দুর্নীতির নষ্ট রাজনীতি এবং সুনীতির ভবিষ্যৎ
এ কে এম শাহনাওয়াজ | ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০
দুর্নীতি বোধকরি মানব জীবনের সমান বয়সী। এ কারণেই দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তির সমান অবস্থানের কথা রয়েছে সব ধর্ম ও দর্শনে। প্রাচীন মিসরের হায়ারোগিফিক লিপিতে যে ধর্মসংগীত পাওয়া যায়, তাতে পাপী আর পুণ্যবানের শেষ বিচারের বর্ণনা রয়েছে। প্রাচীন পারস্যের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাতে আলোর দেবতা আহুরামাজদা আর অন্ধকারের শক্তি আহিরমানের কথা রয়েছে। বাইবেল এবং আল-কোরআনে রয়েছে ফেরেশতা আর শয়তানের ধারণা। আমাদের যাপিত জীবনেও তেমনি সুনীতির পথে হাঁটা ভালো মানুষের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজের উপস্থিতি দৃষ্টির অগোচরে থাকে না। তবে এর মাত্রা ভেদ রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই অন্যায়কারী ছিল বলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচার ব্যবস্থাও চালু ছিল। তবে পার্থক্য এইÑ আগে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করত নিজেকে আড়াল করে, লুকিয়ে-চুরিয়ে। আর এখন করে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতির বয়স দেশটিরই সমান বয়সী। তাই বঙ্গবন্ধু স্বয়ং চোরের দল আর চাটার দল নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। দুর্নীতি নামের পুরনো রোগটি অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি সব সমাজেই কমবেশি ছিল। তবে তারও ছিল কিছুটা মাত্রাজ্ঞান। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শাসন ছিল বলেই সম্ভবত দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ পায়নি। কিন্তু দুর্নীতি এখন রাজনীতির আশ্রয় পেয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে অনেক বেশি সাহসী হয়েছে। এ দেশে দুর্নীতি ও নষ্ট হয়ে যাওয়া রাজনীতি সব সময় গাঁটছড়া বাঁধা। মাঝে মাঝে মনে হয় নষ্ট রাজনীতির ছায়াতলে দুর্নীতি বাড়বাড়ন্ত হয় অথবা দুর্নীতির অক্টোপাসে নষ্ট হতে থাকে রাজনীতি। তবে মানতে হবে, রাজনীতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার সূচনা দুর্নীতির সমান বয়সী নয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালের আওয়ামী লীগ দূরদর্শিতা নিয়ে রাজনীতির ময়দানে স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারেনি।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে রাজনীতিতে পচন ধরার আলামত দৃশ্যমান হতে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাঠে বাকশাল গঠন একটি ছন্দপতন ঘটিয়েছিল সন্দেহ নেই। ক্ষেত্র প্রস্তুতের আগে অমন একটি সমাজতান্ত্রিক ধারণা তাই রাজনীতির পরিমণ্ডলকে অস্থির করে তোলে। এই অস্থির অবস্থা বলবন্ত করে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে। রাজনীতির নষ্টামিতে হত্যার রাজনীতি যুক্ত হয়। একাত্তরের দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি এই ঘোলাটে সময়ে নিজেদের আড়াল করে মত্ত হয় প্রতিশোধের নেশায়। বিষাক্ত করে দিতে থাকে রাজনীতিকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা এবং কয়েক মাস না যেতেই জেলে জাতীয় চার নেতা হত্যা সুস্থ ধারায় রাজনীতির পথ চলাকে কঠিন করে দেয়। খুনি মোশতাকদের তৈরি বিবর্ণ সময়ে সময়ের সুবিধায় বিএনপির জন্ম ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতিতে সহযোগী করে তোলা রাজনীতির নষ্ট আবর্তে তলিয়ে যাওয়ার প্রথম প্রণোদনা ছিল। এ সময় থেকেই এ দেশে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে ভুঁইফোড় রাজনীতির এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। গণতান্ত্রিক বোধকে শক্তিশালী না করেই রাষ্ট্রক্ষমতার মোক্ষে পৌঁছা একমাত্র আরাধ্য হয়ে যায় রাজনৈতিক দলগুলোর। নানা ধারার বাম রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছিল। অনেক হতাশ বাম নেতা, সুবিধাবাদী আমলা, নানা ঘাটে নৌকা ভেড়ানো রাজনীতিক, ব্যবসায়ী অনেকেই এসে ক্ষমতার সুবাস কাছে থেকে পাওয়ার জন্য নতুন জন্ম নেওয়া বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। আওয়ামী লীগের আশ্রয়ও পান কেউ কেউ। ভুঁইফোড় রাজনীতির পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে অথবা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার তাড়নায় আওয়ামী লীগের এ যুগের কাণ্ডারিরা দলের উজ্জ্বল অতীত ভুলতে বসেছেন যেন। ঐতিহ্যের প্রণোদনা থেকে ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তাই আত্মবিশ্বাস তলানিতে চলে আসে। এ কারণে গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের রাজনীতি করার বদলে কার্যত ভুঁইফোড় প্রতিযোগীর সঙ্গে এঁটে ওঠার জন্য রাজনীতি ও নির্বাচনকে অর্থ-শক্তির কাছে সমর্পণ করে। এ দেশে দুর্নীতির ভয়াবহ বাড়বাড়ন্তের উৎসভ‚মি আমি এই বাস্তবতাতেই খুঁজতে চাই।
আজকের ক্যাসিনোবাজ-চাঁদাবাজ বড় বড় নেতা, যারা আটক হয়েছেন তারা কি দলীয় ফাণ্ডে টাকার জোগান দেননি? নষ্টযুগের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার সমর্থক ছাত্রনেতারা সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজি হতো। এসব টাকায় দলের নেতাকর্মীর খাই মেটানো হতো আর নিজেরা ছাত্র অবস্থায় ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াত। এ কারণে কমিটি গঠনের সময় পদ পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে হতো অনেককেই। এখন অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কতটা হয়েছে বলতে পারব না। তবে শোনা যায়, এক দশক আগেও কমিটি গঠনের আগ মুহূর্তে আরও গভীরতার সঙ্গে ছোটাছুটি করতে হতো কেন্দ্রীয় নেতাদের দ্বারে দ্বারে। ব্যবসায়ী, ঠিকাদারদের কাছ থেকে বিশেষ চুক্তিতে অগ্রিম চাঁদা নিতে হতো। কারণ পদের গুরুত্ব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের বড় দাগে পারিতোষিক দিয়ে আদায় করতে হতো সমর্থন। এই টাকার একটি ভাগ যেত ছাত্র সংগঠনগুলোর দেখভালের দায়িত্বে, যেসব নেতা থাকেন তাদের কাছে। ছাত্রনেতাদের আওতায় আবার নাকি জোন ভাগ করা থাকে। জোনভুক্ত অঞ্চলে যেখানে যেমন সুবিধা সেভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মিল-কারখানা, জুট ব্যবসা, ঠিকাদারি প্রভৃতি জায়গা থেকে নিয়মিত ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে চাঁদার ভাগ চলে আসত। এসব ব্যাপারে স্থানীয় দলীয় নেতা-এমপি সবার সঙ্গেই নাকি একটা রফা করা হয়। শোনা যায়, ছাত্রনেতাদেরও এই পথে দলীয় ফান্ড বৃদ্ধি করে মূল দলের প্রতি কিছুটা দায়িত্বও পালন করতে হতো। এমন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের নষ্ট রাজনীতির ছক ছাত্ররাজনীতি-সংশ্লিষ্ট তরুণদের দুর্নীতিবাজে পরিণত করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি এক ধরনের অভিজাত দুর্নীতির জন্ম দিচ্ছে। সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, এমন শিক্ষকরা শিক্ষকতার সম্ভ্রমটুকু রক্ষা করে নীরবে নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা জাতীয় রাজনীতির ছকেই বহুধা বিভক্ত। জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রেও তারা জাতীয় রাজনীতির ছকে চলেন। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীর মতো এ ধারার শিক্ষকদের অনেকে আপন বিবেকের শাসনে চালিত হন না। চালিত হন স্ব-স্ব দলের নেতা-নেত্রীর নির্দেশে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে বড় পদগুলো পাণ্ডিত্যের বিচারই প্রধান নয়, দলীয় আনুগত্যের বিচারেই অনেক ক্ষেত্রে এসব পদ পূরণ করা হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় প্রশাসন দলীয় শক্তি সুপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই ঘর্মাক্ত থাকে। সব দলীয় সরকারের সময়ই প্রশাসনের চেষ্টা থাকে দলীয় শিক্ষক অর্থাৎ ভোটার শিক্ষক নিয়োগ করে হাত শক্ত করা।
ব্যবসায়ীরা তো যুগ যুগ ধরে বণিক স্বার্থেই পার্টি ফান্ডের বড় জোগানদার হয়ে ওঠেন। এরা না হয় দলের শুভেচ্ছা নিয়ে ব্যবসায়ে বড় দাও বাগিয়ে এর ভাগ দিয়ে দেন পার্টিকে। কিন্তু আমলা তো চাকরিজীবী। তারা পার্টির ফান্ডের অর্থ জোগানদাতা হবেন কেমন করে! কিন্তু রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট আমলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ থাকে। তাই অর্থ সংগ্রহে দুর্নীতিবাজ হতে হচ্ছে তাদের। বড়কর্তা দুর্নীতি করার অদৃশ্য লাইসেন্স পেয়ে গেলে ছোটদের শাসন করার কেউ থাকে না। তাই প্রশাসনে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত এত প্রবল। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএনপি আমলের জোট সরকারের সময়ের ঘুষ-বাণিজ্যের লিগ্যাসি পরবর্তী মহাজোট সরকারের আমলেও দাপটের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। নির্বাচনে টাকার প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে বলে এখন মনোনয়ন-বাণিজ্য বলে রাজনীতিতে নতুন এক জোড়া শব্দ যুক্ত হয়েছে। নির্বাচনে দলীয় টিকিট পেতে নাকি কোটি কোটি টাকা পার্টি ফান্ডে দিতে হয়। আর এই প্রতিযোগিতায় নিবেদিতপ্রাণ সৎ রাজনীতিকদের ক্রমে পিছু হটতে হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী আমলাদের ক্রমবর্ধমান পদচারণে মুখরিত হচ্ছে জাতীয় সংসদ। এ জন্য সংগত কারণেই কোরাম সংকটের ফাঁদে পড়ে সংসদ অধিবেশন। এসব কারণে দুর্নীতিকে শাসন করে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার মতো আত্মপ্রত্যয়ী শাসকের সংখ্যা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে এ দেশে। এবার ক্ষমতাসীন হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এ দেশের অধিকাংশ মানুষের আস্থা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। ফলাফলও কিছুটা দেখা যাচ্ছে এখন। দেশপ্রেমিক সৎ মানসিকতার রাজনীতিবিদ যে নেই, তেমন নয়, তবে তারা অসৎদের মধ্যে তেমন কুলিয়ে উঠতে পারেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দেশে নষ্ট রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তার আনুপূর্বিক বর্ণনায় মহাভারত রচিত হবে। এই মহাভারত রচনার প্রয়োজন নেই। কারণ এ দেশের ভুক্তভোগী মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রতিদিন। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা কতটা সুফল ফলাবে তা দেখার বিষয়। তবে আমরা বিশ্বাস করি, নষ্ট ভুবনের রাজনীতিকরা প্রাকৃতিক নিয়মেই সুপথ চিনতে বাধ্য হবেন। উত্থান, বিকাশ ও পতনÑ এই তিনের বৃত্তে আবর্তিত হয় সভ্যতা। পতনের পর নব-উত্থানের সম্ভাবনা মানুষের মনে আশা জাগিয়ে রাখে।
আমাদের সুন্দর সুসভ্য সমৃদ্ধ দেশের উত্থান তো ঘটেছিল হাজার বছর আগেই। প্রাচীন ও মধ্যযুগব্যাপী বিকাশের পথ ধরে বৃত্তের চ‚ড়ায় পৌঁছেছিল। তারপর পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাজনীতির পঙ্কিলতার চোরাবালিতে পতন নিশ্চিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে। নব-উত্থানের আশায় আমরা এখন সুন্দর সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করছি। এ জন্য প্রয়োজন নষ্ট রাজনীতি ও এর প্রযোজনায় বেড়ে ওঠা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করা। প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক মানুষকে এখন দলীয় দায়বদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে সাদা চোখে সোজা কথা দৃঢ়কণ্ঠে বলা উচিত। দেশের রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে চিন্তা ও আচরণে রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রী হতে হবে। জনগণের শক্তির প্রতি হতে হবে শ্রদ্ধাশীল। বিশ্বাস করতে হবে এখন পরিবর্তিত একটি সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষের আত্ম উপলব্ধির জায়গাটি অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে। দলের প্রতি সমর্থন থাকলেও সাধারণ মানুষ এখন নেতা-নেত্রীর হুকুমবরদার নন। তারা ভালো মন্দের হিসাব করতে পারেন।
বিশ্বাস করতে চাই, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে সাধারণ মানুষ এখন প্রস্তুত। দরকার শুধু রাজনীতিবিদদের আত্মশুদ্ধির। আমরা বিশ্বাস করি, নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তারা সে পথে হাঁটবেন। মত-পথের বিভক্তি সত্তে¡ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সমাজ যদি এখন দলীয় রক্ষণশীল ভাবনার কতা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণকে সাহসী ও সচেতন করার দায়িত্বটুকু গ্রহণ করেন, তাহলে মায়ার ঘোরে আবিষ্ট রাজনীতিকরা বাস্তবের উঠোনে নেমে আসতে বাধ্য হবেন। আমরা সবাই এমন দিনের প্রতীক্ষা করছি।
লেখক
অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
এ কে এম শাহনাওয়াজ | ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০

দুর্নীতি বোধকরি মানব জীবনের সমান বয়সী। এ কারণেই দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তির সমান অবস্থানের কথা রয়েছে সব ধর্ম ও দর্শনে। প্রাচীন মিসরের হায়ারোগিফিক লিপিতে যে ধর্মসংগীত পাওয়া যায়, তাতে পাপী আর পুণ্যবানের শেষ বিচারের বর্ণনা রয়েছে। প্রাচীন পারস্যের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাতে আলোর দেবতা আহুরামাজদা আর অন্ধকারের শক্তি আহিরমানের কথা রয়েছে। বাইবেল এবং আল-কোরআনে রয়েছে ফেরেশতা আর শয়তানের ধারণা। আমাদের যাপিত জীবনেও তেমনি সুনীতির পথে হাঁটা ভালো মানুষের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজের উপস্থিতি দৃষ্টির অগোচরে থাকে না। তবে এর মাত্রা ভেদ রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই অন্যায়কারী ছিল বলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচার ব্যবস্থাও চালু ছিল। তবে পার্থক্য এইÑ আগে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করত নিজেকে আড়াল করে, লুকিয়ে-চুরিয়ে। আর এখন করে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতির বয়স দেশটিরই সমান বয়সী। তাই বঙ্গবন্ধু স্বয়ং চোরের দল আর চাটার দল নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। দুর্নীতি নামের পুরনো রোগটি অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি সব সমাজেই কমবেশি ছিল। তবে তারও ছিল কিছুটা মাত্রাজ্ঞান। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শাসন ছিল বলেই সম্ভবত দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ পায়নি। কিন্তু দুর্নীতি এখন রাজনীতির আশ্রয় পেয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে অনেক বেশি সাহসী হয়েছে। এ দেশে দুর্নীতি ও নষ্ট হয়ে যাওয়া রাজনীতি সব সময় গাঁটছড়া বাঁধা। মাঝে মাঝে মনে হয় নষ্ট রাজনীতির ছায়াতলে দুর্নীতি বাড়বাড়ন্ত হয় অথবা দুর্নীতির অক্টোপাসে নষ্ট হতে থাকে রাজনীতি। তবে মানতে হবে, রাজনীতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার সূচনা দুর্নীতির সমান বয়সী নয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালের আওয়ামী লীগ দূরদর্শিতা নিয়ে রাজনীতির ময়দানে স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারেনি।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে রাজনীতিতে পচন ধরার আলামত দৃশ্যমান হতে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মাঠে বাকশাল গঠন একটি ছন্দপতন ঘটিয়েছিল সন্দেহ নেই। ক্ষেত্র প্রস্তুতের আগে অমন একটি সমাজতান্ত্রিক ধারণা তাই রাজনীতির পরিমণ্ডলকে অস্থির করে তোলে। এই অস্থির অবস্থা বলবন্ত করে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে। রাজনীতির নষ্টামিতে হত্যার রাজনীতি যুক্ত হয়। একাত্তরের দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি এই ঘোলাটে সময়ে নিজেদের আড়াল করে মত্ত হয় প্রতিশোধের নেশায়। বিষাক্ত করে দিতে থাকে রাজনীতিকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা এবং কয়েক মাস না যেতেই জেলে জাতীয় চার নেতা হত্যা সুস্থ ধারায় রাজনীতির পথ চলাকে কঠিন করে দেয়। খুনি মোশতাকদের তৈরি বিবর্ণ সময়ে সময়ের সুবিধায় বিএনপির জন্ম ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতিতে সহযোগী করে তোলা রাজনীতির নষ্ট আবর্তে তলিয়ে যাওয়ার প্রথম প্রণোদনা ছিল। এ সময় থেকেই এ দেশে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে ভুঁইফোড় রাজনীতির এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। গণতান্ত্রিক বোধকে শক্তিশালী না করেই রাষ্ট্রক্ষমতার মোক্ষে পৌঁছা একমাত্র আরাধ্য হয়ে যায় রাজনৈতিক দলগুলোর। নানা ধারার বাম রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছিল। অনেক হতাশ বাম নেতা, সুবিধাবাদী আমলা, নানা ঘাটে নৌকা ভেড়ানো রাজনীতিক, ব্যবসায়ী অনেকেই এসে ক্ষমতার সুবাস কাছে থেকে পাওয়ার জন্য নতুন জন্ম নেওয়া বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। আওয়ামী লীগের আশ্রয়ও পান কেউ কেউ। ভুঁইফোড় রাজনীতির পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে অথবা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার তাড়নায় আওয়ামী লীগের এ যুগের কাণ্ডারিরা দলের উজ্জ্বল অতীত ভুলতে বসেছেন যেন। ঐতিহ্যের প্রণোদনা থেকে ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। তাই আত্মবিশ্বাস তলানিতে চলে আসে। এ কারণে গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের রাজনীতি করার বদলে কার্যত ভুঁইফোড় প্রতিযোগীর সঙ্গে এঁটে ওঠার জন্য রাজনীতি ও নির্বাচনকে অর্থ-শক্তির কাছে সমর্পণ করে। এ দেশে দুর্নীতির ভয়াবহ বাড়বাড়ন্তের উৎসভ‚মি আমি এই বাস্তবতাতেই খুঁজতে চাই।
আজকের ক্যাসিনোবাজ-চাঁদাবাজ বড় বড় নেতা, যারা আটক হয়েছেন তারা কি দলীয় ফাণ্ডে টাকার জোগান দেননি? নষ্টযুগের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার সমর্থক ছাত্রনেতারা সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজি হতো। এসব টাকায় দলের নেতাকর্মীর খাই মেটানো হতো আর নিজেরা ছাত্র অবস্থায় ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াত। এ কারণে কমিটি গঠনের সময় পদ পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে হতো অনেককেই। এখন অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কতটা হয়েছে বলতে পারব না। তবে শোনা যায়, এক দশক আগেও কমিটি গঠনের আগ মুহূর্তে আরও গভীরতার সঙ্গে ছোটাছুটি করতে হতো কেন্দ্রীয় নেতাদের দ্বারে দ্বারে। ব্যবসায়ী, ঠিকাদারদের কাছ থেকে বিশেষ চুক্তিতে অগ্রিম চাঁদা নিতে হতো। কারণ পদের গুরুত্ব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের বড় দাগে পারিতোষিক দিয়ে আদায় করতে হতো সমর্থন। এই টাকার একটি ভাগ যেত ছাত্র সংগঠনগুলোর দেখভালের দায়িত্বে, যেসব নেতা থাকেন তাদের কাছে। ছাত্রনেতাদের আওতায় আবার নাকি জোন ভাগ করা থাকে। জোনভুক্ত অঞ্চলে যেখানে যেমন সুবিধা সেভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মিল-কারখানা, জুট ব্যবসা, ঠিকাদারি প্রভৃতি জায়গা থেকে নিয়মিত ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে চাঁদার ভাগ চলে আসত। এসব ব্যাপারে স্থানীয় দলীয় নেতা-এমপি সবার সঙ্গেই নাকি একটা রফা করা হয়। শোনা যায়, ছাত্রনেতাদেরও এই পথে দলীয় ফান্ড বৃদ্ধি করে মূল দলের প্রতি কিছুটা দায়িত্বও পালন করতে হতো। এমন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের নষ্ট রাজনীতির ছক ছাত্ররাজনীতি-সংশ্লিষ্ট তরুণদের দুর্নীতিবাজে পরিণত করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি এক ধরনের অভিজাত দুর্নীতির জন্ম দিচ্ছে। সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, এমন শিক্ষকরা শিক্ষকতার সম্ভ্রমটুকু রক্ষা করে নীরবে নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা জাতীয় রাজনীতির ছকেই বহুধা বিভক্ত। জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রেও তারা জাতীয় রাজনীতির ছকে চলেন। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীর মতো এ ধারার শিক্ষকদের অনেকে আপন বিবেকের শাসনে চালিত হন না। চালিত হন স্ব-স্ব দলের নেতা-নেত্রীর নির্দেশে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে বড় পদগুলো পাণ্ডিত্যের বিচারই প্রধান নয়, দলীয় আনুগত্যের বিচারেই অনেক ক্ষেত্রে এসব পদ পূরণ করা হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় প্রশাসন দলীয় শক্তি সুপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই ঘর্মাক্ত থাকে। সব দলীয় সরকারের সময়ই প্রশাসনের চেষ্টা থাকে দলীয় শিক্ষক অর্থাৎ ভোটার শিক্ষক নিয়োগ করে হাত শক্ত করা।
ব্যবসায়ীরা তো যুগ যুগ ধরে বণিক স্বার্থেই পার্টি ফান্ডের বড় জোগানদার হয়ে ওঠেন। এরা না হয় দলের শুভেচ্ছা নিয়ে ব্যবসায়ে বড় দাও বাগিয়ে এর ভাগ দিয়ে দেন পার্টিকে। কিন্তু আমলা তো চাকরিজীবী। তারা পার্টির ফান্ডের অর্থ জোগানদাতা হবেন কেমন করে! কিন্তু রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট আমলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ থাকে। তাই অর্থ সংগ্রহে দুর্নীতিবাজ হতে হচ্ছে তাদের। বড়কর্তা দুর্নীতি করার অদৃশ্য লাইসেন্স পেয়ে গেলে ছোটদের শাসন করার কেউ থাকে না। তাই প্রশাসনে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত এত প্রবল। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএনপি আমলের জোট সরকারের সময়ের ঘুষ-বাণিজ্যের লিগ্যাসি পরবর্তী মহাজোট সরকারের আমলেও দাপটের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। নির্বাচনে টাকার প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে বলে এখন মনোনয়ন-বাণিজ্য বলে রাজনীতিতে নতুন এক জোড়া শব্দ যুক্ত হয়েছে। নির্বাচনে দলীয় টিকিট পেতে নাকি কোটি কোটি টাকা পার্টি ফান্ডে দিতে হয়। আর এই প্রতিযোগিতায় নিবেদিতপ্রাণ সৎ রাজনীতিকদের ক্রমে পিছু হটতে হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী আমলাদের ক্রমবর্ধমান পদচারণে মুখরিত হচ্ছে জাতীয় সংসদ। এ জন্য সংগত কারণেই কোরাম সংকটের ফাঁদে পড়ে সংসদ অধিবেশন। এসব কারণে দুর্নীতিকে শাসন করে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার মতো আত্মপ্রত্যয়ী শাসকের সংখ্যা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে এ দেশে। এবার ক্ষমতাসীন হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এ দেশের অধিকাংশ মানুষের আস্থা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। ফলাফলও কিছুটা দেখা যাচ্ছে এখন। দেশপ্রেমিক সৎ মানসিকতার রাজনীতিবিদ যে নেই, তেমন নয়, তবে তারা অসৎদের মধ্যে তেমন কুলিয়ে উঠতে পারেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দেশে নষ্ট রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তার আনুপূর্বিক বর্ণনায় মহাভারত রচিত হবে। এই মহাভারত রচনার প্রয়োজন নেই। কারণ এ দেশের ভুক্তভোগী মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রতিদিন। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা কতটা সুফল ফলাবে তা দেখার বিষয়। তবে আমরা বিশ্বাস করি, নষ্ট ভুবনের রাজনীতিকরা প্রাকৃতিক নিয়মেই সুপথ চিনতে বাধ্য হবেন। উত্থান, বিকাশ ও পতনÑ এই তিনের বৃত্তে আবর্তিত হয় সভ্যতা। পতনের পর নব-উত্থানের সম্ভাবনা মানুষের মনে আশা জাগিয়ে রাখে।
আমাদের সুন্দর সুসভ্য সমৃদ্ধ দেশের উত্থান তো ঘটেছিল হাজার বছর আগেই। প্রাচীন ও মধ্যযুগব্যাপী বিকাশের পথ ধরে বৃত্তের চ‚ড়ায় পৌঁছেছিল। তারপর পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাজনীতির পঙ্কিলতার চোরাবালিতে পতন নিশ্চিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে। নব-উত্থানের আশায় আমরা এখন সুন্দর সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করছি। এ জন্য প্রয়োজন নষ্ট রাজনীতি ও এর প্রযোজনায় বেড়ে ওঠা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করা। প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক মানুষকে এখন দলীয় দায়বদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে সাদা চোখে সোজা কথা দৃঢ়কণ্ঠে বলা উচিত। দেশের রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে চিন্তা ও আচরণে রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রী হতে হবে। জনগণের শক্তির প্রতি হতে হবে শ্রদ্ধাশীল। বিশ্বাস করতে হবে এখন পরিবর্তিত একটি সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষের আত্ম উপলব্ধির জায়গাটি অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে। দলের প্রতি সমর্থন থাকলেও সাধারণ মানুষ এখন নেতা-নেত্রীর হুকুমবরদার নন। তারা ভালো মন্দের হিসাব করতে পারেন।
বিশ্বাস করতে চাই, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে সাধারণ মানুষ এখন প্রস্তুত। দরকার শুধু রাজনীতিবিদদের আত্মশুদ্ধির। আমরা বিশ্বাস করি, নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তারা সে পথে হাঁটবেন। মত-পথের বিভক্তি সত্তে¡ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সমাজ যদি এখন দলীয় রক্ষণশীল ভাবনার কতা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণকে সাহসী ও সচেতন করার দায়িত্বটুকু গ্রহণ করেন, তাহলে মায়ার ঘোরে আবিষ্ট রাজনীতিকরা বাস্তবের উঠোনে নেমে আসতে বাধ্য হবেন। আমরা সবাই এমন দিনের প্রতীক্ষা করছি।
লেখক
অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়