প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দুটোই কি বাড়ছে?
রাজেকুজ্জামান রতন | ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০
সাফল্যের খবর শুনতে সবারই ভালো লাগে। আইএমএফের একটি রিপোর্টের পর গত কয়েকদিন তোলপাড় বাংলাদেশের পত্রিকা এবং মুখর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২০ সালের চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ দশমিক ৯৭ মার্কিন ডলার এবং এই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৮ শতাংশ এবং ভারতের জিডিপি ১০.৩ শতাংশ কমবে। ২০২০ সালে মাত্র ২২টি দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে, বাকি সব দেশে তা সংকুচিত হবে। বাংলাদেশ এই ২২টি দেশের অন্যতম এবং গায়ানা, সুদানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান থাকবে। বাংলাদেশ ছাড়াও যে সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে তাদের মধ্যে আছে মিসর, মিয়ানমার, রুয়ান্ডা, বতসোয়ানাসহ বিভিন্ন দেশ। বড় অর্থনীতির দেশ যাদের জিডিপি সংকুচিত হবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্র (- ৩.৬%), চীন (- ১.৯%) ভারত (-১০.৩%), জার্মানি (- ৪%) জাপান (- ৪.৬%)। করোনা সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে যে শক্ত ঝাঁকুনি দিয়েছে, আইএমএফের করা প্রবৃদ্ধির হিসাব তা আবার তুলে ধরল।
বাংলাদেশ করোনা সত্ত্বেও কেন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘটাতে পারল তার অন্যতম প্রধান কারণ করোনা ঝুঁকি নিয়েও কৃষকের উৎপাদন অব্যাহত রাখা, শ্রমজীবীদের জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা এবং প্রবাসীদের কষ্টের উপার্জনের টাকা দেশে পাঠানো। কিন্তু কিছু বিষয় কোনোভাবেই আড়াল করা যাচ্ছে না, দেশের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এ কথাটাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না, মানুষের ব্যয় বাড়ছে, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস এর তথ্য বলছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চলের হিসাবে রংপুরের কথা তো দীর্ঘদিন ধরেই সবার জানা। অথচ এই দুই বিভাগ ধানসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। জেলাভিত্তিক হিসাবে পটুয়াখালীতে দরিদ্র খানার হার ৬০.৬০ শতাংশ আর কুড়িগ্রামে ৫৯.৪ শতাংশ। দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূর না হওয়ার কারণ নিহিত আছে বৈষম্যের মধ্যে। বিভাগওয়ারী দারিদ্র্য দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বৈষম্য কতটা এবং কোথায় তা ছড়িয়ে আছে। ঢাকা বিভাগে ৮.৫%, খুলনা বিভাগে ১৪.৮%, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮.২%, সিলেট বিভাগে ২৮.৯%, রাজশাহী বিভাগে ২২.২%, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২.২%, রংপুর বিভাগে ৩৭.৮%, এবং বরিশাল বিভাগে ৪১.২%। একদিকে উন্নয়ন অন্যদিকে দারিদ্র্য সুষম বণ্টনের অভাবকেই দৃশ্যমান করে তুলেছে।
বিপরীতের ঐক্য কথাটাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাচ্ছে না। আমরা সব সময় বলি ‘আমরা সবাই’ বা ‘দেশের সব মানুষ’ কিন্তু এই কথাটা যে কতটা দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা আয় বৈষম্য দেখলেই বোঝা যায়। মাথাপিছু গড় আয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি আয় করে এমন মানুষ দেশে কয়েক লাখ আছে। বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা বা মাসে ১৩ হাজার ২১৬ টাকা আয় করে এমন মানুষ কয় জন। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, প্রতিবন্ধী সবাই তো গড় আয়ের হিসাবের আওতায়। গড় আয়ের নিচে তাহলে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ। তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পুরোটা বোঝা যায় না। যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকায় শীর্ষ শহর ঢাকা। কস্ট অব লিভিং সার্ভে শীর্ষক এ জরিপটি পোশাক, বাড়িভাড়া, গৃহস্থালি পণ্য, প্রসাধন, পরিবহন, শিক্ষা, বিনোদন ব্যয়সহ ১৬০ ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়। এতে দেখানো হয়, জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম।
আর খালি চোখে দেখা বা ভুক্তভোগীর জীবন দিয়ে বোঝার পাশাপাশি দেশি জরিপেও দেখা যায় শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, গ্রামের মানুষ আছেন আরও বিপাকে। ২০১০ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাদের মোট ব্যয়ের তুলনায় তারা গড়ে বেশি আয় করেন। অর্থাৎ তাদের গড় আয়ের পরিমাণ মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি। এ কারণে তারা মাসে ৩৬ টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। কিন্তু এই চিত্র পাল্টে গেল দেশের জিডিপি বৃদ্ধির প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে। ২০১৬ সালে দেখা যাচ্ছে তাদের মাসিক ব্যয় তাদের মাসিক আয়ের চেয়ে বেশি। গড়ে যা প্রায় মাসে ২৮৮ টাকা। ফলাফল কি? ধারদেনা বা ঋণবৃদ্ধি। ঋণের প্রবাহ বা পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা জিডিপি হয়তো বাড়ায় কিন্তু মানুষের স্বস্তি বাড়ায় না।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বাজারদর বিশ্লেষণকে বিবেচনায় নিলে এ কথা বলা যায়, গড়ে প্রতি বছর ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবা খাতের তথ্য পর্যালোচনা করে ২০১৮-১৯ সালে ক্যাব একটি হিসাব করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫.১৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৮.৪৪ শতাংশ, পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছিল ৭.১৭ শতাংশ। ব্যয় বৃদ্ধি হলেই তা সব সময় খারাপ ফল বয়ে আনে না। যদি আয় বৃদ্ধি হয় তাহলে ব্যয় বৃদ্ধি বরং অর্থনীতিতে গতি বৃদ্ধি করতে পারে। আয় যেহেতু সবার এক রকম হারে বাড়ছে না, তাই ব্যয় বৃদ্ধির এই হার ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন রকম ফল বয়ে আনতে পারে। ব্যয় অনুপাতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি না পেলে তাকে প্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হয় যা খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আয় বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যদি ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় মানুষের আয় বৃদ্ধি হয় তাহলে সেটাই হবে স্বস্তিদায়ক।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, যাতায়াত খরচের বিষয়ে যদি চিন্তা করি এক্ষেত্রে যাতায়াতের ওপর বিশেষ করে গণপরিবহনের ওপর যে ধরনের ইনভেস্টমেন্ট হওয়া দরকার ছিল ওই ধরনের ইনভেস্টমেন্ট কিন্তু করা হয়নি। ফলে দৈনন্দিন যাতায়াত ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নগরের বিনিয়োগগুলো যে সব খাতে হওয়া দরকার বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবন মানের সঙ্গে যেগুলো জড়িত সেগুলোর ওপর ওই ধরনের বিনিয়োগের অগ্রাধিকার নেই। যেমন স্বল্প আয়ের আবাসনের ওপর বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো অত্যন্ত সীমিত। জমিজমা বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির আগ্রহ এবং সরকারেরও উৎসাহিত করার জায়গাগুলোতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনমানের জায়গাগুলোতে আমাদের যে বিনিয়োগ হওয়া দরকার সেখানে বিনিয়োগ অপর্যাপ্ততা আছে। সেজন্য ঘরভাড়া অথবা যাতায়াত খরচাবলি বেড়েই চলেছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের জীবনযাত্রার খরচটা বাড়ে কেন? খরচের মধ্যে একটি উপাদান হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপকরণ। খাদ্য, ওষুধ, পোশাক, শিক্ষা খরচ ক্রমাগত বাড়ছেই। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রশাসনিক ব্যয় আমরা যেটাকে ঘুষ বা দুর্নীতি বলতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ শুধুমাত্র উপকরণ নয় বরং অন্যান্য খরচের বোঝাটাও বেশ বেশি। এসব খরচের ধাক্কাগুলো ভোক্তার ওপর চলে যায়। উৎপাদনের খরচটা শুধু উৎপাদনের জন্য হচ্ছে না। এটা নানা ধরনের নন-ইকোনমিক খরচগুলো বেশি বলে চূড়ান্তভাবে ভোক্তার কাছে যে দামটা যায় সেটা একটু বেশি হয়ে যায়। তৃতীয়ত, বিদ্যুৎসহ এই সংক্রান্ত অন্য বিষয়গুলোর সাশ্রয়ী উৎপাদনের দিকে নজর কম। চতুর্থ কারণ হচ্ছে, দেশে কর বিন্যাস বা কর ব্যবস্থাপনা। দেশে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর বেশি। ধনীরা কর রেয়াত পায়, গরিবদের কর থেকে রেহাই নেই। এটা নিত্যপণ্য থেকে মোবাইলের বিল পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই। এর প্রভাব শুধু শহরে না গ্রামেও এর প্রভাব আছে।
মূল ব্যাপারটা হলো, আমাদের দেশে আয় বৈষম্যটা মারাত্মক হারে বেড়ে গেছে। একদিকে সরকার বলছে উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে শতকরা ৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগের যত দ্রুতগতিতে বাকি ৯০ ভাগ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে ততটাই ধীরে। ফলে বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এতে করে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এটার সমাধান শুধু টিসিবির মাধ্যমে আলু, পেঁয়াজ, চিনি, তেল, খেজুর বিক্রি করে বা মোবাইল টিম গঠন করে মাঝে মাঝে জরিমানা করে হবে না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য যারা বাড়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সাময়িক পদক্ষেপে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনলে হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে আয় বৈষম্য কমাতে হবে। আয় বৈষম্য কমানোর প্রধান হাতিয়ার হবে যারা অত্যন্ত ধনী তাদের কাছ থেকে প্রপারলি ট্যাক্স সংগ্রহ করে জনগণের জন্য ব্যয় করা।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দারিদ্র্য ঝুঁকির মধ্যে রেখে প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধি অঙ্কের হিসাবে বড় দেখালেও বাস্তবে তা বৈষম্য বৃদ্ধির সংখ্যায় পরিণত হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি দ্বারা দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পারিবারিক জীবনে স্বস্তি আনতে হলে বৈষম্য দূর করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট
শেয়ার করুন
রাজেকুজ্জামান রতন | ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০

সাফল্যের খবর শুনতে সবারই ভালো লাগে। আইএমএফের একটি রিপোর্টের পর গত কয়েকদিন তোলপাড় বাংলাদেশের পত্রিকা এবং মুখর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২০ সালের চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ দশমিক ৯৭ মার্কিন ডলার এবং এই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৮ শতাংশ এবং ভারতের জিডিপি ১০.৩ শতাংশ কমবে। ২০২০ সালে মাত্র ২২টি দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে, বাকি সব দেশে তা সংকুচিত হবে। বাংলাদেশ এই ২২টি দেশের অন্যতম এবং গায়ানা, সুদানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান থাকবে। বাংলাদেশ ছাড়াও যে সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে তাদের মধ্যে আছে মিসর, মিয়ানমার, রুয়ান্ডা, বতসোয়ানাসহ বিভিন্ন দেশ। বড় অর্থনীতির দেশ যাদের জিডিপি সংকুচিত হবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্র (- ৩.৬%), চীন (- ১.৯%) ভারত (-১০.৩%), জার্মানি (- ৪%) জাপান (- ৪.৬%)। করোনা সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে যে শক্ত ঝাঁকুনি দিয়েছে, আইএমএফের করা প্রবৃদ্ধির হিসাব তা আবার তুলে ধরল।
বাংলাদেশ করোনা সত্ত্বেও কেন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঘটাতে পারল তার অন্যতম প্রধান কারণ করোনা ঝুঁকি নিয়েও কৃষকের উৎপাদন অব্যাহত রাখা, শ্রমজীবীদের জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা এবং প্রবাসীদের কষ্টের উপার্জনের টাকা দেশে পাঠানো। কিন্তু কিছু বিষয় কোনোভাবেই আড়াল করা যাচ্ছে না, দেশের জিডিপি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এ কথাটাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না, মানুষের ব্যয় বাড়ছে, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস এর তথ্য বলছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে দারিদ্র্য পীড়িত অঞ্চলের হিসাবে রংপুরের কথা তো দীর্ঘদিন ধরেই সবার জানা। অথচ এই দুই বিভাগ ধানসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। জেলাভিত্তিক হিসাবে পটুয়াখালীতে দরিদ্র খানার হার ৬০.৬০ শতাংশ আর কুড়িগ্রামে ৫৯.৪ শতাংশ। দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূর না হওয়ার কারণ নিহিত আছে বৈষম্যের মধ্যে। বিভাগওয়ারী দারিদ্র্য দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বৈষম্য কতটা এবং কোথায় তা ছড়িয়ে আছে। ঢাকা বিভাগে ৮.৫%, খুলনা বিভাগে ১৪.৮%, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮.২%, সিলেট বিভাগে ২৮.৯%, রাজশাহী বিভাগে ২২.২%, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২.২%, রংপুর বিভাগে ৩৭.৮%, এবং বরিশাল বিভাগে ৪১.২%। একদিকে উন্নয়ন অন্যদিকে দারিদ্র্য সুষম বণ্টনের অভাবকেই দৃশ্যমান করে তুলেছে।
বিপরীতের ঐক্য কথাটাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাচ্ছে না। আমরা সব সময় বলি ‘আমরা সবাই’ বা ‘দেশের সব মানুষ’ কিন্তু এই কথাটা যে কতটা দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা আয় বৈষম্য দেখলেই বোঝা যায়। মাথাপিছু গড় আয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি আয় করে এমন মানুষ দেশে কয়েক লাখ আছে। বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা বা মাসে ১৩ হাজার ২১৬ টাকা আয় করে এমন মানুষ কয় জন। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, প্রতিবন্ধী সবাই তো গড় আয়ের হিসাবের আওতায়। গড় আয়ের নিচে তাহলে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ। তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পুরোটা বোঝা যায় না। যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীর তালিকায় শীর্ষ শহর ঢাকা। কস্ট অব লিভিং সার্ভে শীর্ষক এ জরিপটি পোশাক, বাড়িভাড়া, গৃহস্থালি পণ্য, প্রসাধন, পরিবহন, শিক্ষা, বিনোদন ব্যয়সহ ১৬০ ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা হয়। এতে দেখানো হয়, জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের মোট ১৩০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৬২তম।
আর খালি চোখে দেখা বা ভুক্তভোগীর জীবন দিয়ে বোঝার পাশাপাশি দেশি জরিপেও দেখা যায় শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, গ্রামের মানুষ আছেন আরও বিপাকে। ২০১০ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপে দেখা গিয়েছিল, তাদের মোট ব্যয়ের তুলনায় তারা গড়ে বেশি আয় করেন। অর্থাৎ তাদের গড় আয়ের পরিমাণ মোট ব্যয়ের চেয়ে বেশি। এ কারণে তারা মাসে ৩৬ টাকা সাশ্রয় করতে পারতেন। কিন্তু এই চিত্র পাল্টে গেল দেশের জিডিপি বৃদ্ধির প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে। ২০১৬ সালে দেখা যাচ্ছে তাদের মাসিক ব্যয় তাদের মাসিক আয়ের চেয়ে বেশি। গড়ে যা প্রায় মাসে ২৮৮ টাকা। ফলাফল কি? ধারদেনা বা ঋণবৃদ্ধি। ঋণের প্রবাহ বা পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা জিডিপি হয়তো বাড়ায় কিন্তু মানুষের স্বস্তি বাড়ায় না।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বাজারদর বিশ্লেষণকে বিবেচনায় নিলে এ কথা বলা যায়, গড়ে প্রতি বছর ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবা খাতের তথ্য পর্যালোচনা করে ২০১৮-১৯ সালে ক্যাব একটি হিসাব করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫.১৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৮.৪৪ শতাংশ, পণ্যমূল্য ও সেবা সার্ভিসের মূল্য বেড়েছিল ৭.১৭ শতাংশ। ব্যয় বৃদ্ধি হলেই তা সব সময় খারাপ ফল বয়ে আনে না। যদি আয় বৃদ্ধি হয় তাহলে ব্যয় বৃদ্ধি বরং অর্থনীতিতে গতি বৃদ্ধি করতে পারে। আয় যেহেতু সবার এক রকম হারে বাড়ছে না, তাই ব্যয় বৃদ্ধির এই হার ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন রকম ফল বয়ে আনতে পারে। ব্যয় অনুপাতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি না পেলে তাকে প্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হয় যা খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আয় বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যদি ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় মানুষের আয় বৃদ্ধি হয় তাহলে সেটাই হবে স্বস্তিদায়ক।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, যাতায়াত খরচের বিষয়ে যদি চিন্তা করি এক্ষেত্রে যাতায়াতের ওপর বিশেষ করে গণপরিবহনের ওপর যে ধরনের ইনভেস্টমেন্ট হওয়া দরকার ছিল ওই ধরনের ইনভেস্টমেন্ট কিন্তু করা হয়নি। ফলে দৈনন্দিন যাতায়াত ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, নগরের বিনিয়োগগুলো যে সব খাতে হওয়া দরকার বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবন মানের সঙ্গে যেগুলো জড়িত সেগুলোর ওপর ওই ধরনের বিনিয়োগের অগ্রাধিকার নেই। যেমন স্বল্প আয়ের আবাসনের ওপর বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো অত্যন্ত সীমিত। জমিজমা বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির আগ্রহ এবং সরকারেরও উৎসাহিত করার জায়গাগুলোতে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনমানের জায়গাগুলোতে আমাদের যে বিনিয়োগ হওয়া দরকার সেখানে বিনিয়োগ অপর্যাপ্ততা আছে। সেজন্য ঘরভাড়া অথবা যাতায়াত খরচাবলি বেড়েই চলেছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের জীবনযাত্রার খরচটা বাড়ে কেন? খরচের মধ্যে একটি উপাদান হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপকরণ। খাদ্য, ওষুধ, পোশাক, শিক্ষা খরচ ক্রমাগত বাড়ছেই। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রশাসনিক ব্যয় আমরা যেটাকে ঘুষ বা দুর্নীতি বলতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ শুধুমাত্র উপকরণ নয় বরং অন্যান্য খরচের বোঝাটাও বেশ বেশি। এসব খরচের ধাক্কাগুলো ভোক্তার ওপর চলে যায়। উৎপাদনের খরচটা শুধু উৎপাদনের জন্য হচ্ছে না। এটা নানা ধরনের নন-ইকোনমিক খরচগুলো বেশি বলে চূড়ান্তভাবে ভোক্তার কাছে যে দামটা যায় সেটা একটু বেশি হয়ে যায়। তৃতীয়ত, বিদ্যুৎসহ এই সংক্রান্ত অন্য বিষয়গুলোর সাশ্রয়ী উৎপাদনের দিকে নজর কম। চতুর্থ কারণ হচ্ছে, দেশে কর বিন্যাস বা কর ব্যবস্থাপনা। দেশে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর বেশি। ধনীরা কর রেয়াত পায়, গরিবদের কর থেকে রেহাই নেই। এটা নিত্যপণ্য থেকে মোবাইলের বিল পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই। এর প্রভাব শুধু শহরে না গ্রামেও এর প্রভাব আছে।
মূল ব্যাপারটা হলো, আমাদের দেশে আয় বৈষম্যটা মারাত্মক হারে বেড়ে গেছে। একদিকে সরকার বলছে উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে শতকরা ৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগের যত দ্রুতগতিতে বাকি ৯০ ভাগ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে ততটাই ধীরে। ফলে বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এতে করে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এটার সমাধান শুধু টিসিবির মাধ্যমে আলু, পেঁয়াজ, চিনি, তেল, খেজুর বিক্রি করে বা মোবাইল টিম গঠন করে মাঝে মাঝে জরিমানা করে হবে না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য যারা বাড়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সাময়িক পদক্ষেপে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনলে হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে আয় বৈষম্য কমাতে হবে। আয় বৈষম্য কমানোর প্রধান হাতিয়ার হবে যারা অত্যন্ত ধনী তাদের কাছ থেকে প্রপারলি ট্যাক্স সংগ্রহ করে জনগণের জন্য ব্যয় করা।
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দারিদ্র্য ঝুঁকির মধ্যে রেখে প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধি অঙ্কের হিসাবে বড় দেখালেও বাস্তবে তা বৈষম্য বৃদ্ধির সংখ্যায় পরিণত হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি দ্বারা দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পারিবারিক জীবনে স্বস্তি আনতে হলে বৈষম্য দূর করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট