শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা কেন
বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) ২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিবন্ধন পরীক্ষার আয়োজন করে আসছে। এ পর্যন্ত একটি বিশেষ পরীক্ষাসহ ১৫টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা নিয়েছে তারা। একটা সময় ছিল যখন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা এনটিআরসিএ আয়োজন করে থাকলেও নিয়োগ চূড়ান্ত করত সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের কারণে ২০১৫ সাল থেকে এনটিআরসিএ-কেই মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর এ পর্যন্ত দুটি গণবিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে দুই দফায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে এনটিআরসিএ। এতে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষক। এখন তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারির অপেক্ষায় এনটিআরসিএ। এদিকে, দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজে শূন্য পদ প্রায় ৮০ হাজার। অন্যদিকে এনটিআরসিএ-তে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগপ্রত্যাশী প্রার্থী রয়েছেন লক্ষাধিক। কিন্তু গত ২ বছর ধরে নিয়োগ আটকে থাকায় ইতিমধ্যে ৩৫ বছরের বয়সসীমা পার হয়েছে ১০ হাজারের বেশি প্রার্থীর। নিয়োগপ্রত্যাশী এই প্রার্থীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই তারা নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছেন।
এনটিআরসিএ বলছে, আইনি জটিলতার কারণে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি এতদিন। গত বছরের জানুয়ারিতে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। ওই পরীক্ষায় ১১ হাজার ১৩০ জন পরীক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে পাস করেন। কিন্তু এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও এখনো নিয়োগ পাননি কোনো শিক্ষক। কর্তৃপক্ষ বলছে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারির ঠিক আগমুহূর্তে নিয়োগ পেতে ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনে চাকরিবঞ্চিত ২ হাজার ২০০ জন হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলার রায় তাদের পক্ষে গেলে তাদের নিয়োগ দিতে আদেশ দেয় হাইকোর্ট। এ কারণে ১৫তম নিবন্ধনের তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে দেরি হয়। ১৩তম নিবন্ধন নিয়ে মামলার কার্যক্রম শেষ হলে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন সম্পর্কে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধনে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা প্রায় ৪০০টি মামলা করেছেন। এসব কারণে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে আইন মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই জটিলতা কাটিয়ে উঠলেও এনটিআরসিএ নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করছে বলে দাবি নিয়োগপ্রত্যাশীদের। শিক্ষক নিবন্ধন ও নিয়োগের মতো একটা পরীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় কেনই-বা এত জটিলতা সৃষ্টি হবে আর প্রার্থীদেরই কেন বা এই ধরনের মামলার পথে যেতে হবে সেটা বোধগম্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া এভাবে শ্লথগতির হয়ে পড়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারের উচিত হবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা আরও গতিশীল করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিক্ষায় বিনিয়োগের প্রশ্নটি। সরকার যে এখনো শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে আগ্রহী নয় সেটা এই করোনাকালে পাস হওয়া সর্বশেষ শিক্ষা বাজেটেও স্পষ্ট। অথচ শিক্ষাবিদসহ সমাজবিজ্ঞানীদের বিশেষ তাগিদ ছিল বিশেষ এই সংকটে শিক্ষা খাতের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ। আর শিক্ষা বাজেটে দীর্ঘদিনের শুভঙ্করের ফাঁকির কথা তো সবাই জানেন। সর্বশেষ সমাপ্ত হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ছিল সর্বোচ্চ! যদিও এর কৃতিত্ব ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। বাজেটে শিক্ষা খাতের সঙ্গে প্রযুক্তি খাত যুক্ত করে ‘শিক্ষা ও প্রযুক্তি’ খাত করায় এই ঘটনা ঘটেছিল। অথচ খেয়াল করলে দেখা যাবে শিক্ষা খাতের বাজেট দীর্ঘদিন ধরেই মোট বাজেটের ১০-১২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আর সেখান থেকে প্রকৃত শিক্ষা বাজেট হিসাব করলে দেখা যাবে সেটা আরও বেশ খানিকটা কম। অথচ শিক্ষাবিদদের দীর্ঘদিনের দাবি বাজেটে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হোক। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক এক অর্থবছরে শিক্ষা খাতে নেপালের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। পাকিস্তানের বরাদ্দ বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। মালদ্বীপ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ভারত ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২ দশমিক ২ শতাংশ, ভিয়েতনাম ব্যয় করে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকার কেনিয়ার মতো দেশ মোট বাজেটের ৪৫ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে। এই বাস্তবতা বিবেচনা না করলে কেবল দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাব কষে দেশকে সত্যিকার অর্থে সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগে সচেষ্ট হতে হবে।
শেয়ার করুন

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) ২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য নিবন্ধন পরীক্ষার আয়োজন করে আসছে। এ পর্যন্ত একটি বিশেষ পরীক্ষাসহ ১৫টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা নিয়েছে তারা। একটা সময় ছিল যখন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা এনটিআরসিএ আয়োজন করে থাকলেও নিয়োগ চূড়ান্ত করত সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের কারণে ২০১৫ সাল থেকে এনটিআরসিএ-কেই মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর এ পর্যন্ত দুটি গণবিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে দুই দফায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে এনটিআরসিএ। এতে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষক। এখন তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারির অপেক্ষায় এনটিআরসিএ। এদিকে, দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজে শূন্য পদ প্রায় ৮০ হাজার। অন্যদিকে এনটিআরসিএ-তে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগপ্রত্যাশী প্রার্থী রয়েছেন লক্ষাধিক। কিন্তু গত ২ বছর ধরে নিয়োগ আটকে থাকায় ইতিমধ্যে ৩৫ বছরের বয়সসীমা পার হয়েছে ১০ হাজারের বেশি প্রার্থীর। নিয়োগপ্রত্যাশী এই প্রার্থীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই তারা নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছেন।
এনটিআরসিএ বলছে, আইনি জটিলতার কারণে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি এতদিন। গত বছরের জানুয়ারিতে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। ওই পরীক্ষায় ১১ হাজার ১৩০ জন পরীক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে পাস করেন। কিন্তু এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও এখনো নিয়োগ পাননি কোনো শিক্ষক। কর্তৃপক্ষ বলছে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারির ঠিক আগমুহূর্তে নিয়োগ পেতে ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধনে চাকরিবঞ্চিত ২ হাজার ২০০ জন হাইকোর্টে মামলা করেন। মামলার রায় তাদের পক্ষে গেলে তাদের নিয়োগ দিতে আদেশ দেয় হাইকোর্ট। এ কারণে ১৫তম নিবন্ধনের তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে দেরি হয়। ১৩তম নিবন্ধন নিয়ে মামলার কার্যক্রম শেষ হলে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন সম্পর্কে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধনে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা প্রায় ৪০০টি মামলা করেছেন। এসব কারণে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে আইন মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই জটিলতা কাটিয়ে উঠলেও এনটিআরসিএ নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করছে বলে দাবি নিয়োগপ্রত্যাশীদের। শিক্ষক নিবন্ধন ও নিয়োগের মতো একটা পরীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় কেনই-বা এত জটিলতা সৃষ্টি হবে আর প্রার্থীদেরই কেন বা এই ধরনের মামলার পথে যেতে হবে সেটা বোধগম্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া এভাবে শ্লথগতির হয়ে পড়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারের উচিত হবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা আরও গতিশীল করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শিক্ষায় বিনিয়োগের প্রশ্নটি। সরকার যে এখনো শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে আগ্রহী নয় সেটা এই করোনাকালে পাস হওয়া সর্বশেষ শিক্ষা বাজেটেও স্পষ্ট। অথচ শিক্ষাবিদসহ সমাজবিজ্ঞানীদের বিশেষ তাগিদ ছিল বিশেষ এই সংকটে শিক্ষা খাতের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ। আর শিক্ষা বাজেটে দীর্ঘদিনের শুভঙ্করের ফাঁকির কথা তো সবাই জানেন। সর্বশেষ সমাপ্ত হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ছিল সর্বোচ্চ! যদিও এর কৃতিত্ব ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। বাজেটে শিক্ষা খাতের সঙ্গে প্রযুক্তি খাত যুক্ত করে ‘শিক্ষা ও প্রযুক্তি’ খাত করায় এই ঘটনা ঘটেছিল। অথচ খেয়াল করলে দেখা যাবে শিক্ষা খাতের বাজেট দীর্ঘদিন ধরেই মোট বাজেটের ১০-১২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আর সেখান থেকে প্রকৃত শিক্ষা বাজেট হিসাব করলে দেখা যাবে সেটা আরও বেশ খানিকটা কম। অথচ শিক্ষাবিদদের দীর্ঘদিনের দাবি বাজেটে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হোক। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক এক অর্থবছরে শিক্ষা খাতে নেপালের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ যা বাংলাদেশের চেয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। পাকিস্তানের বরাদ্দ বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। মালদ্বীপ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ভারত ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২ দশমিক ২ শতাংশ, ভিয়েতনাম ব্যয় করে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকার কেনিয়ার মতো দেশ মোট বাজেটের ৪৫ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে। এই বাস্তবতা বিবেচনা না করলে কেবল দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাব কষে দেশকে সত্যিকার অর্থে সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগে সচেষ্ট হতে হবে।