আমার প্রিয় শিক্ষক কাশীনাথ রায়
আজফার হোসেন | ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
কাশীনাথ রায়। আশির দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে তিনি ছিলেন আমার বন্ধু, কমরেড ও সতীর্থ নূরুল কবীর (‘নিউ এইজ’ পত্রিকার সম্পাদক) আর আমার সরাসরি শিক্ষক। তিনি ছিলেন আমাদের পরম প্রিয় শিক্ষক। এখনো আমাদের শিক্ষক। ক্লাসরুমে তার নিজস্ব কায়দায় উচ্চারিত ও ধ্বনিতরঙ্গায়িত শব্দগুলো মাঝেমধ্যেই স্মৃতির ভেতরে মধুর আওয়াজ তুলে যায়, যেমন তার কবিতার অনেক লাইনও আমাদের জন্য থেকে গেছে একরত্তি মহাকাল ধরে।
গত রবিবার ভোরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের এই প্রিয় শিক্ষক। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। চার সপ্তাহ ধরে নিউমোনিয়া আর কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে তিনি যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন এই করোনাক্রান্ত মার্কিন মুলুকে বসে তার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। পরে তিনি যে কিছুটা ভালো হয়ে উঠছিলেন সেই সংবাদটাও পেয়েছিলাম, নারীপক্ষের শ্রদ্ধেয় শিরীন হকের বরাতে। তাই ভাবিনি যে, তিনি অত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন! তিনি তার একমাত্র পুত্র বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. অপ্রতিম রায়, পুত্রবধূ প্রকৃতি চক্রবর্তী, পৌত্র অভ্র রায়সহ আমাদের মতো তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এবং গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
কাশীনাথ রায়ের জন্ম ১৯৪৭ সালে নাটোরে। পড়াশোনা করেছেন পাবনা জিলা স্কুল, এডওয়ার্ড কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। শিক্ষকতা জীবনের শুরুর দিকে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। তবে অবসরে যাওয়ার পর তিনি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ডিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জীবনের শেষের দিকে নিভৃতচারী কাশীনাথ রায় বসবাস করতেন সাভারের নিজ বাড়িতে।
তিনি আমাদের পড়িয়েছিলেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি। কিন্তু তিনি হার্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি ছিলেন আসলেই বিশ্বসাহিত্যের সুপণ্ডিত। এক পর্যায়ে আমার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার। সে কারণেই তার বাসায় বসে মালার্মে, উইটগেনস্টাইন আর জীবনানন্দসহ রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণও আমার জানার সুযোগ ঘটেছিল। সাহিত্য ও সঙ্গীত ছাড়াও দর্শন এবং এমনকি মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিতেও ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। এই কাশীনাথ রায়কেও আমাদের চিনে রাখা দরকার। এও বলা দরকার, কাশীনাথ রায় রাজনীতিসচেতন ছিলেন তো বটেই, এমনকি সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার স্পষ্ট পক্ষপাত। আর সেই পক্ষপাতের কথা তিনি একাধিক আলাপ ও আড্ডায় আমাকে সরাসরি জানিয়েছিলেনও বটে।
সত্যি কথা বলতে, কাশীনাথ রায়ের মতো এত উঁচুমানের শিক্ষক আমরা খুব কম দেখেছি আমাদের জীবনে। জীবন সম্পর্কে তার ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি। সাহিত্য পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে জীবনের গল্পও তিনি বলে যেতে পারতেন অসাধারণ দক্ষতা সহকারে। আর বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তার প্রতিভাদীপ্ত ও সৃজনশীল দক্ষতা আমাদের মুগ্ধ করে রাখতো।
বহুগুণে গুণান্বিত এই অধ্যাপক নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার মৃত্যুতে একজন অসাধারণ মানুষ এবং একজন অসাধারণ শিক্ষককে হারিয়েছি আমরা। কাশীনাথ রায়ের প্রিয় ছাত্র ও আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ এবং আমার অগ্রজ কিন্তু বন্ধু কবি গোলাম ফারুক খান যথার্থই বলেছেনঃ ‘এককালের তুখোড় ছাত্র, প্রতিভাবান কবি, মনস্বী প্রাবন্ধিক এবং একজন তিমিরবিনাশী শিক্ষক কাশীনাথ রায় হয়ত বাংলাদেশের সমাজে খুব পরিচিত ছিলেন না। কারণ তিনি সবসময় নিজের অসামান্য দীপ্তিকে ঢেকে রেখে অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাইতেন। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বে কত বিরল গুণের সমাবেশ ঘটেছিল সেটি খুব ভালো করে জানেন তাঁর ছাত্রছাত্রী, বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনেরা।’ দেশ যে একজন আদর্শ শিক্ষককে হারিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর তার মতো বহু গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ রাতারাতি একটি সমাজে আসেন না।
২০১৭ সালে আমেরিকা থেকে ঢাকায় ফিরে আমার বন্ধু নূরুল কবীরের সঙ্গে গিয়েছিলাম স্যারকে দেখতে। তার সঙ্গে তখন জমে উঠেছিল আমাদের এক অসাধারণ স্পন্দিত আড্ডা, যে আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন ইংরেজি বিভাগের আমাদের আরেক প্রিয় শিক্ষক ও কাশীনাথ রায়ের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি কায়সার হক। সেই আড্ডার স্মৃতি এখনও তাজা রয়ে গেছে। বারবার আমাদের সেই আড্ডার কথা মনে পড়ছে।
এবার আরেকটা ব্যক্তিগত স্মৃতির প্রসঙ্গে আসি : সেই অল্প বয়সে, ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকার সময়, আমি কাশীনাথ রায়ের দুর্দান্ত কবিতা ‘চারু বাবু ও কতিপয় বিভ্রান্ত স্থপতি’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেলি। অনুবাদ করার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও খুব ভালো লাগা থেকেই তার কবিতাটা অনুবাদ করে ফেলি। শওকত স্যার (প্রফেসর শওকত হোসেন) কী ভেবে সেই অনুবাদটা আবার তার ‘ফর্ম’ পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন! ছাপানোর পর এও বুঝতে পেরেছিলাম, তার কবিতার প্রতি সুবিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করার কারণে তার সামনাসামনি হতে চাইনি বেশ কিছুদিন। কিন্তু এক দিন তিনি আমাকে দেখতেই ধন্যবাদ জানালেন ওই অনুবাদের জন্য। আরও লজ্জা পেলাম; কিন্তু এও বুঝলাম যে, তিনি উদার।
তিনি যে আপসহীন, তাও বুঝেছি বারবারই। তার কাছে আমার ঋণ অন্তহীন। তাকে দিতে পারিনি কিছুই, কিন্তু তার কাছ থেকে নিয়েছি প্রচুর। জানি, তিনি আছেন এবং থাকবেনও--আমাদের পরম প্রিয় কাশীনাথ স্যার! তিনি থাকবেন আমাদের অনেক স্মৃতিতে, আমাদের অনেক গল্পে, আমাদের ইতিহাসে আর থাকবেন তিনি তার কবিতায়। তবে বন্ধু কবীর আর আমি এও মনে করি, তাকে আমাদের ইংরেজি বিভাগের অনেকেই এবং অবশ্যই আমাদের তথাকথিত সাহিত্যজগৎ এখনো ঠিকমতো চিনতে পারেনি।
২০০৮ সালে ভাষাচিত্র থেকে তার ‘জীবনানন্দ দেখুন’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল এবং ২০১১/১২ সালে খেয়া থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আমি যাহা দিতে পারি’। এই বইয়ের কবিতাগুলো এতোই অসাধারন যে, সেগুলো আসলেই আলাদা আলোচনা দাবি করে। ভবিষ্যতে তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছাও আছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দ দাশের ভীষণ ভক্ত। স্যারের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর জীবনানন্দ দাশের কথাই বারবার মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, তারই প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের এই লাইনগুলো যেন স্যারের নিজস্ব কথা হয়ে উঠেছিল তার জীবদ্দশায় :
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;/আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,/পৌঁছে অনেকক্ষণ ব’সে অপেক্ষা করবার অবসর আছে। /জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা/অন্য সবাই এসে বহন করুক : আমি প্রয়োজন বোধ করি না :/আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ/হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে/নক্ষত্রের নিচে।
লেখকঃ তাত্ত্বিক, সাহিত্যসমালোচক, কবি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক
শেয়ার করুন
আজফার হোসেন | ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

কাশীনাথ রায়। আশির দশকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে তিনি ছিলেন আমার বন্ধু, কমরেড ও সতীর্থ নূরুল কবীর (‘নিউ এইজ’ পত্রিকার সম্পাদক) আর আমার সরাসরি শিক্ষক। তিনি ছিলেন আমাদের পরম প্রিয় শিক্ষক। এখনো আমাদের শিক্ষক। ক্লাসরুমে তার নিজস্ব কায়দায় উচ্চারিত ও ধ্বনিতরঙ্গায়িত শব্দগুলো মাঝেমধ্যেই স্মৃতির ভেতরে মধুর আওয়াজ তুলে যায়, যেমন তার কবিতার অনেক লাইনও আমাদের জন্য থেকে গেছে একরত্তি মহাকাল ধরে।
গত রবিবার ভোরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাদের এই প্রিয় শিক্ষক। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। চার সপ্তাহ ধরে নিউমোনিয়া আর কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে তিনি যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন এই করোনাক্রান্ত মার্কিন মুলুকে বসে তার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। পরে তিনি যে কিছুটা ভালো হয়ে উঠছিলেন সেই সংবাদটাও পেয়েছিলাম, নারীপক্ষের শ্রদ্ধেয় শিরীন হকের বরাতে। তাই ভাবিনি যে, তিনি অত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন! তিনি তার একমাত্র পুত্র বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. অপ্রতিম রায়, পুত্রবধূ প্রকৃতি চক্রবর্তী, পৌত্র অভ্র রায়সহ আমাদের মতো তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এবং গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
কাশীনাথ রায়ের জন্ম ১৯৪৭ সালে নাটোরে। পড়াশোনা করেছেন পাবনা জিলা স্কুল, এডওয়ার্ড কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। শিক্ষকতা জীবনের শুরুর দিকে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান। তবে অবসরে যাওয়ার পর তিনি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ডিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জীবনের শেষের দিকে নিভৃতচারী কাশীনাথ রায় বসবাস করতেন সাভারের নিজ বাড়িতে।
তিনি আমাদের পড়িয়েছিলেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি। কিন্তু তিনি হার্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি ছিলেন আসলেই বিশ্বসাহিত্যের সুপণ্ডিত। এক পর্যায়ে আমার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার। সে কারণেই তার বাসায় বসে মালার্মে, উইটগেনস্টাইন আর জীবনানন্দসহ রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণও আমার জানার সুযোগ ঘটেছিল। সাহিত্য ও সঙ্গীত ছাড়াও দর্শন এবং এমনকি মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতিতেও ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। এই কাশীনাথ রায়কেও আমাদের চিনে রাখা দরকার। এও বলা দরকার, কাশীনাথ রায় রাজনীতিসচেতন ছিলেন তো বটেই, এমনকি সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার স্পষ্ট পক্ষপাত। আর সেই পক্ষপাতের কথা তিনি একাধিক আলাপ ও আড্ডায় আমাকে সরাসরি জানিয়েছিলেনও বটে।
সত্যি কথা বলতে, কাশীনাথ রায়ের মতো এত উঁচুমানের শিক্ষক আমরা খুব কম দেখেছি আমাদের জীবনে। জীবন সম্পর্কে তার ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি। সাহিত্য পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে জীবনের গল্পও তিনি বলে যেতে পারতেন অসাধারণ দক্ষতা সহকারে। আর বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তার প্রতিভাদীপ্ত ও সৃজনশীল দক্ষতা আমাদের মুগ্ধ করে রাখতো।
বহুগুণে গুণান্বিত এই অধ্যাপক নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার মৃত্যুতে একজন অসাধারণ মানুষ এবং একজন অসাধারণ শিক্ষককে হারিয়েছি আমরা। কাশীনাথ রায়ের প্রিয় ছাত্র ও আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ এবং আমার অগ্রজ কিন্তু বন্ধু কবি গোলাম ফারুক খান যথার্থই বলেছেনঃ ‘এককালের তুখোড় ছাত্র, প্রতিভাবান কবি, মনস্বী প্রাবন্ধিক এবং একজন তিমিরবিনাশী শিক্ষক কাশীনাথ রায় হয়ত বাংলাদেশের সমাজে খুব পরিচিত ছিলেন না। কারণ তিনি সবসময় নিজের অসামান্য দীপ্তিকে ঢেকে রেখে অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাইতেন। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বে কত বিরল গুণের সমাবেশ ঘটেছিল সেটি খুব ভালো করে জানেন তাঁর ছাত্রছাত্রী, বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনেরা।’ দেশ যে একজন আদর্শ শিক্ষককে হারিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর তার মতো বহু গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ রাতারাতি একটি সমাজে আসেন না।
২০১৭ সালে আমেরিকা থেকে ঢাকায় ফিরে আমার বন্ধু নূরুল কবীরের সঙ্গে গিয়েছিলাম স্যারকে দেখতে। তার সঙ্গে তখন জমে উঠেছিল আমাদের এক অসাধারণ স্পন্দিত আড্ডা, যে আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন ইংরেজি বিভাগের আমাদের আরেক প্রিয় শিক্ষক ও কাশীনাথ রায়ের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি কায়সার হক। সেই আড্ডার স্মৃতি এখনও তাজা রয়ে গেছে। বারবার আমাদের সেই আড্ডার কথা মনে পড়ছে।
এবার আরেকটা ব্যক্তিগত স্মৃতির প্রসঙ্গে আসি : সেই অল্প বয়সে, ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকার সময়, আমি কাশীনাথ রায়ের দুর্দান্ত কবিতা ‘চারু বাবু ও কতিপয় বিভ্রান্ত স্থপতি’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেলি। অনুবাদ করার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও খুব ভালো লাগা থেকেই তার কবিতাটা অনুবাদ করে ফেলি। শওকত স্যার (প্রফেসর শওকত হোসেন) কী ভেবে সেই অনুবাদটা আবার তার ‘ফর্ম’ পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন! ছাপানোর পর এও বুঝতে পেরেছিলাম, তার কবিতার প্রতি সুবিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করার কারণে তার সামনাসামনি হতে চাইনি বেশ কিছুদিন। কিন্তু এক দিন তিনি আমাকে দেখতেই ধন্যবাদ জানালেন ওই অনুবাদের জন্য। আরও লজ্জা পেলাম; কিন্তু এও বুঝলাম যে, তিনি উদার।
তিনি যে আপসহীন, তাও বুঝেছি বারবারই। তার কাছে আমার ঋণ অন্তহীন। তাকে দিতে পারিনি কিছুই, কিন্তু তার কাছ থেকে নিয়েছি প্রচুর। জানি, তিনি আছেন এবং থাকবেনও--আমাদের পরম প্রিয় কাশীনাথ স্যার! তিনি থাকবেন আমাদের অনেক স্মৃতিতে, আমাদের অনেক গল্পে, আমাদের ইতিহাসে আর থাকবেন তিনি তার কবিতায়। তবে বন্ধু কবীর আর আমি এও মনে করি, তাকে আমাদের ইংরেজি বিভাগের অনেকেই এবং অবশ্যই আমাদের তথাকথিত সাহিত্যজগৎ এখনো ঠিকমতো চিনতে পারেনি।
২০০৮ সালে ভাষাচিত্র থেকে তার ‘জীবনানন্দ দেখুন’ নামে একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল এবং ২০১১/১২ সালে খেয়া থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আমি যাহা দিতে পারি’। এই বইয়ের কবিতাগুলো এতোই অসাধারন যে, সেগুলো আসলেই আলাদা আলোচনা দাবি করে। ভবিষ্যতে তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছাও আছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দ দাশের ভীষণ ভক্ত। স্যারের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর জীবনানন্দ দাশের কথাই বারবার মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, তারই প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের এই লাইনগুলো যেন স্যারের নিজস্ব কথা হয়ে উঠেছিল তার জীবদ্দশায় :
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;/আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,/পৌঁছে অনেকক্ষণ ব’সে অপেক্ষা করবার অবসর আছে। /জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা/অন্য সবাই এসে বহন করুক : আমি প্রয়োজন বোধ করি না :/আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ/হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে/নক্ষত্রের নিচে।
লেখকঃ তাত্ত্বিক, সাহিত্যসমালোচক, কবি ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক