ডলি আনোয়ার ও আনোয়ার হোসেন
মুহাম্মদ সামাদ | ২৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
এক. সিনেমা হলের সাদা পর্দায় জীবন্ত মানুষ নড়েচড়ে, কথা বলে, হাসে-কাঁদে, মারামারি করে, বৃষ্টি পড়ে, নদীর জল কলকল শব্দ করে বয়ে যায়, পাখি ওড়ে, হাতি-ঘোড়ায় চড়ে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয় ছোটবেলা থেকেই আমার মায়ের কাছে এসব গল্প শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত। মা কৈশোরে ভারতের কোচবিহার শহরে কিছু সাদা-কালো সিনেমা দেখেছিলেন। যেহেতু সাদা-কালো বা আজকের রঙিন সিনেমা সম্পর্কে মায়ের ধারণা থাকার কোনো কারণ ছিল না, তাই তার একটা অবুঝ অভিযোগ ছিল যে, সিনেমার পর্দায় সবার ঠোঁট কালো দেখা যায়।
১৯৬৫ সালের কথা। প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় হাইস্কুলে-পড়া পাড়ার বড়ভাইদের সঙ্গে আমার সিনেমা দেখার শুরু। তখন আমাদের মহকুমা শহর জামালপুরে (বর্তমানে জেলা) ‘এন্তেজার’ এবং ‘নিরালা’ নামে দুটি সিনেমা হল ছিল। দুটি হলেই তৃতীয় শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল চৌদ্দ পয়সা অর্থাৎ চার আনা থেকে দুই পয়সা কম। ‘এন্তেজার’-এ লাহোরে নির্মিত উর্দু ছবি লোরী আমার বড় পর্দায় দেখা প্রথম ছবি। গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাস সিক্সে যেমন-তেমন, সেভেনে উঠেই আমি স্বাধীন হয়ে যাই। সেই থেকে নানা ছলছুতোয় মহকুমা শহরে সিনেমা দেখার মাত্রাও বেড়ে যায়। ষাটের দশকের শেষদিকে আমাদের সরিষাবাড়ীর শিমলাবাজারে ‘চম্পাকলি’ নামে একটি সিনেমা হল হয়। বাঁশের চাটাই বিছানো তৃতীয় শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল আট আনা, যা আজকের পঞ্চাশ পয়সার সমান। টিকিটের পয়সা জুটলেই দুপুরে টিফিনের সময় আমরা দু-তিন বন্ধু মিলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বই-পুস্তক নিয়ে ‘চম্পাকলি’-তে ঢুকে পড়তাম। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার সময়ের সঙ্গে ম্যাটিনি শো দেখে বাড়ি ফেরার সময়টা মিলে যেত। ফলে একই সঙ্গে স্কুল আর বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে এহেন কিশোর অপরাধ নির্বিঘেœ চালিয়ে যেতে বেশ সুবিধা হয়েছিল।
সাধারণত ম্যাটিনি শো-তে ইংরেজি সিনেমা দেখানো হতো। সে সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র দি অ্যাবসেন্ট-মাইন্ডেড প্রফেসর (১৯৬১) আমি ম্যাটিনি শো-তেই দেখেছি। কী খেয়ালে জানি না, শুরু থেকেই সিনেমা দেখে এসে দুই আনা দামের একটি বাঁধানো খাতায় আমি ছবির নাম লিখে রাখতাম। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসার আগ পর্যন্ত আমি সাড়ে চারশোর মতো ছবি দেখেছিলাম। ঢাকায় এসেও বেশ কিছু ভালো ছবি দেখার সুযোগ হয় আমার। যেমন সোফিয়া লরেন অভিনীত সানফ্লাওয়ার, সেনেগালের বিখ্যাত পরিচালক ওসমান সেমবেন-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি মান্দাবি, পিটার ব্রুকের মহাভারত প্রভৃতি। দেখেছিলাম মসিহউদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলী নির্মিত সূর্যদীঘল বাড়ি। এই ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের শক্তিমান অভিনেত্রী ডলি আনোয়ার।
শৈশবে, সিনেমার পাত্র-পাত্রীদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মানুষ পৃথিবীতে আছে বলে বিশ্বাস করা বা ভাবা ছিল অসম্ভব। একেকটা ছবি তিন-চারবার করে দেখেছি। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ, গান ও চলন-বলন অনুকরণ করেছি। বলে রাখা যায় যে, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে সিরাজউদ্দৌলাখ্যাত আমাদের জামালপুরের সন্তান আনোয়ার হোসেনকে আমি প্রথম দেখি এবং সেটি তার জামালপুরের বকুলতলা মোড়ের বাড়িতেই। প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালে ডিসেম্বরে অভিনেত্রী ডলি আনোয়ার ও আলোকচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেনের জিগাতলার বাসায় যাওয়ার আগে ওপরের কথাগুলো মনে পড়েছিল।
দুই. ১৯৮৩ সালে অমর একুশের বইমেলায় আমার প্রথম কবিতার বই বের হয়। প্রথম বই প্রকাশের উত্তেজনায় পৃথিবীর সব তরুণ কবির মতোই আমার চোখেও ঘুম নেই। কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদপট আর পেছনে আমার ছবি নিয়ে আমি তখন খুব ভাবছি। অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়েও আমার মধ্যে কেন জানি না যা কিছু নতুন, যা কিছু বড়, যা কিছু ভালো শুধু তার দিকে ঝোঁক। ১৯৭৯ সালের শেষ থেকে ১৯৮১-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত রচিত ও পরিমার্জিত ১৫৬ পঙ্ক্তির ছয় পৃষ্ঠার বিদ্রƒপাত্মক ‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ কবিতাটির নামানুসারে বইয়ের নাম ঠিক হলো একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি চিত্রকর্ম পছন্দ করলাম প্রচ্ছদের জন্য। প্রচ্ছদ করেছিল প্রয়াত তরুণ শিল্পী মোরাদজ্জামান মুরাদ। যা হোক, এখন আমার নিজের ছবি ওঠানোর পালা। সে সময় এলোমেলো চুল আর দাড়িওয়ালা একজন চিত্রগ্রাহক দেশ-বিদেশে পুরস্কার পাচ্ছিলেন। পত্রপত্রিকায় তার তোলা পুরস্কৃত সব অনুপম আলোকচিত্র আর তার নিজের প্রতিকৃতি ছাপা হচ্ছিল। নাম আনোয়ার হোসেন। এরই মধ্যে সূর্যদীঘল বাড়ি ছায়াছবির চিত্রগ্রাহক হিসেবে তিনি জাতীয় পুরস্কার পেলেন। আর এই ছবিতে অসামান্য অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেলেন তার স্ত্রী ডলি আনোয়ার। আমি স্থির করলাম আমার চেহারা যত ভাঙাচোরাই হোক, বইয়ের জন্য ছবি আমি এই বিখ্যাত চিত্রগ্রাহককে দিয়েই ওঠাব। আমি ওই দাড়িওয়ালা আলোকচিত্রীকে ধরার ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাস্টার্সের রেজাল্ট হলেও তখনো সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ৩৭৫ নম্বর রুমে থাকি। হঠাৎ করেই হলে খবর হয়ে গেল সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমার দুই ব্যাচ ওপরের ছাত্র আবদুর রহীম খান আমাদের প্রিয় রহীম ভাই ডলি আনোয়ারের ছোট বোন ইতি ইব্রাহিমকে বিয়ে করেছেন। ইতি ইব্রাহিম মানে আমাদের ইতি ভাবি অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের ছোট মেয়ে। আমি তো মহাখুশি। ইউরেকা, ইউরেকা! উল্লেখ্য, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি (১৯৫৫) চলচ্চিত্রে সর্বজয়া চরিত্রে অত্যন্ত প্রশংসনীয় অভিনয় করে খ্যাতিমান হয়ে ওঠা অভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের মাসতুতো বোন এবং ডলি আনোয়ারের মাসি ছিলেন। আপাতদৃষ্টে কাকতালীয় মনে হলেও সূর্যদীঘল বাড়ি ছবিতে দারিদ্র্যপীড়িত জীবনে প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করা জয়গুণকে (ডলি আনোয়ার) উনুনের পাশে যেভাবে দেখা যায়, ঠিক সেভাবেই পথের পাঁচালি ছবিতে আমরা দেখি দারিদ্র্যের কশাঘাতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে সংসার আর সন্তানের দেখভাল করা সর্বজয়াকে। নয়া-বাস্তববাদী ধারায় তৈরি এই দুই শক্তিশালী চলচ্চিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর ডলি আনোয়ারের অনবদ্য অভিনয় দেখে আমাদের বুক বেদনার্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সূর্যদীঘল বাড়ি ছবির কয়লার ইঞ্জিনচালিত ঝিকঝিক রেলগাড়ি একদিকে যেমন আমার শৈশব আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপু-দুর্গাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, তেমনি মাটির উনুনে ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে ছেলের খোঁজে বের হওয়া জয়গুণের মধ্যে আমি আমার মায়ের চিরায়ত মুখ খুঁজে পেয়েছিলাম। ডলি আনোয়ারের সেই অনুপম অভিনয়ের কথা মনে হলে বাড়িতে মাটির উনুনের পাশে বসা আমার মায়ের মুখ মনে পড়ে। আমি তা ভুলতে পারি না।
জানুয়ারির এক সকালে রহীম ভাই আমাকে ডলি আপার জিগাতলার বাসায় নিয়ে গেলেন। ছোট বোনের জামাইকে বাঙালিপনায় খুব খাতির-যতœ করলেন ডলি আপা। আমি কবিতা লিখি এবং ছবি তোলার জন্য এসেছি শুনে খুব আগ্রহ করে ভেতর থেকে একটি বিদেশি গেঞ্জি আর বাটিকের ছাপমারা লুঙ্গিপরা দাড়িওয়ালা আনোয়ার হোসেনকে ডেকে এনে এক রকম নির্দেশই দিলেন। আনোয়ার ভাই আমাকে পরের শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে আসতে বললেন। পরের শুক্রবারে ছবি তোলারও নতুন অভিজ্ঞতা হলো। এত দিন মহকুমা শহর জামালপুরে বা ঢাকায় স্টুডিওগুলোয় চিত্রগ্রাহকদের ক্যামেরার শাটার বাটনে কেবল একবার চাপ দিয়েই আমার ছবি তুলতে দেখেছি। আনোয়ার ভাই পরপর দুটি ক্যামেরা দিয়ে আমার অনেকগুলো ছবি তুললেন এবং তিন দিন পর ছবি নিয়ে আসতে বললেন। তিন দিন পর আমার সহপাঠী-চাচাতো ভাই নজরুলকে নিয়ে ছবি আনতে গেলাম। আমার থুতনির নিচে মাটির কবুতর বসিয়ে তোলা একটি মাত্র ছবি আমাকে দিয়েছিলেন আনোয়ার ভাই। বইমেলায় আমার প্রথম কবিতার বই বেরোল। প্রচ্ছদে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি চিত্রকর্ম আর পেছনে আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের তোলা আমার প্রতিকৃতি। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এক দিন শীতের সকালে ডলি আপাকে বই দিতে গেলাম। আমার যথেষ্ট শীতের কাপড় নেই জেনে খুব আফসোস করলেন ডলি আপা। তারও তখন হাত খালি, ঘর খালি। ছবি তোলার কাজ নিয়ে আনোয়ার ভাই আফ্রিকায় গেছেন। ঘরের সব দামি জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন ডলি আপা। জানালেন, আনোয়ার ভাইয়ের ছোট ভাই কামালকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটি পড়ায় তাকে সারা বছর মাসিক হারে টাকা দেন তিনি। তার যুক্তি, ছাত্রের স্কুল ছুটি থাকলেও শিক্ষকের তো বেতন বন্ধ করা চলে না। ১৯৯১ সালে ডলি আপা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে কবিতা পড়তে গিয়ে আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। প্রায় তিরিশ বছর পর দেখা। বললাম, আনোয়ার ভাই আমাকে চিনছেন? পাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন আরে সামাদ, তোমারে চিনব না, মাটির কবুতর দিয়া তোমার ছবি তুইলা দিছিলাম; মাঝে-মধ্যে তোমার ছবি দেখি; কেমন আছো? ঘাড়ে-পিঠে হাত দিয়ে স্নেহের পরশ ছড়িয়ে দিলেন। এখন কোথায় আছেন জিজ্ঞেস করতেই জানালেন প্যারিসে থাকেন; মাঝে-মধ্যে দেশে আসেন।
তিন. ২০১৮-এর পহেলা ডিসেম্বর বিকেল ৩টার দিকে মোবাইলে অনলাইন পত্রিকা দেখে চমকে উঠি! ‘চলে গেলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেন!’ সারাটা বিকেল বেদনায় বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করল। বাংলাদেশের অহংকার ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন আমাদের প্রিয় আনোয়ার ভাই নেই! আমি কেন যেন ভাবতেই পারছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার অনেক ছবি তিনি তুলেছেন। গুণী এই চিত্রগ্রাহক পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ৬০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। সূর্যদীঘল বাড়ি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, দহন, চিত্রা নদীর পাড়ে, শ্যামল ছায়া প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর খবর পড়ে আমার অনুজপ্রতিম তারিক সুজাতের সঙ্গে কথা বলি। তারিক জানাল, সম্প্রতি খুব অর্থকষ্টে দিন কাটছিল আনোয়ার ভাইয়ের। অর্থের অভাবে মাঝেমধ্যে মাদারীপুরে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। জীবনের শেষ যাত্রার আগে ঢাকা শহরের পান্থপথের অচেনা একটি ছোট হোটেলে উঠেছিলেন। সেখান থেকেই হতাশা নিয়ে একাই অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। ডলি আপাও এভাবেই চলে গেছেন। এ বয়সে নিজের ও কত মানুষের কত অর্থকষ্ট আমি দেখেছি। তবে, আনোয়ার ভাইয়ের অর্থকষ্টের কথা শুনলে বিচলিত হইনি। সারা পৃথিবীর কোন গুণী অর্থকষ্টে ছিলেন না, শুনি? আবার হাসিও পায় আমার। চারদিকে এত অঢেল অর্থ প্রতিদিন কত অনর্থ ঘটাচ্ছে!
লেখক কবি; প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
মুহাম্মদ সামাদ | ২৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

এক. সিনেমা হলের সাদা পর্দায় জীবন্ত মানুষ নড়েচড়ে, কথা বলে, হাসে-কাঁদে, মারামারি করে, বৃষ্টি পড়ে, নদীর জল কলকল শব্দ করে বয়ে যায়, পাখি ওড়ে, হাতি-ঘোড়ায় চড়ে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয় ছোটবেলা থেকেই আমার মায়ের কাছে এসব গল্প শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত। মা কৈশোরে ভারতের কোচবিহার শহরে কিছু সাদা-কালো সিনেমা দেখেছিলেন। যেহেতু সাদা-কালো বা আজকের রঙিন সিনেমা সম্পর্কে মায়ের ধারণা থাকার কোনো কারণ ছিল না, তাই তার একটা অবুঝ অভিযোগ ছিল যে, সিনেমার পর্দায় সবার ঠোঁট কালো দেখা যায়।
১৯৬৫ সালের কথা। প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় হাইস্কুলে-পড়া পাড়ার বড়ভাইদের সঙ্গে আমার সিনেমা দেখার শুরু। তখন আমাদের মহকুমা শহর জামালপুরে (বর্তমানে জেলা) ‘এন্তেজার’ এবং ‘নিরালা’ নামে দুটি সিনেমা হল ছিল। দুটি হলেই তৃতীয় শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল চৌদ্দ পয়সা অর্থাৎ চার আনা থেকে দুই পয়সা কম। ‘এন্তেজার’-এ লাহোরে নির্মিত উর্দু ছবি লোরী আমার বড় পর্দায় দেখা প্রথম ছবি। গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাস সিক্সে যেমন-তেমন, সেভেনে উঠেই আমি স্বাধীন হয়ে যাই। সেই থেকে নানা ছলছুতোয় মহকুমা শহরে সিনেমা দেখার মাত্রাও বেড়ে যায়। ষাটের দশকের শেষদিকে আমাদের সরিষাবাড়ীর শিমলাবাজারে ‘চম্পাকলি’ নামে একটি সিনেমা হল হয়। বাঁশের চাটাই বিছানো তৃতীয় শ্রেণির টিকিটের মূল্য ছিল আট আনা, যা আজকের পঞ্চাশ পয়সার সমান। টিকিটের পয়সা জুটলেই দুপুরে টিফিনের সময় আমরা দু-তিন বন্ধু মিলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বই-পুস্তক নিয়ে ‘চম্পাকলি’-তে ঢুকে পড়তাম। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার সময়ের সঙ্গে ম্যাটিনি শো দেখে বাড়ি ফেরার সময়টা মিলে যেত। ফলে একই সঙ্গে স্কুল আর বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে এহেন কিশোর অপরাধ নির্বিঘেœ চালিয়ে যেতে বেশ সুবিধা হয়েছিল।
সাধারণত ম্যাটিনি শো-তে ইংরেজি সিনেমা দেখানো হতো। সে সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র দি অ্যাবসেন্ট-মাইন্ডেড প্রফেসর (১৯৬১) আমি ম্যাটিনি শো-তেই দেখেছি। কী খেয়ালে জানি না, শুরু থেকেই সিনেমা দেখে এসে দুই আনা দামের একটি বাঁধানো খাতায় আমি ছবির নাম লিখে রাখতাম। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসার আগ পর্যন্ত আমি সাড়ে চারশোর মতো ছবি দেখেছিলাম। ঢাকায় এসেও বেশ কিছু ভালো ছবি দেখার সুযোগ হয় আমার। যেমন সোফিয়া লরেন অভিনীত সানফ্লাওয়ার, সেনেগালের বিখ্যাত পরিচালক ওসমান সেমবেন-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি মান্দাবি, পিটার ব্রুকের মহাভারত প্রভৃতি। দেখেছিলাম মসিহউদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলী নির্মিত সূর্যদীঘল বাড়ি। এই ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের শক্তিমান অভিনেত্রী ডলি আনোয়ার।
শৈশবে, সিনেমার পাত্র-পাত্রীদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মানুষ পৃথিবীতে আছে বলে বিশ্বাস করা বা ভাবা ছিল অসম্ভব। একেকটা ছবি তিন-চারবার করে দেখেছি। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ, গান ও চলন-বলন অনুকরণ করেছি। বলে রাখা যায় যে, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে সিরাজউদ্দৌলাখ্যাত আমাদের জামালপুরের সন্তান আনোয়ার হোসেনকে আমি প্রথম দেখি এবং সেটি তার জামালপুরের বকুলতলা মোড়ের বাড়িতেই। প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালে ডিসেম্বরে অভিনেত্রী ডলি আনোয়ার ও আলোকচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেনের জিগাতলার বাসায় যাওয়ার আগে ওপরের কথাগুলো মনে পড়েছিল।
দুই. ১৯৮৩ সালে অমর একুশের বইমেলায় আমার প্রথম কবিতার বই বের হয়। প্রথম বই প্রকাশের উত্তেজনায় পৃথিবীর সব তরুণ কবির মতোই আমার চোখেও ঘুম নেই। কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদপট আর পেছনে আমার ছবি নিয়ে আমি তখন খুব ভাবছি। অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়েও আমার মধ্যে কেন জানি না যা কিছু নতুন, যা কিছু বড়, যা কিছু ভালো শুধু তার দিকে ঝোঁক। ১৯৭৯ সালের শেষ থেকে ১৯৮১-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত রচিত ও পরিমার্জিত ১৫৬ পঙ্ক্তির ছয় পৃষ্ঠার বিদ্রƒপাত্মক ‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ কবিতাটির নামানুসারে বইয়ের নাম ঠিক হলো একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি চিত্রকর্ম পছন্দ করলাম প্রচ্ছদের জন্য। প্রচ্ছদ করেছিল প্রয়াত তরুণ শিল্পী মোরাদজ্জামান মুরাদ। যা হোক, এখন আমার নিজের ছবি ওঠানোর পালা। সে সময় এলোমেলো চুল আর দাড়িওয়ালা একজন চিত্রগ্রাহক দেশ-বিদেশে পুরস্কার পাচ্ছিলেন। পত্রপত্রিকায় তার তোলা পুরস্কৃত সব অনুপম আলোকচিত্র আর তার নিজের প্রতিকৃতি ছাপা হচ্ছিল। নাম আনোয়ার হোসেন। এরই মধ্যে সূর্যদীঘল বাড়ি ছায়াছবির চিত্রগ্রাহক হিসেবে তিনি জাতীয় পুরস্কার পেলেন। আর এই ছবিতে অসামান্য অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেলেন তার স্ত্রী ডলি আনোয়ার। আমি স্থির করলাম আমার চেহারা যত ভাঙাচোরাই হোক, বইয়ের জন্য ছবি আমি এই বিখ্যাত চিত্রগ্রাহককে দিয়েই ওঠাব। আমি ওই দাড়িওয়ালা আলোকচিত্রীকে ধরার ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাস্টার্সের রেজাল্ট হলেও তখনো সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ৩৭৫ নম্বর রুমে থাকি। হঠাৎ করেই হলে খবর হয়ে গেল সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমার দুই ব্যাচ ওপরের ছাত্র আবদুর রহীম খান আমাদের প্রিয় রহীম ভাই ডলি আনোয়ারের ছোট বোন ইতি ইব্রাহিমকে বিয়ে করেছেন। ইতি ইব্রাহিম মানে আমাদের ইতি ভাবি অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের ছোট মেয়ে। আমি তো মহাখুশি। ইউরেকা, ইউরেকা! উল্লেখ্য, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি (১৯৫৫) চলচ্চিত্রে সর্বজয়া চরিত্রে অত্যন্ত প্রশংসনীয় অভিনয় করে খ্যাতিমান হয়ে ওঠা অভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের মাসতুতো বোন এবং ডলি আনোয়ারের মাসি ছিলেন। আপাতদৃষ্টে কাকতালীয় মনে হলেও সূর্যদীঘল বাড়ি ছবিতে দারিদ্র্যপীড়িত জীবনে প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করা জয়গুণকে (ডলি আনোয়ার) উনুনের পাশে যেভাবে দেখা যায়, ঠিক সেভাবেই পথের পাঁচালি ছবিতে আমরা দেখি দারিদ্র্যের কশাঘাতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে সংসার আর সন্তানের দেখভাল করা সর্বজয়াকে। নয়া-বাস্তববাদী ধারায় তৈরি এই দুই শক্তিশালী চলচ্চিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর ডলি আনোয়ারের অনবদ্য অভিনয় দেখে আমাদের বুক বেদনার্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সূর্যদীঘল বাড়ি ছবির কয়লার ইঞ্জিনচালিত ঝিকঝিক রেলগাড়ি একদিকে যেমন আমার শৈশব আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপু-দুর্গাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, তেমনি মাটির উনুনে ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে ছেলের খোঁজে বের হওয়া জয়গুণের মধ্যে আমি আমার মায়ের চিরায়ত মুখ খুঁজে পেয়েছিলাম। ডলি আনোয়ারের সেই অনুপম অভিনয়ের কথা মনে হলে বাড়িতে মাটির উনুনের পাশে বসা আমার মায়ের মুখ মনে পড়ে। আমি তা ভুলতে পারি না।
জানুয়ারির এক সকালে রহীম ভাই আমাকে ডলি আপার জিগাতলার বাসায় নিয়ে গেলেন। ছোট বোনের জামাইকে বাঙালিপনায় খুব খাতির-যতœ করলেন ডলি আপা। আমি কবিতা লিখি এবং ছবি তোলার জন্য এসেছি শুনে খুব আগ্রহ করে ভেতর থেকে একটি বিদেশি গেঞ্জি আর বাটিকের ছাপমারা লুঙ্গিপরা দাড়িওয়ালা আনোয়ার হোসেনকে ডেকে এনে এক রকম নির্দেশই দিলেন। আনোয়ার ভাই আমাকে পরের শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে আসতে বললেন। পরের শুক্রবারে ছবি তোলারও নতুন অভিজ্ঞতা হলো। এত দিন মহকুমা শহর জামালপুরে বা ঢাকায় স্টুডিওগুলোয় চিত্রগ্রাহকদের ক্যামেরার শাটার বাটনে কেবল একবার চাপ দিয়েই আমার ছবি তুলতে দেখেছি। আনোয়ার ভাই পরপর দুটি ক্যামেরা দিয়ে আমার অনেকগুলো ছবি তুললেন এবং তিন দিন পর ছবি নিয়ে আসতে বললেন। তিন দিন পর আমার সহপাঠী-চাচাতো ভাই নজরুলকে নিয়ে ছবি আনতে গেলাম। আমার থুতনির নিচে মাটির কবুতর বসিয়ে তোলা একটি মাত্র ছবি আমাকে দিয়েছিলেন আনোয়ার ভাই। বইমেলায় আমার প্রথম কবিতার বই বেরোল। প্রচ্ছদে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি চিত্রকর্ম আর পেছনে আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের তোলা আমার প্রতিকৃতি। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এক দিন শীতের সকালে ডলি আপাকে বই দিতে গেলাম। আমার যথেষ্ট শীতের কাপড় নেই জেনে খুব আফসোস করলেন ডলি আপা। তারও তখন হাত খালি, ঘর খালি। ছবি তোলার কাজ নিয়ে আনোয়ার ভাই আফ্রিকায় গেছেন। ঘরের সব দামি জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন ডলি আপা। জানালেন, আনোয়ার ভাইয়ের ছোট ভাই কামালকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটি পড়ায় তাকে সারা বছর মাসিক হারে টাকা দেন তিনি। তার যুক্তি, ছাত্রের স্কুল ছুটি থাকলেও শিক্ষকের তো বেতন বন্ধ করা চলে না। ১৯৯১ সালে ডলি আপা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে কবিতা পড়তে গিয়ে আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। প্রায় তিরিশ বছর পর দেখা। বললাম, আনোয়ার ভাই আমাকে চিনছেন? পাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন আরে সামাদ, তোমারে চিনব না, মাটির কবুতর দিয়া তোমার ছবি তুইলা দিছিলাম; মাঝে-মধ্যে তোমার ছবি দেখি; কেমন আছো? ঘাড়ে-পিঠে হাত দিয়ে স্নেহের পরশ ছড়িয়ে দিলেন। এখন কোথায় আছেন জিজ্ঞেস করতেই জানালেন প্যারিসে থাকেন; মাঝে-মধ্যে দেশে আসেন।
তিন. ২০১৮-এর পহেলা ডিসেম্বর বিকেল ৩টার দিকে মোবাইলে অনলাইন পত্রিকা দেখে চমকে উঠি! ‘চলে গেলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেন!’ সারাটা বিকেল বেদনায় বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করল। বাংলাদেশের অহংকার ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন আমাদের প্রিয় আনোয়ার ভাই নেই! আমি কেন যেন ভাবতেই পারছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার অনেক ছবি তিনি তুলেছেন। গুণী এই চিত্রগ্রাহক পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ৬০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। সূর্যদীঘল বাড়ি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, দহন, চিত্রা নদীর পাড়ে, শ্যামল ছায়া প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর খবর পড়ে আমার অনুজপ্রতিম তারিক সুজাতের সঙ্গে কথা বলি। তারিক জানাল, সম্প্রতি খুব অর্থকষ্টে দিন কাটছিল আনোয়ার ভাইয়ের। অর্থের অভাবে মাঝেমধ্যে মাদারীপুরে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। জীবনের শেষ যাত্রার আগে ঢাকা শহরের পান্থপথের অচেনা একটি ছোট হোটেলে উঠেছিলেন। সেখান থেকেই হতাশা নিয়ে একাই অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন। ডলি আপাও এভাবেই চলে গেছেন। এ বয়সে নিজের ও কত মানুষের কত অর্থকষ্ট আমি দেখেছি। তবে, আনোয়ার ভাইয়ের অর্থকষ্টের কথা শুনলে বিচলিত হইনি। সারা পৃথিবীর কোন গুণী অর্থকষ্টে ছিলেন না, শুনি? আবার হাসিও পায় আমার। চারদিকে এত অঢেল অর্থ প্রতিদিন কত অনর্থ ঘটাচ্ছে!
লেখক কবি; প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়