নাতিবিলম্ব বিচারের চাবিকাঠি : উদ্ধারপর্ব-১
মঈদুল ইসলাম | ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
বিচারের অতিবিলম্ব ছুটাবার চাবিকাঠি উদ্ধারে কি মহাপ্রকল্প বানিয়ে বিদেশ সফরে যেতে হবে লটবহর নিয়ে! আর যারই হোক, বিচারের বাজেটে তা কুলাবে না। আমার ভাবনাও অতি সাধারণ। বিলম্বের কলকাঠি তো লাগায়নি বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে। লাগিয়েছে খাঁটি স্বদেশি মতলবিতে। খুলবার চাবিকাঠি খুঁজতে হবে এই মাটিতেই। যেই প্যাঁচে তালা আটকায় ঠিক তার উল্টো প্যাঁচেই খোলে।
ন্যায়বিচারের অতিবিলম্ব ঘোচাবার কথা উঠলে চট করেই মাথায় আসে আদালত আর বিচারক বাড়াবার কথা। ভাবনাটা ভুল নয় একেবারে। কিন্তু, বাড়বে কেমন, কতটা! মাথাব্যথা হলে সরকারও আদালত বাড়ায় মাঝেমধ্যে। ভিন্ন আদালত নামেই শুধু! অনেক ক্ষেত্রে বিচারক একই জন, বিচারকক্ষও একটাই। ভোল পাল্টিয়ে হয় কখনো দেওয়ানি, কখনো পারিবারিক, কখনো অর্থঋণ, কখনো দায়রা, কখনো স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল, কখনো স্পেশাল জজ। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে জেলাগুলোতে আদতেই ভিন্ন করা হয়েছিল দ্বিতীয় সাব-জজ আদালত। তাতে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ ছিলেন ঐ সাব-জজই। স্টেনোগ্রাফার-সেরেস্তাদার-আরদালি দূরে থাক একজন পেশকারেরও পদ করা হয়নি তার জন্য। যুগ্ম জেলা জজ নামে চলছে এখনো সেভাবেই। অতিরিক্ত জেলা জজ রিক্ত এসবে তারও আগে থেকে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্টেনোটাইপিস্ট ছাড়াই চলছিল ঢাকার ১০টি স্পেশাল জজ কোর্ট। দুদক থেকে লেখালেখি করে সেই পদগুলো করিয়েছিলাম ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে। হাল আমলে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল হয়েছে সেই দ্বিতীয় সাব-জজের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ আদলে। হাইকোর্ট জজ দিয়ে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম-আদল’ আদবে বাধে বলে আপিল ট্রাইব্যুনাল আর হয়নি, রয়ে গেছে কেতাবে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
মহুকুমা থেকে উন্নীত অনেক জেলায় তখন দ্বিতীয় সাব-জজের মামলা ঘাটতি ছিল। ঘাটতি ছিল অনেক উপজেলা আদালতেও। অল্প কিছু মামলা নিয়ে অপর্যাপ্ত নিষ্পত্তির কৈফিয়ত দিতে দিতে এসিআর বিরূপ হয়েছে অনেকের। যেখানে যতটা প্রয়োজন ততটা বাড়াতে হবে আদালত। সঙ্গে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী, অফিস-এজলাস এবং পৃথক বিচারক দিয়ে। মামলাভারাক্রান্ত আদালতে প্রতিদিন গাদাগাদা নথি লেখা, সেগুলোর ডায়েরি-কজলিস্ট লেখা, সমন-ওয়ারেন্ট লেখা-ইস্যুর অসাধ্য সাধন এক পেশকারের দু-হাতে আর হয় না সবটা, বকেয়াই রয়ে যায় বেশিটা। অনাহূত, তাই সাক্ষী আসে না নির্ধারিত তারিখে। এসব কাজে আরও দু-একটা পদ বাড়ানো জরুরি। পুরো আদলে আদালত বাড়াবার আর জায়গা নেই ঢাকা কিংবা জেলা শহরে। সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, সবার প্রাঙ্গণ আজ বিল্ডিংয়ের বন হয়ে আছে। কোলাহলপূর্ণ পরিসরে বাজার চলে, বিচারে লাগে শান্ত-স্নিগ্ধ পরিসর, ভাবগম্ভীর পরিবেশ। আদালত বাড়াতে হবে সেই পরিবেশের পরিসরে। উকিলবিহীন গ্রাম্য কিংবা ভ্রাম্য আদালত সে বিকল্প নয়। সাক্ষী শুনে আর দলিল দেখে বিচার হয় দেখেই চোখ-কানওয়ালা যে-কেউই বিচারকর্ম সারতে পারে ভাবাটা বিরাট ভ্রম। বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ন্যায়নিষ্ঠ বিচক্ষণ মানুষ ছাড়া সুবিচার মেলে না আসলে। ফিরিয়ে নিতে হবে ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ আদালত সব উপজেলায়। জেলার বাইরে সুবিধাজনক জায়গায় কয়েকটি উপজেলার জন্য যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত নতুন করে বাড়াতে হবে। হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রসারণ করতে হবে বিভাগীয় শহরে। সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ মেনে সার্কিট বা অস্থায়ী, যে-নামেই হোক। আইনজীবীদের সবার কাছেই মামলা থাকবে পর্যাপ্ত। কতিপয় চেম্বারের মামলা উপচানো কমবে। কতিপয়ের স্বার্থে এসব আদালত তুলে আনার অপবাদ (!) মিথ্যে প্রমাণ হবে। আইনজীবীর ব্যক্তিগত কারণে সময় নেওয়াও কমবে।
অর্থ কোথায় পাওয়া যাবে! প্রতিটি আদালতে বিচারক-কর্মচারীর বেতনভাতা আর আনুষঙ্গিকে যত ব্যয় তার প্রায় দ্বিগুণ আয় কোর্ট ফি থেকে। দুর্নীতি-মানিলন্ডারিং মামলায় হাজারো লাখ টাকা জরিমানা, আর শতকোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়। কোর্ট ফির আয়, জরিমানা-বাজেয়াপ্তির অর্থ-সম্পদ ব্যয় হওয়া উচিত আদালতের মান ও বিচারের গতি বাড়াতেই। সিআরপিসির ৩৮৬ ধারায় সংশোধনী এনে ক্রোক-নিলাম-বিক্রির ক্ষমতাটুকুও দণ্ডদাতা আদালতকে দিলে জরিমানা-বাজেয়াপ্তি আদায়ে গতি আসে।
এক বিরোধে মামলা হয় কয়েকটা। পারিবারিক বিরোধ বাধলে মামলা হয় আগে যৌতুকের, পরে নারী নির্যাতনের, চুরির, শেষে হয় পারিবারিক। দেওয়ানির বিরোধ লাগলে মামলা হয় আগে চাঁদাবাজির, পরে দেওয়ানি। একখানা চেকেই হয় প্রতারণা, জালিয়াতি, এনআই অ্যাক্ট, অর্থঋণ। বাদী-বিবাদী, আসামি-ফরিয়াদি একই লোক, বিচারকও একই জন, আইনজীবীও একই। বিচার হয় একই এজলাসে, শুধু পৃথক নথি টেনে। আজ যে-বিচারক ম্যাজিস্ট্রেসিতে কালকে তিনি দেওয়ানিতে। মামলার সংখ্যা কমাতে এক বিরোধে একটাই মামলা, দেওয়ানি-ফৌজদারি প্রতিকার একই বিচারে, এমন ব্যবস্থাই করতে হবে। দেওয়ানির ডিক্রি হলে জারির প্রক্রিয়াটা নিতে হবে সেই আদালতকেই, নিজের রায়-ডিক্রির মান বাঁচাতে। নইলে বিচার থাকে অসমাপ্ত। সে ব্যবস্থাটাও করতে হবে। মিথ্যা মামলা, আর জাল কাগজ প্রমাণ হয় যে আদালতে তাকে ফৌজদারির নালিশকারী হওয়ার যে ঘোরপ্যাঁচ লাগানো আছে কার্যবিধির ১৯৫ ও ৪৭৬ ধারায় সেটা ছুটিয়ে সেই আদালতকেই দণ্ডদাতা করা দরকার। তারই এক রায়ে মিথ্যা-জালিয়াতিরও সাজা হলে আরেক মামলা লাগে না, মিথ্যা মামলাও কমে। ফৌজদারি মামলায় ‘কগনিজ্যান্স’ বড়োই গুরুত্বপূর্ণ। আদালতে ফৌজদারি ঢোকার সেটাই পথ। সে-পথে কড়া পাহারা দরকার, যেন মেরিটবিহীন হয়রানির অচল মামলা ঢুকতে না পারে। এ কাজে থাকতে হবে আরও অভিজ্ঞ বিচক্ষণ বিচারক। তাই, প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের বদলে কগনিজ্যান্সের কাজটা কেবল চিফ জুডিশিয়াল-চিফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়েই করাতে হবে [সিআরপিসির ৬(৩) ধারামতে এখন তারা প্রথম শ্রেণিরও উচ্চশ্রেণিতে]। যেমনটা দায়রা বিচার্য মামলা আগে যায় দায়রা জজের কাছে, তিনি গ্রহণ করলে বিচারে পাঠান অতিরিক্ত ও যুগ্ম জজের কাছে। তবে, আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কগনিজ্যান্স, পরে আবার দায়রা জজের কগনিজ্যান্সের বদলে সরাসরি দায়রা জজেরই কগনিজ্যান্স, শুরু থেকেই মামলাটা দায়রায় থাকার ব্যবস্থা করার দরকার। ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ ধরনের আদালতের আমলযোগ্য ফৌজদারি মামলাও তদন্তকালে আমলি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রাখা চলছে আইন ছাড়া পুরনো স্বভাবে। সেগুলো তো শুরু থেকেই সে-সব ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ আদালতেই থাকার কথা। অর্থহীন এসব ধাপ কমালে কাল কাটানোর অনেক ধাপ কমে, সময় বাঁচে।
যতই পাকা বন্দোবস্ত হোক না কেন, চার আনারও সাধ মিটবে না ঠিকমতো দেখভাল না করলে। দামি যন্ত্রপাতির অত্যাধুনিক কারখানাও অচল হয় নিয়মিত ‘সুপারভিশন’ না থাকলে। নষ্ট ‘পার্টস’ আর দুষ্ট গরু শনাক্ত করে সারাতে হয়, সরাতে হয়। করিয়ে না নিলে কাজ করে না কেউই। কর্তা আর কর্মীতে ফারাক এই। অধস্তন আদালতগুলোর বিচারকদের নিজ নিজ আদালতের এবং নিজ অধস্তনগুলোর জেলা ও দায়রা জজের তদারকি-তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব। নিজেরসহ সব আদালতের তদারকি-তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের। কায়দা-কৌশল দেওয়া আছে ‘সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’, ‘ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’-এ। আছে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের কোর্ট রুলস। সেগুলো মানা হচ্ছে কি না সেই তদারকি ও কাজ করিয়ে নেওয়ার কর্তা সুপ্রিম কোর্ট। অধস্তন সব আদালত থেকে বিচারাধীন মামলার কতগুলো কত মাসের, কত বছরের পুরনো, অতিবিলম্বের কী কারণ সব তথ্যই সুপ্রিম কোর্টে আসে বার্ষিক, ত্রৈমাসিক স্টেটমেন্টে। বছরে কোন আদালতে, কোন বেঞ্চে শতকরা কতভাগ নিষ্পত্তি, কতভাগ দায়ের, কতভাগ পেন্ডিং, কত বছরের পুরনো কতটি কার কাছে থাকল, পুরো হিসাব থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্ট বার্ষিক রিপোর্টে। আসল খবরদারি করতে লাগে খুঁটিনাটি সব খবরাদি। মোটা দাগের হিসাবে ধরা যায় না আসল দাগি কে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯০ সালের ‘সিভিল জাস্টিস রিফর্ম অ্যাক্ট’-এ অভিনব নিয়ম করেছে। ফেডারেল জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের যারা মামলা নিষ্পত্তিতে অতিবিলম্ব করেন তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। সাক্ষী বা শুনানি শুরুর ৬ মাসে, মামলা দাখিলের তিন বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে না পারলে সেই বিচারককেই তা জানাতে হয় ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস অব দি ইউনাইটেড স্টেটস কোর্টস’-এর পরিচালকের কাছে। পরিচালক সেগুলোর রিপোর্ট ৬ মাস পর-পর প্রকাশ করেন। কানাডায় সাধারণ দেওয়ানি মামলা সর্বোচ্চ ৬ মাসে নিষ্পত্তি করা নিয়ম। ৫টা মামলায় এই সীমা লঙ্ঘন করায় বিভাগীয় ব্যবস্থায় ‘ওয়ার্নিং’ খেয়ে বিচারকের পদত্যাগের নজিরও আছে। এমনই করা উচিত আমাদের এখানে বিচারক ও আইনজীবীর জন্য। শনাক্ত হয় সত্যিকারের বিলম্বকারী, আরামকারী। ঢালাও দোষের ভাগি হয় না খেটে-মরা বেচারি। হাইকোর্ট কিংবা আপিল বিভাগের বেঞ্চ থেকে দু-চারটার তলবে তদারকি-তত্ত্বাবধানের সবটা সারবে না। বেঞ্চের প্রধান কাজ বিচারকর্ম। বিচার প্রশাসন দেখভাল ও বিহিত করতে অন্য কাজের ভারমুক্ত দক্ষ লোকের শক্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে। ভারমুক্ত ‘রেডিমেড’ অভিজ্ঞ দক্ষ মানুষ পাওয়া যাবে চাকরির শেষে অবসরে। তাদের এই কাজে লাগানো যায়, অবসরভোগীর আয়েশখানা হওয়ার অপবাদ না ওঠে সেদিকটায় নজর রেখে। অধস্তন-ঊর্ধ্বতন, বিচারক-সহায়ক সবাইকেই রাখতে হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নজরে। দায়মুক্তিতে রাখা যাবে না কাউকেই। তবে, ঢালাও দোষের সার্কুলার নয়ধরতে হবে, সারতে হবে, সরাতে হবে, আসল নষ্ট, আসল দুষ্টকে। কেবল অভিযোগ পেলেই নয়, গন্ধ পেলে, ধোঁয়া দেখলেই নিজ গরজে খবর নেবে, বিহিত করবে। সব আদালতে কড়া তদারকি আর সত্যিকারের দেখভালের তত্ত্বাবধানই হলো বিচার-বিলম্বের একপাশের পাষাণকপাট সরাবার আসল চাবিকাঠি। ঘোরাতে হবে সবল হাতে। ন্যায়বিচার নিয়ে বেরিয়ে যেতে এই সজোর হাঁকটাই লাগবে।
(‘নাতিবিলম্ব বিচারের চাবিকাঠি : উদ্ধারপর্ব-সমাপ্তি’ আগামী কিস্তিতে)
লেখক প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক
শেয়ার করুন
মঈদুল ইসলাম | ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

বিচারের অতিবিলম্ব ছুটাবার চাবিকাঠি উদ্ধারে কি মহাপ্রকল্প বানিয়ে বিদেশ সফরে যেতে হবে লটবহর নিয়ে! আর যারই হোক, বিচারের বাজেটে তা কুলাবে না। আমার ভাবনাও অতি সাধারণ। বিলম্বের কলকাঠি তো লাগায়নি বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে। লাগিয়েছে খাঁটি স্বদেশি মতলবিতে। খুলবার চাবিকাঠি খুঁজতে হবে এই মাটিতেই। যেই প্যাঁচে তালা আটকায় ঠিক তার উল্টো প্যাঁচেই খোলে।
ন্যায়বিচারের অতিবিলম্ব ঘোচাবার কথা উঠলে চট করেই মাথায় আসে আদালত আর বিচারক বাড়াবার কথা। ভাবনাটা ভুল নয় একেবারে। কিন্তু, বাড়বে কেমন, কতটা! মাথাব্যথা হলে সরকারও আদালত বাড়ায় মাঝেমধ্যে। ভিন্ন আদালত নামেই শুধু! অনেক ক্ষেত্রে বিচারক একই জন, বিচারকক্ষও একটাই। ভোল পাল্টিয়ে হয় কখনো দেওয়ানি, কখনো পারিবারিক, কখনো অর্থঋণ, কখনো দায়রা, কখনো স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল, কখনো স্পেশাল জজ। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে জেলাগুলোতে আদতেই ভিন্ন করা হয়েছিল দ্বিতীয় সাব-জজ আদালত। তাতে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ ছিলেন ঐ সাব-জজই। স্টেনোগ্রাফার-সেরেস্তাদার-আরদালি দূরে থাক একজন পেশকারেরও পদ করা হয়নি তার জন্য। যুগ্ম জেলা জজ নামে চলছে এখনো সেভাবেই। অতিরিক্ত জেলা জজ রিক্ত এসবে তারও আগে থেকে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্টেনোটাইপিস্ট ছাড়াই চলছিল ঢাকার ১০টি স্পেশাল জজ কোর্ট। দুদক থেকে লেখালেখি করে সেই পদগুলো করিয়েছিলাম ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে। হাল আমলে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল হয়েছে সেই দ্বিতীয় সাব-জজের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ আদলে। হাইকোর্ট জজ দিয়ে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম-আদল’ আদবে বাধে বলে আপিল ট্রাইব্যুনাল আর হয়নি, রয়ে গেছে কেতাবে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
মহুকুমা থেকে উন্নীত অনেক জেলায় তখন দ্বিতীয় সাব-জজের মামলা ঘাটতি ছিল। ঘাটতি ছিল অনেক উপজেলা আদালতেও। অল্প কিছু মামলা নিয়ে অপর্যাপ্ত নিষ্পত্তির কৈফিয়ত দিতে দিতে এসিআর বিরূপ হয়েছে অনেকের। যেখানে যতটা প্রয়োজন ততটা বাড়াতে হবে আদালত। সঙ্গে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী, অফিস-এজলাস এবং পৃথক বিচারক দিয়ে। মামলাভারাক্রান্ত আদালতে প্রতিদিন গাদাগাদা নথি লেখা, সেগুলোর ডায়েরি-কজলিস্ট লেখা, সমন-ওয়ারেন্ট লেখা-ইস্যুর অসাধ্য সাধন এক পেশকারের দু-হাতে আর হয় না সবটা, বকেয়াই রয়ে যায় বেশিটা। অনাহূত, তাই সাক্ষী আসে না নির্ধারিত তারিখে। এসব কাজে আরও দু-একটা পদ বাড়ানো জরুরি। পুরো আদলে আদালত বাড়াবার আর জায়গা নেই ঢাকা কিংবা জেলা শহরে। সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, সবার প্রাঙ্গণ আজ বিল্ডিংয়ের বন হয়ে আছে। কোলাহলপূর্ণ পরিসরে বাজার চলে, বিচারে লাগে শান্ত-স্নিগ্ধ পরিসর, ভাবগম্ভীর পরিবেশ। আদালত বাড়াতে হবে সেই পরিবেশের পরিসরে। উকিলবিহীন গ্রাম্য কিংবা ভ্রাম্য আদালত সে বিকল্প নয়। সাক্ষী শুনে আর দলিল দেখে বিচার হয় দেখেই চোখ-কানওয়ালা যে-কেউই বিচারকর্ম সারতে পারে ভাবাটা বিরাট ভ্রম। বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ন্যায়নিষ্ঠ বিচক্ষণ মানুষ ছাড়া সুবিচার মেলে না আসলে। ফিরিয়ে নিতে হবে ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী জজ, সিনিয়র সহকারী জজ আদালত সব উপজেলায়। জেলার বাইরে সুবিধাজনক জায়গায় কয়েকটি উপজেলার জন্য যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত নতুন করে বাড়াতে হবে। হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রসারণ করতে হবে বিভাগীয় শহরে। সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ মেনে সার্কিট বা অস্থায়ী, যে-নামেই হোক। আইনজীবীদের সবার কাছেই মামলা থাকবে পর্যাপ্ত। কতিপয় চেম্বারের মামলা উপচানো কমবে। কতিপয়ের স্বার্থে এসব আদালত তুলে আনার অপবাদ (!) মিথ্যে প্রমাণ হবে। আইনজীবীর ব্যক্তিগত কারণে সময় নেওয়াও কমবে।
অর্থ কোথায় পাওয়া যাবে! প্রতিটি আদালতে বিচারক-কর্মচারীর বেতনভাতা আর আনুষঙ্গিকে যত ব্যয় তার প্রায় দ্বিগুণ আয় কোর্ট ফি থেকে। দুর্নীতি-মানিলন্ডারিং মামলায় হাজারো লাখ টাকা জরিমানা, আর শতকোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়। কোর্ট ফির আয়, জরিমানা-বাজেয়াপ্তির অর্থ-সম্পদ ব্যয় হওয়া উচিত আদালতের মান ও বিচারের গতি বাড়াতেই। সিআরপিসির ৩৮৬ ধারায় সংশোধনী এনে ক্রোক-নিলাম-বিক্রির ক্ষমতাটুকুও দণ্ডদাতা আদালতকে দিলে জরিমানা-বাজেয়াপ্তি আদায়ে গতি আসে।
এক বিরোধে মামলা হয় কয়েকটা। পারিবারিক বিরোধ বাধলে মামলা হয় আগে যৌতুকের, পরে নারী নির্যাতনের, চুরির, শেষে হয় পারিবারিক। দেওয়ানির বিরোধ লাগলে মামলা হয় আগে চাঁদাবাজির, পরে দেওয়ানি। একখানা চেকেই হয় প্রতারণা, জালিয়াতি, এনআই অ্যাক্ট, অর্থঋণ। বাদী-বিবাদী, আসামি-ফরিয়াদি একই লোক, বিচারকও একই জন, আইনজীবীও একই। বিচার হয় একই এজলাসে, শুধু পৃথক নথি টেনে। আজ যে-বিচারক ম্যাজিস্ট্রেসিতে কালকে তিনি দেওয়ানিতে। মামলার সংখ্যা কমাতে এক বিরোধে একটাই মামলা, দেওয়ানি-ফৌজদারি প্রতিকার একই বিচারে, এমন ব্যবস্থাই করতে হবে। দেওয়ানির ডিক্রি হলে জারির প্রক্রিয়াটা নিতে হবে সেই আদালতকেই, নিজের রায়-ডিক্রির মান বাঁচাতে। নইলে বিচার থাকে অসমাপ্ত। সে ব্যবস্থাটাও করতে হবে। মিথ্যা মামলা, আর জাল কাগজ প্রমাণ হয় যে আদালতে তাকে ফৌজদারির নালিশকারী হওয়ার যে ঘোরপ্যাঁচ লাগানো আছে কার্যবিধির ১৯৫ ও ৪৭৬ ধারায় সেটা ছুটিয়ে সেই আদালতকেই দণ্ডদাতা করা দরকার। তারই এক রায়ে মিথ্যা-জালিয়াতিরও সাজা হলে আরেক মামলা লাগে না, মিথ্যা মামলাও কমে। ফৌজদারি মামলায় ‘কগনিজ্যান্স’ বড়োই গুরুত্বপূর্ণ। আদালতে ফৌজদারি ঢোকার সেটাই পথ। সে-পথে কড়া পাহারা দরকার, যেন মেরিটবিহীন হয়রানির অচল মামলা ঢুকতে না পারে। এ কাজে থাকতে হবে আরও অভিজ্ঞ বিচক্ষণ বিচারক। তাই, প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের বদলে কগনিজ্যান্সের কাজটা কেবল চিফ জুডিশিয়াল-চিফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়েই করাতে হবে [সিআরপিসির ৬(৩) ধারামতে এখন তারা প্রথম শ্রেণিরও উচ্চশ্রেণিতে]। যেমনটা দায়রা বিচার্য মামলা আগে যায় দায়রা জজের কাছে, তিনি গ্রহণ করলে বিচারে পাঠান অতিরিক্ত ও যুগ্ম জজের কাছে। তবে, আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কগনিজ্যান্স, পরে আবার দায়রা জজের কগনিজ্যান্সের বদলে সরাসরি দায়রা জজেরই কগনিজ্যান্স, শুরু থেকেই মামলাটা দায়রায় থাকার ব্যবস্থা করার দরকার। ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ ধরনের আদালতের আমলযোগ্য ফৌজদারি মামলাও তদন্তকালে আমলি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রাখা চলছে আইন ছাড়া পুরনো স্বভাবে। সেগুলো তো শুরু থেকেই সে-সব ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ আদালতেই থাকার কথা। অর্থহীন এসব ধাপ কমালে কাল কাটানোর অনেক ধাপ কমে, সময় বাঁচে।
যতই পাকা বন্দোবস্ত হোক না কেন, চার আনারও সাধ মিটবে না ঠিকমতো দেখভাল না করলে। দামি যন্ত্রপাতির অত্যাধুনিক কারখানাও অচল হয় নিয়মিত ‘সুপারভিশন’ না থাকলে। নষ্ট ‘পার্টস’ আর দুষ্ট গরু শনাক্ত করে সারাতে হয়, সরাতে হয়। করিয়ে না নিলে কাজ করে না কেউই। কর্তা আর কর্মীতে ফারাক এই। অধস্তন আদালতগুলোর বিচারকদের নিজ নিজ আদালতের এবং নিজ অধস্তনগুলোর জেলা ও দায়রা জজের তদারকি-তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব। নিজেরসহ সব আদালতের তদারকি-তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের। কায়দা-কৌশল দেওয়া আছে ‘সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’, ‘ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডারস’-এ। আছে হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের কোর্ট রুলস। সেগুলো মানা হচ্ছে কি না সেই তদারকি ও কাজ করিয়ে নেওয়ার কর্তা সুপ্রিম কোর্ট। অধস্তন সব আদালত থেকে বিচারাধীন মামলার কতগুলো কত মাসের, কত বছরের পুরনো, অতিবিলম্বের কী কারণ সব তথ্যই সুপ্রিম কোর্টে আসে বার্ষিক, ত্রৈমাসিক স্টেটমেন্টে। বছরে কোন আদালতে, কোন বেঞ্চে শতকরা কতভাগ নিষ্পত্তি, কতভাগ দায়ের, কতভাগ পেন্ডিং, কত বছরের পুরনো কতটি কার কাছে থাকল, পুরো হিসাব থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্ট বার্ষিক রিপোর্টে। আসল খবরদারি করতে লাগে খুঁটিনাটি সব খবরাদি। মোটা দাগের হিসাবে ধরা যায় না আসল দাগি কে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯০ সালের ‘সিভিল জাস্টিস রিফর্ম অ্যাক্ট’-এ অভিনব নিয়ম করেছে। ফেডারেল জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের যারা মামলা নিষ্পত্তিতে অতিবিলম্ব করেন তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। সাক্ষী বা শুনানি শুরুর ৬ মাসে, মামলা দাখিলের তিন বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে না পারলে সেই বিচারককেই তা জানাতে হয় ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিস অব দি ইউনাইটেড স্টেটস কোর্টস’-এর পরিচালকের কাছে। পরিচালক সেগুলোর রিপোর্ট ৬ মাস পর-পর প্রকাশ করেন। কানাডায় সাধারণ দেওয়ানি মামলা সর্বোচ্চ ৬ মাসে নিষ্পত্তি করা নিয়ম। ৫টা মামলায় এই সীমা লঙ্ঘন করায় বিভাগীয় ব্যবস্থায় ‘ওয়ার্নিং’ খেয়ে বিচারকের পদত্যাগের নজিরও আছে। এমনই করা উচিত আমাদের এখানে বিচারক ও আইনজীবীর জন্য। শনাক্ত হয় সত্যিকারের বিলম্বকারী, আরামকারী। ঢালাও দোষের ভাগি হয় না খেটে-মরা বেচারি। হাইকোর্ট কিংবা আপিল বিভাগের বেঞ্চ থেকে দু-চারটার তলবে তদারকি-তত্ত্বাবধানের সবটা সারবে না। বেঞ্চের প্রধান কাজ বিচারকর্ম। বিচার প্রশাসন দেখভাল ও বিহিত করতে অন্য কাজের ভারমুক্ত দক্ষ লোকের শক্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে। ভারমুক্ত ‘রেডিমেড’ অভিজ্ঞ দক্ষ মানুষ পাওয়া যাবে চাকরির শেষে অবসরে। তাদের এই কাজে লাগানো যায়, অবসরভোগীর আয়েশখানা হওয়ার অপবাদ না ওঠে সেদিকটায় নজর রেখে। অধস্তন-ঊর্ধ্বতন, বিচারক-সহায়ক সবাইকেই রাখতে হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নজরে। দায়মুক্তিতে রাখা যাবে না কাউকেই। তবে, ঢালাও দোষের সার্কুলার নয়ধরতে হবে, সারতে হবে, সরাতে হবে, আসল নষ্ট, আসল দুষ্টকে। কেবল অভিযোগ পেলেই নয়, গন্ধ পেলে, ধোঁয়া দেখলেই নিজ গরজে খবর নেবে, বিহিত করবে। সব আদালতে কড়া তদারকি আর সত্যিকারের দেখভালের তত্ত্বাবধানই হলো বিচার-বিলম্বের একপাশের পাষাণকপাট সরাবার আসল চাবিকাঠি। ঘোরাতে হবে সবল হাতে। ন্যায়বিচার নিয়ে বেরিয়ে যেতে এই সজোর হাঁকটাই লাগবে।
(‘নাতিবিলম্ব বিচারের চাবিকাঠি : উদ্ধারপর্ব-সমাপ্তি’ আগামী কিস্তিতে)
লেখক প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক