মাদকের ভয়াবহতা এবং স্বদেশের ভবিষ্যৎ
রাজেকুজ্জামান রতন | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
যদি বলা হয় বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় ৪৫ হাজারের বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হয় তাহলে কি আঁতকে উঠবেন? পরিসংখ্যান কিন্তু এটাই বলে। মাদকের ভয়াবহ বিস্তার গোটা দেশের ভবিষ্যৎকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। মাদকের নেশায় আচ্ছন্ন মাদকাসক্ত ও তাদের বিপন্ন পরিবার, বাবা-মা-স্ত্রী বা স্বামী ও সন্তানদের কথা এখন শুধু প্রচার মাধ্যমে নয় বাস্তব জীবনেও প্রত্যক্ষ করছেন অনেকেই। সম্প্রতি মাদক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তকে মা ও সন্তানদের দেখভাল করার শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছে হাইকোর্ট। একটি অভিজ্ঞতাজনিত প্রবাদ বাক্য চালু হয়েছে ইদানীং ‘একটি সংসারকে পথে বসাতে একজন মাদকাসক্তই যথেষ্ট’। শুধু সংসার নয়, সমাজের শান্তি-স্বস্তি-ভারসাম্য সবই নষ্ট করে ফেলে মাদকাসক্তরা। একটি দেশের বর্তমানের আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ধ্বংস করে ফেলে মাদক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তারা এ পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার করেছেন। তবে সংখ্যাটা এত বেশি হলেও বাংলাদেশের মাদকসেবীরা সেবন করে ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক। এর মধ্যে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা আর ফেনসিডিলই বেশি। এর পাশাপাশি এখন অভিজাত এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে ‘সিসা’ নামের একধরনের ব্যয়বহুল মাদক ব্যবহারের খবর পত্রিকায় এসেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এসবের কোনোটাই বাংলাদেশে উৎপাদন বা তৈরি হয় না। এর মধ্যে ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে আর বাকিগুলো আসে ভারত থেকে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার। মাদকের প্রবেশ পথ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। বৃহত্তর যশোর সীমান্তে ৫২টি এবং উত্তরাঞ্চলের ৬টি জেলার ৭২ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৭০টি ফেনসিডিল ও ১০টি হেরোইন প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার তালিকা একবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। আর মিয়ানমার থেকে ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর শুধু ২০১৬ সালেই প্রায় ৩ কোটি (দুই কোটি ৯৫ লাখ) পিস ইয়াবা বাজেয়াপ্ত করে। অথচ ২০১০ সালে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৮১ হাজার পিস। এই হিসাব থেকে বাজেয়াপ্ত করা ইয়াবার পরিমাণ জানা গেল। ব্যবহার করা ইয়াবা যে এর চাইতে বহুগুণ বেশি তা সবাই মানবেন।
ইয়াবা চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করা হয় টেকনাফের নাফ নদীকে। কেননা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশের অন্যতম রুট এই নাফ নদী। লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এই ইয়াবা ব্যবসা। মিয়ানমারের ৬০ টাকার এই ট্যাবলেট পাচার হয়ে এসে রাজধানী ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। আর এ কারণে ইয়াবা ব্যবসায় ঝুঁকছে মাদক ব্যবসায়ীরা। আর সিন্ডিকেট তৈরি করে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা।
মাদকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে আরেকটি নেশার নাম। তা হলো জুয়া। ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় ‘জুয়ায় ভাসছে রাতের ঢাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ক্লাব ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রাত গভীর হলেই বসছে কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর। প্রভাবশালী মহলের শেল্টারে রাজধানীতেই অন্তত দেড়শ জুয়ার স্পট চলছে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এসব জুয়ার আসর খোলা থাকে, পাহারায় থাকে নিজস্ব অস্ত্রধারী টিম। এদের ঝামেলা থেকে সুরক্ষা দেন খোদ পুলিশ প্রশাসনেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা। একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি স্পটে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। সে হিসাবে রাজধানীর জুয়ার স্পটগুলোতে দৈনিক ৩০০ কোটি টাকা উড়ছে।’ রিপোর্টটিতে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার বাইরেও রূপনগর ও উত্তরায় রমরমা ক্যাসিনো আছে বলে উল্লেখ ছিল।
২০১৫ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি তরল কোকেনের চালান ধরা পড়ে। বলিভিয়া থেকে আসা একটি কন্টেনারে ১০৭ ড্রাম সানফ্লাওয়ার তেলের মধ্যে দুই ড্রাম তরল কোকেন পাওয়া যায়। পরে ল্যাবেরটরি টেস্টেও কোকেনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা কর্র্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় দায়ের করা মাদক আইনের মামলাটি এখন আদালতে বিচারের অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশে কোকেন সংক্রান্ত অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বাংলাদেশের মাদক চোরাচালান এবং ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বাংলাদেশকে মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মোট হেরোইন উদ্ধার করেছে ৪৮ কেজি, গাঁজা ১৬ হাজার কেজি, ফেনসিডিল দেড় লাখ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ৫০ লাখ পিস। এর বাইরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এই আইনে ২০১৭ সালে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ১,০৬,৫৩৬টি। এই মামলাগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের অভিযোগ, আটক এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা হয়েছে। আর এ সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে, তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ। আর ৯০ শতাংশ মাদকই ধরা পড়ে না। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ইউএনওডিসি)’র মতে, বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা ট্যাবলেটই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, প্রতিটির দাম দুইশ টাকা হিসেবে যার বাজারমূল্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবার ব্যবহার ৮০ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। ২০১২ সালে মোট মাদকসেবীর মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা হয়েছে ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ। তাদের মধ্যে ৭০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। যে যুবশক্তি বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করতে পারে মাদকাসক্ত হয়ে তারাই কি দেশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে? এ আশঙ্কা ক্রমাগত বাড়ছে।
মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সপ্তম। মাদকাসক্তরা দিনে যদি গড়ে ১০০ টাকা মাদকের জন্য ব্যয় করে (যদিও এটা খুবই কম করে ধরা হিসাব) তাহলে তারা সারা বাংলাদেশে দিনে মাদকদ্রব্য কেনায় খরচ করে ৭০ কোটি টাকা। এই হিসাবে মাসে ২১০০ কোটি টাকা এবং বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। অত্যন্ত কম করে ধরা হিসাবেও যদি টাকার পরিমাণ এই হয় তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশে মাদকের বাজারটা কত বড়। বাংলাদেশে মাদকের ব্যবহার কমছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর প্রায় সবারই জানা। বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়। মাদকের বড় ব্যবসায়ী আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি। সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১৪১ জন। তাদের মধ্যে প্রাক্তন সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই আছেন। মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার। কোনো কোনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করেন। এ পর্যন্ত ২০ হাজার গ্রেপ্তার ও দেড়শতাধিক ব্যক্তি কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেও কোনো গডফাদার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। সামাজিক প্রভাব, প্রশাসন আর পুলিশের মিলিত চক্র মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে।
মাদকের ভয়াবহতা শুধু সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক জীবনকে ধ্বংস করে তা নয় মাদকসেবীর জীবনকে ধ্বংস করে বিভিন্নভাবে। কিডনি, লিভার, ফুসফুস নষ্ট করে দেওয়া, রক্তচাপ বাড়ানো ও সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকেও নষ্ট করে। গড়ে বছরে দেড় লাখ মাদকসেবীর মৃত্যু ঘটে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। পরিকল্পিতভাবে কোনো কোনো দেশকে ধ্বংস করার জন্য মাদকের নেশা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের সবার জানা আছে। ক্ষমতা, দুর্নীতি, মাদক আর জুয়ার মেলবন্ধন বাংলাদেশকেও কি সেদিকে ধাবিত করছে?
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক এবং কলামনিস্ট
শেয়ার করুন
রাজেকুজ্জামান রতন | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

যদি বলা হয় বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় ৪৫ হাজারের বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হয় তাহলে কি আঁতকে উঠবেন? পরিসংখ্যান কিন্তু এটাই বলে। মাদকের ভয়াবহ বিস্তার গোটা দেশের ভবিষ্যৎকে আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। মাদকের নেশায় আচ্ছন্ন মাদকাসক্ত ও তাদের বিপন্ন পরিবার, বাবা-মা-স্ত্রী বা স্বামী ও সন্তানদের কথা এখন শুধু প্রচার মাধ্যমে নয় বাস্তব জীবনেও প্রত্যক্ষ করছেন অনেকেই। সম্প্রতি মাদক মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তকে মা ও সন্তানদের দেখভাল করার শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছে হাইকোর্ট। একটি অভিজ্ঞতাজনিত প্রবাদ বাক্য চালু হয়েছে ইদানীং ‘একটি সংসারকে পথে বসাতে একজন মাদকাসক্তই যথেষ্ট’। শুধু সংসার নয়, সমাজের শান্তি-স্বস্তি-ভারসাম্য সবই নষ্ট করে ফেলে মাদকাসক্তরা। একটি দেশের বর্তমানের আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ধ্বংস করে ফেলে মাদক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তারা এ পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার করেছেন। তবে সংখ্যাটা এত বেশি হলেও বাংলাদেশের মাদকসেবীরা সেবন করে ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক। এর মধ্যে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা আর ফেনসিডিলই বেশি। এর পাশাপাশি এখন অভিজাত এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে ‘সিসা’ নামের একধরনের ব্যয়বহুল মাদক ব্যবহারের খবর পত্রিকায় এসেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এসবের কোনোটাই বাংলাদেশে উৎপাদন বা তৈরি হয় না। এর মধ্যে ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে আর বাকিগুলো আসে ভারত থেকে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার। মাদকের প্রবেশ পথ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। বৃহত্তর যশোর সীমান্তে ৫২টি এবং উত্তরাঞ্চলের ৬টি জেলার ৭২ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৭০টি ফেনসিডিল ও ১০টি হেরোইন প্রস্তুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার তালিকা একবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। আর মিয়ানমার থেকে ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর শুধু ২০১৬ সালেই প্রায় ৩ কোটি (দুই কোটি ৯৫ লাখ) পিস ইয়াবা বাজেয়াপ্ত করে। অথচ ২০১০ সালে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৮১ হাজার পিস। এই হিসাব থেকে বাজেয়াপ্ত করা ইয়াবার পরিমাণ জানা গেল। ব্যবহার করা ইয়াবা যে এর চাইতে বহুগুণ বেশি তা সবাই মানবেন।
ইয়াবা চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করা হয় টেকনাফের নাফ নদীকে। কেননা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশের অন্যতম রুট এই নাফ নদী। লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এই ইয়াবা ব্যবসা। মিয়ানমারের ৬০ টাকার এই ট্যাবলেট পাচার হয়ে এসে রাজধানী ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। আর এ কারণে ইয়াবা ব্যবসায় ঝুঁকছে মাদক ব্যবসায়ীরা। আর সিন্ডিকেট তৈরি করে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা।
মাদকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে আরেকটি নেশার নাম। তা হলো জুয়া। ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় ‘জুয়ায় ভাসছে রাতের ঢাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ক্লাব ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রাত গভীর হলেই বসছে কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর। প্রভাবশালী মহলের শেল্টারে রাজধানীতেই অন্তত দেড়শ জুয়ার স্পট চলছে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এসব জুয়ার আসর খোলা থাকে, পাহারায় থাকে নিজস্ব অস্ত্রধারী টিম। এদের ঝামেলা থেকে সুরক্ষা দেন খোদ পুলিশ প্রশাসনেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা। একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি স্পটে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। সে হিসাবে রাজধানীর জুয়ার স্পটগুলোতে দৈনিক ৩০০ কোটি টাকা উড়ছে।’ রিপোর্টটিতে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার বাইরেও রূপনগর ও উত্তরায় রমরমা ক্যাসিনো আছে বলে উল্লেখ ছিল।
২০১৫ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি তরল কোকেনের চালান ধরা পড়ে। বলিভিয়া থেকে আসা একটি কন্টেনারে ১০৭ ড্রাম সানফ্লাওয়ার তেলের মধ্যে দুই ড্রাম তরল কোকেন পাওয়া যায়। পরে ল্যাবেরটরি টেস্টেও কোকেনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা কর্র্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় দায়ের করা মাদক আইনের মামলাটি এখন আদালতে বিচারের অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশে কোকেন সংক্রান্ত অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বাংলাদেশের মাদক চোরাচালান এবং ব্যবসা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বাংলাদেশকে মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই চার বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মোট হেরোইন উদ্ধার করেছে ৪৮ কেজি, গাঁজা ১৬ হাজার কেজি, ফেনসিডিল দেড় লাখ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ৫০ লাখ পিস। এর বাইরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এই আইনে ২০১৭ সালে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ১,০৬,৫৩৬টি। এই মামলাগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের অভিযোগ, আটক এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ভিত্তিতে করা হয়েছে। আর এ সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে, তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ। আর ৯০ শতাংশ মাদকই ধরা পড়ে না। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ইউএনওডিসি)’র মতে, বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা ট্যাবলেটই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, প্রতিটির দাম দুইশ টাকা হিসেবে যার বাজারমূল্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবার ব্যবহার ৮০ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। ২০১২ সালে মোট মাদকসেবীর মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা হয়েছে ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ। তাদের মধ্যে ৭০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। যে যুবশক্তি বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করতে পারে মাদকাসক্ত হয়ে তারাই কি দেশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে? এ আশঙ্কা ক্রমাগত বাড়ছে।
মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সপ্তম। মাদকাসক্তরা দিনে যদি গড়ে ১০০ টাকা মাদকের জন্য ব্যয় করে (যদিও এটা খুবই কম করে ধরা হিসাব) তাহলে তারা সারা বাংলাদেশে দিনে মাদকদ্রব্য কেনায় খরচ করে ৭০ কোটি টাকা। এই হিসাবে মাসে ২১০০ কোটি টাকা এবং বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। অত্যন্ত কম করে ধরা হিসাবেও যদি টাকার পরিমাণ এই হয় তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশে মাদকের বাজারটা কত বড়। বাংলাদেশে মাদকের ব্যবহার কমছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর প্রায় সবারই জানা। বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়। মাদকের বড় ব্যবসায়ী আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি। সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১৪১ জন। তাদের মধ্যে প্রাক্তন সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই আছেন। মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার। কোনো কোনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করেন। এ পর্যন্ত ২০ হাজার গ্রেপ্তার ও দেড়শতাধিক ব্যক্তি কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেও কোনো গডফাদার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। সামাজিক প্রভাব, প্রশাসন আর পুলিশের মিলিত চক্র মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে।
মাদকের ভয়াবহতা শুধু সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক জীবনকে ধ্বংস করে তা নয় মাদকসেবীর জীবনকে ধ্বংস করে বিভিন্নভাবে। কিডনি, লিভার, ফুসফুস নষ্ট করে দেওয়া, রক্তচাপ বাড়ানো ও সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকেও নষ্ট করে। গড়ে বছরে দেড় লাখ মাদকসেবীর মৃত্যু ঘটে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। পরিকল্পিতভাবে কোনো কোনো দেশকে ধ্বংস করার জন্য মাদকের নেশা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের সবার জানা আছে। ক্ষমতা, দুর্নীতি, মাদক আর জুয়ার মেলবন্ধন বাংলাদেশকেও কি সেদিকে ধাবিত করছে?
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক এবং কলামনিস্ট