আফগান সংকটে পশ্চিমা প্রতারণা
রায়হান আহমেদ তপাদার | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০
দুই হাজার এক সালের এগারো সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হৃদয়বিদারক হামলার প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন বুশ প্রশাসনের শক্তিধর সশস্ত্র বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। সাত অক্টোবর অভিযান শুরু করে মাত্র দুই মাসের মধ্যে তৎকালীন তালেবান সরকারের পতন ঘটিয়ে মার্কিনিরা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। এরপর তারা সুদীর্ঘ বিশ বছর তাঁবেদার সরকারের মাধ্যমে এই দখলদারিত্ব কায়েম রাখে এবং নিজেদের পশ্চিমা ধাঁচের সংস্কৃতি ও জীবনাচার আফগান জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এজন্য তারা অজস্র অর্থ-সম্পদ, অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি এবং জনবল ক্ষয় করে। কিন্তু এই ব্যয়বহুল যুদ্ধে মার্কিনিরা চূড়ান্ত বিচারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে একটি মুখরক্ষার চুক্তির আড়ালে গত একত্রিশ আগস্ট দুই হাজার একুশ আফগানিস্তান থেকে শেষ সৈন্যটি প্রত্যাহার করে নিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, কেন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রেসিডেন্ট দুই দশক ধরে রক্তক্ষয়ী এই ব্যয়বহুল যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন? এই লেখায় সেই প্রশ্নেরই উত্তর বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে যত টাকা খরচ করেছে তার ৬০ শতাংশের বেশি খরচ করেছে আফগান সেনা এবং নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে। গত বছর পর্যন্ত এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ বছর বাড়তি ৩৩০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে আফগান সেনাবাহিনীকে। আফগান সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মিলিয়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কাগজে-কলমে তিন লাখের কিছু বেশি। একটি বিমানবাহিনী তৈরি হয়েছে। একটি কমান্ডো সেনা ইউনিট রয়েছে যাদের দক্ষতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগান সরকার খুবই গর্বিত। এই বাহিনীর ক্যাডেটদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অথচ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার পর তালেবান যখন জায়গা দখলের লড়াই জোরদার করল, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্বলতা নগ্নভাবে প্রকাশ হতে শুরু করে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে পুরো দেশ দখল করে নিয়েছে তালেবান। এতে অনেক মানুষের হতভম্ব হওয়ার কারণ, তারা এখন বুঝতে পারছেন যে, ২০ বছর আগে তাদের সরকারগুলো মানবাধিকার রক্ষা করতে আফগানিস্তানে যায়নি, গিয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে। কিন্তু এখন রাজনৈতিক অগ্রাধিকারে পরিবর্তনের আসায় এবং খরচ-লাভের হিসাব যুক্তিসংগত মনে না হওয়ায় তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে চেয়েছেন।
এদিকে জো বাইডেন চাননি, যে মিশন চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমলে চলেছে, সেটা পঞ্চমজনের সময়ও চলুক। মানবাধিকার? নারী অধিকার? গণতন্ত্র? মনে হচ্ছে, এখন আর এসব পশ্চিমার সমস্যা নয়, হঠাৎ করে এখন এগুলো আফগানদের নিজেদের সমাধানের বিষয় হয়ে উঠেছে। আফগান নেতাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, সম্প্রতি বলেছেন বাইডেন। কিন্তু বাইডেন তার বক্তব্যে এটা উল্লেখ করেননি যে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র শুধু তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে লড়তে আফগানিস্তানে যায়নি। আফগানদের গণতন্ত্র এনে দেওয়ারও অঙ্গীকার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আফগান নারীদের অধিকার রক্ষার কথাও বলেছিল তারা। কিন্তু এখন এটা পরিষ্কার যে, ওই বক্তব্যগুলো শুধু ফাঁকা বুলিই ছিল; নারী অধিকার কিংবা গণতন্ত্র কোনোটাই মূল অগ্রাধিকারের বিষয় ছিল না। আফগানিস্তানের যে নারীরা এত দিন তাদের অধিকারের জন্য লড়ছিলেন, তাদের এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সব সময় জয়ী হয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আবারও তাদের ২০০১ সালের আগের কালো সময়ে ফিরে যেতে হবে। এই নারীরা এখন নিজেদের প্রতারিত ও পরিত্যক্ত মনে করছেন। অনেক নারী অধিকারকর্মী এখন তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানির শরণার্থী নীতিতেও কম ভণ্ডামি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে লাখ লাখ আফগান ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। এর পরও আফগানিস্তানকে ‘নিরাপদ দেশ’ চিহ্নিত করে ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া অনেক শরণার্থীকে দেশে পাঠানো হয়েছে। গ্রিস, তুরস্ক আর বলকান দেশগুলোতে অনেক আফগান করুণ অবস্থায় আছে। এত দিন আফগানিস্তানের যুদ্ধবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের সমর্থন না করে জার্মানিসহ পশ্চিমা বিশ্বের উচিত ছিল আফগান মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করা। নারী অধিকার কর্মীদের অর্থহীন অঙ্গীকারের বাণী না শুনিয়ে তাদের শঙ্কার কথা শোনা উচিত ছিল। আরও উচিত ছিল সেনাবাহিনী গড়ে তোলায় সহায়তা না করে ভবিষ্যৎ গড়তে আফগান মানুষদের সহায়তা করা।
যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে এবং হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি করে শেষমেশ সবকিছু গুটিয়ে ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষ্ফল প্রত্যাবর্তনের পর অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক বলেছেন, আমরা কিছুই অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু তাদের এই কথা ভুল। তাদের বলা উচিত, আমরা সে জায়গাটাকে যেভাবে পেয়েছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় রেখে এসেছি। অনেক নিকৃষ্ট অবস্থায় তাদের রেখে চলে এসেছি। কোনো অন্যায় ও অবিচার চাপিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত তারাও কট্টরপন্থি হয়ে উঠতে পারে।
এবার আফগানিস্তানের দিকে তাকান। সেখানে যুগের পর যুগ সাধারণ মানুষ সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। তারা প্রতিবারই দেখেছে, বাইরের শক্তিগুলো তাদের ‘সহায়তা’ করতে এসে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে চলে যায়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য তাদের গ্রাস করে আছে। তাদের শিশুরা পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে না। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েক কয়েক লাখ আফগান নাগরিক মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে ৩৩ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যাদের সন্ত্রাসী বলে নির্বিচার মেরেছে, তারা আফগানদের চোখে কেবলই সন্ত্রাসী নয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ তাদের মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই, কেউবা বোন।
আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান ফিরে আসার পর বাকি বিশ্ব যখন দেশটির ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে তা নিয়ে শঙ্কিত, তখন পেইচিং, মস্কো এবং ইসলামাবাদে দেখা যাচ্ছে কিছুটা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। চীন বলেছে, তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আরও গভীর করতে প্রস্তুত। রাশিয়া বলেছে, কাবুল থেকে তাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো এমন মন্তব্য করে বসেছেন যে, আফগানিস্তানের জনগণ অবশেষে ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙেছে’।
লেখক : গবেষক ও কলামনিস্ট
শেয়ার করুন
রায়হান আহমেদ তপাদার | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০

দুই হাজার এক সালের এগারো সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হৃদয়বিদারক হামলার প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন বুশ প্রশাসনের শক্তিধর সশস্ত্র বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। সাত অক্টোবর অভিযান শুরু করে মাত্র দুই মাসের মধ্যে তৎকালীন তালেবান সরকারের পতন ঘটিয়ে মার্কিনিরা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। এরপর তারা সুদীর্ঘ বিশ বছর তাঁবেদার সরকারের মাধ্যমে এই দখলদারিত্ব কায়েম রাখে এবং নিজেদের পশ্চিমা ধাঁচের সংস্কৃতি ও জীবনাচার আফগান জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এজন্য তারা অজস্র অর্থ-সম্পদ, অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি এবং জনবল ক্ষয় করে। কিন্তু এই ব্যয়বহুল যুদ্ধে মার্কিনিরা চূড়ান্ত বিচারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে একটি মুখরক্ষার চুক্তির আড়ালে গত একত্রিশ আগস্ট দুই হাজার একুশ আফগানিস্তান থেকে শেষ সৈন্যটি প্রত্যাহার করে নিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, কেন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রেসিডেন্ট দুই দশক ধরে রক্তক্ষয়ী এই ব্যয়বহুল যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন? এই লেখায় সেই প্রশ্নেরই উত্তর বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে যত টাকা খরচ করেছে তার ৬০ শতাংশের বেশি খরচ করেছে আফগান সেনা এবং নিরাপত্তা বাহিনী গঠনে। গত বছর পর্যন্ত এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ বছর বাড়তি ৩৩০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে আফগান সেনাবাহিনীকে। আফগান সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মিলিয়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কাগজে-কলমে তিন লাখের কিছু বেশি। একটি বিমানবাহিনী তৈরি হয়েছে। একটি কমান্ডো সেনা ইউনিট রয়েছে যাদের দক্ষতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগান সরকার খুবই গর্বিত। এই বাহিনীর ক্যাডেটদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। অথচ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকার সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার পর তালেবান যখন জায়গা দখলের লড়াই জোরদার করল, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্বলতা নগ্নভাবে প্রকাশ হতে শুরু করে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে পুরো দেশ দখল করে নিয়েছে তালেবান। এতে অনেক মানুষের হতভম্ব হওয়ার কারণ, তারা এখন বুঝতে পারছেন যে, ২০ বছর আগে তাদের সরকারগুলো মানবাধিকার রক্ষা করতে আফগানিস্তানে যায়নি, গিয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে। কিন্তু এখন রাজনৈতিক অগ্রাধিকারে পরিবর্তনের আসায় এবং খরচ-লাভের হিসাব যুক্তিসংগত মনে না হওয়ায় তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে চেয়েছেন।
এদিকে জো বাইডেন চাননি, যে মিশন চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমলে চলেছে, সেটা পঞ্চমজনের সময়ও চলুক। মানবাধিকার? নারী অধিকার? গণতন্ত্র? মনে হচ্ছে, এখন আর এসব পশ্চিমার সমস্যা নয়, হঠাৎ করে এখন এগুলো আফগানদের নিজেদের সমাধানের বিষয় হয়ে উঠেছে। আফগান নেতাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, সম্প্রতি বলেছেন বাইডেন। কিন্তু বাইডেন তার বক্তব্যে এটা উল্লেখ করেননি যে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র শুধু তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে লড়তে আফগানিস্তানে যায়নি। আফগানদের গণতন্ত্র এনে দেওয়ারও অঙ্গীকার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আফগান নারীদের অধিকার রক্ষার কথাও বলেছিল তারা। কিন্তু এখন এটা পরিষ্কার যে, ওই বক্তব্যগুলো শুধু ফাঁকা বুলিই ছিল; নারী অধিকার কিংবা গণতন্ত্র কোনোটাই মূল অগ্রাধিকারের বিষয় ছিল না। আফগানিস্তানের যে নারীরা এত দিন তাদের অধিকারের জন্য লড়ছিলেন, তাদের এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সব সময় জয়ী হয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আবারও তাদের ২০০১ সালের আগের কালো সময়ে ফিরে যেতে হবে। এই নারীরা এখন নিজেদের প্রতারিত ও পরিত্যক্ত মনে করছেন। অনেক নারী অধিকারকর্মী এখন তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানির শরণার্থী নীতিতেও কম ভণ্ডামি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে লাখ লাখ আফগান ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। এর পরও আফগানিস্তানকে ‘নিরাপদ দেশ’ চিহ্নিত করে ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া অনেক শরণার্থীকে দেশে পাঠানো হয়েছে। গ্রিস, তুরস্ক আর বলকান দেশগুলোতে অনেক আফগান করুণ অবস্থায় আছে। এত দিন আফগানিস্তানের যুদ্ধবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের সমর্থন না করে জার্মানিসহ পশ্চিমা বিশ্বের উচিত ছিল আফগান মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতি বোঝার চেষ্টা করা। নারী অধিকার কর্মীদের অর্থহীন অঙ্গীকারের বাণী না শুনিয়ে তাদের শঙ্কার কথা শোনা উচিত ছিল। আরও উচিত ছিল সেনাবাহিনী গড়ে তোলায় সহায়তা না করে ভবিষ্যৎ গড়তে আফগান মানুষদের সহায়তা করা।
যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে এবং হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি করে শেষমেশ সবকিছু গুটিয়ে ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষ্ফল প্রত্যাবর্তনের পর অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক বলেছেন, আমরা কিছুই অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু তাদের এই কথা ভুল। তাদের বলা উচিত, আমরা সে জায়গাটাকে যেভাবে পেয়েছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় রেখে এসেছি। অনেক নিকৃষ্ট অবস্থায় তাদের রেখে চলে এসেছি। কোনো অন্যায় ও অবিচার চাপিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত তারাও কট্টরপন্থি হয়ে উঠতে পারে।
এবার আফগানিস্তানের দিকে তাকান। সেখানে যুগের পর যুগ সাধারণ মানুষ সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। তারা প্রতিবারই দেখেছে, বাইরের শক্তিগুলো তাদের ‘সহায়তা’ করতে এসে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে চলে যায়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য তাদের গ্রাস করে আছে। তাদের শিশুরা পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে না। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কয়েক কয়েক লাখ আফগান নাগরিক মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে ৩৩ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যাদের সন্ত্রাসী বলে নির্বিচার মেরেছে, তারা আফগানদের চোখে কেবলই সন্ত্রাসী নয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ তাদের মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই, কেউবা বোন।
আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবান ফিরে আসার পর বাকি বিশ্ব যখন দেশটির ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে তা নিয়ে শঙ্কিত, তখন পেইচিং, মস্কো এবং ইসলামাবাদে দেখা যাচ্ছে কিছুটা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। চীন বলেছে, তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আরও গভীর করতে প্রস্তুত। রাশিয়া বলেছে, কাবুল থেকে তাদের কূটনীতিকদের সরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো এমন মন্তব্য করে বসেছেন যে, আফগানিস্তানের জনগণ অবশেষে ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙেছে’।
লেখক : গবেষক ও কলামনিস্ট