
১৯০৫ সালের ২১ জুন জন্মগ্রহণ করেন দার্শনিক ও সাহিত্যিক জাঁ-পল সার্ত্রে। প্রথম জীবনের ১০ বছর কাটে পিতামহ শার্ল শোয়াইৎজারের তত্ত্বাবধানে। শৈশবে তিনি মাতামহের বিশাল গ্রন্থাগারের প্রায় সব পুস্তকই পড়ে ফেলেছিলেন। তার বয়স যখন ৯ বছর তখন দ্বিতীয় বিয়ের কারণে মায়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে তার। ১৯২৫ সালে তিনি ভর্তি হন ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের সূতিকাগার বলে খ্যাত ইকোলে নরমাল সুপিরিয়রে। পরীক্ষায় প্রথমবার অকৃতকার্য হলেও দ্বিতীয়বার কৃতকার্য হন। দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করার পর ফ্রান্স ও বিশ্বের খ্যাতনামা একাধিক দার্শনিকের সঙ্গে তার আলাপ হয়। ক্রমে কান্ট, হেগেল ও হেইডেগারের মতো দার্শনিকদের তত্ত্ব অধ্যয়ন করেন তিনি। ১৯২৯ সালে পরিচয় ঘটে লেখিকা সিমন দ্য বোভোঁয়ার সঙ্গে, যার সঙ্গে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক বজায় ছিল তার। ১৯৩১ সালে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে তিনি লা হার্ভেতে যোগ দেন। ১৯৩২ সালে বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে দর্শনশাস্ত্রের ওপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন একজন ‘মেটেরোলজিস্ট’ হিসেবে। তিনি নাৎসি পার্টির হাতে বন্দিও হন। জার্মানদের কাছে যুদ্ধবন্দি থাকা অবস্থায়ই রচনা করেন তার প্রথম নাটক। যুদ্ধ ও যুদ্ধকালীন বাস্তবতা গভীর ছাপ ফেলে তার মনে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। ব্যক্তিজীবনে কোনো সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না রাখলেও নানা সময়ে তার লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় এ ধারার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন। ১৯৬৪ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেও তিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি মারা যান।
করোনাকালে চলে গেলেন কামাল লোহানী। শেষ পর্যন্ত করোনা তাকে পরাজিত করল। অবশ্য বার্ধক্যজনিত অনেক সমস্যাই তার দেহে বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু ঐসব রোগের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিবারই তিনি জীবনে ফিরে এসেছেন। এবারও সে রকমই আশা করেছিলাম। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ঐসব রোগকে প্রকট করে তাকে জীবনে ফিরতে দিল না। কেবল এই ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই ছিলেন তিনি লড়াকু ব্যক্তিত্ব।
আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটির পুরো নাম ছিল আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। তার জন্ম সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন। মাকে হারান মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যেই তার স্কুলজীবন শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে চলে আসেন পাবনায়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। ভাষা আন্দোলনেই তার রাজনীতির শুরু। এরপর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চা মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ করতে থাকেন।
১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠানে নুরুল আমীনের আগমনের প্রতিবাদে যে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী বিক্ষোভ করেন, তাদেরই একজন ছিলেন কামাল লোহানী। পাবনার রাজনৈতিক নেতা, এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কামাল লোহানীও গ্রেপ্তার হন। এরপর একাধিকবার তার জায়গা হয় জেলখানায়।
এভাবে স্কুল পাস করার সময় ভাষা আন্দোলনে যোগদান করে তার যে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তা অব্যাহত থাকে আজীবন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারা দিয়ে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরের শাসন’ চালু করার পর আবার ধরপাকড় শুরু হয়। এ সময় আবার গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে ছাড়া পান। বাড়িতে পড়াশোনা নিয়ে মতবিরোধ হয়। ছোট চাচা তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে ১৫ টাকা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। তিনি ততদিনে মার্ক্সবাদের অনুসারী হয়ে উঠেছেন। শুরু হয় সাংবাদিকতার জীবন। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকায়। ইতিমধ্যে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হলে যোগ দিয়েছেন তাতে।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে যেমন, তেমনি সাংবাদিকতায়ও তিনি বিশিষ্ট হিসেবে পরিচিত হন। বাষট্টির সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে আবার জেলে। এর আগে আইয়ুবের রবীন্দ্রবিরোধী চক্রান্তের বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনে রাখেন বিশিষ্ট ভূমিকা। সংস্কৃতি জগতে কেবল নাটকেই বিশিষ্ট নন, নৃত্যে ও নৃত্যনাট্যে হয়ে ওঠেন অনন্য। এ দেশের প্রথিতযশা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট গড়ে তুলতে যেমন ভূমিকা রাখেন, তেমনি রাজনৈতিক মতান্তরের কারণে গড়ে তোলেন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী। এই ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীই ষাটের দশকে গণসঙ্গীত, গণনাট্য ও গণধর্মী নৃত্যনাট্য প্রসারে বিশিষ্ট ভূমিকা রাখে। ঢাকার পল্টন ময়দানে নৃত্যনাট্য ‘আলোর পথ যাত্রী’ লাখো মানুষকে মাতিয়েছিল।
ষাটের দশকের শেষভাগে এসে মস্কো-পিকিং প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে তিনি পিকিং অংশে অবস্থান নেন। সে সময় তার নয়া পল্টনের বাসা যেমন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর কেন্দ্র ছিল, ছিল আমাদের মতো কমিউনিস্ট কর্মীদের আড্ডার জায়গা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখেন কামাল লোহানী। এই সময় চিত্রপরিচালক জহির রায়হানসহ তিনি ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র বুদ্ধিজীবী সেলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরে বাংলাদেশ বেতার পুনর্গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে এলে তিনি সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনার সরাসরি ধারা বিবরণী দেন রেডিওতে। পরে তিনি আবার সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন এবং প্রথমে সাপ্তাহিক নয়াযুগ ও দৈনিক বঙ্গবার্তা গড়ে তুলতে কাজ করেন।
বাকশাল গঠন করা হলে সাংবাদিকদের মধ্যে কামাল লোহানী, নির্মল সেন, কবি শামসুর রাহমানসহ তাতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তবে বিএনপির তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে দেন। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের হয়েও তিনি অনন্য ভূমিকা রাখেন। এ কারণে এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু এবারও বিএনপির সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ঐ পদ ছেড়ে দেন। শেখ হাসিনার সরকার তাকে পুনরায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
কিন্তু প্রথাবিরোধী কামাল লোহানী আবার সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিকতার জীবনে ফিরে আসেন। এই সময়কালে তিনি পত্র-পত্রিকায় কলাম লেখার পাশাপাশি ওয়ার্কার্স পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘নতুন কথা’র উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব নেন এবং পত্রিকাটিকে নতুন রূপ দেন।
কামাল লোহানী পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করলেও শেষদিকে সংগঠনটি নিয়ে তার সাংগঠনিক অতৃপ্তি কাজ করছিল। এ সময় ‘উদীচী’ তাকে সভাপতি করে তাদের সংগঠনে নিয়ে যায় এবং জানা যায় এই সময় সিপিবিও তাকে তাদের পার্টির সদস্যপদ দেয়।
শেষ দিকে তার চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও তিনি তার কলাম লেখার কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। আর মাঠে সক্রিয় ছিলেন সাম্প্রদায়িকতাবিরোধিতা ও ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে। সারা জীবনের লড়াকু যোদ্ধা কামাল লোহানী শেষ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে চলেই গেলেন। তবে বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগৎ ও সাংবাদিকতার জগৎই কেবল নয়, দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি তাকে স্মরণ করবে চিরকাল।
লেখক
সংসদ সদস্য এবং সভাপতি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
করোনাভাইরাস মহামারী বিস্তারের প্রেক্ষাপটে লকডাউন ও অন্যান্য কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশেও খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম মৎস্য খাত। প্রাণিজ আমিষের ৬০ ভাগ জোগানই আসে মৎস্য খাত থেকে। অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এবং মৎস্যচাষের ওপর ভিত্তি করে খাতটির অর্জন কম নয়। সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ৪২ দশমিক ৭৭ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ১২ লাখ ১৬ হাজার ৫৩৯ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা সম্ভব হয়েছে। আর অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে ২৪ লাখ ৫ হাজার ৪১৫ মেট্রিক টন উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে আহরিত হয়েছে ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭ মেট্রিক টন মৎস্য।
ঐতিহ্যগতভাবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ হিসেবে আমাদের খ্যাতি আছে। আধুনিক কালে এসে এখন শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়; আয়-উপার্জনের অবলম্বন হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে মৎস্য চাষ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে তৃতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে। আর চাষাবাদের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এছাড়া ‘তেলাপিয়া’ জাতের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ ও এশিয়া মহাদেশে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এভাবে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে মৎস্য চাষ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টায় জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। তবে এখন করোনাভাইরাসের মহামারী বিস্তারের কারণে দেশের বিভিন্ন খাতের মতো এদেশের মৎস্য খাতেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
দেশে যখন করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয় তখনই মাছের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণের ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক গুজব রটেছিল। তবে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর সঠিক সময়ে কার্যকর ভূমিকা নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করায় গুজবটি খুব প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু লকডাউনের প্রবল প্রভাবে বিদেশে পণ্য রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ পরিবহন সেবা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে দেশে উৎপাদিত মাছের বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থায় বেশ বড় আঘাত লেগেছে। পরিবহন সংকটে মাছচাষিরা রেণু পোনা সংগ্রহ করতে পারছেন না। ফলে রেণু উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন সারা দেশের উৎপাদনকারীরা। এই পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোতে শ্রমিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। চাষিরা তাদের উৎপাদন বাজারজাত করতে না পারায় পুকুরে মাছ ফেলে রেখেছেন। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। যে সময় বিক্রি করে আবার নতুন পোনা ছাড়ার কথা, সে সময় তারা তা করতে পারছেন না। চাষের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ দুর্লভ হওয়ার কারণেও মৎস্যচাষিদের জীবিকা সংকটে পড়েছেন। লকডাউনে মাছের দাম কমে যাওয়া, বাজার বন্ধ হওয়াসহ বেশ কিছু সংবাদও নানা গণমাধ্যমে এসেছে। লকডাউনের কারণে হোটেল রেস্তোরাঁ ও নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় মাছের চাহিদার ওপর প্রচুর প্রভাব পড়ছে। এতসব কিছুর ফলে মৎস্য উৎপাদন ও বিপণনের যে শৃঙ্খল, সেটি বিঘিœত হচ্ছে।
এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের প্রান্তিক মৎস্যচাষি, পোনা উৎপাদনকারী, মৎস্য ব্যবসায়ী, মৎস্য পরিবহন, মৎস্য উৎপাদন ও পোনা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সবাই; শ্রমিকরা পর্যন্ত। এই শৃঙ্খল থমকে যাওয়ায় আগামীতে বাংলাদেশের মৎস্য চাষ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। পেটের দায়ে অনেকে মৎস্য আহরণের কাজ নিয়মিত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলমান রাখলেও কোনোভাবেই উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না। ফলে তাদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা যেমন হুমকির মুখে তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও তারা দৈন্যদশায় পতিত হচ্ছেন। দেশের ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী, যারা বিশ্বজুড়ে ‘স্মল স্কেল ফিশারিজ’-এর বড়সড় অংশীদার, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে আরও অবনতির সমূহ আশঙ্কা করছেন মৎস্য খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত মাছ রপ্তানিতে স্থবিরতা নেমে আসায় বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে। রপ্তানি বন্ধ থাকায় চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাবের সংবাদ গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে, প্রলয় সৃষ্টিকরা ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে আমাদের মাছ উৎপাদনের প্রধান বিভাগ খুলনার ছয় জেলার ১৯৭টি ইউনিয়নের বিরাট মৎস্য খাতে মোট ২৮৪ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়। কার্প জাতের মাছ (সাদা মাছ), চিংড়ি, কাঁকড়া, কুঁচিয়ার পাশাপাশি সেখানকার অবকাঠামোগত ক্ষতিও ব্যাপক।
সার্বিকভাবে মহামারী ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে আমাদের মৎস্য খাতে জড়িত সব শিল্প অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ও ভবিষ্যতে করণীয় খুব দ্রুত ভাবা প্রয়োজন। মৎস্য খাতের প্রবৃদ্ধির হার সচল রাখতে ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন সংস্থা, দাতা সংস্থা ও গবেষকদের একত্রে কাজ করতে হবে। উল্লেখ্য, দেশের উপকূলের জেলেদের করোনাভাইরাস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে নৌবাহিনী কাজ করছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ মৎস্য চাষ, ব্যবস্থাপনা, মাছের খাদ্যপ্রয়োগ, মাছের চিকিৎসা ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে সৃষ্ট সমস্যায় সেবা দিতে বিনা পয়সায় ‘টেলিফোন সহায়তা সেবা’ চালু করেছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খামারি, মৎস্য উৎপাদক, মৎস্য উদ্যোক্তাদের অর্থ সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করেছে। এসব সহযোগিতা যাতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষি ও মৎস্যশ্রমিকরা দ্রুত পান সেই বিষয়টি খুবই জরুরি।
একই সঙ্গে জরুরি করোনা মহামারীর প্রভাব থেকে মৎস্য খাতকে রক্ষায় মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে গবেষণাগারের বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রকৃত ক্ষতি নিরূপণে গবেষকদের কাজ করা। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মহামারী পরবর্তী সময়ের করণীয় ঠিক করতে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। দাতা সংস্থাগুলোর ঠিক করা উচিত, মৎস্য খাতের আসন্ন বিপদে কীভাবে কোথায় সহযোগিতা করবেন। মহামারী পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্য নিরাপত্তা। বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় অবদান রাখা মৎস্য খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য তাই সরকারি-বেসরকারি কর্র্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তাদের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ও গবেষক, জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
স্কুল থেকে ফেরার পথে কিছু ছেলে নিয়মিত মেয়েটিকে ‘টিজিং’ করে। মেয়েটি এক দিন বাড়ি ফিরে মাকে জানায়। মা শোনেন, তারপর নরম গলায় বলেন, ছেলেরা একটু অমন করেই থাকে। তুই ওদের দিকে তাকাস না। একটু মানিয়ে নে। আদরের মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়ার সময়ও বারবার মানিয়ে চলার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। সেজন্য হয়তো আদরের মেয়েটি সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পরিবার থেকে প্রাপ্ত ‘মানিয়ে চলো’ শিক্ষার কারণে শ্বশুরবাড়ির লোকদের নানাবিধ অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে। বাংলাদেশের হাজার হাজার নারী এভাবে মানিয়ে নেওয়ার দুর্বিপাকে পড়ে জীবন খুইয়ে চলেছে। তারপরও মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা আমরা দিয়েই যাচ্ছি।
অফিসে অন্যায়ভাবে আপনাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সুপারভাইজার বাজে আচরণ করছে। একজন শুভাকাক্সক্ষী সহকর্মীর সঙ্গে শেয়ার করুন। সেও বলবে, অফিসে এমন হয়েই থাকে। একটু মানিয়ে নিন, অ্যাডজাস্ট করে চলুন। সমাজে এটা বেশ প্রচলিত তত্ত্ব যে, বস ইজ অলয়েস রাইট। কাজেই বস যদি ঠিক নাও থাকেন তারপরও বসের কথা শুনতে হবে বা বসের আদেশ পালন করতে হবে। নিজের বিবেকবুদ্ধি দিয়ে যেটা যেটা অন্যায় বলে মনে হচ্ছে, বসের আদেশ বলে সেটাই করতে হচ্ছে। নিজের বিচার-বুদ্ধি-বিবেক বা চিন্তাশক্তি এখানে প্রবলভাবে ব্যর্থ। নিয়োগকর্তার প্রতি আনুগত্য হয়তো প্রত্যাশিত। নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ মেনে চলা অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। তেমনিভাবে নিয়োগকর্তারও উচিত অধস্তন কর্মীকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা। বঞ্চিত করলে সেটাকে কখনোই সততা বলে ধরে নেওয়া যায় না। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে হামেশাই দেখা যায় অধিকার হরণের ঘটনা, যা কর্মীর মনোবল দুর্বল করে দেয়। তারপরও সবাই মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে নিয়েই চলছে!
আমাদের সমাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তান-সন্ততিদের মানিয়ে চলা বা খাপখাইয়ে নেওয়ার শিক্ষাটা বেশ জোরেশোরেই দেওয়া হয়। জীবনে চলার ক্ষেত্রে প্রতি পদে আমরা শিখি এই অ্যাডজাস্ট করা বা মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা! সেটা অন্যায়-অবিচার হলেও। এই মানিয়ে চলার অর্থই হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়ের সঙ্গে এক ধরনের আপস করা। অন্যায়কারীর সঙ্গে সমঝোতা করে টিকে থাকা। এভাবে সৃষ্টি হচ্ছে একটি প্রতিবাদহীন ‘মানিয়ে নেওয়া’ প্রজন্ম।
হ্যাঁ, পরিস্থিতি বিবেচনায়, বাস্তবতার কারণে হয়তো অনেক সময় মানিয়ে নিতেই হয়। মানিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প থাকে না। কিন্তু সব ক্ষেত্রে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা কি সুস্থ এবং স্বাভাবিক বলে গণ্য হতে পারে? আসলে সবকিছুকে মানিয়ে নিতে নিতে এখন এমন একটা অবস্থায় আমরা পৌঁছে গিয়েছি, যখন কোথাও অন্যায়, অবিচার হতে দেখলে আমরা প্রতিবাদে না করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাটাই সবার আগে করি। সে দুর্নীতি দেখলেও, অন্যায় হতে দেখলেও! খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, জুলুম দেখলেও। রাষ্ট্রশক্তির অন্যায়-অনাচার-জুলুম দেখলেও। মানিয়ে চলার মধ্যেই যেন মেলে এক ধরনের আত্মতুষ্টি! বড়রা ছোটদের বলবে, মানিয়ে চলো। ছোটরাও বিশেষ পরিস্থিতিতে বড়দের বলবে মানিয়ে চলতে। আমরা ছোট-বড় নির্বিশেষে শিখে গিয়েছি মানিয়ে চলতে!
বলা হয়, অন্যায়কারী আর অন্যায়ের সমর্থনকারী সমান অপরাধী। কিন্তু আমরা এটা বিশ্বাস করি না। আমরা বরং প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে শিখেছি যে, বোবার কোনো শত্রু নেই। সেজন্য আমরা কথা বলতে পারলেও বলি না, বোবা সেজে থাকি অথবা বোবা বানানোর চূড়ান্ত আয়োজন বিদ্যমান থাকায় বোবার মতো আচরণ করি। অহেতুক শত্রু সৃষ্টি করে কী লাভ? সব সময় সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য হওয়ার মানসে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে মুখ বুজে থাকি এবং শত্রু-মিত্র, অন্যায়কারী, সবার সঙ্গে সমঝোতা করে চলি। কিন্তু প্রশ্নটা দাঁড়ায়, এভাবে আর কত দিন? আর কত দিন মানিয়ে চলতে হবে? অনেকের কাছে হয়তো মানিয়ে চলাই চলতি সময়ের পক্ষে সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতি! তাতে কারও সঙ্গেই অশান্তিতে জড়াতে হয় না! এভাবে দেখলে বেশির ভাগ পরিস্থিতিই মোটামুটি এড়িয়ে চলা সম্ভব। তা সে বিপদই হোক বা আপদ! আর এই ভাবনাটাই ভালো করে বুঝেছে শাসকযন্ত্র। সাধারণ মানুষের মনের এই সুবিধাবাদী নীতিকে দেখেই শাসক বুঝতে পারে, তারা কত দূর অবধি মানিয়ে নিতে পারে।
পৃথিবী বদলায়, সমাজ পাল্টায়। তাও মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে যে নেতিবাচক মনোভাবই কাজ করে, তা বোধ হয় আমরা বুঝেও না-বোঝার ভান করি। কিন্তু সমাজের মধ্যে এক শ্রেণির মানুষও থাকেন, যারা এই নেতিবাচক দিকের কুফল বুঝেই মানিয়ে নেওয়ার ‘সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। তাদেরই শাসক তথা সমাজপ্রভুরা দেশদ্রোহী বা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর বলে অভিহিত করে। রাজনীতির খেলায় মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া মানুষজনকেই আক্রমণের শিকার হতে হয় চিরকাল।
আমরা সারা পৃথিবীর যেকোনো মানিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকেই দুহাত তুলে সমর্থন জানাই! অথচ, ঘরের পাশে অন্যায় ঘটলে, মানিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে তাকে কতটা স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন করি, সে এক বিরাট প্রশ্ন! কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে আগে থেকে স্থির করা কিছু তকমা দিয়ে দেগে দিয়ে বিষয়টাকে সরলীকৃত করে তোলার চেষ্টা করি। আবার তার প্রতিক্রিয়ায় কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেও আক্রমণ করতে দ্বিধা বোধ করি না। সমস্যার গভীরে না গিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আর যত সেই সিদ্ধান্তকে নিজেদের মনের মতো যুক্তিতে বাঁধতে যাই, ততই তা শাসকের সমর্থন পায়। মূল সমস্যাকে গৌণ করে অন্য সমস্যাকে মুখ্য করে তোলা হয় এভাবেই।
আমরা অনেক কিছুই মেনে নিয়েছি! রাষ্ট্রশক্তির যথেচ্ছাচার মেনে নিয়েছি! সংকীর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি! আসলে, এই মানিয়ে নেওয়াই এখন আমাদের ‘সংস্কৃতি’! কিন্তু মুশকিল হলো, সবাই তো আমাদের মতো নয়! কেউ কেউ তো একটু অন্যভাবেও ভাবতে পারেন! পৃথিবীর যেকোনো দেশেই প্রতিবাদ মূলত নবীন প্রজন্মই করে। ছাত্রসমাজই করে। তা সে তিয়েনআন মেন স্কয়ারই হোক বা টিএসসি কিংবা শাহবাগে অথবা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই হোক। ছাত্রসমাজই এই মানিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। তাই চিরকাল শাসকের চক্ষুশূল বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জীবিত ছাত্রছাত্রীরাই। সমস্যা হলো, ছোট মাপের রাজনীতি নবীন প্রজন্মকে দিশা না দেখিয়ে নিজেদের ফায়দা তোলার জন্যই ব্যস্ত থাকে। এটাই গণতন্ত্রের করুণ বাস্তবতা!
আমরা এক সর্বনাশা ভাবনায় আচ্ছন্ন। ‘কী হবে এসব করে’ বা ‘ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ’, আমাদের এই নির্বিকার অবস্থান ক্রমেই দৈত্যদের অবাধ বিচরণের পথ করে দিচ্ছে। আমরা মেনে নিতে শিখে গিয়েছি আর ভেবে নিয়েছি, যাই ঘটুক না কেন, আমাদের কিছু হবে না!
এক অন্য রকম ঝরা সময় এখন। সব সময় নিরাপত্তাহীনতা আর আতঙ্ক সর্বস্তরে সর্বক্ষেত্রে বয়ে চলেছে। প্রতিবাদে মুখর হওয়াই সম্ভবত পরিত্রাণের পথ। কিন্তু শাসকের কাছে কতটা সেই প্রতিবাদ পৌঁছাতে পেরেছে, সেটা প্রশ্ন। পরিবর্তন কখনোই প্রবীণরা একা আনতে পারেননি। সব সময়ই উদ্যম দেখিয়েছে যৌবনই। তা সে রাশিয়ায় বিপ্লবই হোক বা আমেরিকার পুলিশি ব্যবস্থা পরিবর্তনের চলমান আন্দোলনই হোক। বাংলাদেশে প্রতিটি অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে কিন্তু তরুণসমাজই রুখে দাঁড়িয়েছিল।
সব ধরনের অন্যায়-অপকর্ম আমরা নির্বিকার চিত্তে মেনে নিচ্ছি আর অন্য প্রান্ত আরও উৎসাহিত হচ্ছে। সর্বস্তরে যেভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া দরকার, তা হয়ে উঠছে না। যাদের প্রতিবাদ করার কথা তারাও কেমন যেন চুপচাপ! আসলে, ওই মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস! আর আমরা অভ্যাসের দাস! সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যায়, যেকোনো সমস্যার ক্ষেত্রে দিশাহীনতাই এ দেশে প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে। নেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি। নেই সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো আন্তরিক উদ্যোগ।
এদিকে ক্রমেই সমাজ দেহের দগদগে ঘা উন্মোচিত হচ্ছে। সবখানে অনিয়ম, সবখানে দুর্নীতি, অনাচার। অথচ আমরা এজন্য কোথাও কোনো কার্যকর প্রতিবাদের ভাষা রচনা করতে পারছি না। রাজনীতির খেলায়, মানিয়ে নেওয়ার খেলায় আজ অভ্যস্ত আমরা! যাই ঘটুক, চুপচাপ থাকো, মানিয়ে নাও! মানিয়ে নাও, সবকিছু মানিয়ে নাও!
না, সব ক্ষেত্রে মানিয়ে নেওয়া বা মেনে নেওয়ার শিক্ষা থেকে আমাদের বের হয়ে আসার সময় হয়েছে। সমস্ত স্তাবকতা, ভীরুতা আর আপসকামিতার ঊর্ধ্বে উঠে আসুন আমরা প্রতিবাদী হই।
লেখক
লেখক ও কলামনিস্ট
বিগত বছরগুলোতে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে সব বড় পরিবর্তন দেখা গেছে তার মধ্যে বহুল আলোচিত একটি বিষয় জনপ্রতিনিধিদের জনবিচ্ছিন্নতা। সমালোচকরা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এখন আর আগের মতো নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। চলমান এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সারা দেশ যখন ইতিহাসের ভয়াবহতম মহামারীর কবলে পড়ল তখন আবারও আলোচনায় চলে আসেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। বিশেষত মহামারী মোকাবিলার শুরুর দিকে জাতীয় সংসদের সদস্য বা এমপিদের দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা না থাকায় বিষয়টি নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়। রাজনৈতিক অঙ্গন তো বটেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও মন্ত্রী-এমপিদের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা হয়। এ সময় জনপ্রতিনিধিদের বদলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদেরই মহামারী মোকাবিলায় সম্মুখসারিতে দেখা গেলে তারও সমালোচনা হয়। অবশ্য এরপর দৃশ্যপট কিছুটা বদলায় এবং রাজনীতিকদের সক্রিয়তাও দেখা যায়। এখন আবার করোনাকালে এমপিদের জন্য স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘করোনার মধ্যেই সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছেন এমপিরা’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের এই বরাদ্দ পাশের জন্য রবিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) উত্থাপনের খবর জানানো হয়। পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক এ প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে। এটি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের চলমান একটি প্রকল্পেরই তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্প। এতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৬ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। ২০২৪ সাল নাগাদ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রতি বছর ৫ কোটি করে চার বছরে মোট ২০ কোটি করে টাকা পাবেন প্রত্যেক এমপি। এ অর্থে নিজ নিজ সংসদীয় এলাকার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে রাস্তাঘাট, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে এ অর্থ ব্যয় করবেন তারা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতেও এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ টাকা মূলত এমপিদের তুষ্ট করার জন্য দেওয়া হয়; স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় হয় না। নতুন করে প্রকল্প শুরুর আগে পুরনো প্রকল্পগুলোর নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রয়োজন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রত্যেক এমপি নিজ নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সে সময় প্রকল্প ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৮৯২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ প্রকল্প ২০১০ সালের মার্চে শুরু হয়ে ২০১৬ সালের জুনে শেষ হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে এ প্রকল্পের দ্বিতীয় দফায় এমপিদের ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৭৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন মাস। এখন সেই প্রকল্প শেষ না করেই তৃতীয় মেয়াদে এমপিদের ফের ২০ কোটি টাকা করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এমপি বা জনপ্রতিনিধিদের প্রতি স্থানীয় ভোটারদের অনেক চাহিদা বা দাবি থাকে। বাস্তবতার খাতিরে এসব দাবির অনেক কিছুই পূরণ করতে হয়। মন্ত্রী আরও বলেন, করোনার সময় এ প্রকল্প নেওয়া হলেও এখনই বাস্তবায়ন হয়ে যাবে তা নয়। কিন্তু করোনার পরে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের রাখতে হবে।
নানা সমালোচনা সত্ত্বেও স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এমপিদের জন্য এমন বরাদ্দ দেশে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। মূলত স্থানীয় রাজনীতিতে এমপিদের অবস্থান শক্তিশালী করা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে রাখার কাজেই বিলিবণ্টন হয়ে থাকে এ ধরনের বরাদ্দগুলো। অবশ্য, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী এই প্রকল্পের আওতায় এমপিরা সরাসরি টাকা পান না। এমপিরা শুধু তাদের নির্বাচনী আসনে পছন্দ মোতাবেক বিভিন্ন প্রকল্পের নাম দেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রশ্ন হচ্ছে, করোনা মহামারীর দুর্যোগ সামলাতে যখন জনপ্রতিনিধিদের জরুরি কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করার কথা তখন এমন রাজনৈতিক প্রকল্প স্থানীয় জনসাধারণের কী উপকারে আসবে? আগে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কী উপকার হয়েছে, জনগণের কী কল্যাণ হয়েছে সেটা জানা যেমন জরুরি তেমনি এসব প্রকল্পের আওতায় অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে দুর্নীতি বাড়াবে। বিচ্ছিন্নতা বজায় রেখে এমন প্রকল্প বরাদ্দের নীতি দিয়ে নয়, জনপ্রতিনিধিদের জনসংশ্লিষ্টতা বাড়াতে সত্যিকারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো জরুরি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।