বারোমাসি আম চাষে বিপ্লব
নিতাই চন্দ্র রায় | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
ফল মানুষের প্রিয় খাদ্য। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। শুধু মানুষ ও জীবজন্তুর নয়, ফলেরও রাজা আছে। ফলের রাজা হলো আম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে ফাগুন মাসে আমের মুকুলের মধুর হাসির কথা উল্লেখ আছে। শীত শেষে বসন্ত বাতাসের স্পর্শে বাংলাদেশে আমগাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। আর কদিন পর বাতাস ভরে উঠবে আমের ম-ম গন্ধে।
আমের উৎপাদন, স্বাদ-গন্ধ, রোগ-পোকার আক্রমণ আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে খুব। মুকুল আসার পর বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি হলে মুকুল কালো হয়ে ঝরে পড়ে। বেশি তাপমাত্রা থাকলে এবং সেচ না দিলেও মুকুল ঝরে পড়ে। আবার রোগ ও পোকার আক্রমণেও আমের মুকুল ঝরে যায়। আমগাছে প্রতি বছর বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে এই দুবার জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং দুবার কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক এবং একবার গ্রোথ হরমোন এবং দু-তিনবার সেচ প্রয়োগ করলেই প্রত্যাশিত ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ আমচাষি এ কাজটি করতে চান না। অথচ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, পাবনা, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরার চাষিরা জানেন কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুস্বাদু আম উৎপাদন করতে হয়। তারা জানেন আম উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল ও সংরক্ষণ পদ্ধতি।
একসময় আমের চাষ শুধু দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি জেলায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আম্রপালি ও মল্লির মতো দুটি জাতের প্রবর্তনের ফলে আমের চাষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড় ও বরিশালেও দেখা যায় সুমিষ্ট আমের চাষ। যে ময়মনসিংহ, সিলেট, বগুড়া ও রংপুরের মতো বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় মোটেই আম চাষ হতো না, সে জেলাগুলোয়ও এখন ফলের রাজার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বসতবাড়ির আঙিনায়।
আমাদের দেশে আমপ্রাপ্তি জ্যৈষ্ঠ-ভাদ্র মাসেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ভোজনরসিক বাঙালি বারো মাসই আমের স্বাদ উপভোগ করতে চায়। পৃথিবীর বহু দেশে বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন ও কম্বোডিয়ায় বছরের বারো মাসেই আম উৎপাদিত হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ফল বিজ্ঞানীরাও বসে নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাহাড়তলী কেন্দ্র সম্প্রতি বারি-১১ জাতের একটি বারোমাসি আমের জাত উদ্ভাবন করে সারা দেশের আমচাষিদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ জাতের আম বছরে তিনবার উৎপাদিত হয়। জাতটি বসতবাড়ির আঙিনা, ছাদবাগানের ড্রাম, রাস্তার ধার, অফিস-আদালত এবং শিক্ষাঙ্গনের অব্যবহৃত জায়গায়ও রোপণ করা যায়। গাছের আকৃতি ছোট। আম খেতে সুস্বাদু। একই গাছে মুকুল, গুটি ও পাকা আমের নজরকাড়া দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের বারোমাসি কাটিমন ও কিউজাই সারা দেশের শৌখিন বাগানিদের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আবুল কাশেম নামের এক ফলচাষি ও নার্সারি মালিক এ জাতের আমের চাষ করেন ২২ বিঘা জমিতে। তার সফলতার কাহিনী দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশেষ করে চ্যানেল আইয়ের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হলে সারা দেশের মানুষের মধ্যে কাটিমন জাতের আম চাষে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলায় দেখা যায় কাটিমন জাতের আমের ব্যাপক চাহিদা। চুয়াডাঙ্গার বাঁদা গ্রামের আবুল কাশেম প্রথম ছয় বিঘা জমিতে ৬০০টি কাটিমন জাতের আমের চারা রোপণ করেন। চারা রোপণের দেড় বছর থেকেই গাছে আম ধরতে শুরু করে। সাড়ে চার বছরের একটি আমগাছে ১০০টির মতো আম পাওয়া যায়। চারটি আমের ওজন এক কেজি। মৌসুমে প্রতি কেজি আম বিক্রি হয় ২৫০ টাকা দরে। অ-মৌসুমে আরও বেশি দামে এই বারোমাসি আম বিক্রি হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আমটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ আমে আঁশ নেই। পাকলে হলুদবর্ণ ধারণ করে। খেতে খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু। আমের চামড়া কাগজের মতো পাতলা। ১০ থেকে ১৫ দিন স্বাভাবিক অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
এই আম কাঁচা অবস্থায় খেলেও মিষ্টি লাগে। প্রোনিং বা অঙ্গজ ছাঁটাই এই আমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রোনিং করলে বেশি করে ডালপালা বের হয়। গাছ খাটো ও ঝোপালো হয়। এক ডালে ৪-৫টি আম ধরে। একবার প্রোনিং করে ৫টি এবং দুবার প্রোনিং করে এই জাতের গাছে ১৩টি পর্যন্ত ডাল পাওয়া গেছে। জাতটির বড় বৈশিষ্ট্য হলো বছরে তিনবার আম ধরে এবং প্রতি গাছে আমের সংখ্যাও বেশি। প্রতিটি আমের ওজন গড়ে ২৫০ গ্রাম। লম্বাটে জাতের এই আম পাকলে হলুদাভ সবুজ রং ধারণ করে, আমে কোনো আঁশ থাকে না, রোগবালাই নেই বললেই চলে এবং স্বাভাবিকভাবে ঘরের তাপমাত্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত অনায়াসে সংরক্ষণ করে রাখা যায় এ জাতের আম।
এ আমের চাষপদ্ধতিও সহজ। তেমন পুঁজি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। প্রতি বিঘা জমিতে আম চাষের জন্য ১০০টি চারা প্রয়োজন হয়। সারি থেকে সারি দূরত্ব দিতে হয় ১২ ফুট। প্রতি বিঘা জমিতে আম চাষের জন্য খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আম রোপণের ১ম বছর ১ বিঘা জমি থেকে ১ লাখ টাকার এবং ২য় বছরে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা এবং ৪র্থ বছর থেকে পুরোদমে ফলন পাওয়া যায়। প্রতি গাছে ১০০টি করে আম হলে ১০০টি গাছে ১০ হাজার আম ধরবে। প্রতিটি আমের ওজন ২০০ গ্রাম হলে এবং প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা হলে এক বিঘা জমির আম বিক্রি করে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব।
আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে নামা-ত্রিশাল গ্রামে আবদুর রহমানের বাড়ি। আবদুর রহমান আজ থেকে ৩০ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। সেখানে দীর্ঘ ১০ বছর চাকরি করার পর বাড়ি ফিরে আসেন। দুই একর জমি কিনে মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি করেন। পুকুরে পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই কাতলাসহ বিভিন্ন দেশীয় মাছের চাষ করেন। অন্যদিকে পুকুর পাড়ে চাষ করেন বিভিন্ন জাতের ফল, শাকসবজি ও চিবিয়ে খাওয়া রংবিলাস জাতের আখ। আবদুর রহমানের এক বন্ধু ছিলেন। তার বাড়ি ছিল সাতক্ষীরায়। সাতক্ষীরার সেই বন্ধু চাকরি শেষে মালয়েশিয়া থেকে স্বদেশে আসার পথে ৪-৫টি বারোমাসি আমের কচি ডাল বা সায়ন নিয়ে আসেন। সায়নগুলো এক নার্সারিতে দিয়ে সেগুলো থেকে বারোমাসি জাতের আমের চারা তৈরি করেন। প্রতি বছরই বাড়াতে থাকে তার আমের চারার সংখ্যা। এই খবরটি আসে আবদুর রহমানের কাছে। তিনি সাতক্ষীরায় বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে ২টি বারোমাসি জাতের আমের চারা নিয়ে আসেন এবং সেই চারা রোপণ করে পরের বছর থেকে কলমের চারা তৈরি করেন। প্রতিটি কলম বিক্রি করেন বয়স ও উচ্চতাভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। পুকুরের উত্তর-দক্ষিণ পাড়ে ১৫টি বারোমাসি আমগাছ বেশ বড় হয়েছে। এসব গাছে সারা বছরই আম ধরে। তিনি এখন সারা বছরই আম বিক্রি করেন। কলমের চারাও বিক্রি করেন। গত বছর চারা ও আম বিক্রি করে তিনি ৭ লাখ টাকা আয় করেন। তার আম চাষের এ খবর আশপাশের গ্রাম ও উপজেলায় ছড়িয়ে পড়লে বারোমাসি আম চাষে মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
বছরব্যাপী আম উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য আমার কিছু সুপারিশ আছে ১. দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি নার্সারিতে বারোমাসি বারি-১১ আম, কাটিমন ও কিউজাই জাতের আমের চারা ও কলম সুলভ মূল্যে ফলচাষিদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। ২. প্রতিটি জেলার সরকারি হর্টিকালচার নার্সারিতে বারোমাসি জাতের আমের চারা ভর্তুকি মূল্যে জনসাধারণের মধ্যে বিক্রি করতে হবে। ৩. বারোমাসি আমের চাষপদ্ধতি, পরিচর্যা পোকা ও রোগদমন সম্পর্কে আমচাষি ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৪. বর্তমান সরকার গৃহীত বাড়ির আঙিনায় পুষ্টিবাগান প্রকল্পে বারো মাসের আমের চারা বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে দিতে হবে। ৫. দেশের প্রতিটি গ্রামে এবং শহরের পাড়া-মহল্লার ছাদবাগানে বারোমাসি আমের প্রদর্শনী স্থাপন করতে হবে। ৬. নার্সারি মালিকদের মধ্যে সরকারিভাবে বিনামূল্যে বিভিন্ন জাতের বারোমাসি আমের মার্তৃগাছ সরবরাহ করতে হবে। ৭. থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া থেকে অধিকসংখ্যক বারোমাসি আমের জাত সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারোমাসি আমের ওপর গবেষণা জোরদার করতে হবে। ৮. বারোমাসি আমের চাষপদ্ধতি ও লাভ-লোকসান সংবলিত পোস্টার-লিফলেট, ফোল্ডার কৃষকের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। ৯. বারোমাসি আম চাষ সম্প্রসারণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় প্রদর্শনী ও মাঠ দিবসের ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমানে দেশে বছরে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। সারা দেশে বারোমাসি আমের চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমের উৎপাদন দেড় থেকে দুই গুণ বাড়ানো সম্ভব।
লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড নাটোর
শেয়ার করুন
নিতাই চন্দ্র রায় | ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

ফল মানুষের প্রিয় খাদ্য। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ রয়েছে। শুধু মানুষ ও জীবজন্তুর নয়, ফলেরও রাজা আছে। ফলের রাজা হলো আম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে ফাগুন মাসে আমের মুকুলের মধুর হাসির কথা উল্লেখ আছে। শীত শেষে বসন্ত বাতাসের স্পর্শে বাংলাদেশে আমগাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। আর কদিন পর বাতাস ভরে উঠবে আমের ম-ম গন্ধে।
আমের উৎপাদন, স্বাদ-গন্ধ, রোগ-পোকার আক্রমণ আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে খুব। মুকুল আসার পর বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি হলে মুকুল কালো হয়ে ঝরে পড়ে। বেশি তাপমাত্রা থাকলে এবং সেচ না দিলেও মুকুল ঝরে পড়ে। আবার রোগ ও পোকার আক্রমণেও আমের মুকুল ঝরে যায়। আমগাছে প্রতি বছর বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে এই দুবার জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং দুবার কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক এবং একবার গ্রোথ হরমোন এবং দু-তিনবার সেচ প্রয়োগ করলেই প্রত্যাশিত ফলন পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ আমচাষি এ কাজটি করতে চান না। অথচ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, পাবনা, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরার চাষিরা জানেন কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুস্বাদু আম উৎপাদন করতে হয়। তারা জানেন আম উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল ও সংরক্ষণ পদ্ধতি।
একসময় আমের চাষ শুধু দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি জেলায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আম্রপালি ও মল্লির মতো দুটি জাতের প্রবর্তনের ফলে আমের চাষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড় ও বরিশালেও দেখা যায় সুমিষ্ট আমের চাষ। যে ময়মনসিংহ, সিলেট, বগুড়া ও রংপুরের মতো বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় মোটেই আম চাষ হতো না, সে জেলাগুলোয়ও এখন ফলের রাজার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বসতবাড়ির আঙিনায়।
আমাদের দেশে আমপ্রাপ্তি জ্যৈষ্ঠ-ভাদ্র মাসেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ভোজনরসিক বাঙালি বারো মাসই আমের স্বাদ উপভোগ করতে চায়। পৃথিবীর বহু দেশে বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চীন ও কম্বোডিয়ায় বছরের বারো মাসেই আম উৎপাদিত হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ফল বিজ্ঞানীরাও বসে নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাহাড়তলী কেন্দ্র সম্প্রতি বারি-১১ জাতের একটি বারোমাসি আমের জাত উদ্ভাবন করে সারা দেশের আমচাষিদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ জাতের আম বছরে তিনবার উৎপাদিত হয়। জাতটি বসতবাড়ির আঙিনা, ছাদবাগানের ড্রাম, রাস্তার ধার, অফিস-আদালত এবং শিক্ষাঙ্গনের অব্যবহৃত জায়গায়ও রোপণ করা যায়। গাছের আকৃতি ছোট। আম খেতে সুস্বাদু। একই গাছে মুকুল, গুটি ও পাকা আমের নজরকাড়া দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের বারোমাসি কাটিমন ও কিউজাই সারা দেশের শৌখিন বাগানিদের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আবুল কাশেম নামের এক ফলচাষি ও নার্সারি মালিক এ জাতের আমের চাষ করেন ২২ বিঘা জমিতে। তার সফলতার কাহিনী দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশেষ করে চ্যানেল আইয়ের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হলে সারা দেশের মানুষের মধ্যে কাটিমন জাতের আম চাষে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলায় দেখা যায় কাটিমন জাতের আমের ব্যাপক চাহিদা। চুয়াডাঙ্গার বাঁদা গ্রামের আবুল কাশেম প্রথম ছয় বিঘা জমিতে ৬০০টি কাটিমন জাতের আমের চারা রোপণ করেন। চারা রোপণের দেড় বছর থেকেই গাছে আম ধরতে শুরু করে। সাড়ে চার বছরের একটি আমগাছে ১০০টির মতো আম পাওয়া যায়। চারটি আমের ওজন এক কেজি। মৌসুমে প্রতি কেজি আম বিক্রি হয় ২৫০ টাকা দরে। অ-মৌসুমে আরও বেশি দামে এই বারোমাসি আম বিক্রি হয়। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আমটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ আমে আঁশ নেই। পাকলে হলুদবর্ণ ধারণ করে। খেতে খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু। আমের চামড়া কাগজের মতো পাতলা। ১০ থেকে ১৫ দিন স্বাভাবিক অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
এই আম কাঁচা অবস্থায় খেলেও মিষ্টি লাগে। প্রোনিং বা অঙ্গজ ছাঁটাই এই আমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রোনিং করলে বেশি করে ডালপালা বের হয়। গাছ খাটো ও ঝোপালো হয়। এক ডালে ৪-৫টি আম ধরে। একবার প্রোনিং করে ৫টি এবং দুবার প্রোনিং করে এই জাতের গাছে ১৩টি পর্যন্ত ডাল পাওয়া গেছে। জাতটির বড় বৈশিষ্ট্য হলো বছরে তিনবার আম ধরে এবং প্রতি গাছে আমের সংখ্যাও বেশি। প্রতিটি আমের ওজন গড়ে ২৫০ গ্রাম। লম্বাটে জাতের এই আম পাকলে হলুদাভ সবুজ রং ধারণ করে, আমে কোনো আঁশ থাকে না, রোগবালাই নেই বললেই চলে এবং স্বাভাবিকভাবে ঘরের তাপমাত্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত অনায়াসে সংরক্ষণ করে রাখা যায় এ জাতের আম।
এ আমের চাষপদ্ধতিও সহজ। তেমন পুঁজি বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। প্রতি বিঘা জমিতে আম চাষের জন্য ১০০টি চারা প্রয়োজন হয়। সারি থেকে সারি দূরত্ব দিতে হয় ১২ ফুট। প্রতি বিঘা জমিতে আম চাষের জন্য খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আম রোপণের ১ম বছর ১ বিঘা জমি থেকে ১ লাখ টাকার এবং ২য় বছরে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা এবং ৪র্থ বছর থেকে পুরোদমে ফলন পাওয়া যায়। প্রতি গাছে ১০০টি করে আম হলে ১০০টি গাছে ১০ হাজার আম ধরবে। প্রতিটি আমের ওজন ২০০ গ্রাম হলে এবং প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা হলে এক বিঘা জমির আম বিক্রি করে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব।
আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে নামা-ত্রিশাল গ্রামে আবদুর রহমানের বাড়ি। আবদুর রহমান আজ থেকে ৩০ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। সেখানে দীর্ঘ ১০ বছর চাকরি করার পর বাড়ি ফিরে আসেন। দুই একর জমি কিনে মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি করেন। পুকুরে পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই কাতলাসহ বিভিন্ন দেশীয় মাছের চাষ করেন। অন্যদিকে পুকুর পাড়ে চাষ করেন বিভিন্ন জাতের ফল, শাকসবজি ও চিবিয়ে খাওয়া রংবিলাস জাতের আখ। আবদুর রহমানের এক বন্ধু ছিলেন। তার বাড়ি ছিল সাতক্ষীরায়। সাতক্ষীরার সেই বন্ধু চাকরি শেষে মালয়েশিয়া থেকে স্বদেশে আসার পথে ৪-৫টি বারোমাসি আমের কচি ডাল বা সায়ন নিয়ে আসেন। সায়নগুলো এক নার্সারিতে দিয়ে সেগুলো থেকে বারোমাসি জাতের আমের চারা তৈরি করেন। প্রতি বছরই বাড়াতে থাকে তার আমের চারার সংখ্যা। এই খবরটি আসে আবদুর রহমানের কাছে। তিনি সাতক্ষীরায় বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে ২টি বারোমাসি জাতের আমের চারা নিয়ে আসেন এবং সেই চারা রোপণ করে পরের বছর থেকে কলমের চারা তৈরি করেন। প্রতিটি কলম বিক্রি করেন বয়স ও উচ্চতাভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। পুকুরের উত্তর-দক্ষিণ পাড়ে ১৫টি বারোমাসি আমগাছ বেশ বড় হয়েছে। এসব গাছে সারা বছরই আম ধরে। তিনি এখন সারা বছরই আম বিক্রি করেন। কলমের চারাও বিক্রি করেন। গত বছর চারা ও আম বিক্রি করে তিনি ৭ লাখ টাকা আয় করেন। তার আম চাষের এ খবর আশপাশের গ্রাম ও উপজেলায় ছড়িয়ে পড়লে বারোমাসি আম চাষে মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
বছরব্যাপী আম উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য আমার কিছু সুপারিশ আছে ১. দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি নার্সারিতে বারোমাসি বারি-১১ আম, কাটিমন ও কিউজাই জাতের আমের চারা ও কলম সুলভ মূল্যে ফলচাষিদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। ২. প্রতিটি জেলার সরকারি হর্টিকালচার নার্সারিতে বারোমাসি জাতের আমের চারা ভর্তুকি মূল্যে জনসাধারণের মধ্যে বিক্রি করতে হবে। ৩. বারোমাসি আমের চাষপদ্ধতি, পরিচর্যা পোকা ও রোগদমন সম্পর্কে আমচাষি ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ৪. বর্তমান সরকার গৃহীত বাড়ির আঙিনায় পুষ্টিবাগান প্রকল্পে বারো মাসের আমের চারা বিনামূল্যে কৃষকদের মধ্যে দিতে হবে। ৫. দেশের প্রতিটি গ্রামে এবং শহরের পাড়া-মহল্লার ছাদবাগানে বারোমাসি আমের প্রদর্শনী স্থাপন করতে হবে। ৬. নার্সারি মালিকদের মধ্যে সরকারিভাবে বিনামূল্যে বিভিন্ন জাতের বারোমাসি আমের মার্তৃগাছ সরবরাহ করতে হবে। ৭. থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া থেকে অধিকসংখ্যক বারোমাসি আমের জাত সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারোমাসি আমের ওপর গবেষণা জোরদার করতে হবে। ৮. বারোমাসি আমের চাষপদ্ধতি ও লাভ-লোকসান সংবলিত পোস্টার-লিফলেট, ফোল্ডার কৃষকের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। ৯. বারোমাসি আম চাষ সম্প্রসারণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় প্রদর্শনী ও মাঠ দিবসের ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমানে দেশে বছরে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। সারা দেশে বারোমাসি আমের চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমের উৎপাদন দেড় থেকে দুই গুণ বাড়ানো সম্ভব।
লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড নাটোর