মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও সম্মানী
সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র হিসেবে সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতাসহ নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদান করে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক বা সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিমুক্ত তালিকা প্রস্তুতের কাজ সম্পন্ন করতে না পারা খুবই দুঃখজনক। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, সর্বশেষ গেজেটসহ এখন পর্যন্ত মোট ৭ বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ হালনাগাদের পর মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৫৬ জন। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা, স্বীকৃত বয়স ও মানদন্ড পরিবর্তন করা হয়েছে মোট ১১ বার। কিন্তু এরপরও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নানারকম ত্রুটি এবং নানা অনিয়মের অভিযোগের যেন কোনো শেষ নেই। তার ওপর যদি মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে মাসিক সম্মানীভাতা কিংবা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হন সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই বেশ কয়েকবার এ ধরনের নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। সর্বশেষ জানা গেল, মূল তালিকার স্ক্যান কপি থেকে নাম কাটা যাওয়ায় ওয়েবসাইটে নাম নেই ঢাকা মহানগরের প্রায় চারশত বীর মুক্তিযোদ্ধার। আর ওয়েবসাইটে নাম না থাকার কারণে গত জুলাই মাস থেকে তারা মাসিক ভাতাও পাচ্ছেন না।
সোমবার দেশ রূপান্তরে ‘কার ভুলে ভাতাবঞ্চিত ৪ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ পড়ার খবর প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু তালিকার স্ক্যানিংয়ের ত্রুটির কারণেই নয়, সর্বশেষ ‘লাল মুক্তিবার্তা’র ওয়েবসাইটে তালিকার ক্রমেও রয়েছে অসংগতি। এসব অসংগতির কারণে প্রায় চার শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চার মাস ধরে। তারা অনেকেই অভিযোগ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা শাখায় যোগাযোগ করলেও কেউ কানে তুলছে না। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধারা। নাম না প্রকাশের শর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন এই তালিকায় এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যাদের সংসার চলে এই ভাতার টাকা দিয়ে। আবার অনেকেই আছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে তারা কোনো কাজে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে গেলে ন্যূনতম শ্রদ্ধাও পান না, খুব অবহেলা করা হয়। অথচ ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের’ জন্য ঠিকই সব ব্যবস্থা রয়েছে। নাম বাদ পড়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন সরকার কীসের ভিত্তিতে তাদের নাম ফেলে দিয়েছে, সেটিও তারা জানেন না। আবার অনেকেই হতাশায় রয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তাদের সন্তান-সন্ততিরা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবে কি না কিংবা তারা মারা গেলে তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে কি না এসব নিয়েও সংশয়ে পড়েছেন তারা। ত্রুটি সংশোধন করে সম্মানীভাতা পুনরায় চালু করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধারা। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই এটা ঠিক করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ে কতটা উদাসীনতা থাকলে স্ক্যানিংয়ের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা কাটা পড়ে সেটা ভাবা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় অংশই শেষ বয়সে রয়েছেন এবং অনেকেই মারা যাচ্ছেন। নিজেদের জীবদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি পূর্ণ তালিকা দেখে যেতে পারছেন না এটা খুবই বেদনাদায়ক। খেয়াল করা দরকার যে, বিভিন্ন সরকারের আমলে মোট সাত বার হালনাগাদ করা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বহু সমালোচনা ও বিতর্ক হলেও এখনো পর্যন্ত সেসব অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের তালিকার গেজেট প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আগের তালিকায় ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলে দাবি করে তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নেয়। সে সময় আরও সাড়ে ১১ হাজার ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয় সরকার। কিন্তু ৭০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলে যে দাবি করা হয়েছিল তাদের সনদ বাতিল করা হয়নি। উল্টো সেই সময়ে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই ২০১৪ সালে ভুয়া প্রমাণিত হন। কিন্তু ছয়জন সচিব ও পাঁচজন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকসহ মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা দাবি করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং সম্মানী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এমন কোনো অপারগতাকে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই অবিলম্বে ত্রুটিমুক্ত পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
শেয়ার করুন

সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র হিসেবে সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতাসহ নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রদান করে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক বা সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পূর্ণাঙ্গ ও ত্রুটিমুক্ত তালিকা প্রস্তুতের কাজ সম্পন্ন করতে না পারা খুবই দুঃখজনক। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, সর্বশেষ গেজেটসহ এখন পর্যন্ত মোট ৭ বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ হালনাগাদের পর মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৫৬ জন। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা, স্বীকৃত বয়স ও মানদন্ড পরিবর্তন করা হয়েছে মোট ১১ বার। কিন্তু এরপরও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নানারকম ত্রুটি এবং নানা অনিয়মের অভিযোগের যেন কোনো শেষ নেই। তার ওপর যদি মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে মাসিক সম্মানীভাতা কিংবা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হন সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই বেশ কয়েকবার এ ধরনের নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। সর্বশেষ জানা গেল, মূল তালিকার স্ক্যান কপি থেকে নাম কাটা যাওয়ায় ওয়েবসাইটে নাম নেই ঢাকা মহানগরের প্রায় চারশত বীর মুক্তিযোদ্ধার। আর ওয়েবসাইটে নাম না থাকার কারণে গত জুলাই মাস থেকে তারা মাসিক ভাতাও পাচ্ছেন না।
সোমবার দেশ রূপান্তরে ‘কার ভুলে ভাতাবঞ্চিত ৪ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ পড়ার খবর প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু তালিকার স্ক্যানিংয়ের ত্রুটির কারণেই নয়, সর্বশেষ ‘লাল মুক্তিবার্তা’র ওয়েবসাইটে তালিকার ক্রমেও রয়েছে অসংগতি। এসব অসংগতির কারণে প্রায় চার শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চার মাস ধরে। তারা অনেকেই অভিযোগ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা শাখায় যোগাযোগ করলেও কেউ কানে তুলছে না। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধারা। নাম না প্রকাশের শর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন এই তালিকায় এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যাদের সংসার চলে এই ভাতার টাকা দিয়ে। আবার অনেকেই আছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে তারা কোনো কাজে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে গেলে ন্যূনতম শ্রদ্ধাও পান না, খুব অবহেলা করা হয়। অথচ ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের’ জন্য ঠিকই সব ব্যবস্থা রয়েছে। নাম বাদ পড়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন সরকার কীসের ভিত্তিতে তাদের নাম ফেলে দিয়েছে, সেটিও তারা জানেন না। আবার অনেকেই হতাশায় রয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তাদের সন্তান-সন্ততিরা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবে কি না কিংবা তারা মারা গেলে তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে কি না এসব নিয়েও সংশয়ে পড়েছেন তারা। ত্রুটি সংশোধন করে সম্মানীভাতা পুনরায় চালু করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন এই মুক্তিযোদ্ধারা। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই এটা ঠিক করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ে কতটা উদাসীনতা থাকলে স্ক্যানিংয়ের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা কাটা পড়ে সেটা ভাবা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় অংশই শেষ বয়সে রয়েছেন এবং অনেকেই মারা যাচ্ছেন। নিজেদের জীবদ্দশায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি পূর্ণ তালিকা দেখে যেতে পারছেন না এটা খুবই বেদনাদায়ক। খেয়াল করা দরকার যে, বিভিন্ন সরকারের আমলে মোট সাত বার হালনাগাদ করা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বহু সমালোচনা ও বিতর্ক হলেও এখনো পর্যন্ত সেসব অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের তালিকার গেজেট প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আগের তালিকায় ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলে দাবি করে তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নেয়। সে সময় আরও সাড়ে ১১ হাজার ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয় সরকার। কিন্তু ৭০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলে যে দাবি করা হয়েছিল তাদের সনদ বাতিল করা হয়নি। উল্টো সেই সময়ে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই ২০১৪ সালে ভুয়া প্রমাণিত হন। কিন্তু ছয়জন সচিব ও পাঁচজন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকসহ মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা দাবি করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং সম্মানী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এমন কোনো অপারগতাকে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই অবিলম্বে ত্রুটিমুক্ত পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।