নিরপরাধের কারাভোগ
বিবাদী জামিন পাচ্ছে না, ফরিয়াদি বিচার পাচ্ছে না, আদালত সাক্ষী পাচ্ছে না, পুলিশ আসামি পাচ্ছে না। অনেকে বিনাবিচারে বছরের পর বছর হাজত খাটছেন কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না, খালাসও পাচ্ছেন না। এমনকি অনেকে অপরাধী না হয়েও ভুল আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটছেন কিন্তু মুক্তি পাচ্ছেন না! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কুখ্যাত সন্ত্রাসী কিংবা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ‘খুঁজে না পেলেও’ দুর্নীতির মামলা থেকে শুরু করে খুনের মামলার আসামি কাগজে-কলমে ‘পলাতক’ থেকেও বহাল তবিয়তে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরিও করছেন, এমন প্রতিবেদনও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অভিযুক্ত আসামির বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকার কারণে রাজধানীর পল্লবী এলাকার বেনারসি কারিগর মো. আরমানের পাঁচ বছরের কারাভোগের সংবাদ এসব সংবাদের তালিকায় নতুন সংযোজন।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিস্ফোরক আইনে হওয়া একটি মামলার মূল আসামির বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকায় আরমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ ছিল। ২০১৬ সাল থেকে তিনি কাশিমপুর কারাগার-২-এ বন্দি ছিলেন। বর্তমানে তার বয়স ৪৫ বছর। বিষয়টি নিয়ে ‘কারাগারে আরেক জাহালম’ শিরোনামে ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি যুক্ত করে আরমানকে বেআইনিভাবে আটক রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তার মা বানু হাইকোর্টে রিট করেন। এর প্রাথমিক শুনানির পর ৯ জুলাই হাইকোর্ট রুল দেয়। আরমানকে ভুলভাবে আটক করে রাখা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে রুলে জানতে চাওয়া হয়। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রায় দেয় আদালত। গত বৃহস্পতিবার কাশিমপুর কারাগার থেকে আরমান মুক্তি পেলেও তার জীবনের মূল্যবান পাঁচ-পাঁচটি বছর বিনা অপরাধে কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে।
আরেকজনের অপরাধের ভার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুলের কারণে নিরপরাধের কাঁধে চাপিয়ে বছরের পর বছর কারাভোগের ঘটনার অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশে। কয়েক বছর আগে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলে সালেকের বদলে টাঙ্গাইলের জাহালমকে কারান্তরীণ থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। বিনা অপরাধে দুর্নীতির ৩৩ মামলা কাঁধে নিয়ে তিন বছর কারাভোগের পর হাইকোর্টের আদেশে মুক্ত হন টাঙ্গাইলের জাহালম। ২০০৪ সালের ভয়াবহ একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় নিরপরাধ জজ মিয়াকে আসামি বানিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তির ঘটনা সর্বজনবিদিত। এছাড়াও ১৩ বছর জেল খাটার পর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া, ফাঁসির দ-াদেশ থেকে খালাসের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর আগেই মারা যান সাতক্ষীরার ওবায়দুর রহমান ওরফে অবেদ আলী (৬৫)। মৃত্যুর কারণে বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাভোগের পর বেকসুর খালাস পেয়ে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামের মো. বাবুলের মতো তাকে অন্তত বলতে হয়নি, ‘কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?’
আরমানের এ ঘটনা আমাদের একদিকে নির্দোষ হয়েও জেলখাটা মানুষের কথা মনে করিয়ে দেয়; অন্যদিকে পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও পদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ নীতিতে কোনো অপরাধী ‘ফস্কে’ বেরিয়ে যাবেন আর কোনো নিরপরাধ মানুষ ‘বজ্র আঁটুনি’র বাঁধন খুলে বেরোতে না পারার কারণে কারাবাস করবেন সেটাকে নিয়তি বলার কোনো সুযোগ নেই। কেননা স্পষ্টতই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী আর রাজনীতি ও অপরাধ জগতের অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশেই এমন দ্বৈতনীতির ফলাফল সমাজে দেখা যাচ্ছে। ‘সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস’-এর বরাতে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ৪৬২ জন ব্যক্তি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে বিনা বিচারে হাজত খাটছিলেন। এদের মধ্যে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সতেরো বছর ধরে কারাভোগ করা ব্যক্তিও রয়েছেন। নীতিনির্ধারক মহল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিচারসংশ্লিষ্টদের অবশ্যই এই দ্বৈততার অবসান ঘটাতে হবে।
শেয়ার করুন

বিবাদী জামিন পাচ্ছে না, ফরিয়াদি বিচার পাচ্ছে না, আদালত সাক্ষী পাচ্ছে না, পুলিশ আসামি পাচ্ছে না। অনেকে বিনাবিচারে বছরের পর বছর হাজত খাটছেন কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না, খালাসও পাচ্ছেন না। এমনকি অনেকে অপরাধী না হয়েও ভুল আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটছেন কিন্তু মুক্তি পাচ্ছেন না! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কুখ্যাত সন্ত্রাসী কিংবা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ‘খুঁজে না পেলেও’ দুর্নীতির মামলা থেকে শুরু করে খুনের মামলার আসামি কাগজে-কলমে ‘পলাতক’ থেকেও বহাল তবিয়তে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরিও করছেন, এমন প্রতিবেদনও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অভিযুক্ত আসামির বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকার কারণে রাজধানীর পল্লবী এলাকার বেনারসি কারিগর মো. আরমানের পাঁচ বছরের কারাভোগের সংবাদ এসব সংবাদের তালিকায় নতুন সংযোজন।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিস্ফোরক আইনে হওয়া একটি মামলার মূল আসামির বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকায় আরমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ ছিল। ২০১৬ সাল থেকে তিনি কাশিমপুর কারাগার-২-এ বন্দি ছিলেন। বর্তমানে তার বয়স ৪৫ বছর। বিষয়টি নিয়ে ‘কারাগারে আরেক জাহালম’ শিরোনামে ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি যুক্ত করে আরমানকে বেআইনিভাবে আটক রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তার মা বানু হাইকোর্টে রিট করেন। এর প্রাথমিক শুনানির পর ৯ জুলাই হাইকোর্ট রুল দেয়। আরমানকে ভুলভাবে আটক করে রাখা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে রুলে জানতে চাওয়া হয়। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর রায় দেয় আদালত। গত বৃহস্পতিবার কাশিমপুর কারাগার থেকে আরমান মুক্তি পেলেও তার জীবনের মূল্যবান পাঁচ-পাঁচটি বছর বিনা অপরাধে কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে।
আরেকজনের অপরাধের ভার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুলের কারণে নিরপরাধের কাঁধে চাপিয়ে বছরের পর বছর কারাভোগের ঘটনার অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশে। কয়েক বছর আগে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলে সালেকের বদলে টাঙ্গাইলের জাহালমকে কারান্তরীণ থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। বিনা অপরাধে দুর্নীতির ৩৩ মামলা কাঁধে নিয়ে তিন বছর কারাভোগের পর হাইকোর্টের আদেশে মুক্ত হন টাঙ্গাইলের জাহালম। ২০০৪ সালের ভয়াবহ একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় নিরপরাধ জজ মিয়াকে আসামি বানিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তির ঘটনা সর্বজনবিদিত। এছাড়াও ১৩ বছর জেল খাটার পর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া, ফাঁসির দ-াদেশ থেকে খালাসের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর আগেই মারা যান সাতক্ষীরার ওবায়দুর রহমান ওরফে অবেদ আলী (৬৫)। মৃত্যুর কারণে বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাভোগের পর বেকসুর খালাস পেয়ে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামের মো. বাবুলের মতো তাকে অন্তত বলতে হয়নি, ‘কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?’
আরমানের এ ঘটনা আমাদের একদিকে নির্দোষ হয়েও জেলখাটা মানুষের কথা মনে করিয়ে দেয়; অন্যদিকে পুলিশের খাতায় পলাতক থাকলেও পদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ নীতিতে কোনো অপরাধী ‘ফস্কে’ বেরিয়ে যাবেন আর কোনো নিরপরাধ মানুষ ‘বজ্র আঁটুনি’র বাঁধন খুলে বেরোতে না পারার কারণে কারাবাস করবেন সেটাকে নিয়তি বলার কোনো সুযোগ নেই। কেননা স্পষ্টতই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী আর রাজনীতি ও অপরাধ জগতের অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশেই এমন দ্বৈতনীতির ফলাফল সমাজে দেখা যাচ্ছে। ‘সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস’-এর বরাতে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ৪৬২ জন ব্যক্তি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে বিনা বিচারে হাজত খাটছিলেন। এদের মধ্যে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সতেরো বছর ধরে কারাভোগ করা ব্যক্তিও রয়েছেন। নীতিনির্ধারক মহল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিচারসংশ্লিষ্টদের অবশ্যই এই দ্বৈততার অবসান ঘটাতে হবে।