স্বপ্নের দেশে আত্মঘাতের দুঃস্বপ্ন
বিগত শতকের মধ্যভাগের পর থেকেই দুনিয়াজুড়ে বহুল আলোচিত ‘দ্য আমেরিকান ড্রিম’। অনুন্নত আর উন্নয়নশীল তো বটেই এমনকি উন্নত দেশগুলোর বহু নাগরিকও সংক্রমিত ছিল ওই স্বপ্নে। একুশ শতকের শুরুতে নানা কারণে তা ফিকে হয়ে আসতে শুরু করলেও পৃথিবীজুড়ে আমেরিকান ড্রিম অদৃশ্য হয়ে গেছে বলা যাবে না। এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিচিত ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। তারপরও স্বপ্নের এই দেশে কেন লুকিয়ে থাকে আত্মঘাতের দুঃস্বপ্ন? দেশটির স্বাস্থ্য বিষয়ক এক সংস্থার হিসাব বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতিদিন ১৩৩ জন আত্মহত্যা করেন আর আত্মহত্যার কথা ভাবেন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এর অন্তত ৫০ গুণ মানুষ!
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে লুকিয়ে থাকা এই আত্মঘাতের দুঃস্বপ্নের কথা হয়তো সাধারণ বাংলাদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। হয়তো এখনো বাংলাদেশের বহু মানুষ উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবন গড়ার স্বপ্নে সুযোগ পেলে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর কথা ভাবেন। কিন্তু এই মহামারীকালে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একটি আপাত সফল ও সুখী বাংলাদেশি পরিবারের ছয় সদস্যের রহস্যময় মৃত্যুতে অনেক প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে সচেতন বাংলাদেশিদের মনে। করোনাভাইরাসের চলমান মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্রে বহু বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুও যতটা নাড়া দিতে পারেনি তারচেয়ে অনেক বেশি আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে টেক্সাসের রাজধানী ডালাসের অ্যালেন সিটিতে বাংলাদেশি পরিবারটির সব সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু। গত সোমবার একটি ফোন কলের সূত্র ধরে অ্যালেন শহরের বাসভবন থেকে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে বলে জানিয়েছে সিএনএন। নিহতরা হচ্ছেন ১৯ বছরের যমজ ভাই-বোন ফারহান তৌহিদ ও ফারবিন তৌহিদ, তাদের বড় ভাই ২১ বছরের তানভির তৌহিদ, মা আইরিন ইসলাম (৫৬), বাবা তৌহিদুল ইসলাম (৫৪) এবং তানভির তৌহিদের নানি ৭৭ বছরের আলতাফুন নেসা।
যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, পরিবারটির ছয় সদস্যের মধ্যে দুই ভাই অন্য চার সদস্যকে হত্যার পর নিজেরা আত্মহত্যা করেছেন বলে তাদের ধারণা। তবে পরিবারটির দেশে থাকা স্বজনরা এই ধারণা মেনে নিতে পারছেন না। তারা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই দুই ভাই ফারহান ও তানভীর মেধাবী। তাদের পরিবারেও তেমন কোনো সংকট ছিল না। হতাশার কারণে পরিবারের সবাইকে হত্যা করে এই দুই ভাই আত্মহত্যা করেছে এমন কথা মানতে পারছেন না কেউ। পুলিশের এই ধারণার নেপথ্যে রয়েছে ইন্সটাগ্রামে ফারহান তৌহিদের দীর্ঘ এক সুইসাইড নোট। যেখানে ফারহান জানায়, নবম শ্রেণি থেকেই হতাশা আর বিষণœতার বিরুদ্ধে তার লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের পথও খুঁজছে সে। কিন্তু নিজে আত্মহত্যা করলে পরিবারের অন্যরা সারা জীবন কষ্ট পাবে বিধায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে মারা যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সে। পরে দুই ভাই মিলে বন্দুক কিনতে যায়। আরেকটি পোস্টে ফারহান জানিয়েছেন, ‘বড়ভাই গেলেন দোকানে। বললেন যে, বাড়ির নিরাপত্তার জন্য বন্দুক দরকার। দোকানি কয়েকটি ফরম ধরিয়ে দিলে সেখানে স্বাক্ষর করলেন ভাই। এরপর হাতে পেলাম কাক্সিক্ষত বস্তুটি, যা দিয়ে নিজের কষ্ট এবং পরিবারের কষ্ট সহজে লাঘব করা যাবে।’
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফারহান-ফারবিনের মনে কী হতাশা ছিল জানা যাচ্ছে না। কিন্তু আপাত সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার পরও ওই পরিবারের দুই ছেলে কিংবা অন্যরা কি অভিবাসী হিসেবে কোনো সংকটে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে? মুসলিম বা এশীয় হিসেবে কি কোনে বর্ণবৈষম্যের শিকার ছিলেন তারা? যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বর্ণবাদী বৈষম্য ও নিপীড়নের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দৃষ্টান্তে এই প্রশ্ন অমূলক মনে হয় না। অবশ্য পরিবারের সব সদস্যই মারা যাওয়ায় এ বিষয়ে জানানোরও কেউ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ হয়তো তদন্ত সাপেক্ষে বিস্তারিত জানাতে পারবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এমন ঘটনা বিরল নয় মোটেই। বরং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া গুলিবর্ষণ আর আত্মহত্যার দেশ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র পরিচিত। দেশটির ফেডারেল সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র-সিডিসি ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৯০ লাখ মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবে। আর আত্মহত্যা করে ৫০ হাজার মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালে ৪৮ হাজার ৩৪৪ জন আত্মহত্যা করেন। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ১৭৩। বিশ বছরের ব্যবধানে দেশটিতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৩৫ ভাগ। আত্মহত্যার দুঃস্বপ্ন আর আত্মহত্যার সঙ্গে সঙ্গে আলোচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের বহুল বিতর্কিত অস্ত্র আইন। চাইলেই যে কারোর অস্ত্র কেনার সুযোগ নিশ্চিত করা ওই আইনই সাধারণ মানুষের হাতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র থাকা দেশ হিসেবে যুুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে। পরিসংখ্যান বলছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জনের কাছে ১২১টি বন্দুক থাকে। অবশ্য ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কংগ্রেসকে অনুরোধ জানিয়েছেন পার্লামেন্টে বন্দুক আইন সংশোধনের বিল আনতে। প্রশ্ন হলো, কেবল বন্দুক আইন সংশোধন করলেই কি সেরে যাবে স্বপ্নের দেশে আত্মঘাতের এই দুঃস্বপ্নের দুরারোগ্য অসুখ?
শেয়ার করুন

বিগত শতকের মধ্যভাগের পর থেকেই দুনিয়াজুড়ে বহুল আলোচিত ‘দ্য আমেরিকান ড্রিম’। অনুন্নত আর উন্নয়নশীল তো বটেই এমনকি উন্নত দেশগুলোর বহু নাগরিকও সংক্রমিত ছিল ওই স্বপ্নে। একুশ শতকের শুরুতে নানা কারণে তা ফিকে হয়ে আসতে শুরু করলেও পৃথিবীজুড়ে আমেরিকান ড্রিম অদৃশ্য হয়ে গেছে বলা যাবে না। এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিচিত ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। তারপরও স্বপ্নের এই দেশে কেন লুকিয়ে থাকে আত্মঘাতের দুঃস্বপ্ন? দেশটির স্বাস্থ্য বিষয়ক এক সংস্থার হিসাব বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতিদিন ১৩৩ জন আত্মহত্যা করেন আর আত্মহত্যার কথা ভাবেন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এর অন্তত ৫০ গুণ মানুষ!
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে লুকিয়ে থাকা এই আত্মঘাতের দুঃস্বপ্নের কথা হয়তো সাধারণ বাংলাদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। হয়তো এখনো বাংলাদেশের বহু মানুষ উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবন গড়ার স্বপ্নে সুযোগ পেলে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর কথা ভাবেন। কিন্তু এই মহামারীকালে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একটি আপাত সফল ও সুখী বাংলাদেশি পরিবারের ছয় সদস্যের রহস্যময় মৃত্যুতে অনেক প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে সচেতন বাংলাদেশিদের মনে। করোনাভাইরাসের চলমান মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্রে বহু বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুও যতটা নাড়া দিতে পারেনি তারচেয়ে অনেক বেশি আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে টেক্সাসের রাজধানী ডালাসের অ্যালেন সিটিতে বাংলাদেশি পরিবারটির সব সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু। গত সোমবার একটি ফোন কলের সূত্র ধরে অ্যালেন শহরের বাসভবন থেকে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে বলে জানিয়েছে সিএনএন। নিহতরা হচ্ছেন ১৯ বছরের যমজ ভাই-বোন ফারহান তৌহিদ ও ফারবিন তৌহিদ, তাদের বড় ভাই ২১ বছরের তানভির তৌহিদ, মা আইরিন ইসলাম (৫৬), বাবা তৌহিদুল ইসলাম (৫৪) এবং তানভির তৌহিদের নানি ৭৭ বছরের আলতাফুন নেসা।
যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, পরিবারটির ছয় সদস্যের মধ্যে দুই ভাই অন্য চার সদস্যকে হত্যার পর নিজেরা আত্মহত্যা করেছেন বলে তাদের ধারণা। তবে পরিবারটির দেশে থাকা স্বজনরা এই ধারণা মেনে নিতে পারছেন না। তারা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই দুই ভাই ফারহান ও তানভীর মেধাবী। তাদের পরিবারেও তেমন কোনো সংকট ছিল না। হতাশার কারণে পরিবারের সবাইকে হত্যা করে এই দুই ভাই আত্মহত্যা করেছে এমন কথা মানতে পারছেন না কেউ। পুলিশের এই ধারণার নেপথ্যে রয়েছে ইন্সটাগ্রামে ফারহান তৌহিদের দীর্ঘ এক সুইসাইড নোট। যেখানে ফারহান জানায়, নবম শ্রেণি থেকেই হতাশা আর বিষণœতার বিরুদ্ধে তার লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের পথও খুঁজছে সে। কিন্তু নিজে আত্মহত্যা করলে পরিবারের অন্যরা সারা জীবন কষ্ট পাবে বিধায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে মারা যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সে। পরে দুই ভাই মিলে বন্দুক কিনতে যায়। আরেকটি পোস্টে ফারহান জানিয়েছেন, ‘বড়ভাই গেলেন দোকানে। বললেন যে, বাড়ির নিরাপত্তার জন্য বন্দুক দরকার। দোকানি কয়েকটি ফরম ধরিয়ে দিলে সেখানে স্বাক্ষর করলেন ভাই। এরপর হাতে পেলাম কাক্সিক্ষত বস্তুটি, যা দিয়ে নিজের কষ্ট এবং পরিবারের কষ্ট সহজে লাঘব করা যাবে।’
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফারহান-ফারবিনের মনে কী হতাশা ছিল জানা যাচ্ছে না। কিন্তু আপাত সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার পরও ওই পরিবারের দুই ছেলে কিংবা অন্যরা কি অভিবাসী হিসেবে কোনো সংকটে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে? মুসলিম বা এশীয় হিসেবে কি কোনে বর্ণবৈষম্যের শিকার ছিলেন তারা? যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বর্ণবাদী বৈষম্য ও নিপীড়নের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দৃষ্টান্তে এই প্রশ্ন অমূলক মনে হয় না। অবশ্য পরিবারের সব সদস্যই মারা যাওয়ায় এ বিষয়ে জানানোরও কেউ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ হয়তো তদন্ত সাপেক্ষে বিস্তারিত জানাতে পারবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এমন ঘটনা বিরল নয় মোটেই। বরং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া গুলিবর্ষণ আর আত্মহত্যার দেশ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র পরিচিত। দেশটির ফেডারেল সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র-সিডিসি ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৯০ লাখ মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবে। আর আত্মহত্যা করে ৫০ হাজার মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ সালে ৪৮ হাজার ৩৪৪ জন আত্মহত্যা করেন। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ১৭৩। বিশ বছরের ব্যবধানে দেশটিতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৩৫ ভাগ। আত্মহত্যার দুঃস্বপ্ন আর আত্মহত্যার সঙ্গে সঙ্গে আলোচিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের বহুল বিতর্কিত অস্ত্র আইন। চাইলেই যে কারোর অস্ত্র কেনার সুযোগ নিশ্চিত করা ওই আইনই সাধারণ মানুষের হাতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র থাকা দেশ হিসেবে যুুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে। পরিসংখ্যান বলছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জনের কাছে ১২১টি বন্দুক থাকে। অবশ্য ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কংগ্রেসকে অনুরোধ জানিয়েছেন পার্লামেন্টে বন্দুক আইন সংশোধনের বিল আনতে। প্রশ্ন হলো, কেবল বন্দুক আইন সংশোধন করলেই কি সেরে যাবে স্বপ্নের দেশে আত্মঘাতের এই দুঃস্বপ্নের দুরারোগ্য অসুখ?