অনলাইন ভর্তি পরীক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
নজরুল ইসলাম | ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ভূগোল ও পরিবেশবিদ, নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৩৯, শরীয়তপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু করে চার দশকেরও বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। ১৯৯৯-২০০২ সালে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ২০০৭-২০১১ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খ্যাতিমান এই অধ্যাপক। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের নগরায়ণ, নগর উন্নয়ন ও নগর পরিকল্পনাবিষয়ক নানা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন এবং বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ প্রকল্পের উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সব শিক্ষার্থীর ‘অটো পাস’, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়াসহ করোনাকালে শিক্ষার নানা সংকট নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : এবার এইচএসসিতে সব শিক্ষার্থীকে অটো পাসের মাধ্যমে উত্তীর্ণ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীর জেএসসি এবং এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা নির্ধারণে এইচএসসি পরীক্ষার ফল বা প্রাপ্ত জিপিএর পয়েন্ট বিবেচিত হয়, সঙ্গে থাকে লিখিত পরীক্ষার ফল। অটো পাসের গ্রেড পয়েন্টকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এবার কী ধরনের জটিলতা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে?
নজরুল ইসলাম : এবার উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে (পিইসি) পরীক্ষা না নিয়ে অটো পাস এবং অটো প্রমোশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এ ব্যবস্থাটি শুধু এইচএসসির ক্ষেত্রে করা হলেই ভালো হতো। তারপরও যা করা হয়েছে, সেটা খারাপ নয়। এখন স্কোরটা ঠিকমতো সাজিয়ে ফল প্রকাশ করা দরকার। এখন প্রশ্ন হলো এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে কীভাবে উচ্চশিক্ষার ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে? দেশে ৪৬টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৯৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চলছিল। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের নতুন ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে এবার যে ১৩ লাখের ওপর শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে, তাদের তো ভর্তি করতে হবে। অবশ্য এর মধ্যে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ইচ্ছুক, তা তো নয়। ধরা যাক, এদের একটা বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। তাই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়, তাদের জন্য তো ব্যবস্থা রাখতে হবে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তারা অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করবেন। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সরাসরি লিখিত পরীক্ষা নেবে। এখন এ রকম দু-চারটি বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি লিখিত পরীক্ষা নিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা যেন স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াই সম্পন্ন করা যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বিবেচনা করতে হবে শিক্ষার্থীরা দূরদূরান্ত থেকে পরীক্ষা দিতে আসবে।
এ বিষয়ে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মো. আবদুল হামিদ একটি জাতীয় দৈনিকে তার প্রকাশিত নিবন্ধে বেশ কয়েকটি ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এবার শিক্ষার্থীদের এলাকার কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। আমি যখন ইউজিসির চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন এ রকম পরামর্শ দিয়েছিলাম। শ্রীলঙ্কায় এরকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যেটা আমি ২০ বছর আগে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। এলাকাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই এলাকার ছেলেমেয়েদের ভর্তির অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কেবল যারা উচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখবে, তারা নিজেদের পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে, বাকিরা নিজ নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করবে। আর যারা উচ্চ মেধার প্রতিফলন ঘটাবে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পাবে। সেক্ষেত্রে কোটা না তৈরি করেও এসব শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির একধরনের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে। এর ফলে খরচ কমবে, স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে, ক্লান্তিকর ভ্রমণও হ্রাস পাবে এবং বাড়িতে বসে প্রস্তুতির সুযোগ থাকবে।
করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতি আমাদের সবকিছুকে নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে। দেখুন, পৃথিবীতে এমন কিছু পরীক্ষা আছে যেগুলো নির্ধারিত কেন্দ্রে বসে দেওয়া যায়। যেমনস্যাটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যায় বা গ্র্যাজুয়েট রেকর্ডস এক্সামিনেশন অর্থাৎ জিআরই পরীক্ষাও দেওয়া যায়। এ পরীক্ষাগুলো ঢাকাতে কয়েকটি নির্ধারিত কেন্দ্রে বসেই দেওয়া যায়। তাহলে করোনার সময় এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ রকম ব্যবস্থা কেন প্রণয়ন করা যাবে না? যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি পরীক্ষা নিতে চায়, তারা সে পরীক্ষা নিতে পারে। বাকিরা অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুক। এক্ষেত্রে শাবিপ্রবির মো. আবদুল হামিদ ভালো কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মুনাজ আহমেদ নুরও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এসব পরামর্শ একত্র করে পথ বের করতে হবে। তবে অনলাইন পরীক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর : যারা মাধ্যমিকের পর বিভাগ পরিবর্তন করেছে তাদের গ্রেডিং করার ক্ষেত্রে কী জটিলতা তৈরি হবে না? এ বিষয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা কী?
নজরুল ইসলাম : এখন কেউ তো মানবিক থেকে বিজ্ঞানে বা ব্যবসা শিক্ষা থেকে বিজ্ঞানে যেতে পারে না। বিজ্ঞান থেকে মানবিক বা ব্যবসায়ে শিক্ষায় যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে কিছু ঝামেলা তো হবেই। আর কিছু বিষয় আছে, যেগুলো প্রায়োগিক বিষয়। যেমন স্থাপত্যবিদ্যা কিংবা চারুকলা অথবা সংগীত। সেগুলো তো শুধু লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় না। হাতে-কলমে টেস্ট করতে হবে। সেটা অনলাইনেও করা যায়। আবার অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেও মেধা নির্ধারণ করা যায়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ক্ষেত্রে আগে এরকম মৌখিক পরীক্ষার পদ্ধতি দেখেছি। তাতে তো খুব ক্ষতি হয়নি, বরং এদের অনেকেই বড় শিল্পী হয়েছেন। এ রকম আরও অনেক পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা এখন যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছি, তাতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে তা সামলানোর জন্য দেশে অনেক বিদ্বান লোক রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে খোলা মনে পরামর্শ নিয়ে কাজে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সমন্বয়ের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশ রূপান্তর : যারা জেএসসি ও এসএসসিতে কোনো রকম উতরে এসেছিলেন এবং জেএসসি ও এসএসসিতে খারাপ করার কারণে এইচএসসিতে ভালো করার লক্ষ্যে পরিশ্রম করে তৈরি হয়েছিলেন, তারা কী এই অটোপাসের সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? এমন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে এ ধরনের অটো পাসের সিদ্ধান্ত কী নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে?
নজরুল ইসলাম : সুযোগ বঞ্চিত হলোএ কথা বলা যাবে না। তবে একটু অসুবিধায় যে পড়েছে, সেটা বলা যায়। কেননা, তাদের এখন আর ভালো ফল না করে আগের ফলের ভিত্তিতে তৈরি রেজাল্টকেই মেনে নিতে হবে না। তবে তাদের সুযোগ আরও থাকবে। তারা আবারও মেধার পরিচয় দিতে পারবে। স্নাতক প্রথম শ্রেণিতে তারা ভালো ফল করে এ সাময়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। আর আমরা আশা করব যে, করোনা দীর্ঘকাল ধরে থাকবে না। যখন এ ভয়ংকর পরিস্থিতি কেটে যাবে, তখন এসব শিক্ষার্থী স্নাতক প্রথম শ্রেণি বা পরবর্তী স্তরগুলোতে ভালো ফল করবে। আমরা আগে দেখেছি যে, অনেকে কোনো রকম ভর্তির সুযোগ পেয়ে ভালো লাগা এবং উদ্যম ও উদ্যোগের ফলে অনেক ভালো ফল করেছে। আবার অনেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারছে না।
দেশ রূপান্তর : আগের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশন জটের ভয়াবহতা তেমন একটা না থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে আবার সেশনজটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকেই স্থবির হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষাবর্ষ শেষের দিকে অথচ তেমন ক্লাস, কোর্স সম্পন্ন, পরীক্ষা নেওয়া কিছুই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেশনজট যাতে না তৈরি হয় সেজন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
নজরুল ইসলাম : করোনার কারণে সেশনজট যাতে না হয়, সেটা এখন থেকেই চেষ্টা করতে হবে। এজন্য এক বা আধা বছর কনডেন্সড কোর্স থাকতে পারে। কোর্স ২৫ শতাংশ বা এর একটু বেশি কমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এটা কলা কিংবা সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে করলে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সব এক্সপেরিমেন্ট বা সব ধাপ সম্পন্ন না করলে সমস্যা হয়। কিছু তো সমস্যা হবে। তবে সেশনজট যাতে না হয় সেজন্য কিছু সমন্বয় বা অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হবে। এই করোনাকাল কতদিন থাকবে তা তো এখনই বলা যাচ্ছে না। এটা যদি অনির্দিষ্টকাল থাকে, তাহলে তো জীবনপ্রবাহই বদলে যাবে। তাই সে অনুযায়ী চিন্তাভাবনা করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : অনেকেই করোনার ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য শিক্ষাবর্ষ ডিসেম্বরে শেষ করার পরিবর্তে মার্চ পর্যন্ত নেওয়ার কথা আলোচনা করছেন। আবার অনেক শিক্ষাবিদ উচ্চমাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাবর্ষও জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
নজরুল ইসলাম : এটা এখন চট করে বলা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে একটা বছর যদি সংক্ষেপ করার দরকার হয়, তবে তা করতে হবে। কনডেন্সড করার প্রয়োজন পড়লে তা করতেই হবে। এটা তো একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তো আমাদের সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। সে সময় অটো প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। কিন্তু একসময় সব স্বাভাবিক করা গিয়েছিল। এখন সেই ধরনের পরিস্থিতিকেই মাথায় রাখতে হবে। এজন্য যদি শিক্ষাবর্ষ জুলাই থেকে শুরু করতে হয়, তাহলে তাই করতে হবে। প্রথম এক-দুই বছর হয়তো সমস্যা হবে। তারপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কথা। তবে সবকিছুই যেহেতু অনিশ্চিত, তাই এখনই কিছু বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে সবার বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে, ধৈর্য দিয়ে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা দিয়ে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভূমিকা নিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : করোনা মহামারীর সময়ে অনলাইন ক্লাসের ধারণা সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। কিন্তু দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে খুব একটা সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি। তবে বুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে লেখাপড়ার গতি বাড়িয়েছে। অনলাইন শিক্ষার এই সার্বিক চিত্রটিকে কীভাবে দেখছেন?
নজরুল ইসলাম : এক্ষেত্রে বলা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের উদ্যোগ নিয়েছেন, তা নিয়ে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু এখন এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় ইউনিয়ন পর্যায়ে কয়েক হাজার তথ্যকেন্দ্র হওয়ায় আমরা এ সময় ভালো সুফল পাচ্ছি। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে স্কুলগুলোতে অনলাইন ক্লাসের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ব্যবস্থা করা দরকার। এ ক্লাসগুলো চালানোর জন্য বিদ্যুৎ, ভালো কম্পিউটার, প্রজেকশন এবং ভালো শিক্ষক দরকার। ঘরে ঘরে তো প্রযুক্তি পৌঁছায়নি। কয়জনের একটা ভালো কম্পিউটার বা স্মার্টফোন রয়েছে? আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত। তাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যে অনলাইন ক্লাস করবে, সে সক্ষমতা সব শিক্ষার্থীর রয়েছে? তবে যতটুক অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে করা যায়, ততটুকু ভালো। করোনা তো বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস করার সক্ষমতা অনেকেরই কমে যাবে। সেক্ষেত্রে পাবলিক হল কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। আর অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে তো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। তারা শুধু নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা জাতিকে শেখাতে পারত। সেটা না হওয়া দুঃখজনক।
শেয়ার করুন
নজরুল ইসলাম | ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ভূগোল ও পরিবেশবিদ, নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৩৯, শরীয়তপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ১৯৬৩ সাল থেকে শুরু করে চার দশকেরও বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। ১৯৯৯-২০০২ সালে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ২০০৭-২০১১ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খ্যাতিমান এই অধ্যাপক। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের নগরায়ণ, নগর উন্নয়ন ও নগর পরিকল্পনাবিষয়ক নানা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন এবং বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ প্রকল্পের উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সব শিক্ষার্থীর ‘অটো পাস’, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়াসহ করোনাকালে শিক্ষার নানা সংকট নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : এবার এইচএসসিতে সব শিক্ষার্থীকে অটো পাসের মাধ্যমে উত্তীর্ণ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীর জেএসসি এবং এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা নির্ধারণে এইচএসসি পরীক্ষার ফল বা প্রাপ্ত জিপিএর পয়েন্ট বিবেচিত হয়, সঙ্গে থাকে লিখিত পরীক্ষার ফল। অটো পাসের গ্রেড পয়েন্টকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এবার কী ধরনের জটিলতা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে?
নজরুল ইসলাম : এবার উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে (পিইসি) পরীক্ষা না নিয়ে অটো পাস এবং অটো প্রমোশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এ ব্যবস্থাটি শুধু এইচএসসির ক্ষেত্রে করা হলেই ভালো হতো। তারপরও যা করা হয়েছে, সেটা খারাপ নয়। এখন স্কোরটা ঠিকমতো সাজিয়ে ফল প্রকাশ করা দরকার। এখন প্রশ্ন হলো এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে কীভাবে উচ্চশিক্ষার ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে? দেশে ৪৬টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৯৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চলছিল। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের নতুন ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে এবার যে ১৩ লাখের ওপর শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে, তাদের তো ভর্তি করতে হবে। অবশ্য এর মধ্যে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ইচ্ছুক, তা তো নয়। ধরা যাক, এদের একটা বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। তাই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়, তাদের জন্য তো ব্যবস্থা রাখতে হবে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তারা অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করবেন। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সরাসরি লিখিত পরীক্ষা নেবে। এখন এ রকম দু-চারটি বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি লিখিত পরীক্ষা নিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা যেন স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াই সম্পন্ন করা যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বিবেচনা করতে হবে শিক্ষার্থীরা দূরদূরান্ত থেকে পরীক্ষা দিতে আসবে।
এ বিষয়ে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মো. আবদুল হামিদ একটি জাতীয় দৈনিকে তার প্রকাশিত নিবন্ধে বেশ কয়েকটি ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এবার শিক্ষার্থীদের এলাকার কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। আমি যখন ইউজিসির চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন এ রকম পরামর্শ দিয়েছিলাম। শ্রীলঙ্কায় এরকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যেটা আমি ২০ বছর আগে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। এলাকাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই এলাকার ছেলেমেয়েদের ভর্তির অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কেবল যারা উচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখবে, তারা নিজেদের পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে, বাকিরা নিজ নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করবে। আর যারা উচ্চ মেধার প্রতিফলন ঘটাবে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পাবে। সেক্ষেত্রে কোটা না তৈরি করেও এসব শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির একধরনের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে। এর ফলে খরচ কমবে, স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে, ক্লান্তিকর ভ্রমণও হ্রাস পাবে এবং বাড়িতে বসে প্রস্তুতির সুযোগ থাকবে।
করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতি আমাদের সবকিছুকে নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে। দেখুন, পৃথিবীতে এমন কিছু পরীক্ষা আছে যেগুলো নির্ধারিত কেন্দ্রে বসে দেওয়া যায়। যেমনস্যাটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যায় বা গ্র্যাজুয়েট রেকর্ডস এক্সামিনেশন অর্থাৎ জিআরই পরীক্ষাও দেওয়া যায়। এ পরীক্ষাগুলো ঢাকাতে কয়েকটি নির্ধারিত কেন্দ্রে বসেই দেওয়া যায়। তাহলে করোনার সময় এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ রকম ব্যবস্থা কেন প্রণয়ন করা যাবে না? যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি পরীক্ষা নিতে চায়, তারা সে পরীক্ষা নিতে পারে। বাকিরা অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুক। এক্ষেত্রে শাবিপ্রবির মো. আবদুল হামিদ ভালো কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মুনাজ আহমেদ নুরও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এসব পরামর্শ একত্র করে পথ বের করতে হবে। তবে অনলাইন পরীক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর : যারা মাধ্যমিকের পর বিভাগ পরিবর্তন করেছে তাদের গ্রেডিং করার ক্ষেত্রে কী জটিলতা তৈরি হবে না? এ বিষয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা কী?
নজরুল ইসলাম : এখন কেউ তো মানবিক থেকে বিজ্ঞানে বা ব্যবসা শিক্ষা থেকে বিজ্ঞানে যেতে পারে না। বিজ্ঞান থেকে মানবিক বা ব্যবসায়ে শিক্ষায় যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে কিছু ঝামেলা তো হবেই। আর কিছু বিষয় আছে, যেগুলো প্রায়োগিক বিষয়। যেমন স্থাপত্যবিদ্যা কিংবা চারুকলা অথবা সংগীত। সেগুলো তো শুধু লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় না। হাতে-কলমে টেস্ট করতে হবে। সেটা অনলাইনেও করা যায়। আবার অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেও মেধা নির্ধারণ করা যায়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ক্ষেত্রে আগে এরকম মৌখিক পরীক্ষার পদ্ধতি দেখেছি। তাতে তো খুব ক্ষতি হয়নি, বরং এদের অনেকেই বড় শিল্পী হয়েছেন। এ রকম আরও অনেক পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা এখন যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছি, তাতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে তা সামলানোর জন্য দেশে অনেক বিদ্বান লোক রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে খোলা মনে পরামর্শ নিয়ে কাজে এগিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সমন্বয়ের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশ রূপান্তর : যারা জেএসসি ও এসএসসিতে কোনো রকম উতরে এসেছিলেন এবং জেএসসি ও এসএসসিতে খারাপ করার কারণে এইচএসসিতে ভালো করার লক্ষ্যে পরিশ্রম করে তৈরি হয়েছিলেন, তারা কী এই অটোপাসের সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? এমন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে এ ধরনের অটো পাসের সিদ্ধান্ত কী নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে?
নজরুল ইসলাম : সুযোগ বঞ্চিত হলোএ কথা বলা যাবে না। তবে একটু অসুবিধায় যে পড়েছে, সেটা বলা যায়। কেননা, তাদের এখন আর ভালো ফল না করে আগের ফলের ভিত্তিতে তৈরি রেজাল্টকেই মেনে নিতে হবে না। তবে তাদের সুযোগ আরও থাকবে। তারা আবারও মেধার পরিচয় দিতে পারবে। স্নাতক প্রথম শ্রেণিতে তারা ভালো ফল করে এ সাময়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। আর আমরা আশা করব যে, করোনা দীর্ঘকাল ধরে থাকবে না। যখন এ ভয়ংকর পরিস্থিতি কেটে যাবে, তখন এসব শিক্ষার্থী স্নাতক প্রথম শ্রেণি বা পরবর্তী স্তরগুলোতে ভালো ফল করবে। আমরা আগে দেখেছি যে, অনেকে কোনো রকম ভর্তির সুযোগ পেয়ে ভালো লাগা এবং উদ্যম ও উদ্যোগের ফলে অনেক ভালো ফল করেছে। আবার অনেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারছে না।
দেশ রূপান্তর : আগের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশন জটের ভয়াবহতা তেমন একটা না থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে আবার সেশনজটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকেই স্থবির হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষাবর্ষ শেষের দিকে অথচ তেমন ক্লাস, কোর্স সম্পন্ন, পরীক্ষা নেওয়া কিছুই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেশনজট যাতে না তৈরি হয় সেজন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
নজরুল ইসলাম : করোনার কারণে সেশনজট যাতে না হয়, সেটা এখন থেকেই চেষ্টা করতে হবে। এজন্য এক বা আধা বছর কনডেন্সড কোর্স থাকতে পারে। কোর্স ২৫ শতাংশ বা এর একটু বেশি কমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এটা কলা কিংবা সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে করলে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সব এক্সপেরিমেন্ট বা সব ধাপ সম্পন্ন না করলে সমস্যা হয়। কিছু তো সমস্যা হবে। তবে সেশনজট যাতে না হয় সেজন্য কিছু সমন্বয় বা অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হবে। এই করোনাকাল কতদিন থাকবে তা তো এখনই বলা যাচ্ছে না। এটা যদি অনির্দিষ্টকাল থাকে, তাহলে তো জীবনপ্রবাহই বদলে যাবে। তাই সে অনুযায়ী চিন্তাভাবনা করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : অনেকেই করোনার ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য শিক্ষাবর্ষ ডিসেম্বরে শেষ করার পরিবর্তে মার্চ পর্যন্ত নেওয়ার কথা আলোচনা করছেন। আবার অনেক শিক্ষাবিদ উচ্চমাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাবর্ষও জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
নজরুল ইসলাম : এটা এখন চট করে বলা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে একটা বছর যদি সংক্ষেপ করার দরকার হয়, তবে তা করতে হবে। কনডেন্সড করার প্রয়োজন পড়লে তা করতেই হবে। এটা তো একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তো আমাদের সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। সে সময় অটো প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। কিন্তু একসময় সব স্বাভাবিক করা গিয়েছিল। এখন সেই ধরনের পরিস্থিতিকেই মাথায় রাখতে হবে। এজন্য যদি শিক্ষাবর্ষ জুলাই থেকে শুরু করতে হয়, তাহলে তাই করতে হবে। প্রথম এক-দুই বছর হয়তো সমস্যা হবে। তারপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কথা। তবে সবকিছুই যেহেতু অনিশ্চিত, তাই এখনই কিছু বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে সবার বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে, ধৈর্য দিয়ে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা দিয়ে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভূমিকা নিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : করোনা মহামারীর সময়ে অনলাইন ক্লাসের ধারণা সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। কিন্তু দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে খুব একটা সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি। তবে বুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে লেখাপড়ার গতি বাড়িয়েছে। অনলাইন শিক্ষার এই সার্বিক চিত্রটিকে কীভাবে দেখছেন?
নজরুল ইসলাম : এক্ষেত্রে বলা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের উদ্যোগ নিয়েছেন, তা নিয়ে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু এখন এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় ইউনিয়ন পর্যায়ে কয়েক হাজার তথ্যকেন্দ্র হওয়ায় আমরা এ সময় ভালো সুফল পাচ্ছি। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে স্কুলগুলোতে অনলাইন ক্লাসের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ব্যবস্থা করা দরকার। এ ক্লাসগুলো চালানোর জন্য বিদ্যুৎ, ভালো কম্পিউটার, প্রজেকশন এবং ভালো শিক্ষক দরকার। ঘরে ঘরে তো প্রযুক্তি পৌঁছায়নি। কয়জনের একটা ভালো কম্পিউটার বা স্মার্টফোন রয়েছে? আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত। তাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যে অনলাইন ক্লাস করবে, সে সক্ষমতা সব শিক্ষার্থীর রয়েছে? তবে যতটুক অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে করা যায়, ততটুকু ভালো। করোনা তো বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস করার সক্ষমতা অনেকেরই কমে যাবে। সেক্ষেত্রে পাবলিক হল কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। আর অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে তো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। তারা শুধু নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা জাতিকে শেখাতে পারত। সেটা না হওয়া দুঃখজনক।