষণাও এখনই দেবে না বিএনপি। শেষ বেলায় নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেবে বিএনপি। এখন মাঠে অনড় থেকে কতটুকু দাবি আদায় করতে পারে সে চেষ্টায় আন্দোলন ও অনমনীয় অবস্থানে আছে দলটি।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদ আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। ১০ বছর পর নতুন রাষ্ট্রপতি পাচ্ছে দেশ। যদিও ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবে, কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী দুই মাস আগে অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
সেই হিসেবে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগে বাকি আর ২২ দিন।
এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে নানা জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে কে বসছেন রাষ্ট্রপতির চেয়ারে। বেশ কয়েকজন আছেন আলোচনায়। তবে এদের মধ্যে বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন।
বিস্তারিত পড়ুন রবিবার দেশ রূপান্তরেরর প্রথম পাতায়।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।