আমন সংগ্রহ অভিযান ও নিরাপত্তা মজুদ
বদরুল হাসান | ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
এ বছর ৭ নভেম্বর থেকে সারা দেশে আমন ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং ৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল। মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা এবং চাল ৩৭ টাকা। বরাবরের মতো এবারও এ ধান কেনা হবে কৃষকদের কাছ থেকে এবং চাল কেনা হবে মিলারদের কাছ থেকে। মিল মালিকদের সঙ্গে চাল কেনার জন্য চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের শেষ তারিখ নির্ধারিত আছে ২৬ নভেম্বর। এখন পর্যন্ত ধান সংগ্রহ শুধু দুই এক স্থানে উদ্বোধনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়েছে; কিন্তু কোনো মিলের সঙ্গে চাল কেনার চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি; মিলাররা বর্তমান দরে সরকারের গুদামে চাল সরবরাহে আদৌ উৎসাহিত নন।
কেবল নতুন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু বাজারে অনেকটা ভেজা ধানই ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকা মণ (প্রতি ৪০ কেজি) দরে বিক্রি হচ্ছে, কেজিতে যার মূল্য দাঁড়ায় ২৭.৫০ টাকার ওপর। এ ধান চালে রূপান্তর করলে সব খরচসহ চালের কেজিতে মূল্য পড়ে কমপক্ষে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক ঢাকার বাজারে ১৭ নভেম্বর মোটা ও মাঝারি মানের চালের খুচরা দর চলছে যথাক্রমে ৪২ থেকে ৪৮ টাকা; পাইকারি মূল্য ৪০ থেকে ৪৬ টাকা। মফস্বল এলাকায় মূল্য কেজিপ্রতি ২ টাকা কম হওয়া যৌক্তিক। কিন্তু বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে নতুন চালের খুচরা মূল্য চলছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা। ফলে এই মুহূর্তে ধানের দামের তুলনায় পাইকারি বাজারে চালের দাম কম হওয়ায় মিলারদের চাল উৎপাদনে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এরকম দুঃসময়ে অনেক মালিক, বিশেষ করে ক্ষুদ্র চালকল মালিকরা মিল বন্ধ রেখেছেন; যারা চালু রেখেছেন, তারা কিছুটা সচ্ছল ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, তারা তা করছেন অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে, ভবিষ্যতের আশায়। তারা ‘আলিবাবা’র জ্যাক মা’কে চেনেন না। কিন্তু করোনাকালে তার সেই বিখ্যাত উক্তি ‘Just make sure you stay alive. If you can stay alive,then you would have made a profit already’ নিজ গুণে অনুশীলন করে চলেছেন। মিল বন্ধ রাখলে শ্রমিক ধরে রাখা যাবে না, লাভের সময় মিল চালু করা যাবে না।
ধান ও চালের এই ভারসাম্যহীন মূল্যস্তর বজায় থাকা অবস্থায় মিলাররা যে সরকারি সংগ্রহ অভিযানে যুক্ত হবেন না, তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। ধানের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটা অর্জনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বিগত বোরো সংগ্রহ মৌসুমেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি, যদিও ঐ সময় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ কোটি টনের বেশি। তাছাড়া বোরো ধানের বাজারজাতযোগ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ মোট উৎপাদনের ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ। অপর পক্ষে আমনের বেলায় সেটা মাত্র ৩৫ শতাংশ; বাকিটা কৃষকের কাছে সারা বছরের খোরপোষের অবলম্বন হিসেবে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা মজুদ কীভাবে সমুন্নত রাখা হবে, তা ভেবে দেখা দরকার। আমাদের দেশে এই নিরাপত্তা মজুদের সরাসরি গুরুত্ব ততটা না থাকলেও পরোক্ষ তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ, খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা তাদের লাভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে সরকারি মজুদের দিকে সব সময় শ্যেন দৃষ্টি রাখেন।
অর্থবছরের শেষে ৩০ জুন তারিখে ১০ লাখ মেট্রিক টনের বাস্তব মজুদকে ‘নিরাপত্তা মজুদ’ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এই পরিমাণ নিয়ে অ্যাকাডেমিশিয়ান ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। প্রথমোক্ত দলভুক্তদের মতে এ পর্যন্ত কোনো দুর্যোগে ৩ লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য বিতরণের প্রয়োজন হয়নি। কাজেই ৬ লাখ টন দিয়েই এ কাজ সম্পন্ন করা যায়; অনর্থক বেশি মজুদ আবদ্ধ করে রাখলে তার সুযোগ-খরচ (opportunity costs) হয়ে পড়ে অনেক বেশি। আবার শেষোক্ত দলের কুশীলবদের মতে এটা এখন ১৫ লাখ টন করা প্রয়োজন; জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে; আগের মানদণ্ডে এখনো স্থির থাকলে সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। আমার মনে হয় নিরাপত্তা মজুদের এই সংখ্যাগত ধারণার চেয়ে বেশি জরুরি খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও চৌকস করে তোলা। ব্যবস্থাপনা দক্ষ হলে পরিমাণ খুব একটা বড় বিষয় হয়ে দেখা দেবে না। এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
বিগত বোরো মৌসুমে চালের যেমন রেকর্ড উৎপাদন হয়েছিল, এবার আমন ফসলও অধিকাংশ জায়গায় ভালোই হয়েছে। তবে নিচু এলাকায় বন্যায় এবং পাহাড়ি অঞ্চলে ঢলে কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের তেমন কোনো ঘাটতি নেই; উৎপাদন গত বছরের চেয়ে ২০২০/২১ সালে ৭ মিলিয়ন টন বাড়িয়ে ৫০৮.৭ মিলিয়ন টনের প্রাক্কলন করা হয়েছে। গমের উৎপাদনও একই রকম; ৭৬৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তাছাড়া ভারতে ২০১৯-২০ সালে হয়েছে চালের রেকর্ড উৎপাদন ১১৭.৯৪ মিলিয়ন টন। তবুও আগাম সতর্কতার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দ্রুত আমাদের উৎপাদনের পরিমাণ যাচাই করে প্রকৃত তথ্য নির্ণয় করা প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে সরকারি মজুদ ৮.৬৫ লাখ টন; আমন সংগ্রহ না হলে সামনে এটা আরও কমে যাবে। তখন তা বাজারে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে। এই জন্য উৎপাদন ঘাটতি যদি নাও পাওয়া যায়, তার পরও শুধু সরকারি মজুদ বৃদ্ধির স্বার্থে চাল আমদানি এবং অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে চাল আমদানির ওপর আরোপিত শুল্ক সীমিত সময়ের জন্য হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তবে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন চালের মজুদ যাতে তলানিতে না পৌঁছে যায়, সেদিকে। দ্রুত গমের আমদানি, সরবরাহ ও বিতরণ বাড়িয়ে এটা করা যেতে পারে। আগামী প্রান্তিকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে যে ৩ লাখ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করার কথা, তা আটায় রূপান্তর করা হলে বিষয়টি সহজ হয়ে যেতে পারে। তাতে শুধু ভোক্তাদের পছন্দের কিছু হেরফের হলেও পুষ্টির ইতর বিশেষ হবে না। সরকারের আর্থিক সংশ্লেষও কমে যাবে।
মজুদ বৃদ্ধির জন্য আর যে সব বিকল্প রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো চালের সংগ্রহ মূল্য ধানের সমানুপাতিক করা। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু চাল সংগ্রহের সম্ভাবনা তৈরি হলেও পরবর্তী সময়ে সেটা আর থাকবে না; মূল্যস্তর আরও বেড়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত চাল আমদানি এবং দীর্ঘমেয়াদি শুল্ক হ্রাস অভ্যন্তরীণ বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি মোকাবিলায় বিলম্বে হলেও দুই দফায় শুল্ক কমিয়ে ফেলায় ঐ সময় দেশে সরকারি-বেসরকারি চ্যানেল মিলে প্রায় ৯৮ লাখ মেট্রিক টনের মতো খাদ্যশস্য আমদানি হয়, যার মধ্যে চালের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। এর প্রভাবে পরের দুই মৌসুমে চালের দরে মন্দাভাব লক্ষ করা যায় এবং কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে চালের বাজারদর অবশ্যই উৎপাদকের জন্য লাভজনক পর্যায়ে রাখতে হবে; সেটাকে অন্যান্য কৃষিপণ্যের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
চালের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধিতে মিলারদের কারসাজিকে সব সময়ই দোষারোপ করা হয়ে থাকে। এ অভিযোগের মধ্যে যে সত্যতা নেই, তা বলা যাবে না। তবে এই কারণে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই; ধান থেকে চাল করতে তাদের অবশ্যই প্রয়োজন হবে। কিন্তু এই দোষে বড় বড় মিলার যেভাবে দোষী, ছোটরা তেমনটা নয়; তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নেই। বিআইডিএস-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, দেশে প্রায় এক হাজার স্বয়ংক্রিয় চালকলের মধ্যে ৫০টির ছাঁটাই এবং ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি; তারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তাই এদের কাজ-কারবারের নিবিড় পরিবীক্ষণ অতীব জরুরি।
বৃহৎ পুঁজির দাপটে স্বল্প পুঁজির ছোট মিলগুলো আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে; প্রতিযোগিতামূলক প্রান্তদেশ না থাকায় অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এগুলো লুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিকের জন্য কর্মসৃজন ও আয় বৈষম্য নিরসনে এদের অবদান অনেক বেশি। একটি স্বয়ংক্রিয় চালকলে প্রতিদিন হাজার মণ ধান ছাঁটাই হলেও শ্রমিক প্রয়োজন হয় মাত্র নয় দশ জন; অথচ পঞ্চাশ টন ধান ছাঁটাইক্ষম একটি ছোট মিলে শ্রমিকের প্রয়োজন হয় পনের থেকে বিশ জন যাদের অধিকাংশই অদক্ষ নারী শ্রমিক। কাজেই এই সেক্টরে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রদানবের যাত্রা দ্রুততর হলে অনেক আর্থ-সামাজিক ও বাজার নিয়ন্ত্রণগত সমস্যা দেখা দেবে, যার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
পরিশেষে বলব যে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে মজুদ যেমন দ্রুত বাড়াতে হবে, তেমনি উৎপাদন টেকসই করতে চালের মূল্য উৎপাদকদের জন্য লাভজনক পর্যায়েও রাখতে হবে। যারা সেই মূল্যে খাদ্যশস্য কেনায় অসমর্থ হবেন, তাদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে চাল ও অপেক্ষাকৃত কমদামি অন্যান্য খাদ্যশস্য বিশেষ করে গম সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে গম ভেঙে আটা করে প্যাকেটে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে যে আর্থিক সাশ্রয় হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার কাজে সেটা ব্যয় করা সম্ভব হবে।
লেখক খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
শেয়ার করুন
বদরুল হাসান | ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

এ বছর ৭ নভেম্বর থেকে সারা দেশে আমন ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ মেট্রিক টন ধান এবং ৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল। মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা এবং চাল ৩৭ টাকা। বরাবরের মতো এবারও এ ধান কেনা হবে কৃষকদের কাছ থেকে এবং চাল কেনা হবে মিলারদের কাছ থেকে। মিল মালিকদের সঙ্গে চাল কেনার জন্য চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের শেষ তারিখ নির্ধারিত আছে ২৬ নভেম্বর। এখন পর্যন্ত ধান সংগ্রহ শুধু দুই এক স্থানে উদ্বোধনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়েছে; কিন্তু কোনো মিলের সঙ্গে চাল কেনার চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি; মিলাররা বর্তমান দরে সরকারের গুদামে চাল সরবরাহে আদৌ উৎসাহিত নন।
কেবল নতুন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু বাজারে অনেকটা ভেজা ধানই ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকা মণ (প্রতি ৪০ কেজি) দরে বিক্রি হচ্ছে, কেজিতে যার মূল্য দাঁড়ায় ২৭.৫০ টাকার ওপর। এ ধান চালে রূপান্তর করলে সব খরচসহ চালের কেজিতে মূল্য পড়ে কমপক্ষে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক ঢাকার বাজারে ১৭ নভেম্বর মোটা ও মাঝারি মানের চালের খুচরা দর চলছে যথাক্রমে ৪২ থেকে ৪৮ টাকা; পাইকারি মূল্য ৪০ থেকে ৪৬ টাকা। মফস্বল এলাকায় মূল্য কেজিপ্রতি ২ টাকা কম হওয়া যৌক্তিক। কিন্তু বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে নতুন চালের খুচরা মূল্য চলছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা। ফলে এই মুহূর্তে ধানের দামের তুলনায় পাইকারি বাজারে চালের দাম কম হওয়ায় মিলারদের চাল উৎপাদনে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এরকম দুঃসময়ে অনেক মালিক, বিশেষ করে ক্ষুদ্র চালকল মালিকরা মিল বন্ধ রেখেছেন; যারা চালু রেখেছেন, তারা কিছুটা সচ্ছল ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, তারা তা করছেন অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে, ভবিষ্যতের আশায়। তারা ‘আলিবাবা’র জ্যাক মা’কে চেনেন না। কিন্তু করোনাকালে তার সেই বিখ্যাত উক্তি ‘Just make sure you stay alive. If you can stay alive,then you would have made a profit already’ নিজ গুণে অনুশীলন করে চলেছেন। মিল বন্ধ রাখলে শ্রমিক ধরে রাখা যাবে না, লাভের সময় মিল চালু করা যাবে না।
ধান ও চালের এই ভারসাম্যহীন মূল্যস্তর বজায় থাকা অবস্থায় মিলাররা যে সরকারি সংগ্রহ অভিযানে যুক্ত হবেন না, তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। ধানের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটা অর্জনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। বিগত বোরো সংগ্রহ মৌসুমেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি, যদিও ঐ সময় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ কোটি টনের বেশি। তাছাড়া বোরো ধানের বাজারজাতযোগ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ মোট উৎপাদনের ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ। অপর পক্ষে আমনের বেলায় সেটা মাত্র ৩৫ শতাংশ; বাকিটা কৃষকের কাছে সারা বছরের খোরপোষের অবলম্বন হিসেবে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা মজুদ কীভাবে সমুন্নত রাখা হবে, তা ভেবে দেখা দরকার। আমাদের দেশে এই নিরাপত্তা মজুদের সরাসরি গুরুত্ব ততটা না থাকলেও পরোক্ষ তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ, খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা তাদের লাভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে সরকারি মজুদের দিকে সব সময় শ্যেন দৃষ্টি রাখেন।
অর্থবছরের শেষে ৩০ জুন তারিখে ১০ লাখ মেট্রিক টনের বাস্তব মজুদকে ‘নিরাপত্তা মজুদ’ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এই পরিমাণ নিয়ে অ্যাকাডেমিশিয়ান ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। প্রথমোক্ত দলভুক্তদের মতে এ পর্যন্ত কোনো দুর্যোগে ৩ লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য বিতরণের প্রয়োজন হয়নি। কাজেই ৬ লাখ টন দিয়েই এ কাজ সম্পন্ন করা যায়; অনর্থক বেশি মজুদ আবদ্ধ করে রাখলে তার সুযোগ-খরচ (opportunity costs) হয়ে পড়ে অনেক বেশি। আবার শেষোক্ত দলের কুশীলবদের মতে এটা এখন ১৫ লাখ টন করা প্রয়োজন; জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে; আগের মানদণ্ডে এখনো স্থির থাকলে সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। আমার মনে হয় নিরাপত্তা মজুদের এই সংখ্যাগত ধারণার চেয়ে বেশি জরুরি খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও চৌকস করে তোলা। ব্যবস্থাপনা দক্ষ হলে পরিমাণ খুব একটা বড় বিষয় হয়ে দেখা দেবে না। এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
বিগত বোরো মৌসুমে চালের যেমন রেকর্ড উৎপাদন হয়েছিল, এবার আমন ফসলও অধিকাংশ জায়গায় ভালোই হয়েছে। তবে নিচু এলাকায় বন্যায় এবং পাহাড়ি অঞ্চলে ঢলে কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের তেমন কোনো ঘাটতি নেই; উৎপাদন গত বছরের চেয়ে ২০২০/২১ সালে ৭ মিলিয়ন টন বাড়িয়ে ৫০৮.৭ মিলিয়ন টনের প্রাক্কলন করা হয়েছে। গমের উৎপাদনও একই রকম; ৭৬৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। তাছাড়া ভারতে ২০১৯-২০ সালে হয়েছে চালের রেকর্ড উৎপাদন ১১৭.৯৪ মিলিয়ন টন। তবুও আগাম সতর্কতার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দ্রুত আমাদের উৎপাদনের পরিমাণ যাচাই করে প্রকৃত তথ্য নির্ণয় করা প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে সরকারি মজুদ ৮.৬৫ লাখ টন; আমন সংগ্রহ না হলে সামনে এটা আরও কমে যাবে। তখন তা বাজারে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে। এই জন্য উৎপাদন ঘাটতি যদি নাও পাওয়া যায়, তার পরও শুধু সরকারি মজুদ বৃদ্ধির স্বার্থে চাল আমদানি এবং অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে চাল আমদানির ওপর আরোপিত শুল্ক সীমিত সময়ের জন্য হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তবে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন চালের মজুদ যাতে তলানিতে না পৌঁছে যায়, সেদিকে। দ্রুত গমের আমদানি, সরবরাহ ও বিতরণ বাড়িয়ে এটা করা যেতে পারে। আগামী প্রান্তিকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে যে ৩ লাখ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করার কথা, তা আটায় রূপান্তর করা হলে বিষয়টি সহজ হয়ে যেতে পারে। তাতে শুধু ভোক্তাদের পছন্দের কিছু হেরফের হলেও পুষ্টির ইতর বিশেষ হবে না। সরকারের আর্থিক সংশ্লেষও কমে যাবে।
মজুদ বৃদ্ধির জন্য আর যে সব বিকল্প রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো চালের সংগ্রহ মূল্য ধানের সমানুপাতিক করা। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু চাল সংগ্রহের সম্ভাবনা তৈরি হলেও পরবর্তী সময়ে সেটা আর থাকবে না; মূল্যস্তর আরও বেড়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত চাল আমদানি এবং দীর্ঘমেয়াদি শুল্ক হ্রাস অভ্যন্তরীণ বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি মোকাবিলায় বিলম্বে হলেও দুই দফায় শুল্ক কমিয়ে ফেলায় ঐ সময় দেশে সরকারি-বেসরকারি চ্যানেল মিলে প্রায় ৯৮ লাখ মেট্রিক টনের মতো খাদ্যশস্য আমদানি হয়, যার মধ্যে চালের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। এর প্রভাবে পরের দুই মৌসুমে চালের দরে মন্দাভাব লক্ষ করা যায় এবং কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে চালের বাজারদর অবশ্যই উৎপাদকের জন্য লাভজনক পর্যায়ে রাখতে হবে; সেটাকে অন্যান্য কৃষিপণ্যের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
চালের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধিতে মিলারদের কারসাজিকে সব সময়ই দোষারোপ করা হয়ে থাকে। এ অভিযোগের মধ্যে যে সত্যতা নেই, তা বলা যাবে না। তবে এই কারণে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই; ধান থেকে চাল করতে তাদের অবশ্যই প্রয়োজন হবে। কিন্তু এই দোষে বড় বড় মিলার যেভাবে দোষী, ছোটরা তেমনটা নয়; তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নেই। বিআইডিএস-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, দেশে প্রায় এক হাজার স্বয়ংক্রিয় চালকলের মধ্যে ৫০টির ছাঁটাই এবং ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি; তারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তাই এদের কাজ-কারবারের নিবিড় পরিবীক্ষণ অতীব জরুরি।
বৃহৎ পুঁজির দাপটে স্বল্প পুঁজির ছোট মিলগুলো আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে; প্রতিযোগিতামূলক প্রান্তদেশ না থাকায় অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এগুলো লুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিকের জন্য কর্মসৃজন ও আয় বৈষম্য নিরসনে এদের অবদান অনেক বেশি। একটি স্বয়ংক্রিয় চালকলে প্রতিদিন হাজার মণ ধান ছাঁটাই হলেও শ্রমিক প্রয়োজন হয় মাত্র নয় দশ জন; অথচ পঞ্চাশ টন ধান ছাঁটাইক্ষম একটি ছোট মিলে শ্রমিকের প্রয়োজন হয় পনের থেকে বিশ জন যাদের অধিকাংশই অদক্ষ নারী শ্রমিক। কাজেই এই সেক্টরে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রদানবের যাত্রা দ্রুততর হলে অনেক আর্থ-সামাজিক ও বাজার নিয়ন্ত্রণগত সমস্যা দেখা দেবে, যার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
পরিশেষে বলব যে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে মজুদ যেমন দ্রুত বাড়াতে হবে, তেমনি উৎপাদন টেকসই করতে চালের মূল্য উৎপাদকদের জন্য লাভজনক পর্যায়েও রাখতে হবে। যারা সেই মূল্যে খাদ্যশস্য কেনায় অসমর্থ হবেন, তাদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে চাল ও অপেক্ষাকৃত কমদামি অন্যান্য খাদ্যশস্য বিশেষ করে গম সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে গম ভেঙে আটা করে প্যাকেটে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে যে আর্থিক সাশ্রয় হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার কাজে সেটা ব্যয় করা সম্ভব হবে।
লেখক খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক