অন্যের ক্ষতি করে ভালো থাকা যায় না
এম মনসুর আলী | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
‘পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন
নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।’
নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে আসত এই দুটো লাইন। তখন লাইন দুটোর বাস্তবতা, সত্যতা এবং মর্মকথা বুঝতাম না। শুধু বেশি নম্বর পাওয়ার আশায় চোখ বুজে তোতাপাখির মতো মুখস্ত করতাম আর পরীক্ষার খাতায় বড় করে লিখে দিয়ে আসতাম। এখন এই লাইন দুটোর বাস্তবতা ও সত্যতা উপলব্ধি করতে পারছি। আপনি জেনেশুনে অন্যের ক্ষতি করবেন, করুন; মাস যেতে না যেতেই দেখবেন আপনার দ্বিগুণ ক্ষতি হয়ে গেছে। আপনি বুদ্ধি বা ক্ষমতার বলে দুর্বল বা নিরীহ মানুষের টাকা মেরে খাবেন, খান। একদিন দেখবেন আপনার বা আপনার সন্তানের বড় একটা রোগ হয়ে গেছে। এক হাজার টাকার জন্য আপনার লাখ টাকা এক পলকে চলে গেছে। অন্যের অকল্যাণ চাইলে আপনার নিজেরই অকল্যাণ হবে। আপনি অন্যের যেটুকু ক্ষতি করলেন তার সমপরিমাণ বা দ্বিগুণ ক্ষতি আপনার নিজেরও হয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিদান। ভালো করলে ভালো প্রতিদান পাবেন আর মন্দ করলে মন্দ প্রতিদান পাবেন। প্রকৃতি কারও সরষে পরিমাণ অপরাধও সহ্য করে না বরং সময়ের প্রয়োজনে প্রকৃতি হিংস্র হয়ে ওঠে। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর অভাবে আদালতও অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না অনেক সময়। কিন্তু এই অপরাধীরা কখনো প্রকৃতির শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে না। কোনো-না-কোনো সময় প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যায়। অপঘাত, অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগভোগ, দুর্ঘটনা ও বিপদ আপদের মাধ্যমে শাস্তি পায়। আর প্রকৃতির এই প্রাপ্য শাস্তি হয়ে থাকে মানুষের কল্পনারও বাইরে।
ইতিহাসও তাই বলে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা যে বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন এবং যারা নবাবকে হত্যা করেছিলেন সেই বিশ্বাসঘাতকদের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তা জানলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, অপরাধীরা মানুষের বিচার থেকে রক্ষা পেলেও প্রকৃতির শাস্তি থেকে কখনো বাঁচতে পারে না। প্রথমে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী মীর জাফরের শেষ পরিণতির কথা বলছি। মীর জাফর দীর্ঘদিন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার শরীরে অসংখ্য ঘা ও ফোঁড়া হয়ে রক্ত ও পুঁজ পড়ত এবং সমস্ত শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হতো। দুর্গন্ধের কারণে তার পরিবারের লোকজন তাকে লোকালয়হীন জঙ্গলে রেখে আসে। বাঁচানোর আশায় রাজা নন্দকুমার কিরিটেশ্বরী দেবীর পা ধোয়া পানি ওষুধ হিসেবে খাওয়ান। কোনো কাজ হয়নি। শরীরের পচন আরও বাড়তে থাকে। অবশেষে মৃত্যু জ্বালায় ধুঁকতে ধুঁকতে রাস্তায় পড়ে থাকা কুকুরের মতো প্রাণ যায় মীর জাফরের। আর সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকারী মীর জাফরের পুত্র মীরণ বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেন জনৈক ইংরেজ সেনাপতি তার বাড়াবাড়ি দেখে তাকে গুলি করে হত্যা করেছেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা আপন খালা নিঃসন্তান বিধবা ঘষেটি বেগমকে মায়ের মতো সম্মান করতেন। কিন্তু ক্ষমতার লোভে লর্ড ক্লাইভ আর মীর জাফরের সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার গোপন চক্রান্তে হাত মেলান ঘষেটি বেগম। প্রয়োজনে চক্রান্ত খাতে খরচ করার জন্য ঘষেটি বেগম বিপুল পরিমাণ অর্থ মীর জাফরকে দেবেন বলেও প্রস্তাব করেন। পরিশেষে প্রতিশ্রুত অর্থ না দেওয়ায় মীর জাফর ঘষেটি বেগমকে বন্দি করে পাঠিয়ে দেন ঢাকার (বর্তমান পুরান ঢাকায়) জিঞ্জিরা প্রাসাদে। ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে ভেবে মীরণ ঘষেটি বেগমকে বন্দি অবস্থায় নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠানোর আদেশ দেন। নৌকা ঘষেটি বেগমকে নিয়ে জিঞ্জিরা প্রাসাদ ছেড়ে গেলেও মুর্শিদাবাদে পৌঁছেনি কোনো দিন। ঘষেটি বেগমকে মীরণের নির্দেশে নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মাটিও ঠাঁই দেয়নি কুচক্রী ঘষেটি বেগমকে। সাড়ে তিন হাত মাটিও জোটেনি এই বিশ্বাসঘাতিনীর কপালে। আর নবাব সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। পাগল অবস্থায় একদিন বিনা কারণে কূপে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। প্রকৃতি এভাবেই বিচার করে বিশ্বাসঘাতক ও জুলুমকারীদের।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা হত্যার চক্রান্তের গুরু ক্লাইভের শেষ পরিণতির কথা এবার শুনুন। ক্লাইভের ছিল মাথা পেটানোর রোগ। জুতা দিয়ে সারাক্ষণ মাথা না পেটালে অস্থির হয়ে পড়তেন। ক্লাইভ সারা দিন বসে বসে জুতা দিয়ে মাথা পেটাতেন। ষড়যন্ত্রকারী ও লুণ্ঠনকারী ছাড়াও ক্লাইভ ছিলেন ল¤পটের চূড়ামণি। ফলে আক্রান্ত হন গুরুতর যৌনব্যাধিতে। এসবের নিবৃত্তি হিসেবে মহৌষধ ছিল আফিম। ক্লাইভ একদিন সেই আফিম খেয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের গলা নিজে কর্তন করে মৃত্যুবরণ করেন। যে অন্যের ক্ষতি করে সে কখনো ভালো থাকে না, থাকতে পারে না। প্রকৃতি ভালো থাকতে দেয় না। ক্ষতির পরিমাণ যত বড় প্রকৃতির প্রতিদানের পরিমাণও তত ভয়াবহ।
এলাকায় আপনার অনেক প্রভাব। আপনার ভয়ে কেউ কথা কথা বলে না। কথায় কথায় গালিগালাজ করেন, করুন! একজনের কাছে জমির আলু বিক্রি করে পরে বেশি দাম পেয়ে অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দিলেন, দিন। ঐ লোক দুর্বল বলে আপনার বিচার করতে পারবেন না। জেনে রাখুন প্রকৃতি আপনাকে ক্ষমা করবে না। প্রকৃতির কাঠগড়ায় আপনাকে দাঁড়াতে হবেই। প্রকৃতি আপনার বিচার এই ধরাতেই করবে। শুধু আপনাকে বুঝতে হবে। একটা বাস্তব গল্প বলছি, শুনুন।
কদম আলী খুব ভালো মানুষ, সৎ এবং আল্লাহ ভক্ত। তিনি খবর পেলেন পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক বাড়িতে খুব মিষ্টি আম পাওয়া যায়। সাধ হলো পুরো গাছ কিনে আম খাবেন। ওই গ্রামেই থাকেন তার এক আত্মীয়। কদম আলী ওই গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে ঘুরতে গেলেন। ভাবলেন ঘোরাও হবে সঙ্গে আমও কেনা হবে। আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে তিনি তার পরিকল্পনার কথা বললেন। আত্মীয়রা ভাবলেন, কী! আমাদের পাশের বাড়িতে এত ভালো আম আর আমরাই জানি না! কদম আলী অগ্রিম টাকা দিয়ে গাছের সব আম কিনে চলে গেলেন। আম পাকলে দু’তিন দফায় এসে পেড়ে নিয়ে যাবেন। গাছ মালিককে আরও ১ হাজার টাকা বেশি দিয়ে গেলেন আমগুলো দেখে রাখার জন্য। এদিকে কদম আলীর সেই আত্মীয় তার টাকাওয়ালা ভাইকে দিয়ে সেই বাড়ির আমগাছ কিনতে পাঠালেন। আমগাছের মালিক বললেন, গাছ তো বিক্রি হয়ে গেছে। কদম আলীর আত্মীয়ের ভাই বললেন, আমরা দুইগুণ টাকা বেশি দাম দেব। লোভ সামলাতে না পেরে তিনিও গাছ আবার বিক্রি করে দিলেন এবং কদম আলীর টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন। কদম আলীর টাকা আছে কিন্তু পরিচিতি ও পেশিশক্তি নেই। তাই তিনি বিচার পেলেন না। যা হোক, কদম আলী আবার সেই গ্রামে ঘুরতে গেলেন এবং তার আত্মীর বাড়িতে উঠলেন। কদম আলীকে তারা অনেক সমাদর করলেন, মাছ-ভাত খাওয়ালেন, সঙ্গে মিষ্টি আম। কদম আলী জিজ্ঞেস করলেনএত মজার আম কোথা থেকে আনলেন? তার আত্মীয় বললেন, আমার ছোট ভাই ওই বাড়ির পুরো গাছ কিনেছে, ওই আম। কদম আলী খুব কষ্ট পেলেন, ভাবলেন তার আত্মীয়ই তো তাদের ভাইকে না করতে পারতেন!
তার কিছুদিন পরে কদম আলী তার আত্মীয়ের বাড়িতে গেলেন, দেখলেন তারা সবাই হাসপাতালে! কেন? কী হয়েছে! দেখলেন তার আত্মীয়ের ওই ভাই অসুখে পড়েছেন, এত আম খেয়ে খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়েছিল। কদম আলী হাসলেন! পরের বছর কদম আলী আবার ওই আম কিনতে গেলেন, মালিক বললেন এবার গাছে কোনো আম ধরেনি। তার পরের বছর তিনি আবার খোঁজ নিলেন, জানতে পারলেন এবারও গাছে আমি ধরেনি।
আমরা চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, যারাই মানুষের ক্ষতি করেছে, পেশিশক্তি বলে মানুষকে অত্যাচার করেছে প্রকৃতির বিচার থেকে তারা রক্ষা পায়নি। আমি দুজন শিক্ষিত সরদারকে চিনি যারা সারাটা জীবন শয়তানি করেছেন। ভালো মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন। গ্রামের দুই পক্ষকেই কু-পরামর্শ দিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে রেখেছেন। ফায়দা লুটেছেন। অথচ কেউ কোনোদিন ভাবতেই পারেনি যে, এই দুই সরদারের কখনো পতন হবে। কিন্তু তাদের শেষ পরিণাম খুবই শোচনীয়। এদের একজন হত্যা মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘ তিন বছর ফেরারি জীবন কাটিয়েছেন। আড়া-জঙ্গলে রাত্রিযাপন করেছেন। অন্য একজন শেষ বয়সে মিথ্যা মামলার আসামি হয়ে আজও গ্রামছাড়া। শুধু তাই নয়, তাদের সহযোগীরা আজ বিভিন্ন জালিয়াতি মামলায় জেল খাটছেন।
লেখক : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাসরত সাংবাদিক ও কলামনিস্ট
শেয়ার করুন
এম মনসুর আলী | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

‘পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন
নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।’
নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরীক্ষায় ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে আসত এই দুটো লাইন। তখন লাইন দুটোর বাস্তবতা, সত্যতা এবং মর্মকথা বুঝতাম না। শুধু বেশি নম্বর পাওয়ার আশায় চোখ বুজে তোতাপাখির মতো মুখস্ত করতাম আর পরীক্ষার খাতায় বড় করে লিখে দিয়ে আসতাম। এখন এই লাইন দুটোর বাস্তবতা ও সত্যতা উপলব্ধি করতে পারছি। আপনি জেনেশুনে অন্যের ক্ষতি করবেন, করুন; মাস যেতে না যেতেই দেখবেন আপনার দ্বিগুণ ক্ষতি হয়ে গেছে। আপনি বুদ্ধি বা ক্ষমতার বলে দুর্বল বা নিরীহ মানুষের টাকা মেরে খাবেন, খান। একদিন দেখবেন আপনার বা আপনার সন্তানের বড় একটা রোগ হয়ে গেছে। এক হাজার টাকার জন্য আপনার লাখ টাকা এক পলকে চলে গেছে। অন্যের অকল্যাণ চাইলে আপনার নিজেরই অকল্যাণ হবে। আপনি অন্যের যেটুকু ক্ষতি করলেন তার সমপরিমাণ বা দ্বিগুণ ক্ষতি আপনার নিজেরও হয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিদান। ভালো করলে ভালো প্রতিদান পাবেন আর মন্দ করলে মন্দ প্রতিদান পাবেন। প্রকৃতি কারও সরষে পরিমাণ অপরাধও সহ্য করে না বরং সময়ের প্রয়োজনে প্রকৃতি হিংস্র হয়ে ওঠে। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর অভাবে আদালতও অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না অনেক সময়। কিন্তু এই অপরাধীরা কখনো প্রকৃতির শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে না। কোনো-না-কোনো সময় প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যায়। অপঘাত, অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগভোগ, দুর্ঘটনা ও বিপদ আপদের মাধ্যমে শাস্তি পায়। আর প্রকৃতির এই প্রাপ্য শাস্তি হয়ে থাকে মানুষের কল্পনারও বাইরে।
ইতিহাসও তাই বলে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা যে বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন এবং যারা নবাবকে হত্যা করেছিলেন সেই বিশ্বাসঘাতকদের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তা জানলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, অপরাধীরা মানুষের বিচার থেকে রক্ষা পেলেও প্রকৃতির শাস্তি থেকে কখনো বাঁচতে পারে না। প্রথমে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী মীর জাফরের শেষ পরিণতির কথা বলছি। মীর জাফর দীর্ঘদিন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার শরীরে অসংখ্য ঘা ও ফোঁড়া হয়ে রক্ত ও পুঁজ পড়ত এবং সমস্ত শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হতো। দুর্গন্ধের কারণে তার পরিবারের লোকজন তাকে লোকালয়হীন জঙ্গলে রেখে আসে। বাঁচানোর আশায় রাজা নন্দকুমার কিরিটেশ্বরী দেবীর পা ধোয়া পানি ওষুধ হিসেবে খাওয়ান। কোনো কাজ হয়নি। শরীরের পচন আরও বাড়তে থাকে। অবশেষে মৃত্যু জ্বালায় ধুঁকতে ধুঁকতে রাস্তায় পড়ে থাকা কুকুরের মতো প্রাণ যায় মীর জাফরের। আর সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকারী মীর জাফরের পুত্র মীরণ বজ্রাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেন জনৈক ইংরেজ সেনাপতি তার বাড়াবাড়ি দেখে তাকে গুলি করে হত্যা করেছেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা আপন খালা নিঃসন্তান বিধবা ঘষেটি বেগমকে মায়ের মতো সম্মান করতেন। কিন্তু ক্ষমতার লোভে লর্ড ক্লাইভ আর মীর জাফরের সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার গোপন চক্রান্তে হাত মেলান ঘষেটি বেগম। প্রয়োজনে চক্রান্ত খাতে খরচ করার জন্য ঘষেটি বেগম বিপুল পরিমাণ অর্থ মীর জাফরকে দেবেন বলেও প্রস্তাব করেন। পরিশেষে প্রতিশ্রুত অর্থ না দেওয়ায় মীর জাফর ঘষেটি বেগমকে বন্দি করে পাঠিয়ে দেন ঢাকার (বর্তমান পুরান ঢাকায়) জিঞ্জিরা প্রাসাদে। ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে ভেবে মীরণ ঘষেটি বেগমকে বন্দি অবস্থায় নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠানোর আদেশ দেন। নৌকা ঘষেটি বেগমকে নিয়ে জিঞ্জিরা প্রাসাদ ছেড়ে গেলেও মুর্শিদাবাদে পৌঁছেনি কোনো দিন। ঘষেটি বেগমকে মীরণের নির্দেশে নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মাটিও ঠাঁই দেয়নি কুচক্রী ঘষেটি বেগমকে। সাড়ে তিন হাত মাটিও জোটেনি এই বিশ্বাসঘাতিনীর কপালে। আর নবাব সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। পাগল অবস্থায় একদিন বিনা কারণে কূপে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। প্রকৃতি এভাবেই বিচার করে বিশ্বাসঘাতক ও জুলুমকারীদের।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা হত্যার চক্রান্তের গুরু ক্লাইভের শেষ পরিণতির কথা এবার শুনুন। ক্লাইভের ছিল মাথা পেটানোর রোগ। জুতা দিয়ে সারাক্ষণ মাথা না পেটালে অস্থির হয়ে পড়তেন। ক্লাইভ সারা দিন বসে বসে জুতা দিয়ে মাথা পেটাতেন। ষড়যন্ত্রকারী ও লুণ্ঠনকারী ছাড়াও ক্লাইভ ছিলেন ল¤পটের চূড়ামণি। ফলে আক্রান্ত হন গুরুতর যৌনব্যাধিতে। এসবের নিবৃত্তি হিসেবে মহৌষধ ছিল আফিম। ক্লাইভ একদিন সেই আফিম খেয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের গলা নিজে কর্তন করে মৃত্যুবরণ করেন। যে অন্যের ক্ষতি করে সে কখনো ভালো থাকে না, থাকতে পারে না। প্রকৃতি ভালো থাকতে দেয় না। ক্ষতির পরিমাণ যত বড় প্রকৃতির প্রতিদানের পরিমাণও তত ভয়াবহ।
এলাকায় আপনার অনেক প্রভাব। আপনার ভয়ে কেউ কথা কথা বলে না। কথায় কথায় গালিগালাজ করেন, করুন! একজনের কাছে জমির আলু বিক্রি করে পরে বেশি দাম পেয়ে অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দিলেন, দিন। ঐ লোক দুর্বল বলে আপনার বিচার করতে পারবেন না। জেনে রাখুন প্রকৃতি আপনাকে ক্ষমা করবে না। প্রকৃতির কাঠগড়ায় আপনাকে দাঁড়াতে হবেই। প্রকৃতি আপনার বিচার এই ধরাতেই করবে। শুধু আপনাকে বুঝতে হবে। একটা বাস্তব গল্প বলছি, শুনুন।
কদম আলী খুব ভালো মানুষ, সৎ এবং আল্লাহ ভক্ত। তিনি খবর পেলেন পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক বাড়িতে খুব মিষ্টি আম পাওয়া যায়। সাধ হলো পুরো গাছ কিনে আম খাবেন। ওই গ্রামেই থাকেন তার এক আত্মীয়। কদম আলী ওই গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে ঘুরতে গেলেন। ভাবলেন ঘোরাও হবে সঙ্গে আমও কেনা হবে। আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে তিনি তার পরিকল্পনার কথা বললেন। আত্মীয়রা ভাবলেন, কী! আমাদের পাশের বাড়িতে এত ভালো আম আর আমরাই জানি না! কদম আলী অগ্রিম টাকা দিয়ে গাছের সব আম কিনে চলে গেলেন। আম পাকলে দু’তিন দফায় এসে পেড়ে নিয়ে যাবেন। গাছ মালিককে আরও ১ হাজার টাকা বেশি দিয়ে গেলেন আমগুলো দেখে রাখার জন্য। এদিকে কদম আলীর সেই আত্মীয় তার টাকাওয়ালা ভাইকে দিয়ে সেই বাড়ির আমগাছ কিনতে পাঠালেন। আমগাছের মালিক বললেন, গাছ তো বিক্রি হয়ে গেছে। কদম আলীর আত্মীয়ের ভাই বললেন, আমরা দুইগুণ টাকা বেশি দাম দেব। লোভ সামলাতে না পেরে তিনিও গাছ আবার বিক্রি করে দিলেন এবং কদম আলীর টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন। কদম আলীর টাকা আছে কিন্তু পরিচিতি ও পেশিশক্তি নেই। তাই তিনি বিচার পেলেন না। যা হোক, কদম আলী আবার সেই গ্রামে ঘুরতে গেলেন এবং তার আত্মীর বাড়িতে উঠলেন। কদম আলীকে তারা অনেক সমাদর করলেন, মাছ-ভাত খাওয়ালেন, সঙ্গে মিষ্টি আম। কদম আলী জিজ্ঞেস করলেনএত মজার আম কোথা থেকে আনলেন? তার আত্মীয় বললেন, আমার ছোট ভাই ওই বাড়ির পুরো গাছ কিনেছে, ওই আম। কদম আলী খুব কষ্ট পেলেন, ভাবলেন তার আত্মীয়ই তো তাদের ভাইকে না করতে পারতেন!
তার কিছুদিন পরে কদম আলী তার আত্মীয়ের বাড়িতে গেলেন, দেখলেন তারা সবাই হাসপাতালে! কেন? কী হয়েছে! দেখলেন তার আত্মীয়ের ওই ভাই অসুখে পড়েছেন, এত আম খেয়ে খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়েছিল। কদম আলী হাসলেন! পরের বছর কদম আলী আবার ওই আম কিনতে গেলেন, মালিক বললেন এবার গাছে কোনো আম ধরেনি। তার পরের বছর তিনি আবার খোঁজ নিলেন, জানতে পারলেন এবারও গাছে আমি ধরেনি।
আমরা চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, যারাই মানুষের ক্ষতি করেছে, পেশিশক্তি বলে মানুষকে অত্যাচার করেছে প্রকৃতির বিচার থেকে তারা রক্ষা পায়নি। আমি দুজন শিক্ষিত সরদারকে চিনি যারা সারাটা জীবন শয়তানি করেছেন। ভালো মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন। গ্রামের দুই পক্ষকেই কু-পরামর্শ দিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে রেখেছেন। ফায়দা লুটেছেন। অথচ কেউ কোনোদিন ভাবতেই পারেনি যে, এই দুই সরদারের কখনো পতন হবে। কিন্তু তাদের শেষ পরিণাম খুবই শোচনীয়। এদের একজন হত্যা মামলার আসামি হয়ে দীর্ঘ তিন বছর ফেরারি জীবন কাটিয়েছেন। আড়া-জঙ্গলে রাত্রিযাপন করেছেন। অন্য একজন শেষ বয়সে মিথ্যা মামলার আসামি হয়ে আজও গ্রামছাড়া। শুধু তাই নয়, তাদের সহযোগীরা আজ বিভিন্ন জালিয়াতি মামলায় জেল খাটছেন।
লেখক : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাসরত সাংবাদিক ও কলামনিস্ট