জ্ঞানসূচকে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে
বদরুল হাসান | ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
কয়েক দিন আগে, বিগত বছরের ঠিক শেষের দিকে আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আসলে আমাদের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ভিশন-২০২১-২০৪১-এর অংশ; ২০৪১ সালের ভিশন অর্জন করতে আমাদের এরূপ আরও তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নিতে হবে। এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় এবারের অতিমারীর মতো কোনো অভূতপূর্ব বাধা যেমন আসতে পারে, তেমনি অনেক সুযোগও হাজির হয়ে যেতে পারে। সেগুলো সামলে নিয়ে এবং কাজে লাগিয়ে এগোতে পারলেই কেবল আমরা ভিশন-২০৪১ অনুযায়ী ২০৩১ সালের মধ্যে ‘মধ্য আয়ের দেশ’ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত রাষ্ট্রে’ পরিণত হব, আমাদের মাথাপিছু আয় তখন ১২ হাজার ৫০০ ডলারের চৌহদ্দি অতিক্রম করবে, দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামবে। আমরা যে এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম, অতীত অর্জনের ধারাবাহিকতা সেই প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত বহন করে। এই অতিমারীর মধ্যেও সেদিন লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Centre for Economics and Business Research প্রাক্কলন করে বলেছে, ২০২৮ সালে চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলবে। আর বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৮তম এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে। অর্থনীতির এসব প্রাক্কলন অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিতে প্রণীত এবং এর নির্ভরযোগ্যতাও হেলাফেলার বিষয় নয়, তবে এটি স্বতঃসিদ্ধ কোনো বিষয়ও নয়। কারণ, এগুলো করা হয় সংশ্লিষ্ট অন্যসব বিষয়কে সমান ধরে, যার লাতিন শব্দগুচ্ছ ‘Ceteris Paribus’। এই অন্য সবকিছু সব সময় সমান থাকে না। তা ছাড়া পর্বতের পাদদেশের আরোহণ যতটা সহজ, সে তুলনায় শীর্ষদেশে আরোহণ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ও শ্রমসাধ্য কারণ, পথ সেখানে বন্ধুর ও অধিকতর পিচ্ছিল। এজন্য দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলার কোনো বিকল্প নেই।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা হিসাব করা হয়েছে ৬৪ দশমিক ৯৬ ট্রিলিয়ন টাকা। এখন দেশের অর্থনীতির যে কলেবর এবং তার কর্মচাঞ্চল্য, তাতে কভিড-১৯ বাগে চলে এলে এই অর্থের সংস্থান করা তেমন কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা হলো এই অর্থের যারা জোগান দেবে, যারা এই বিনিয়োগ থেকে আয় করবে, যারা এসব কাজ করবে, যারা উৎপাদন ও ভোগে অংশগ্রহণ করবে, সেই জনমানুষের অবস্থা এবং তাদের সক্ষমতা। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের সক্ষমতা সমান তালে না এগোলে উন্নয়নের গতি যেমন বেগবান হয় না, তেমনি বৈষম্যও কমে আসে না। অথচ বৈষম্য কমলে তা গুণক-প্রভাবের মাধ্যমে উন্নয়নে নতুন ত্বরণ সৃষ্টি করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন এখনো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI) বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম। বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে (GII) আমাদের অবস্থান ১৩১টি দেশের মধ্যে ১১৬তম। সম্প্রতি ইউএনডিপি (UNDP) এবং মোহাম্মাদ বিন রাশিদ আল মাক্তুম জ্ঞান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে ‘বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক’ প্রকাশ করেছে। এতে ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১২তম স্থানে অবস্থান করছে। অথচ আর্থসামাজিক ও ভৌতিক যেকোনো ধরনের টেকসই উন্নয়নে সবপর্যায়ে জ্ঞানের ভূমিকা অপরিহার্য; এটি শরীরের গ্রন্থি ব্যবস্থাপনায় পিটিউটরি গ্ল্যান্ডের মতো অন্য সবকিছুকে প্রভাবিত করে। ভৌত উন্নতি যতই হোক না কেন, সামাজিক উন্নয়নের অপর্যাপ্ততায় সাধারণ্যে সেগুলো কাম্যপর্যায়ে কাজে না লাগলে সে উন্নতি টেকসই হতে পারে না। মিয়ানমারের নতুন রাজধানী নেপিডোউতে অ্যাসফল্ট প্লান্ট দিয়ে বিশ লেনের মসৃণ রাস্তা করা হয়েছে; কিন্তু সেখানে কোনো গাড়ি চলে না। এ যেন উন্নয়নের এক জনবিচ্ছিন্ন মহোৎসব। এ জাতীয় উন্নতি কত দিন স্থায়ী হতে পারে, সেটা অবশ্যই প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমরা নিশ্চয়ই সে ধরনের উন্নতি চাই না।
১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুরকে যখন অনেকটা একতরফাভাবে স্বাধীনতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেখানে বেকারত্বের হার ছিল ১৪ শতাংশ। তার ওপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শ্রমবাজার প্রবেশ করছিল; সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিটিশ নৌঘাঁটিও স্বল্পসময়ের ব্যবধানে গুটিয়ে ফেলার ঘোষণা আসছিল। প্রাকৃতিক সম্পদশূন্য সিঙ্গাপুরে তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃজন এবং দেশোন্নয়নের লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ দেশে বিদেশি বিনিয়োগের উদার নীতি গ্রহণ করেন এবং সেসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উপযোগী স্থানীয় দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শিখতে আগ্রহী এই ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশটির নাগরিকদের তিনি গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় শিক্ষা প্রদানে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে থাকেন। ফলে সেখানকার উন্নতি ত্বরান্বিত হয় এবং শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের নজর কাড়ে। শুধু তা-ই না, ১৯৯৯ সালে International Association for the Evaluation of Educational Achievement-এর বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনসহ ৩৭টি উন্নত দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুর গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রথম স্থান অধিকার করে সবাইকে চমকে দেয়। এরপর ২০১৫ সালে Organization for Economic Cooperation and Development পরিচালিত Pisa (Program for International Student Assessment)-এর মূল্যায়নেও সিঙ্গাপুর ওই তিনটি বিষয়ে বড় ব্যবধানে প্রথম স্থান দখল করে। বলা হয়ে থাকে, সিঙ্গাপুরে গণিত শেখার অর্থ ওই বিষয়ে সবকিছু জানা নয়; বরং প্রকৃত অর্থে তা হলো একজন গণিতবিদের মতো চিন্তা করতে শেখা। ইসলাম ধর্মেও জ্ঞানার্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে দূরবর্তী চীন দেশে যাওয়ারও তাগিদ রয়েছে। এই নীতি অনুসরণ করায় অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রশিদের আমল থেকে ইসলামের যে স্বর্ণ যুগ শুরু হয়, সে সময়ে মুসলমানরা গণিত, রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যায় অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে সমর্থ হয়।
উন্নয়নের এই পর্যায়ে আমাদেরও জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আর সে শিক্ষার মধ্যে গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে রাখতে হবে সবার ওপর। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও উল্লেখ করা হয়েছে যে, চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের এই যুগে দেশকে জ্ঞানের চক্রনাভিতে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু জ্ঞানসূচকে দৃষ্টিপাত করলে বাস্তবতা আর আকাক্সক্ষার মধ্যে আকাশ-পাতালের ব্যবধান দেখা যায়। এর কারণ, এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞানচর্চা হয় সামান্যই। সেখানে তেমন কোনো গবেষণা নেই; ফলে জ্ঞান তৈরি হচ্ছে না, বিতরণ করা হবে কী? যাওবা করা হচ্ছে, সেগুলো সেকেলে; এখনকার বাজারে তার কোনো মূল্য নেই। ফলে বিশ্বে চাকরির বাজারে আমরা তো সেভাবে প্রবেশাধিকার পাচ্ছিই না, উল্টো দেশের অভ্যন্তরেও যে কিছু কাজ সৃজন হচ্ছে, তার লাভজনক একটা অংশ বিদেশিরা বাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; বছরে যার বদৌলতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে মর্মে অসমর্থিত সূত্রে প্রকাশ। এখন ইপিজেড, বেজপাসহ সংশ্লিষ্ট সেক্টরে যেসব কর্মসৃজন হবে, সেগুলোর জন্য দক্ষ ও আধা-দক্ষ কর্মী তৈরির পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।
জ্ঞানসূচকে এগোতে হলে শুধু বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসে থাকলেই চলবে না; মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে আধুনিক জীবন ও জীবিকার উপযোগী পাঠ্যসূচি প্রণয়ন এবং তা শিক্ষণের জন্য যুগপৎ অ্যাকাডেমিক এবং উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম প্রবর্তন করতে হবে। বর্তমানের অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার কাজ যেমন অবলুপ্ত হচ্ছে, তেমনি লাখ লাখ নতুন কাজ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এসব নতুন কাজ অগ্রভাগে চিহ্নিত করে সেসব কাজে যুক্ত হওয়ার মতো যোগ্য ও দক্ষ করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটিসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, যার প্রধান কাজ হবে শিক্ষার মানোন্নয়নে নিয়মিত গবেষণা পরিচালনা, বিভিন্ন দেশে প্রচলিত পাঠ্যসূচি অনুধ্যান, দেশে ও বিদেশে সৃজিত নতুন নতুন কাজের উপযোগী পাঠ্যসূচি প্রবর্তন, অদূর ও সুদূর ভবিষ্যতে উদীয়মান কর্মসম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা এবং শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। জ্ঞানসূচকের উন্নতির জন্য শিক্ষার ব্যয় অবশ্যই বাড়াতে হবে। এখন এ খাতে আমরা যে ব্যয় করছি, তার পরিমাণ জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের মতো। বিশ্বে এ খাতে গড় ব্যয় জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ; সিঙ্গাপুরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। ব্যয় বাড়ালেই যে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বাড়বে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই; এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মান ও পাঠ্যসূচির আধুনিকতা এবং সৃজনশীলতা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দেশে দামি উপকরণ ক্রয় ও চাকচিক্যময় দালান-কোঠা নির্মাণের দিকে প্রকট ঝোঁক লক্ষ করা যায়; শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে এ বস্তুগুলোর ভূমিকা ততটা মুখ্য নয়। তবে উপযুক্ত ও মেধাবী শিক্ষক ধরে রাখতে অবশ্যই শিক্ষকদের মর্যাদা এবং বেতন আকর্ষণীয় করতে হবে; উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের করে তুলতে হবে সমর্থ ও প্রেষণা-সিক্ত। তবেই আমরা এই শিক্ষা খাতে উন্নতি আশা করতে পারি।
লেখক খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
শেয়ার করুন
বদরুল হাসান | ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

কয়েক দিন আগে, বিগত বছরের ঠিক শেষের দিকে আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আসলে আমাদের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ভিশন-২০২১-২০৪১-এর অংশ; ২০৪১ সালের ভিশন অর্জন করতে আমাদের এরূপ আরও তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নিতে হবে। এই সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় এবারের অতিমারীর মতো কোনো অভূতপূর্ব বাধা যেমন আসতে পারে, তেমনি অনেক সুযোগও হাজির হয়ে যেতে পারে। সেগুলো সামলে নিয়ে এবং কাজে লাগিয়ে এগোতে পারলেই কেবল আমরা ভিশন-২০৪১ অনুযায়ী ২০৩১ সালের মধ্যে ‘মধ্য আয়ের দেশ’ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত রাষ্ট্রে’ পরিণত হব, আমাদের মাথাপিছু আয় তখন ১২ হাজার ৫০০ ডলারের চৌহদ্দি অতিক্রম করবে, দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামবে। আমরা যে এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম, অতীত অর্জনের ধারাবাহিকতা সেই প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত বহন করে। এই অতিমারীর মধ্যেও সেদিন লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান Centre for Economics and Business Research প্রাক্কলন করে বলেছে, ২০২৮ সালে চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলবে। আর বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৮তম এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে। অর্থনীতির এসব প্রাক্কলন অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিতে প্রণীত এবং এর নির্ভরযোগ্যতাও হেলাফেলার বিষয় নয়, তবে এটি স্বতঃসিদ্ধ কোনো বিষয়ও নয়। কারণ, এগুলো করা হয় সংশ্লিষ্ট অন্যসব বিষয়কে সমান ধরে, যার লাতিন শব্দগুচ্ছ ‘Ceteris Paribus’। এই অন্য সবকিছু সব সময় সমান থাকে না। তা ছাড়া পর্বতের পাদদেশের আরোহণ যতটা সহজ, সে তুলনায় শীর্ষদেশে আরোহণ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ও শ্রমসাধ্য কারণ, পথ সেখানে বন্ধুর ও অধিকতর পিচ্ছিল। এজন্য দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলার কোনো বিকল্প নেই।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা হিসাব করা হয়েছে ৬৪ দশমিক ৯৬ ট্রিলিয়ন টাকা। এখন দেশের অর্থনীতির যে কলেবর এবং তার কর্মচাঞ্চল্য, তাতে কভিড-১৯ বাগে চলে এলে এই অর্থের সংস্থান করা তেমন কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা হলো এই অর্থের যারা জোগান দেবে, যারা এই বিনিয়োগ থেকে আয় করবে, যারা এসব কাজ করবে, যারা উৎপাদন ও ভোগে অংশগ্রহণ করবে, সেই জনমানুষের অবস্থা এবং তাদের সক্ষমতা। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের সক্ষমতা সমান তালে না এগোলে উন্নয়নের গতি যেমন বেগবান হয় না, তেমনি বৈষম্যও কমে আসে না। অথচ বৈষম্য কমলে তা গুণক-প্রভাবের মাধ্যমে উন্নয়নে নতুন ত্বরণ সৃষ্টি করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন এখনো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI) বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম। বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে (GII) আমাদের অবস্থান ১৩১টি দেশের মধ্যে ১১৬তম। সম্প্রতি ইউএনডিপি (UNDP) এবং মোহাম্মাদ বিন রাশিদ আল মাক্তুম জ্ঞান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে ‘বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক’ প্রকাশ করেছে। এতে ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১২তম স্থানে অবস্থান করছে। অথচ আর্থসামাজিক ও ভৌতিক যেকোনো ধরনের টেকসই উন্নয়নে সবপর্যায়ে জ্ঞানের ভূমিকা অপরিহার্য; এটি শরীরের গ্রন্থি ব্যবস্থাপনায় পিটিউটরি গ্ল্যান্ডের মতো অন্য সবকিছুকে প্রভাবিত করে। ভৌত উন্নতি যতই হোক না কেন, সামাজিক উন্নয়নের অপর্যাপ্ততায় সাধারণ্যে সেগুলো কাম্যপর্যায়ে কাজে না লাগলে সে উন্নতি টেকসই হতে পারে না। মিয়ানমারের নতুন রাজধানী নেপিডোউতে অ্যাসফল্ট প্লান্ট দিয়ে বিশ লেনের মসৃণ রাস্তা করা হয়েছে; কিন্তু সেখানে কোনো গাড়ি চলে না। এ যেন উন্নয়নের এক জনবিচ্ছিন্ন মহোৎসব। এ জাতীয় উন্নতি কত দিন স্থায়ী হতে পারে, সেটা অবশ্যই প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমরা নিশ্চয়ই সে ধরনের উন্নতি চাই না।
১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুরকে যখন অনেকটা একতরফাভাবে স্বাধীনতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেখানে বেকারত্বের হার ছিল ১৪ শতাংশ। তার ওপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শ্রমবাজার প্রবেশ করছিল; সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিটিশ নৌঘাঁটিও স্বল্পসময়ের ব্যবধানে গুটিয়ে ফেলার ঘোষণা আসছিল। প্রাকৃতিক সম্পদশূন্য সিঙ্গাপুরে তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃজন এবং দেশোন্নয়নের লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ দেশে বিদেশি বিনিয়োগের উদার নীতি গ্রহণ করেন এবং সেসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উপযোগী স্থানীয় দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শিখতে আগ্রহী এই ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশটির নাগরিকদের তিনি গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় শিক্ষা প্রদানে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে থাকেন। ফলে সেখানকার উন্নতি ত্বরান্বিত হয় এবং শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের নজর কাড়ে। শুধু তা-ই না, ১৯৯৯ সালে International Association for the Evaluation of Educational Achievement-এর বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনসহ ৩৭টি উন্নত দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুর গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রথম স্থান অধিকার করে সবাইকে চমকে দেয়। এরপর ২০১৫ সালে Organization for Economic Cooperation and Development পরিচালিত Pisa (Program for International Student Assessment)-এর মূল্যায়নেও সিঙ্গাপুর ওই তিনটি বিষয়ে বড় ব্যবধানে প্রথম স্থান দখল করে। বলা হয়ে থাকে, সিঙ্গাপুরে গণিত শেখার অর্থ ওই বিষয়ে সবকিছু জানা নয়; বরং প্রকৃত অর্থে তা হলো একজন গণিতবিদের মতো চিন্তা করতে শেখা। ইসলাম ধর্মেও জ্ঞানার্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে দূরবর্তী চীন দেশে যাওয়ারও তাগিদ রয়েছে। এই নীতি অনুসরণ করায় অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রশিদের আমল থেকে ইসলামের যে স্বর্ণ যুগ শুরু হয়, সে সময়ে মুসলমানরা গণিত, রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যায় অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে সমর্থ হয়।
উন্নয়নের এই পর্যায়ে আমাদেরও জ্ঞান, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আর সে শিক্ষার মধ্যে গণিত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে রাখতে হবে সবার ওপর। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও উল্লেখ করা হয়েছে যে, চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের এই যুগে দেশকে জ্ঞানের চক্রনাভিতে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু জ্ঞানসূচকে দৃষ্টিপাত করলে বাস্তবতা আর আকাক্সক্ষার মধ্যে আকাশ-পাতালের ব্যবধান দেখা যায়। এর কারণ, এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞানচর্চা হয় সামান্যই। সেখানে তেমন কোনো গবেষণা নেই; ফলে জ্ঞান তৈরি হচ্ছে না, বিতরণ করা হবে কী? যাওবা করা হচ্ছে, সেগুলো সেকেলে; এখনকার বাজারে তার কোনো মূল্য নেই। ফলে বিশ্বে চাকরির বাজারে আমরা তো সেভাবে প্রবেশাধিকার পাচ্ছিই না, উল্টো দেশের অভ্যন্তরেও যে কিছু কাজ সৃজন হচ্ছে, তার লাভজনক একটা অংশ বিদেশিরা বাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; বছরে যার বদৌলতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে মর্মে অসমর্থিত সূত্রে প্রকাশ। এখন ইপিজেড, বেজপাসহ সংশ্লিষ্ট সেক্টরে যেসব কর্মসৃজন হবে, সেগুলোর জন্য দক্ষ ও আধা-দক্ষ কর্মী তৈরির পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।
জ্ঞানসূচকে এগোতে হলে শুধু বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসে থাকলেই চলবে না; মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে আধুনিক জীবন ও জীবিকার উপযোগী পাঠ্যসূচি প্রণয়ন এবং তা শিক্ষণের জন্য যুগপৎ অ্যাকাডেমিক এবং উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম প্রবর্তন করতে হবে। বর্তমানের অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার কাজ যেমন অবলুপ্ত হচ্ছে, তেমনি লাখ লাখ নতুন কাজ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এসব নতুন কাজ অগ্রভাগে চিহ্নিত করে সেসব কাজে যুক্ত হওয়ার মতো যোগ্য ও দক্ষ করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটিসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, যার প্রধান কাজ হবে শিক্ষার মানোন্নয়নে নিয়মিত গবেষণা পরিচালনা, বিভিন্ন দেশে প্রচলিত পাঠ্যসূচি অনুধ্যান, দেশে ও বিদেশে সৃজিত নতুন নতুন কাজের উপযোগী পাঠ্যসূচি প্রবর্তন, অদূর ও সুদূর ভবিষ্যতে উদীয়মান কর্মসম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা এবং শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। জ্ঞানসূচকের উন্নতির জন্য শিক্ষার ব্যয় অবশ্যই বাড়াতে হবে। এখন এ খাতে আমরা যে ব্যয় করছি, তার পরিমাণ জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের মতো। বিশ্বে এ খাতে গড় ব্যয় জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ; সিঙ্গাপুরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। ব্যয় বাড়ালেই যে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বাড়বে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই; এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মান ও পাঠ্যসূচির আধুনিকতা এবং সৃজনশীলতা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দেশে দামি উপকরণ ক্রয় ও চাকচিক্যময় দালান-কোঠা নির্মাণের দিকে প্রকট ঝোঁক লক্ষ করা যায়; শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে এ বস্তুগুলোর ভূমিকা ততটা মুখ্য নয়। তবে উপযুক্ত ও মেধাবী শিক্ষক ধরে রাখতে অবশ্যই শিক্ষকদের মর্যাদা এবং বেতন আকর্ষণীয় করতে হবে; উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের করে তুলতে হবে সমর্থ ও প্রেষণা-সিক্ত। তবেই আমরা এই শিক্ষা খাতে উন্নতি আশা করতে পারি।
লেখক খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক