করোনাকালে শহীদ মিলন দিবস
মো. শারফুদ্দিন আহমেদ | ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর সারা বিশ্ব যখন করোনা মহামারীর ভয়াল গ্রাসে বিপর্যস্ত, যখন করোনার আঘাতে বাংলাদেশে ১০৫ জন চিকিৎসকসহ প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন; তেমন একটা সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তৎকালীন যুগ্ম-সম্পাদক শহীদ ডা. সামসুল আলম মিলনের শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও মারাত্মক করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় প্রবাহের হুমকির সম্মুখীন। প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতি সচল রাখার জন্য জীবন ও জীবিকা সমানভাবে চলমান রেখেছেন। ভ্যাকসিন আমদানির ব্যবস্থা করেছেন, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ পদ্ধতি চালু করেছেন এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলেছেন। তাই এ বছর শহীদ ডা. মিলন দিবস স্বল্প পরিসরে পালন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিএমএ। শহীদ ডা. মিলন আত্মাহুতি দিয়ে বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিলেন। স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আজ ২৭ নভেম্বর ২০২০। শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ৩০তম শাহাদাতবার্ষিকী। দেখতে দেখতে ৩০ বছর কেটে গেল। সহযোদ্ধা ডা. মিলনের শাহাদাতবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার মন ভারাক্রান্ত। আজকের দিনে আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। ডা. মিলন ছিলেন অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ। তার অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল এদেশের হাজার হাজার চিকিৎসকের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি। ডা. মিলন যে আদর্শ ধারণ করতেন, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তার অনেকটাই বাস্তবায়িত করেছে। গণমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, ১৩৬২ অ্যাডহক শিক্ষক-চিকিৎসকের চাকরি নিয়মিতকরণ, ডিপিসি ও এসএসবি-এর মাধ্যমে হাজার হাজার চিকিৎসক-শিক্ষক-কর্মকর্তার পদোন্নতি, নতুন নতুন পদ ও বিভাগ সৃষ্টি, বেকার চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, নতুন নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজ-নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠা, করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ এসবের অন্যতম। স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, ভ্যাকসিন হিরো, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে।
১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর সারা দেশে সামরিক স্বৈরাচারী সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএ’র নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা দেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন ‘পিজি’ হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহূত চিকিৎসক সমাবেশ। চিকিৎসক সমাবেশে যোগদানের লক্ষ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা করেন তৎকালীন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্ম-সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন। পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমকালে তাদের রিকশা লক্ষ্য করে গুলি চালায় এরশাদের বাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। সঙ্গে সঙ্গে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে জরুরি বিভাগে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সাহসী সৈনিক ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে। তার প্রিয় মেডিকেল কলেজে সবাইকে কাঁদিয়ে শহীদের বেশে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে, যে কলেজে তিনি পড়েছেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে। ডা. মিলনের শাহাদাতে সৈ¦রাচারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পতন ঘটে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। সার্থক হয় মিলনের আত্মদান।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স আগামী বছরই ৫০ হবে। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক-চিকিৎসক, কৃষক-শ্রমিক-জনতাসহ সব পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ। আবার এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় খুনি মোশতাক-জিয়ার অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক এরশাদের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্রে উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল।
১৯৯০ সালে ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সব মতের, সব পেশার মানুষ। লক্ষ্য একটাই ‘স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রে উত্তরণ’। তাই ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ২১ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচার ১৯৯০ সালে এদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল একটি গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। এরপর ২০০০ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশে গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি প্রবর্তন করেন।
আজকের দিনে সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োজিত প্রায় ৩১ হাজার চিকিৎসক কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশার বা ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য দূর করা, কমপক্ষে ৩০ জনকে ১ নম্বর গ্রেড প্রদান, প্রশাসন ক্যাডারের মতো স্বাস্থ্য ক্যাডারের সম-স্কেল/গ্রেডের কর্মকর্তাদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য ক্যাডারের ‘ক্যাডার পদ’ সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে প্রশাসন ক্যাডারের মতো আনুপাতিক হারে ‘গ্রেড-১’ ও তদনুযায়ী ‘গ্রেড-২’ ও ‘গ্রেড-৩’-এর পদের সংখ্যা নিশ্চিত করা এবং প্রশাসন ক্যাডারে স্বাস্থ্য ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে কমপক্ষে ২০% অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা। এছাড়া কর্মস্থলে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং চিকিৎসা অবকাঠামো ও বাসস্থান নির্মাণ করা দরকার। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা, মানব সম্পদ উন্নয়ন করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ডাক্তার-নার্স-প্যারামেডিক্স-এর নতুন পদ সৃষ্টি করা, ¯œাতকোত্তর শিক্ষায় বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজন অনুযায়ী ছাত্র ভর্তি করা।
শেখ হাসিনার সরকার বর্তমানে জঙ্গি ও মাদকবিরোধী অভিযান এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স তথা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করছে; বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, হাওর এলাকায় রাস্তা নির্মাণসহ বহু রাস্তা কালভার্ট ব্রিজ নির্মাণ, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছে। তাই গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ও বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাহত করতে পারে এমন শক্তি যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিরাজমান অসামঞ্জ্য ও বৈষম্য দূর করে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হোক এটাই এবারের শহীদ ডা. মিলন দিবস পালনের আহ্বান।
লেখক চিকিৎসক ও অধ্যাপক, সাবেক উপ-উপাচার্য ও চেয়ারম্যান, কমিউনিটি অফথালমোলজি বিভাগ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন
শেয়ার করুন
মো. শারফুদ্দিন আহমেদ | ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর সারা বিশ্ব যখন করোনা মহামারীর ভয়াল গ্রাসে বিপর্যস্ত, যখন করোনার আঘাতে বাংলাদেশে ১০৫ জন চিকিৎসকসহ প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন; তেমন একটা সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তৎকালীন যুগ্ম-সম্পাদক শহীদ ডা. সামসুল আলম মিলনের শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও মারাত্মক করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় প্রবাহের হুমকির সম্মুখীন। প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতি সচল রাখার জন্য জীবন ও জীবিকা সমানভাবে চলমান রেখেছেন। ভ্যাকসিন আমদানির ব্যবস্থা করেছেন, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ পদ্ধতি চালু করেছেন এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলেছেন। তাই এ বছর শহীদ ডা. মিলন দিবস স্বল্প পরিসরে পালন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিএমএ। শহীদ ডা. মিলন আত্মাহুতি দিয়ে বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিলেন। স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আজ ২৭ নভেম্বর ২০২০। শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ৩০তম শাহাদাতবার্ষিকী। দেখতে দেখতে ৩০ বছর কেটে গেল। সহযোদ্ধা ডা. মিলনের শাহাদাতবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার মন ভারাক্রান্ত। আজকের দিনে আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। ডা. মিলন ছিলেন অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ। তার অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল এদেশের হাজার হাজার চিকিৎসকের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি। ডা. মিলন যে আদর্শ ধারণ করতেন, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তার অনেকটাই বাস্তবায়িত করেছে। গণমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন, ১৩৬২ অ্যাডহক শিক্ষক-চিকিৎসকের চাকরি নিয়মিতকরণ, ডিপিসি ও এসএসবি-এর মাধ্যমে হাজার হাজার চিকিৎসক-শিক্ষক-কর্মকর্তার পদোন্নতি, নতুন নতুন পদ ও বিভাগ সৃষ্টি, বেকার চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, নতুন নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজ-নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠা, করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট নিয়োগ এসবের অন্যতম। স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, ভ্যাকসিন হিরো, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে।
১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর সারা দেশে সামরিক স্বৈরাচারী সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএ’র নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা দেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন ‘পিজি’ হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহূত চিকিৎসক সমাবেশ। চিকিৎসক সমাবেশে যোগদানের লক্ষ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা করেন তৎকালীন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্ম-সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন। পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমকালে তাদের রিকশা লক্ষ্য করে গুলি চালায় এরশাদের বাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। সঙ্গে সঙ্গে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে জরুরি বিভাগে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সাহসী সৈনিক ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে। তার প্রিয় মেডিকেল কলেজে সবাইকে কাঁদিয়ে শহীদের বেশে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে, যে কলেজে তিনি পড়েছেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে। ডা. মিলনের শাহাদাতে সৈ¦রাচারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পতন ঘটে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। সার্থক হয় মিলনের আত্মদান।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স আগামী বছরই ৫০ হবে। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক-চিকিৎসক, কৃষক-শ্রমিক-জনতাসহ সব পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ। আবার এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় খুনি মোশতাক-জিয়ার অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। পরবর্তী সময়ে স্বৈরশাসক এরশাদের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্রে উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল।
১৯৯০ সালে ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সব মতের, সব পেশার মানুষ। লক্ষ্য একটাই ‘স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রে উত্তরণ’। তাই ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ২১ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচার ১৯৯০ সালে এদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল একটি গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। এরপর ২০০০ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশে গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি প্রবর্তন করেন।
আজকের দিনে সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োজিত প্রায় ৩১ হাজার চিকিৎসক কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশার বা ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য দূর করা, কমপক্ষে ৩০ জনকে ১ নম্বর গ্রেড প্রদান, প্রশাসন ক্যাডারের মতো স্বাস্থ্য ক্যাডারের সম-স্কেল/গ্রেডের কর্মকর্তাদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য ক্যাডারের ‘ক্যাডার পদ’ সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে প্রশাসন ক্যাডারের মতো আনুপাতিক হারে ‘গ্রেড-১’ ও তদনুযায়ী ‘গ্রেড-২’ ও ‘গ্রেড-৩’-এর পদের সংখ্যা নিশ্চিত করা এবং প্রশাসন ক্যাডারে স্বাস্থ্য ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে কমপক্ষে ২০% অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা। এছাড়া কর্মস্থলে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং চিকিৎসা অবকাঠামো ও বাসস্থান নির্মাণ করা দরকার। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা, মানব সম্পদ উন্নয়ন করা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ডাক্তার-নার্স-প্যারামেডিক্স-এর নতুন পদ সৃষ্টি করা, ¯œাতকোত্তর শিক্ষায় বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজন অনুযায়ী ছাত্র ভর্তি করা।
শেখ হাসিনার সরকার বর্তমানে জঙ্গি ও মাদকবিরোধী অভিযান এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স তথা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করছে; বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, হাওর এলাকায় রাস্তা নির্মাণসহ বহু রাস্তা কালভার্ট ব্রিজ নির্মাণ, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছে। তাই গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ও বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাহত করতে পারে এমন শক্তি যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিরাজমান অসামঞ্জ্য ও বৈষম্য দূর করে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হোক এটাই এবারের শহীদ ডা. মিলন দিবস পালনের আহ্বান।
লেখক চিকিৎসক ও অধ্যাপক, সাবেক উপ-উপাচার্য ও চেয়ারম্যান, কমিউনিটি অফথালমোলজি বিভাগ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক মহাসচিব, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন